#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৮।
‘আচ্ছা, আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
‘গেলেই তো দেখতে পারবেন।’
‘আজকে কি আপনার আর কোনো কাজ নেই?’
‘খুব জরুরি কিছু নেই।’
মেইন রোডে না রাবীরের গাড়ি আজ ভেতরের রোড দিয়ে যাচ্ছে। আর তাই এই দিকে বড়ো কোনো গাড়ি নেই। যা আছে সব রিক্সা আর অটোরিক্সা। এই রাস্তাটা মেহুলের অপরিচিত। তাই একটু বেশিই উৎসুক নয়নে সে এদিক ওদিক দেখছে। রাবীর যে তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সেটাও সে জানে না। তবে যেখানেই যাক, এই সময়টা তার সুন্দর যাচ্ছে। গাড়ির জানলা দিয়ে সা সা করে বাতাস তার চোখে মুখে আঁছড়ে পড়ছে। তার খোলা চুলগুলোও তাই বড্ড বিরক্ত করছে তাকে। মেহুল দুহাত দিয়ে সামনের চুলগুলো কানের পিছে গুঁজে দেয়। তবে এতে লাভ হয় না কিছুই। সেগুলো বাতাসের তালে আবার বেরিয়ে আসে। চোখে মুখে এভাবে এসে চুল পড়ে থাকলে কার ভালো লাগে। সে এর কারণে ভালো মতো তাকাতেও পারছে না। বিরক্ত হয়ে ব্যাগ হাতিয়ে একটা বেন্ড বের করে। বড়ো চুলগুলো পেছন দিকে নিয়ে বাঁধলেও সামনের ছোট চুলগুলো তো আর যায় না। সেগুলো আগের মতোই তাকে বিরক্ত করে চলছে। সে তাই এবার হাল ছেড়ে দেয়। যা, উড়ুক তারা, যত খুশি উড়ুক। সেও আর বাঁধা দিবে না।
গাড়িটা একটা দোকানের সামনে থামে। রাবীর বেরিয়ে একটা পানির বোতল আর দু’টো আইসক্রিম নিয়ে আসে। আইসক্রিম দেখে মেহুলের মনে প্রশান্তি আসে। মন তো তার এটাই চাইছিল। মেহুল আইসক্রিম খাওয়ার সময় একটু আইসক্রিম গড়িয়ে তার জামাতে পড়ে যায়। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই সে চেঁচিয়ে উঠে,
‘আআআআ, আমার সাদা জামা।’
মেহুলের এত জোরে চিৎকার শুনে রাবীর ভাবে কী না কী হয়ে গিয়েছে। সে অস্থির হয়ে বলতে থাকে,
‘কী হয়েছে, মেহুল? কোথাও ব্যথা পেয়েছেন নাকি? আপনার জামায় কী হয়েছে?’
মেহুল অসহায় সুরে বলে,
‘আইসক্রিম পড়ে গিয়েছে।’
রাবীর এটা শুনে দম ফেলে। বলে,
‘আপনি এর জন্য এত জোরে চিৎকার দিয়েছেন? আমি তো ভেবেছি, কী না কী হয়ে গিয়েছে।’
‘এটা কি কোনো সামান্য ব্যাপার? আমার একটা মাত্র সাদা জামা। সেটাও আজ শেষ। মা আমাকে খুব বকবে।’
রাবীর মৃদু হেসে বলে,
‘আচ্ছা আমি আপনাকে সাদা জামার একটা দোকান কিনে দিব।’
‘লাগবে না, এমনিতেও আমার সাদা পছন্দ না। শুধুমাত্র আপনার কথা ভেবে পড়েছিলাম। আর তাই এমন হয়েছে।’
রাবীর আলতো হেসে একটা টিস্যু নিয়ে তার জামাটা ভালোভাবে পরিষ্কার করে দয়। যদিও খুব একটা দাগ পড়েনি, তাও মেহুলের মন খারাপ। একটু পর টিস্যু বাইরে ফেলে রাবীর সোজা হতেই দেখল তার আইসক্রিম গলে গিয়ে তার পাঞ্জাবীতে পড়েছে। সে মেহুলের দিকে চেয়ে বলে,
‘আপনার অভিশাপ যে সাথে সাথেই লেগে যায় সেটা তো বলেননি।’
মেহুল না বুঝে তার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। রাবীর তাকে ইশারা দিয়ে তার পাঞ্জাবীর অবস্থা দেখায়। মেহুল তা দেখে শব্দ করে হেসে ফেলে। হাসতে হাসতে বলে,
‘থাক, কষ্ট পেয়েন না। আমি আপনাকে একটা সাদা পাঞ্জাবীর দোকান কিনে দেব।’
এই বলে সে আবার হাসে। আর রাবীরও তখন মৃদু হেসে তার পাঞ্জাবী পরিষ্কার করে। তারপর আবার গাড়ি স্টার্ট দেয়।
গাড়িটা থেমে যেতেই মেহুলের ঘুম ভাঙে। চেয়ে দেখে একটা গেইটের বাইরে তাদের গাড়ি থেমেছে। এই জায়গাটা সে চিনে না। ড্রাইভিং সিটে রাবীরকে দেখতে না পেয়ে ভয় পেয়ে যায় সে। দ্রুত গাড়ি থেকে নামে। বের হতেই রাবীরকে দেখে গেইটের দারোয়ানের সাথে কথা বলছে। তা দেখে শান্তি পায় সে। তারপর আস্তে আস্তে সেও রাবীরের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। রাবীর দারোয়ানের সাথে কথা শেষ করে মেহুলের দিকে চেয়ে বলে,
‘চলুন তাহলে ভেতরে যাওয়া যাক।’
মেহুলকে নিয়ে রাবীর ভেতরে প্রবেশ করে। ভেতরের পরিবেশ দেখে মেহুল ভীষণ অভিভূত হয়। কী সুন্দর জায়গাটা। একটা দু’তালা ডুপ্লেক্স বাড়ি। বাড়ির সামনেই বিশাল একটা সুইমিং পুল। আর তার সামনেই কিছুটা জায়গা জুড়ে বসার কিছু ছোট ছোট স্থান তৈরি করে রাখা। একপাশে অনেক রকমের গাছ লাগানো। অন্যদিকটাই ছোট্ট বাগান করা। গেইটের সাথে লাগানোই একটা বিশাল গেইট গাছ আছে। আর তার পাশে নিচে ছোট ছোট টবে বেশ কিছু ফুলের গাছ। মেহুল তো আশেপাশে তাকিয়ে তার বিস্ময়’ই কাটাতে পারছে না। এটা নিশ্চয়ই কোনো রিসোর্ট।
রাবীর বলল,
‘চলুন, ভেতরে যাই।’
ডুপ্লেক্স বিল্ডিংটার সিঁড়ি বাইরের দিকে। পুরো বাড়ি সাদা রঙের। দুতালার পশ্চিম দিকে মুখ করা একটা বড়ো বারান্দা আছে। তার উপর থেকে পুরো রিসোর্টটা বেশ সুন্দর দেখা যায়। মেহুল নিচতালার ভেতরে যেতেই দেখে একটা বড়ো হল রুমের স্পেস। সাথে লাগানো একটা লম্বা বারান্দা। আর একটা ছোট্ট বসার রুম। তাছাড়া আর কোনো রুম নেই সেখানে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে দেখে সেখানে দুইটা বড়ো বেড রুম। একটা ডাইনিং রুম যদিও এটাকে রুম বলা যায় না, অনেকটা বেলকনি টাইপ। আর বেশ ছিমছাম একটা রান্নাঘর। আর দুইটা ওয়াশরুমও আছে। তবে দুতালার সিঁড়ির পাশের জায়গাটা বেশ সুন্দর।
মেহুলের তো এইসব কিছু বেশ পছন্দ হয়।
রাবীর তাকে জিজ্ঞেস করে,
‘পছন্দ হয়েছে।’
‘এত সুন্দর একটা জায়গা, পছন্দ না হয়ে আর কোনো উপায় আছে।’
‘তাহলে কথা ফাইনাল করব?’
মেহুল জিজ্ঞেস করে,
‘কী কথা?’
‘এই পুরো বাড়ি সহ জায়গাটা আমি একজনের কাছ থেকে কিনতে চাচ্ছি। যদি আপনার পছন্দ হয় তবেই কথা আগাবে। এখন বলুন, পছন্দ হয়েছে তো?’
মেহুল অবাক হয়ে বলল,
‘এই পুরো জায়গাটা আপনি কিনে নিবেন? কত টাকা লাগবে?’
‘সেটা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না, আপনি শুধু বলুন পছন্দ হয়েছে কিনা? কারণ, এই বাড়ি আমি আপনার নামে কিনছি।’
মেহুলের এবার চোখ বেরিয়ে আসবে যেন। সে হতভম্ব হয়ে বলে,
‘কী! এত বড়ো বাড়ি আমার? কেন? আমার তো কোনো বাড়ির দরকার নেই। আপনি কিনলে আপনার নামেই কিনুন, আমার লাগবে না।’
রাবীর গভীর নিঃশ্বাস ফেলে। মেহুলের দুই বাহুতে হাত রেখে কিছুটা কাছে যায়। নরম সুরে বলে,
‘আমি আগেও বলেছি মেহুল, আমার অনেক শত্রু। আমার জীবনের কোনো ভরসা নেই। আমি চাই, আমার অনুপস্থিতিতেও যেন আপনি সাবলম্বী হয়ে বাঁচতে পারেন। কখনো যেন কারোর কাছে আশ্রয় চেতে না হয়। আর তার জন্য যা যা করা দরকার আমি সব করে যাব। আমি চাই আপনি ভালো থাকুন, জীবনের সবটুকু সুখ পান। সেটা আমার উপস্থিতেই হোক বা অনুপস্থিতিতে, আপনাকে সুখী দেখতে পারলেই আমার শান্তি।’
মেহুল অবাক হয়ে চেয়ে থাকে লোকটার দিকে। এত মুগ্ধতা কেন উনার মাঝে? এত কেন ভাবেন উনি? এত কেন ভালোবাসেন? মেহুলের তো এখন ভয় হচ্ছে, উনার এই অতিরিক্ত ভালোবাসা যদি কোনোদিন উনার জীবনে আতঙ্ক হয়ে দাঁড়ায়, তখন?
মেহুলকে নিরব দেখে রাবীর প্রশ্ন করে,
‘কী হলো, মেহুল? আপনার বাড়িটা পছন্দ হয়নি?’
‘হ্যাঁ, খুব পছন্দ হয়েছে। কিন্তু, এটার অনেক টাকা আমি জানি। এখন এত টাকা খরচ করার কোনো দরকার আছে?’
রাবীর হেসে বলে,
‘আমার টাকা আপনি আর মা ছাড়া আর কার পেছনেই বা খরচ করব, বলুন। আপনারা ছাড়া আমার আর আছেই বা কে। আচ্ছা, আপনি গিয়ে বসুন। আমি জমির মালিককে কল দিয়ে আসতে বলছি। আজই সব ফাইনাল হোক।’
চলবে….
(পর্ব ছোট হওয়ার জন্য দুঃখিত)