#মায়াবন_বিহারিণী পর্ব ১২
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
৩০.
– “কি লিখতেছিস তুই বুবু? আর তোর হাতে ঐটা কি?”
পেছন থেকে হঠাৎ পূর্ণার কন্ঠ শুনতে পেয়ে হকচকিয়ে যায় উপমা। দ্রুত লেখা থামিয়ে দিয়ে ডায়েরি বন্ধ করে নিয়ে কোনোমতে বলে উঠে,
– “ক,কই কিছু না তো। আর এইটাতো পায়েল; অনেকদিন আগের।”
উপমার জবাবে সন্দিহান চোখে উপমার দিকে তাকায় পূর্ণা; ঠিক যেন তার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না।
– “আচ্ছা ঠিক আছে, তয় রাইত হইয়া গেছে বুবু। কয়টা খাওয়াইয়া দে; মেলা ঘুম পাইতাছে।”
পূর্ণার আবদার শুনে অগত্যা উঠে যেতে হয় উপমাকে। সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে পূর্ণাকে খাইয়ে দেয়ার পর নিজেও কিছুটা খেয়ে নেয়। আসলেই অনেকটা রাত হয়ে গিয়েছে। পূর্ণাও ঘুমিয়ে পড়েছে ইতোমধ্যে। সেও গিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ে বিছানায়। চৈত্র মাসের মাঝামাঝি সময় হওয়ায় গরম বেশ ভালোই পড়েছে। মাথার ওপর ঘুরতে থাকা ফ্যানের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে উপমা। চোখে কেন যেন ঘুম নেই। বিছানায় কয়েকবার এপাশ ওপাশ করলেও চোখে ঘুম নামে না তার।
– “মনে হয় না এখানে আর কখনো আসা হবে।”
মস্তিষ্ক জুড়ে শুধু আবেগের বলা শেষোক্ত কথাটুকুই বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে উপমার। মন জুড়ে শুধু একপ্রকার অস্থিরতার বসবাস। শেষমেষ আর না পেরে লাফ দিয়ে উঠে বসে উপমা। আজ তার এমন অদ্ভুত লাগছে কেন? সবকিছুই তো ঠিকঠাক রয়েছে। দ্রুত খাট থেকে নেমে টেবিলের উপর রাখা পানির গ্লাস থেকে সবটুকু পানি ঢকঢক করে খেয়ে নেয় সে। আয়নায় চোখ পড়তেই খেয়াল করে শরীর ঘেমে রীতিমতো জুবুথুবু হয়ে গিয়েছে। আবেগের চলে যাওয়ায় এমন লাগছে কেন? কই আগে তো কখনো হয়নি এমন। কখনো কারো প্রতি এত শূন্য লাগেনি তার? কয়েকদিনেই তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে বলে এমন লাগছে নাকি এর পেছনেও কোনো বিশাল ব্যাখ্যা লুকায়িত? আচ্ছা সেদিন হৈমন্তীর বলা কথার সাথে সত্যিই এর কোনো যোগসূত্র নেই তো! হৈমন্তী তো বলেছিল উপমা নিজের অজান্তেই কোনো একদিন তার ডাক্তার মশাইয়ের প্রেমে পড়বে। তবে কি সেই একদিন তার জীবনে আসলেই চলে এলো? পরক্ষণেই পিলে চমকায় উপমা। না এটা কি করে সম্ভব? কি সব চিন্তা ধারণায় মগ্ন হয়ে গিয়েছে ভেবেই নিজেকে নিজেই দু গাল বকা দেয় উপমা।
ইজি চেয়ারের সাথে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে রয়েছে আবেগ। ঘরের লাইট নিভিয়ে দেয়াতে শুধু জানালা ভেদ করে বাইরের প্রাকৃতিক আলোয় আলোকিত হয়েছে ব্যালকনি। চোখে ঘুম নেই আবেগের। বিকেলের কথা মনে পড়তেই বিষন্ন লাগে তার। তবে কি সে আগ বাড়িয়ে একটু বেশিই ভেবে নিয়েছিল? কিন্তু কি আর করার। সে তো না চাইতেও সেই চঞ্চল কিশোরীর মায়ায় আবদ্ধ হয়ে গিয়েছে। কি এমন আছে মেয়েটার মাঝে? অসীম মায়া? থাকতেই পারে। মেয়েটা তো আপাদমস্তক ই মায়াময়।
– “কি ব্যাপার ডক্টর আবেগ? এখন ও রাত জেগে কি করছেন? আজকে তো ফাইলপত্র ও তেমন নেই।”
– “এমনিতেই ডক্টর সায়ান। ঘুম আসছিল না তাই ভাবলাম ব্যালকনিতে বসেই রাত কাটানো যাক। আর এটা ঢাকা শহর ও না সোডিয়াম লাইটের আলোয় অন্ধকার রাতেও রাস্তায় ঘুরে আসা যাবে।”
আবেগের কথায় মৃদু হাসে সায়ান। সায়ান প্রায়শই অবাক হয় আবেগকে দেখে। লোকটা অন্যান্যদের চেয়ে বড়ই অদ্ভুত। এগিয়ে গিয়ে সে ও পাশের ইজি চেয়ারটাতে বসে পড়ে। অতঃপর উৎসুক কন্ঠে আবেগের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,
– “তারপর সেই চঞ্চল কিশোরীর কি হলো? বলতে পেরেছেন তাকে যে তার ডাক্তার সাহেব যে কি না আগে কোনো মেয়ের দিকে তাকায় পর্যন্ত নি সে শেষমেশ একটা ছোট্ট মেয়ের প্রেমে পড়ে গিয়েছে?”
সায়ানের প্রশ্ন শুনে মাথা তুলে তাকায় আবেগ। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠলেও মুখশ্রীতে তার বেদনার ছাপ।
– “উহু! আমাকে দিয়ে একটা ভুল হয়ে গিয়েছে ডক্টর সায়ান। অনেক বড় একটা ভুল। উপমা চঞ্চল কিশোরী বটে। তবে তার সময়টা আবেগে ভেসে বেড়ানোর। মেয়েটার সেসব ইম্যাচুউরিটি কথাবার্তা আমি একটু বেশিই গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছিলাম; যেটা আমার একদম ই উচিত হয়নি।”
সায়ান আবেগের বলা কথাগুলোর ভাবার্থ ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।
– “কিন্তু ডক্টর আবেগ? আপনি তো উপমাকে ভালোবাসেন; তাই না? তাহলে এখানে ভুল বোঝাবুঝির কি আছে?”
– “হ্যাঁ, হয়তো আমি সত্যিই উপমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। কিন্তু উপমা? উপমা কি এসব স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারবে? আর এই কথারই বা কি গ্যারান্টি যে উপমা আমাকে ভালোবাসে? আমি কি করব ঠিক বুঝতে পারছি না ডক্টর সায়ান। আই নিড এ টাইম।”
সায়ান কোনো জবাব দেয় না। আসলেই তো। আবেগ তো ঠিকই বলছে। আবেগ না হয় যথেষ্ট পরিমাণ ম্যাচিউর। কিন্তু উপমা? সে কি আদৌ ভালোবাসে আবেগকে। রাত ধীরে ধীরে গভীর হতে শুরু করেছে। সাথে করে আবেগের মনে জাগ্রত হওয়া প্রশ্নগুলো ও।
৩১.
আজ খুব বেলা করেই ঘুম ভাঙে উপমার। শরীরটাও খুব একটা ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে শরীর থেকে উত্তপ্ত ধোঁয়া বের হচ্ছে। জ্বর টর আসেনি তো আবার? শেষ রাতে কখন যে চোখ লেগে এসেছিল তা খেয়াল নেই। বহুকষ্টে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে। বেশ দেরি হয়ে গিয়েছে উঠতে আজ। আমেনা বেগমের কতই না কটুক্তি শুনতে হবে আজ কে জানে?
একরাশ ভীতি নিয়ে বারান্দার দরজার আড়ালে লুকিয়ে বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই অবাক হয় উপমা। বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে আছেন ইন্সপেক্টর অফিসার আমান, সাথে করে দারোগা আলী। আর তাদের দুজনের সামনেই ভয়ে জড়সড় হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন আমেনা বেগম। তার মুখশ্রী দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে তিনি কোনো বিষয় নিয়ে বেশ ভয়ে ভয়ে আছেন। কিন্তু অফিসার আমান এই অসময়ে এখানে কি করছে? আর কাকেই বা খুঁজছে এখানে? আমেনা বেগমকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে করতে আমান সাহেবের চোখ পড়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাদের চুপিচুপি পর্যবেক্ষণ করা উপমার উপর।
আমান সাহেব বারান্দায় তাকাতেই দ্রুত আড়ালে সরে আসে উপমা। বাইরে উঠানে কি যাওয়া উচিত নাকি ফের ঘরে চলে যাওয়া উচিত এই সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে ভুগতেই আমেনা বেগমের চড়া গলা কর্ণকুহরে পৌঁছায় তার। কিঞ্চিৎ পরিমাণ হকচকিয়ে গেলেও পা টিপে টিপে অতি ধীর গতিতে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসে উপমা। অফিসার আমান একবার উপমার দিকে সরু দৃষ্টে তাকিয়ে আমেনা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠেন,,
– “আপনি এখন আসতে পারেন। আমার এখন উপমার সাথে কিছু কথা আছে। ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করাটা জরুরি।”
এতেই যেন কপালে দুশ্চিন্তার ছাপ ফুটে ওঠে আমেনা বেগমের। অস্থিরতার পরিমাণ আগের চেয়ে একটু বেশিই বেড়ে গিয়েছে। আমান সাহেব পুনরায় তাড়া দিতেই তিনি একপলক উপমার দিকে তাকিয়ে ঘরের দিকে পা বাড়ান। এদিকে উপমা পড়েছে বেশ অস্বস্তিতে। কি জিজ্ঞাসাবাদ করবেন অফিসার আমান যার জন্য আমেনা বেগমকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে এখান থেকে?
– “ইফতেখার সাহেব কোথায় উপমা?”
আমান সাহেবের হঠাৎ প্রশ্নে প্রথমে খানিকটা ইতস্তত বোধ করে উপমা।
– “আব্বা সজল ভাইয়ের সাথে সদরে গেছেন।”
– “কখন গিয়েছে বলতে পারবে?”
– “না, তখন আমি বাড়ি ছিলাম না। তয় পূর্ণার কাছ থেইকা শুনছি ৪:৫০ টা নাগাদ বের হইয়া গিয়েছেন আব্বা।”
এরপর কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করে আমান সাহেব। দারোগা আলী ও তার নোটপ্যাডে কি যেন লিখছেন। কিছু একটা গভীরভাবে চিন্তা করে আমান সাহেব পুনরায় জিজ্ঞেস করে উঠেন,
– “আচ্ছা এটা বলতে পারবে যে যার কাছে চেয়ারম্যান সাহেব তোমাকে বিক্রি করে দিতে চলেছিল তার সাথে চেয়ারম্যান সাহেবের সম্পর্ক কেমন?
চেয়ারম্যান সাহেবের কি আন্ডার ওয়ার্ল্ডের কারো সাথে কোনো প্রকার যোগাযোগ রয়েছে; কিংবা সহজ কথায় কোনো মাদকদ্রব্য মালামাল ও হত্যার সাথে জড়িত আছেন কি না?”
আমান সাহেবের কথায় হতভম্ব হয়ে যায় উপমা। কি সব জিজ্ঞেস করছেন সে? হত্যা মামলা? এ ও কি সম্ভব নাকি! কিন্তু পরক্ষণেই ভাবে হতেও তো পারে। যে মানুষটাকে উপমা এত বছরেও ঠিকঠাক করে চিনতে পারে নি তার সম্পর্কে এত তথ্য বের হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। আর বাকি রইল মাদকদ্রব্য? হ্যাঁ, সেদিনই তো সজলের হাতে ইফতেখার সাহেব একটা ব্যাগ দিয়েছিলেন যা দেখে উপমা নিজেই এ ব্যাপারে সন্দেহ করেছিল। তবে কি এ ব্যাপারে আমান সাহেবকে বলে দেয়া উচিত হবে?
– “কি হয়েছে উপমা? কিছু বলছো না যে? ভয় পেয়ো না কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। নির্ভয়ে বলতে পারো সব।”
উপমাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই ভেতর থেকে আমেনা বেগমের কর্কশ কন্ঠস্বর ভেসে আসে। উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকা আমান সাহেবের দিকে একপ্রকার তেড়ে আসেন তিনি।
– “কি ব্যাপার সাহেব? আপনে উপমারে কি কানপট্টি পড়াইতাছেন? আমি তো কইলামই চেয়ারম্যান সাহেব এখন বাড়িতে নাই। নির্বাচনের কাজে সদরে গেছে। উপমারে কি জিগাইতাছেন আপনে হ্যাঁ?
আমেনা বেগমের কথায় কিছু বলতে যেয়েও থেমে যায় উপমা। এখন কিছু বললে তা হিতের বিপরীতেও হতে পারে। তাই এখন কিছু না বলাটাই শ্রেয়। অফিসার আমান একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টে আমেনা বেগমের দিকে তাকাতেই তিনি বেশ চুপসে যান। অতঃপর শান্ত গলায় বলে উঠেন,
– “ঠিক আছে। আজ আসছি। ইফতেখার সাহেবের সঙ্গে আমার জরুরি কথা রয়েছে। আর যদি কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে হয় তাহলে আমি পুনরায় আসব। ঐ যে বলেছিলাম আমার বিশেষ নজরদারি আপনাদের উপর।”
বলেই সেখান থেকে দ্রুত প্রস্থান করে আমান সাহেব। তিনি চলে যেতেই আমেনা বেগম দ্রুত উপমার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে উঠেন,
– “এই অপয়া, ঐ পুলিশ তোরে কি জিগাইতেছিল হ্যাঁ! তোর আব্বারে নিয়ে কি কইছে, তাড়াতাড়ি বল।”
উপমা জবাব দেয় না। উল্টো দিকে ঘুরে চলে যেতে নিলেই আমেনা বেগম পুনরায় চেঁচিয়ে উঠেন,
– “কি হইলো কথা কানে যায় নাই? কথা বলতেছিস না কেন? আর তুই যদি কিছু না বলিস তাইলে কিন্তু অনেক খারাপ হইবো উপমা।”
মৃদু হাসে উপমা। ঘাড় ঘুরিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে উঠে,
– “যা জিজ্ঞেস করার তাই করছে! আর কি করবা? বড়জোর মাইরাই ফেলবা; তয় মনে রাইখো আমি চুপ কইরা আছি বইলা এইটা মনে কইরো না যে উপমা সব অন্যায় সহ্য করে নিবে। পাপের ঘড়া একবার পূর্ণ হইয়া গেলে তা সবার সামনে আসতে বেশি দেরি লাগে না। যার যার কর্মফল সেই ভোগ করব।”
এ যেন হিংস্র আহত বাঘিনী। যার চোখে প্রতিবাদী মনোভাব। আমেনা বেগম রাগে গজগজ করলেও মুখ ফুটে কিছু বলেন না; কেননা মস্তিষ্ক জুড়ে তার অন্য কোনো পরিকল্পনা।……………….
#চলবে 🍂