এক_টুকরো_সুখ #পর্ব_৭

0
415

#এক_টুকরো_সুখ
#পর্ব_৭
#লেখনীতে_শুভ্রতা_প্রাণ

“রুবি তবে কোন বংশের মেয়ে? কে ওর বাবা? কি করেন তিনি?”

দুলাভাই একসাথে সব গুলো প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন আব্বার দিকে। আব্বা বিরস মুখে বললেন

“এগুলোর কিছুই জানিনা আমি। এখন তুমি যাও আকাশ।”

দুলাভাই গেলেন না। আব্বার অপর পাশে বসে পড়লেন ধপ করে।

“আব্বা আপনি এগুলো আগে কেনো জানাননি? এখন আমার মা যদি কোনোভাবে জানতে পারে তাহলে কত সমস্যা হবে বুঝতে পারছেন আপনি? আমার সংসার ভেঙে যাবে।”

“ওই জন্যই সবার সামনে না বলে শুধু আমার মেয়েকে একা ডেকে বুঝিয়েছি। তুমি আছো, আমাদের কথা শুনছো জানলে বলতাম না। এখন যেহেতু জেনেই গেছো তাই ঝামেলা না করে নিজের সংসার সামলাও। তাতেই সবার মঙ্গল। আমি নিজেও চাই না রুবির সাথে খারাপ কিছু হোক। ছোট থেকেই আমি কখনো আয়ু আর তাকে আলাদা করে দেখিনি। কিন্তু কেন জানি তোমার শাশুড়ি আর স্ত্রী কখনো আমার মেয়েকে ভালো চোখে দেখতে পারে না। আমার মেয়ে অতিরিক্ত রূপবতী বলেই হয়তো। রূপ মেয়েদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে থাকে আর আমার মেয়ের জন্য হয়েছে অভিশাপ।”

আব্বা ভুল কিছু বলেননি। আপার তুলনায় আমার গায়ের রং কিছুটা উজ্জ্বল। ছোট থেকে শুনে আসছি সবার মুখে রুবির বোনটা ওর থেকে এত বেশি রূপবতী হলো কীভাবে কে জানে। পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়, স্বজন কম বেশি সবাই একপ্রকার দুই বোনের মাঝে একটা দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে দিয়েছে। যার সূত্রপাত রূপ নিয়ে। তারপর আব্বা আমাকে লেখাপড়া শেখাতে তৎপর হলেন। আমিও স্কুলে যাওয়ার পর থেকে কত শত বার মেধাবীর তকমা পেয়েছি তার ইয়াত্তা নেই। আর আপা তো সেই ছোট থেকেই সারাদিন খালি সাজগোজ নিয়ে পড়ে থেকেছেন। আমার আগ্রহ নেই দেখে আমার জিনিস গুলোও নিজের দখলে নিয়ে ব্যবহার করেছে। সেই হিসেবে আমার থেকে প্রায় সব দিকেই পিছিয়ে আপা। গ্রামের লোকজনের কাছে এ নিয়ে অনেক কথা শুনেছি। আমি কানে না নিলে ওই ব্যাপার গুলো ধরে আমার প্রতি তীক্ষ্ণ প্রতিদ্বন্দ্বিতার মনোভাব পুষে রেখেছে আপা। এসব বোধহয় তারই ফল।

“দেখো আয়না আমি জানি রুবি বা আমার মা কখনো তোমার সাথে ভালো ব্যবহার করেনি। সব সময় সুযোগ খুঁজেছে তোমাকে ছোট করার জন্য। করেছেও। কোনো সুযোগই তারা ছাড়েনি। এমনকি অকারণেও দোষারোপ করেছে। কিন্তু তবু হাত জোর করে অনুরোধ করছি রুবি যে তোমার নিজের বোন নয় একথা তুমি কাউকে বলো না। বিশেষ করে আমার মা যেন জানতে না পারে। তবে তিনি আমার সংসার টিকতে দেবেন না। বড় ভাইয়ের মতো হয়ে তোমাকে অনুরোধ করছি বোন আমার সংসারটা ভেঙো না।”

আমি মৃদু হাসলাম। সেই দুলাভাই আমার কাছে হাত জোর করে অনুরোধ করছেন যে কখনো আমার সাথে ঠিকঠাক কথা পর্যন্ত বলেনি। তার স্ত্রী, মা যখন আমাকে বিনা কারণে কথা শুনিয়েছে তখনও নীরবে শুধু শুনে গেছেন। এখন নত মস্তকে আমার সামনে। হাহাহা। প্রকৃতি কি অদ্ভুত। কখন কাকে কেমন পরিস্থিতিতে ফেলবে তা কেউ জানে না।

“আপনি চিন্তা করবেন না দুলাভাই। আমার মুখ থেকে অন্তত এই কথা কেউ জানবে না।”

বাড়ি ফিরে গেলাম। দুলাভাই বসে রইলেন সেখানে। হয়তো এখনো ধাক্কা সামলাতে পারেননি। সমস্যা না, একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে। তবে আমাকে আরো শক্ত হতে হবে। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। কারো আলগা কথায় কেঁদে ভাসালে হবে না। মনে মনে ঠিক করে নিলাম আমূল বদলে যাবো এখন থেকে। এমনি এমনি কাউকে ছেড়ে দেবো না। কাউকে অকারণ কথা শোনাবার সুযোগও দেবো না।

সবকিছুই স্বাভাবিক হয়ে গেলো। আপা তার শাশুড়ির সাথে মিলে বেশ ভালোই নিজের পরনিন্দা পরচর্চা অনুশীলন করে চলেছে। করুক, তাতে আমার কি। এগুলো আর ভাববো না। পড়ার মধ্যে ডুবে গেলাম। আশেপাশে যা হচ্ছে হোক। আমি না দেখলেও চলবে। আমার জন্য কিছুই থেমে থাকবে না। আমাকে গোছাতে হবে নিজের জীবন।

ঈদ শেষে আপা আর দুলাভাই চলে গেলেন পুরো পরিবার নিয়ে। সেই সাথে চলে গেলেন দুপুরও। তার সাথে আর পরবর্তীতে কথা বলিনি আমি। কি প্রয়োজন? তার সাথে আমার এমন কোনো জরুরি দরকার নেই যার জন্য কথা বলে অযথা বদনাম কুড়োতে হবে। উটকো ঝামেলা এড়িয়ে চলাই উত্তম। তিনি যদিও সরি বলেছিলেন। কারণ তার জন্যই আমাকে অত গুলো কথা শুনতে হয়েছে। আমি জবাবে শুধু মুচকি হেসেছিলাম। কিছু বলতে ইচ্ছে হয়নি।

সময় চলে যাচ্ছে দ্রুত। সময়ের সাথে সাথে আমাদের জীবনেও পরিবর্তন আসছে। আমি আগের থেকে অনেক বেশি মনোযোগী হয়েছি পড়ালেখায়। আব্বা সব ঋণ প্রায় শোধ করে ফেলেছেন। আপা গর্ভবতী হয়েছে। আরো কত শত পরিবর্তন। দেখতে দেখতে এগিয়ে আসছে আমার মাধ্যমিক পরীক্ষার সময়। পরীক্ষার দিন তারিখ সব ঠিকঠাক কেবল শুরু হওয়া বাকি মাত্র। এক সপ্তাহ পরেই পরীক্ষা শুরু। এরমধ্যে খবর এলো আপার ডেলিভারির আর বেশি সময় বাকি নেই তাকে যেন এ বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। এতেই বুঝতে পারছি আমার জন্য সামনে কি অপেক্ষা করছে। এসএসসি পরীক্ষার মধ্যে আপাকে এবাড়িতে পাঠানোর কোনো মানে হয়? কিন্তু না তার শাশুড়ির কথা হলো মেয়েদের প্রথম সন্তান নাকি বাপের বাড়িতে হয়। কোথায় লেখা আছে কে জানে!

আপাকে নিয়ে আমার পরীক্ষা শুরু হওয়ার তিন দিন আগেই এসে পড়লেন দুলাভাই। আমাকে শুধু একবার জিজ্ঞেস করলেন অবস্থা কেমন, লেখাপড়া ঠিকমতো করছি কি না। কোনোরকম মাথা নেড়ে উত্তর দিয়েই চলে এসেছি আমি। নষ্ট করার মতো সময় আপাতত নেই। আপাকে দিয়ে দুপুরের খাবার খেয়েই দুলাভাই চলে গেলেন। আবার বাচ্চা হওয়ার সময় নাকি আসবেন। তাতে আমার কিছু না। আমাকে পড়তে হবে।

অন্য সময় আসলে আপা আর দুলাভাই আমার ঘরেই থাকে। সেই অনুযায়ী আম্মা আমার ঘরেই আপাকে রাখার ব্যবস্থা করতে শুরু করলেন। কিন্তু এখন পরীক্ষার আগে আমাকে রাত জেগে পড়তে হবে। ভাইয়ের ঘরে থাকলে তা হবে না। বই খাতা সব এই ঘরে, কয়বার বিরক্ত করবো?

“আম্মা আমি ঘর ছাড়তে পারবো না। দুইদিন পর পরীক্ষা আমাকে রাত জেগে পড়তে হবে।”

আম্মা যেন খানিক অবাক হলেন আমার কথায়। অন্য কাউকে কথায় ছাড় না দিলেও আম্মার মুখে মুখে বা কথার ওপর কখনো কথা বলিনি আমি। সেই জন্য বোধহয় চমকে গেলেন। সমস্যা না, ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু ঘর ছাড়া যাবে না আপাতত।

“তাহলে তোর আপা কোথায় থাকবে?”

“সেটা আমার জানার বিষয় না আম্মা। আমি বলিনি তাকে নিজের শশুর বাড়ি ছেড়ে এখানে চলে আসতে। তুমি জানো এখন তোমার মেয়েকে কোথায় রাখবে। আমি ঘর ছাড়তে পারবো না। সারা বছর কষ্ট করে পড়ার পর এখন যদি ঠিকমতো প্রস্তুতি না নিতে পারি তবে আমার সব কষ্ট বৃথা হয়ে যাবে। এগুলোর প্রভাব পড়বে আমার ভবিষ্যতের ওপর,আব্বার স্বপ্নের ওপর।”

আম্মা বোধহয় আরো খানিক চমকালেন। তার চোখ দুটো কেমন বড় বড় দেখাচ্ছে।

“তোর বোন হয় রুবি। বোনের জন্য এটুকু ছাড় দিতে পারবি না?”

“আমিও তার বোন হই আম্মা। কই আমার বেলায় তো আপা এক চুলও ছাড় দেয় না। ছোট থেকে দুইজনের জন্য এক জিনিস আব্বা আনার পরেও আপা আমার গুলো নিয়ে টানাটানি করেছে। দিয়ে দিয়েছি। নিজে সাজগোজ নিয়ে ব্যাস্ত থেকেছে সারাদিন আর আমি স্কুল থেকে এসেও তোমাকে কাজে সাহায্য করেছি। না করলে ঝগড়া শুনেছি কিন্তু আপাকে কখনো কিছু বলোনি। কই তখন তো আপার মনে হয়নি আমি ওর ছোট বোন, স্কুল থেকে দুপুর বেলায় এসে কষ্ট হয়েছে, ও তোমাকে একটু সাহায্য করুক। কখনো তো করেনি! নিজের শশুর, শাশুড়ি, স্বামী সহ দেবরের সামনে আমাকে বাজে ভাবে অপমান করেছে, তখনও মনে হয়নি আমি তার ছোট বোন। এমনকি তুমি নিজেও কিছু বলোনি। তাহলে আম্মা আমার বেলায় যখন তোমরা কেউই কিছু মনে রাখো না, কোনো ছাড় দাও না তবে আমি কেন দেবো?”

কথা গুলো শুনে আপা তেড়ে এলেন আমার দিকে মারার জন্য। তখনই আব্বা ঘরে এলেন। আম্মা এখনো বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে আছেন। বোধহয় বিশ্বাস করতে পারছেন না আমার এরকম আচরণ। কখনো বলিনি তো কিছু। চুপচাপ ছিলাম কিন্তু ওরা সেটাকে দুর্বলতা ভেবে বসে আছে।

“আয়ুর গায়ে যেন হাত না লাগে রুবি। কথায় কথায় ওর গায়ে হাত তোলা বন্ধ করো। তুমি এখন আর ছোট নও, কদিন পরে মা হবে। নিজেকে বদলে নাও নইলে পরে পস্তাবে। আর রাবেয়া তোমাকে বলছি, এক মেয়ের জন্য আরেক মেয়ের প্রতি অবিচার কিন্তু আল্লাহ সইবেন না। সাবধান।”

আব্বা চলে গেলেন। আমিও আমার মতো পড়তে বসে গেলাম। আম্মা খানিক সময় দাঁড়িয়ে কিছু ভাবলেন। হয়তো নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন বা হয়তো পারেননি। কিছু যায় আসে না। এখন থেকে যে যেমন করবে তার সাথেও আয়ু তেমনই করবে। একটুও ছাড় না। খানিক বাদে আপাকে নিজের সাথে যেতে বলে আম্মা ঘর থেকে বের হতে নিলেন।

“তুমি এই আয়নার কথা মতো আমাকে এ ঘর থাকতে দেবে না আম্মা? এত লায় কেনো দিচ্ছো? কি করবে এত বিদ্যাধর হয়ে? সেই তো দেখবে দুদিন পরে পড়তে গিয়ে কোন ছেলের সাথে ফস্টিনস্টি করে কেলেঙ্কারি করে বসে আছে।”

আপার কথা শেষ হতে না হতেই আম্মা তার গালে চড় বসিয়ে দিলেন। অবাক হওয়ার মতো ঘটনা না হলেও আমি অবাক হলাম। কারণ আমার জন্য আম্মা আপার গায়ে হাত তুলবেন এটা অকল্পনীয় একটা ব্যাপার। সেটাই যখন বাস্তবে ঘটছে অবাক তো একটু হতেই হয়।

“ভুলে যেও না রুবি আমার তোমার আম্মা। আয়না নিজেও আমার মেয়ে। তুমি তাকে নিয়ে এরকম বাজে কথা বলতে পারো না। একটা মেয়ে হয়ে অন্য একটা মেয়ে সম্পর্কে এমন ধারণা কীভাবে করতে পারো তুমি? তুমি নিজে করেছো ছেলেদের সাথে ফস্টিনস্টি?”

“আম্মা…”

“তোমার গায়ে কথাটা যেভাবে লেগেছে অন্যজনের গায়েও একই ভাবে লাগে। মনে রাখবে সব সময় তুমি ইট ছুড়লে তোমাকেও পাটকেলের ঘা খেতে হবে। নিজের সীমা অতিক্রম করবে না কখনো। চুপচাপ বেরিয়ে এসো।”

চোখে পানি জমে এলো। আম্মা এভাবে আমার জন্য প্রতিবাদ করলেন? আমার জন্য? ছোট থেকেই দেখে আসছি আম্মা আমার থেকে আপাকে বেশি ভালোবাসেন। তা নিয়ে আমার কোনো আপত্তি ছিলো না ঠিকই তবু মানুষের মন তো! একটা না একটা সময় ঠিক খারাপ লাগে। কখনো মুখে কিছু বলতাম না তাও। আজ বোধহয় আব্বার কথায় হুশ ফিরেছে আম্মার।

চলবে…?

[আস্সালামুআলাইকুম। গল্প কি ভালো লাগছে না আপনাদের?শেষ করে দেবো? রেসপন্স পাচ্ছি না তেমন 🙂]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here