#প্রেয়সীর_শব্দপ্রেম (দ্বিতীয় খন্ড)
#ফারজানা_মুমু
[৯]
সারারাত বৃষ্টির কারণে সকালে নতুন সূর্য উঁকি দিয়েছে ঝলমল করে। রাতের আকাশের কান্না থেমে যেন এখন নিজস্ব তেজ দেখাতে ব্যস্ত।চারদিকে পাখির কিচিরমিচির । কাকের কর্কশ কণ্ঠস্বরও কানে বাজছে। গতকাল রাতে জানালা বন্ধ না করায় রোদ এসে পড়তে লাগলো চোখে-মুখে। সূর্যের তেজস্ক্রিয় আলো নীরা’র চোখে পড়তেই ক্লান্ত দুটো চোখ ধীরে-ধীরে জেগে উঠল। বিরক্তিতে ‘চ’ কারান্ত শব্দ বের করে চারদিকে চোখ বুলালো। অজানা অচেনা রুমটি দেখে প্রথম ভ’য়ে পা দুটি গুটিয়ে নিলো, আকস্মিক মনে পড়লো আজ থেকে এই রুমটি তার। রাতের কথা মনে হতেই লজ্জায় মিইয়ে পড়ল। চোখ বুলিয়ে হিরণ কোথায় আছে দেখতে চাইলো। ওয়াশরুমের দরজার শব্দে ওদিকে তাকাতেই দেখল অর্ধলগ্ন হিরণ দাঁতপাতি বের নির্লজ্জের
মত হাসছে। ওই হাসিতে লজ্জা আরো বাড়িয়ে তুলল দ্বিগুণ। গায়ে জড়ানো পাতলা কম্বলখানা আরেকটু উপরে তুলে শব্দ করেই বলল, এভাবে হাসবেন না আমার অনেক লজ্জা করে।
-” এখনও লজ্জা আছে?
-” আপনি বের হোন আমি ফ্রেশ হবো।
-” তো যাও আমি থাকলে সমস্যা কী?
লজ্জায় ঠোঁট কামড়ে ধরল নীরা। শরীরের প্রতিটি ভাঁজে লজ্জার অস্তিত্বও টের পাচ্ছে। নীরাকে লজ্জায় লাল হতে দেখে হিরণ নিজেই খাটের উপরে উঠে বসল। মুখটা সামনে এগিয়ে দিয়ে বলল, হবে নাকি মিষ্টি মুখ?
-” আপনি এমন কেনো? দেখছেন আমি লজ্জা পাচ্ছি কই না একটু দূরে থাকবেন কিন্তু না ঠিকই আমার সামনে ঘুরঘুর করছেন। মনস্ত্ব আছে আপনার?
-” নেই তো। গতকাল রাতে সব হাঁটে বেছে দিয়েছি। বিক্রীত পণ্য ফেরত নহে জানো না?
-” আবার।
কাঁদো-কাঁদো কণ্ঠে বলল নীরা। হিরণ নীরার কপালে চুমু দিয়ে বলল, আরেহ বোকা মেয়ে, আমরা স্বামী-স্ত্রী লজ্জা পাচ্ছ কেন। আচ্ছা যাও আমি রুম থেকে যাচ্ছি তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো। আব্বা কি করছে দেখে আসি।
নীরা মাথা ঝাঁকাল। হিরণ যেতে গিয়েও নীরার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে অমৃতের স্বাদ নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ল। নীরা ছাড়া পেয়ে তখন এক দৌড়ে ওয়াশরুমে ছুটল। অজানা সুখ,আনন্দ টিকরে পড়ছে ওর দুনিয়া জুড়ে। বিড়বিড় করে গাইলো, ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো
তোমার মনের মন্দিরে।
____________
মঙ্গলবার আজ। গৌতম বাজারে প্রতি মঙ্গলবার ও শনিবার হাট বসে। বড় হাট বলা এই বাজারকে। অন্যান্য দিনের থেকে এই দুটো দিন সবজি,মাছ কমে পাওয়া যায় বাজারে। ক্রেতা-বিক্রেতাদের ভিড়ে পা রাখার জায়গা থাকে না তখন। ঝুমঝুমি আগেও এখানে এসেছে রাস্তাটা ওর খুব পরিচিত। বাবার হাত ধরে কত বাজার করেছে তখন। ওদের বাড়ি থেকে এই বাজারে আসতে দশ টাকা ভাড়া লাগে। গোপনে বিষাদের নিঃশ্বাস ছেড়ে সামনে এগিয়ে গেল ঝুমঝুমি।
দু-দুটো সপ্তাহ ফেরিয়ে আজ আবারও চলে আসছে এখানে। ঝুমঝুমি আরো দুবার এসেছিল গৌতম বড় বাজারে। দুবারই ব্যর্থ হয়ে ফিরতে হয়েছে। আজও প্রস্তুতিতে নিয়ে গৌতম বড় রাস্তার মোড়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে ঝুমঝুমি। গায়ে জড়ানো মেরুন বোরখা। নিকাব দিয়ে মুখ ঢাকা, চোখে ইয়া বড় চশমা। বাম সাইডে কাপড়ের ব্যাগ। ঈগল চোখে তাকিয়ে আছে দূরে থাকা বয়স্ক এক লোকের পানে। লোকটি ওর বড় চাচা। বাবার মৃ’ত্যু’র পর ওদের যাবতীয় সম্পত্তি হস্তান্তর করেছে এই লোক। এমনকি নিজ মেয়ের জামাইয়ের কীর্তিকলাপ ঢাকা দিয়ে নোংরা অপবাদ দিয়েছে ঝুমঝুমি ও ওর মা-বোনের উপর। ঝুমঝুমির মাথা গরম হলো। তবুও নিজেকে রাখলো শান্ত। লোকটার হাতে বড় বাজারের ব্যাগ। আনমনে হেঁটে গলি পার হবার সময় ঝুমঝুমি এগিয়ে যায় লোকটির সামনে। তখন সন্ধ্যা প্রায়। দূরের মসজিদে আযানের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। আযানের ধ্বনি শেষ হতেই যথাসম্ভব কণ্ঠ নামিয়ে বলল ঝুমঝুমি, আমায় দিন ব্যাগটা। আমি এগিয়ে দিচ্ছি।
বয়স হয়েছে অনেক সেজন্য ঝুমঝুমির কণ্ঠ চিনতে পারেনি ওর চাচা। তবে সন্দিহান নজরে একবার পলক করে জিজ্ঞাসা করে, কে তুমি?
ঝুমঝুমি নড়ে চড়ে উঠে। কি বলবে খোঁজে না পেয়ে খানিক নিরবতা পালন করে। আচমকা মাথায় এক কঠিন বুদ্ধি খাটিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে বলে, চাচা ওই মোড়ের শেষ দিকগটায় একটা মহিলা মাদ্রাসা হয়েছে না ঐখানে আমি জব করি। দেখলাম আপনি ভারী ব্যাগটা নিয়ে হাঁটতে কষ্ট পাচ্ছেন তাই সাহায্য করতে আসলাম।
ঝুমঝুমির পোশাকের দিকে তাকিয়ে থেকে সন্দেহ দূর করল লোকটি। বিশ্বস্ত কণ্ঠে বলল, নেও মা। সত্যিই খুব কষ্ট হচ্ছিল। এইজন্যই দীনদার মানুষ আমার খুবই পছন্দ। আমি নিজেও একজন ধার্মিক মানুষ।
মনেমনে তিরস্কার হাসি দিল ঝুমঝুমি। ধার্মিক-দীনদার মানুষেরা কখনোই অন্যর হোক মে’রে দেয় না। ওরা আল্লাহর রাস্তায় চলে। পরকালের ভয় আছে। তাছাড়া দীনদার মানুষেরা কখনোই বলে না সে দীনদার বরং মানুষ ওদের আচরণে বুঝতে পারে। ঠোঁটের কোণায় কুটিল হাসি ফুটলো ঝুমঝুমির। ব্যাগটা হাতে নিয়ে এগুতে লাগলো সামনের দিকে। ওর বড় চাচাও ওর সাথে-সাথে এগুচ্ছে। ঝুমঝুমি আরেকবার সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে দেখল চতুর্দিক। না কেউ নেই এখানে। বাজারের ব্যাগটা ওর বড় চাচার হাতে ধরিয়ে বলল, চাচা একটু ধরুন তো আমার ফোন বাজছে।
ব্যাগ হাতে নিয়ে ধীরে-ধীরে এগুতে লাগলো লোকটি। ঝুমঝুমি ব্যাগ থেকে একটি ইনজেকশন বের করে দ্রুত হেঁটে পুশ করল লোকটির ঘাড়ে। সাথে সাথে লোকটি হাতের ব্যাগটা নিচে ফেলে ঝুমঝুমির দিকে তাকিয়ে বলল, কে তুমি?
নিকাব সরালো মুখ থেকে। দীর্ঘদিন পর পরিচিত মুখটি দেখে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, ঝুমঝুমি।
লোকটি রাস্তায় ঢলে পড়ল। এই ইনজেকশনের কাজ হলো পুরো শরীরকে নিস্তেজ করে ফেলা। প্যারালাইজড যাকে বলে। সবকিছু শুনতে পারবে, অনুভব করতে পারবে কিন্তু বলতে পারবে না,ইশারা করতে পারবে না,শরীর নাড়াতে পারবে না। যতদিন বেঁচে থাকবে এইভাবেই বাঁচতে হবে। ক্ষণে-ক্ষণে নিজের মৃ’ত্যু কামনা করবে কিন্তু হবে না। দুনিয়ায় থেকেও মৃ’ত হয়ে থাকার শাস্তি পাবে বেঈমানরা। র’ক্ত’কে আ’ঘা’ত করা হলে বুকে এক ধরনের ব্যাথা তৈরি হয়,চিনচিনে সেই ব্যাথা। ঝুমঝুমি খেয়াল করছে সে হঠাৎই করেই ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছে। যতই হোক লোকটি তার বড় চাচা। ছোট থেকে বাবার মতোই ভালোবেসে শেষে কিনা প্রতারণা করার জন্য মৃ’ত্যু’র থেকেও ভ’য়া’ব’হ শাস্তিটা দিয়েছে বলে নিজের মনে অপরাধবোধ কাজ করছে। দু-চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। চাচার একটি হাত বুকে জড়িয়ে ক্রন্দন মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, ক্ষমা করে দাও বড় বাবা। আমি চাইনি তোমায় এভাবে কষ্ট দিতে কিন্তু আমি নিরূপায়। তুমি বা তোমরা যা আমাদের সাথে করেছ তারজন্য তোমাদের আমি ক্ষমা করতে পারি না। তবে তোমার শাস্তিটা আমি কমিয়ে দিচ্ছি। তিলে-তিলে ম’রা’র চেয়ে একেবারেই তোমায় মে’রে দিচ্ছি। তোমার কষ্ট আমার সহ্য হচ্ছে না বড় বাবা।
ঝুমঝুমি ব্যাগ থেকে বড় ছু’রি’টা বের করল। পরপর তিনবার বসালো বু’কে। ইহকালের মায়া ত্যাগ করে পরকালে ভ্রমণ করল ঝুমঝুমির বড় চাচা। সস্তির এক নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে উঠল, ভালো থেকো বড় বাবা। তোমার কষ্ট আমার সহ্য হবে না যতই হোক তোমার হাত ধরে ঘুরে বেড়িয়েছি। কাঁধে ছড়িয়ে ঘুরিয়েছ। তুমি ভুলে গেলেও আমি ভুলব না তাই তোমাকে মৃ’ত্যু দিলাম,সহজ মৃ’ত্যু। কিন্তু তুমি যা করেছ আমাদের সাথে ভয়াবহ মৃ’ত্যু দেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও র’ক্তে’র টানের কারণে পারিনি।
ঝুমঝুমি দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে উল্টো পথে হাঁটা দিল। একটু পরেই নামাজ শেষ করে লোকজন এদিকে আসবে। তখনই শুরু হবে হট্টগোল।
গলির ডানদিকে খালি জায়গা রয়েছে ওদিকটায় বাচ্চাদের পার্ক। ঝুমঝুমি বেঞ্চে বসে চিন্তায় মগ্ন তখন। দুহাতের উপর মুখের ভর রেখে ভাবছে ঠিক তখনি স্পষ্ট ভরাট কণ্ঠ কানে বাজলো,বোরখার আড়ালে থেকেও আমার চোখের আড়ালে যেতে পারলি না ঝুমঝুমি। তোর শরীরের ঘ্রাণেই আমি তোকে ঠিক চিনে নিবো।
কথাগুলো খুব দ্রুত পৌঁছালো ঝুমঝুমির কানে। মস্তিষ্ক গেঁথে নিলো খুব তাড়াতাড়ি। চোখ তুলে তাকিয়ে সামনের মানুষটিকে দেখে ভয়ে চুপসে গেল। কাঁপা গলায় বলল, মেঘ ভাই!
একগাল হাসলো মেঘ। ঝুমঝুমির পাশে বসে ফিচেল হেসে বলে উঠল, আমি জানতাম তুই সাহসী। কিন্তু তোর যে এত সাহস আমার জানা ছিল না। তিন-তিনটা খু’ন করে ফেললি? মানলাম তোর চাচাতো বোনের জামাই তোর কেউ হয় না,ও’কে খু’ন করলে তোর হাত পা কাঁপবে না। তাছাড়া ও ডিজার্ভ করে মৃ’ত্যু। কিন্তু আমি ভাবছি নিজের আপন ফুপু,চাচাকে খু’ন করার সময় তোর হাত কাঁপেনি? খুব নিষ্ঠুর তুই ঝুমঝুমি।
অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ঝুমঝুমি। মেঘ কীভাবে জানলো এসব? তখনই ঝুমঝুমিকে অবাক করে দিয়ে কুঠিল হেসে বলল মেঘ, ঝিনুক তাহলে আমার মেয়ে তাই না?
##চলবে,,
[গতকাল থেকে বাচ্চাদের হাতে মেহেদি পড়িয়ে দিচ্ছি। হাত ব্যাথা হয়ে গেছে। বহু কষ্টে আজকের পর্ব লিখলাম। রি-চেইক করা হয়নি। দুদিন গল্প দিবো না সরি। 😑]
ঈদ মোবারক সবাইকে 🖤