#আমার_ভাঙা_ক্যানভাসে (১০)
#তানজিলা_খাতুন_তানু
তিথির বিয়ের আয়োজন ধুমধাম করে চলছে। চৌধুরী বাড়ির মেয়ের বিয়ে বলে কথা আয়োজন তো একটু হবেই। সবাই নিজেদের মতো আনন্দ করছে কিন্তু রুহি আর প্রিয়া আনন্দ করতে পারছে না। জয়কে সামনে থেকে দেখে রুহির বিরক্ত লাগছে অন্যদিকে প্রিয়া প্রতিনিয়ত প্রেমিক পুরুষকে সামনে থেকে দেখে মন ভা’ঙার কষ্টটা আরো দ্বিগুন হয়ে উঠছে।
বিয়ের দিন আগিয়ে আসতে লাগল। কেনাকাটা, নেমন্তন্ন সবকিছুই কমপ্লিট হয়ে গেছে এখন শুধু অপেক্ষা সেই কাঙ্ক্ষিত দিনটার।
– ‘কিরে রুহু তোর হলো।’
অর্নবের কথাতে রুহি মাথা তুলে তাকাল। অর্নব মুগ্ধ হলো, রুহির পরনে সি গ্রিন কালার সালোয়ার কামিজ আর হালকা সাজ তাতেই বেশ সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে।
– ‘হয়ে গেছে তো। চলো।’
রুহির কথাতে অর্নবের ধ্যান ভাঙে। ওরা দুজন একসাথে কথা বলে বলে বসার ঘরের দিকে আসতেই জয়ের নজর পড়ে ওদের দিকে। সোহানকে ঘুচিয়ে কিছু একটা বলতেই সোহান বলল,
– ‘কিরে রুহু কোথায় যাচ্ছিস?’
– ‘হ্যাঁ আসলে অর্নবদার কিছু কেনাকাটা করার ছিল তাই আর কি।’
– ‘তাহলে তো ভালোই হলো।’
– ‘কেন!!’
– ‘আমি আর জয়ও তো কেনাকাটা করতে বের হবো বলে ভাবছিলাম।ভালোই হলো সবাই একসাথে যাওয়া হবে।’
রুহি রাগে কটমট করে জয়ের দিকে তাকাল। জয় মুখ টিপে হাসছে। রুহি কিছু বলতে যাবে তার আগেই অর্নব পারমিশন দিয়ে দিলো। জয় আর সোহান ওদের সাথে বেড়িয়ে পড়ল। রুহি ফোঁস ফোঁস করছে কিন্তু কিছু বলতে পারছে না।
সোহান তো অর্নবের সাথে বকবক করেই চলেছে। শপিং মলে গিয়ে যে যার মতো কেনাকাটা করছে, তখনি জয় রুহিকে ধরে একটা সাইডে নিয়ে গিয়ে দেয়ালের সাথে চেপে ধরল।
– ‘কি হলো এইসব কি অসভ্যতামী!!’
– ‘এখনো অসভ্যতামীর কিছুই শুরু হয়নি। ভালো করে বলছি ওই অর্নবের থেকে দূরে থাক।’
– ‘আমি কি করবো না কি করবো সেটা আপনার থেকে জানব না। আমি যা ইচ্ছা করবো, প্রয়োজনে অর্নবদাকে বিয়েও করবো।’
জয়ের চোয়ালে শক্ত হয়ে উঠল। রুহির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
– ‘চেষ্টা করে দ্যাখ, এর ফল কতটা ভয়া’বহ হবে সেটা তুই কল্পনাও করতে পারবি না।’
রুহি একটু দমে গেল, জয়কে এতগুলো জয়কে এতগুলো দিন ধরে চেনে কিন্তু আগে কখনোই ওর চোখে এতটা রাগ দেখিনি। রুহি ভালো করেই জানে এই রাগ জিনিসটা এতটা ভয়াবহ, তাই চাই না কারোর রাগের আগুনে দগ্ধ হতে।
– ‘ছাড়ুন আমাকে। আপনার সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছা নেই আমার।’
– ‘তোর ইচ্ছা থাকুক আর নাই বা থাকুক তুই আমার হবি এইটাই ফাইনাল তাই অন্যের দিকে গুরুত্ব না দিয়ে আমার দিকে দে লাভ হবে।’
রুহি বিরক্ত হয়ে জয়কে কোনোরকমে ধাক্কা দিয়ে চলে গেল।
**
বিকালে তিথির হলুদের অনুষ্ঠান। আয়োজন চলছে, জয় গার্ডেন সাইডে ডেকোরেশনের কাজে ব্যস্ত তখনি একটা গাড়ি বাড়ির সামনে থামল।
রুহি দৌড়ে এসে ওনাদের জড়িয়ে ধরলেন। জয় একটু ভালো করে লক্ষ্য করতেই দেখল রুহির মামা আর মামি এসেছেন, হয়তো বিয়েতে বলেছে তাই এসেছেন। দুপুরে এই বাড়িতেই জয়ের খাওয়ার আয়োজন হলো, যদিও রুহির মামার সাথে একসাথে বসতে একটু ইতস্তত বোধ করছিল। রুহির মামা অনেক বড়ো ব্যবসায়ী আর সেখানে জয় একটা সাধারন কোম্পানিতে জব কর।
– ‘কি হলো জয় তুমি খাচ্ছো না কেন?’ (রুহির বড়ো আব্বু)
– ‘আসলে আঙ্কেল..
– ‘আরে এতটা ইতস্তত বোধ করছ কেন? ফ্রি মাইন্ডৈ খাও এইখানে আমরা সবাই তো তোমার নিজের লোক।’
হামিদ চৌধুরীর কথাতে জয় একটু সাহস পায়, মুচকি হেসে খাওয়া শুরু করবে তখনি রুহির মামা বললেন,
– ‘ওহ কে? ওহ কে তো ঠিক চিনলাম না!’
কেউ কোনো উত্তর দিচ্ছে না দেখে জয় মুখ তুলে সবার দিকে তাকাল, সকলে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। রুহির মামা বিষয়টিতে অবাক হয়ে বললেন,
– ‘কি ব্যাপার কেউ কিছু বলছ না কেন?’
হামিদ চৌধুরী জয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
– ‘কি হলো জয়, ওনার প্রশ্নের উত্তরটা দাও।’
– ‘কিন্তু আঙ্কেল..
– ‘কোনো কিন্তু নয়, উনি যেটা জানতে চাইছেন সেটার উত্তর দাও।’
– ‘আমি জয়, আদ্রিয়ান নিহান জয়। রুহির বেস্টফ্রেন্ড।’
রুহি চমকে জয়ের দিকে তাকাতেই দুজনের চোখাচোখি হয়ে যায়। রুহির মামা বললেন,
– ‘রুহির বেস্টফ্রেন্ড!!’
– ‘জ্বি।’
খাওয়া পর্ব শেষ হয়ে যাবার পর মোটামুটি যে যার ঘরের দিকে পা বাড়িয়েছে, জয় যেহেতু এই বাড়িতে থাকে না বিধায় ড্রইং রুমেই তার স্থান হয়েছে বাড়িতে যেতে চেয়েছিল কিন্তু হামিদ চৌধুরী এইখানে থাকতে বলেছেন। রুহি মায়ের সাথে হাতে হাতে কাজ করার জন্য বসে আছে। হামিদ চৌধুরী সোফাতে বসে বললেন,
– ‘জয়।’
– ‘জ্বি আঙ্কেল বলুন।’
– ‘খাবার সময়ে এতটা ইতস্তত বোধ করছিলে কেন?’
– ‘আসলে আঙ্কেল…
– ‘তুমি রুহির মামার সামনে নিজেকে ছোট, সামান্য ভাবছিলে তাই তো!’
জয় রুহি দুজনেই চমকে উঠল। রুহি হামিদ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে জয়ের দিকে তাকাতেই বুঝল বিষয়টি সত্যি। জয় মাথা নীচু করে বসে আছে। রুহির বিষয়টিতে খারাপ লাগল।
– ‘জয় নিজেকে কখনোই কারোর থেকে ছোট ভাববে না। রুহির মামা হয়তো বিশাল বড়ো ব্যবসায়ী হতে পারেন, রাজা হতে পারেন কিন্তু সবটাই তিনি নিজের জায়গাই। তোমার নিজের রাজত্বে তুমিই রাজা, কোনো কাজই ছোট নয় তাই নিজের পেশাকে নিয়ে ছোট হবে না। মনে থাকবে!’ (হামিদ চৌধুরী)
– ‘হুম।’
– ‘আর একটা কথা।’
– ‘কি!’
– ‘তুমি এই বাড়ির ছেলে ছিলে আর আছো, রুহির সাথে তোমার সম্পর্ক খারাপ হতেই পারে কিন্তু আমাদের কারোর সাথে হয়নি। তাই এই বাড়িটাকে নিজের বাড়ি ভেবে আনন্দ করো কেমন।’
রুহির সাথে সম্পর্ক খারাপ হতেই পারে মানে কি!! রুহি চমকে উঠল, তারমানে কি হামিদ চৌধুরী জানে রুহি আর জয়ের সম্পর্ক ঠিক নেয়!!
***
রুহির মামা ভীষন রকমের অসন্তুষ্ট হয়েছেন হামিদ চৌধুরীর উপর। একটা বাইরের ছেলেকে নিয়ে এতটা বাড়াবাড়ি ওনার এরকম পছন্দ হয়নি তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিয়েটা হয়ে গেলেই কালকে রাতে বাড়ি ফিরে যাবেন। আর সেই বিষয়টায় বোঝানোর জন্য রুহির মা এসেছেন,
– ‘কি ব্যাপার দাদা তুমি নাকি কালকেই চলে যাবে বলছো?’
– ‘হ্যাঁ যদি পারতাম আজকেই চলে যেতাম।’
– ‘কেন কি হয়েছে?’
– ‘তোমার ভাসুরের ওই বাইরের ছেলেকে নিয়ে এতটা বাড়াবাড়ি কিসের!’
– ‘দাদা জয় আমাদের বাড়ির ছেলের মতো।’
– ‘মতো বাড়ির ছেলে তো নয়, এইসব বাইরের ছেলেকে বেশি লাই দিতে নেয় মাথাতে চড়ে বসবে।’
রুহির মায়ের মাথাতে আগুন জ্বলছে, শুধুমাত্র সমানের মানুষটা বড়ো দাদা বলে চুপ করে আছে নাহলে বুঝিয়ে দিত জয় আসলে কে হয়। ওনার এইসব কথাবার্তা রুহির মায়ের সহ্য হলো না, তাই বিরক্ত হয়ে বলল,
– ‘ঠিকাছে তাহলে তোমরা কালকে রাতেই চলে যাচ্ছো এইটাই ফাইনাল।’
বোনের কথাতে রুহির মামা কিছুটা দমে গেলেন। শান্ত কন্ঠে বললেন,
– ‘তোর ভাসুর কোথায়?’
– ‘কেন?’
– ‘ওনার সাথে কিছু কথা ছিল।’
রুহির মা ওনার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই উনি বললেন,
– ‘চিন্তা করিস না। আজকের বিষয় বা ওই ছেলেটার বিষয়ে কিছু বলব না। আমার ওনার সাথে আলাদা কিছু কথা ছিল।’
– ‘ওহ। নিজের ঘরেই আছে।’
– ‘আচ্ছা আমি আসছি।’
**
– ‘আসব।’
– ‘আরে আপনি আসুন। কিছু দরকার না মানে আমার রুমে আসলেন তাই।’
– ‘আসলে আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিল।’
– ‘কি কথা।’
– ‘দেখুন এমনিতেই রুহি আমার বাড়িতে চারবছর ছিল, তাই আমি চাইছিলাম ওকে সারাজীবনের জন্য আমার বাড়িতে নেবার জন্য।’
– ‘পরিস্কার করে বলুন।’
– ‘আমি অর্নবের সাথে রুহির বিয়ে দিতে চাই।’
হামিদ চৌধুরী মুচকি হাসলেন।
– ‘সত্যিই কি রুহি আপনার বাড়িতে চারবছর ছিল!!’
উনি একটু ঘাবড়ে গেলেন। আমতা আমতা করে বললেন,
– ‘মানে!!’
– ‘না কিছুই না।’ (রহস্যময় হাসি দিয়ে)
– ‘আপনার মতামত জানতে চাইছি।’
– ‘আমার মতামতে কি আপনার কিছু যায় আসে!!’
– ‘ একচুয়ালী না, আপনার মতামতে আমার কিছুই যায় আসে না। আপনি বাড়ির বড়ো তাই আপনাকেই জানালাম।’
– ‘আপনার যদি এই মানসিকতা থাকে তাহলে আপনি ভুল মানুষের কাছে এসেছেন।’
– ‘মানে?’
– ‘মানে আমি এই বাড়ির বড়ো নয়, আমার বাবা এখনো জীবিত আছেন। তাই বাড়ির বড়োরা মতামত জানতে হলে বাবার কাছে যান।’
– ‘আপনার মতামতটা জানতে চাই।’
– ‘যদি বলি না।’
– ‘কেন? আমার ছেলের কি কম আছে! কেন আপনি রাজি নন।’
– ‘যার বাবা এইরকম মানসিকতার মানুষ সেই বাড়িতে আমি আমার ভাইঝির বিয়ে দেব না।’
– ‘রুহি কিন্তু এতদিন আমার বাড়িতেই থাকত।’
হামিদ চৌধুরী হাসলেন।
– ‘কি হলো আপনি হাসছেন কেন? আমি হাসার মতো কি বললাম!’
– ‘থাক বাদ দিন এইসব। আমি আমার মতামত জানিয়ে দিলাম এইবার আপনি আসতে পারেন।’
– ‘আমি কিন্তু রুহিকে আমার বাড়ির বউ করবোই।’
– ‘দেখা যাবে।’
রুহির মামা প্রচন্ড রকমের অহংকারী একজন লোক। নিজের ইমেজ ধরে রাখতে যা তা করতে পারেন। দেখা যাক মুখের উপর না করে দেবার ফল কি হয়!
#চলবে…
অনেকদিন পর গল্প দিলাম তার জন্য দুঃখিত। ঈদের কারনে কয়েকদিন একটু ব্যস্ত ছিলাম। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
আসসালামু আলাইকুম।
–