#প্রেয়সীর_শব্দপ্রেম (দ্বিতীয় খন্ড)
#ফারজানা_মুমু
[১০]
পুরো দুনিয়া থেমে গেল। অসাড় হয়ে উঠল শরীর। নিষিদ্ধ পুরুষ জীবনের কলঙ্ক। ফুলের চরিত্রে দাগ বসানো নিষিদ্ধ পুরষের কর্ম। হাত-পা কাঁপতে শুরু করল ঝুমঝুমির। মাথায় ভোঁ-ভোঁ শব্দ হতে শুরু করল। প্রতিবাদী হয়ে বলে উঠল,
-” ঝিনুক আমার মেয়ে।
মেঘের ঠোঁটে হাসি ফুটলো। বিশ্রী এক হাসি। ঝুমঝুমির শরীরে কাঁ’টা’র মত বিঁ’ধ’লো সেই জগণ্য হাসি। বাতাস বইছে সাঁই-সাঁই করে। বাতাসের ছন্দের সাথে তাল মিলিয়েছে আধো-আলো ছায়া বৃহত্তম ধরণী জুড়ে। মেঘ ঝুমঝুমির ঘনিষ্ট হয়ে বলল, ঝিনুক কার মেয়ে আমি জানি তোকে মাইকিং করে বলতে হবে না। শোন আগেও বলেছি এখনও বলছি আমাদের দুজনের মধ্যে আমি তৃতীয় ব্যাক্তি মেনে নিবো না। হয় মেয়েটাকে মে’রে ফেল নয়তো অনাথ আশ্রমে দিয়ে দে। আমার শুধু তোকে চাই। আমি মানুষটা খুব খারাপ আমার ভালোবাসাও খারাপ কিন্তু তোর প্রতি আমার ভালোবাসা কিঞ্চিৎ পরিমাণ খারাপ নয়। তোকে আমি ভালোবাসি। ভালোবাসা শুধু দুটো মনের নয় দুটো শরীরের হওয়াও ইম্পর্টেন্ট। আগে শরীর ভালোবাসবে পরে না হয় হৃদয়ের মিলন ঘটবে।
-” ঝিনুক আমার মেয়ে মেঘ ভাই। আপনার সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি। পাঁচ বছর আগেও আমি আমার মেয়েকে মা’র’তে চাইনি এখন তো নই ই। ঝিনুক আমার অস্তিত্ব, আমার যত্নে করা মোমের পুতুল। ওর গায়ে কিঞ্চিৎ পরিমাণ আঁচ আমি লাগতে দিবো না। যে বা যারা আমার মেয়ের ক্ষতি চাইবে আমি তাদের খু’ন করব। আমার ফুপু,বড় বাবাকে খু’ন করতে যেখানে আমার হাত কাঁপেনি সেখানে আপনার মত শয়তানকে মা’র’তে আমার হাত কাঁপবে না বরং আপনার মৃ’ত্যু আমার মনে তৈরি করা আ’ঘা’তে’র ওষুধ হবে। আমি আপনায় খুব কঠিন মৃ’ত্যু দিবো।
কথাগুলো বলে ঝুমঝুমি মেঘকে ধাক্কা দিলো। আচমকা আ’ক্র’ম’ণে মেঘ তাল সামলাতে না পেরে রাস্তায় পরে গেল। ঝুমঝুমি তাড়াতাড়ি করে ব্যাগ থেকে চা’কু’টা বের করল। মেঘ তখন উঠে দাঁড়িয়েছে। ঝুমঝুমি যখনই আ’ঘা’ত করতে যাবে মেঘ ধরে ফেলল। হেচকা টানে উল্টো ঘুরে ঝুমঝুমির কাঁধে নাক ডুবলো। ঝুমঝুমি ঘৃণায় সরে আসতে গিয়েও পারলো না। শক্ত করে জাপ্টে ধরেছে মেঘ। কানের লতিতে ঠোঁট ডুবিয়ে বলল, আমায় দূর্বল ভাবিস না ঝুমঝুমি। আমি বিড়াল নই,আমি বাঘ। আমার থাবা মিস যায় না। যখন তোর উপর সত্যি সত্যিই থাবা বসাবো না তুই বাঁ’চ’তে পারবি না। তোকে আমি প্রা’ণে মা’র’বো না। তোকে মা’র’বো আমার ভালোবাসার অত্যাচার দিয়ে। আমি মানুষটা সহজ ভালোবাসায় বিশ্বাসী নই আমার ভালোবাসা আগুনের মত উত্তপ্ত, ছু’রির’ মত ধারালো,পাথরের মত শক্ত। ভালো হতে চেয়েছিলাম কিন্তু তুই সুযোগ দিসনি। তাই আমি খারাপের থেকে খারাপ হলাম। আমি তোর খারাপ ভাগ্য মেনে নে।
ছু’রি’টা কেরে নিয়ে ঝুমঝুমিকে ছেড়ে দিল মেঘ। ঝুমঝুমি তখন নিজের কান নিকাব দিয়ে মুছতে ব্যাস্ত। মেঘ তখন ঝুমঝুমির কাঁধে মাথা রেখে দুহাত চেপে ধরে কঠিন কণ্ঠে আবারও বলল,আমার হিং’স্র’তা দেখে তুই ভয় পাবি খুব ভয়। খু’ন করেছিস তিনটা দূর্বল প্রাণী। ওরা মেঘ নয়,মেঘকে খু’ন করা তোর মত সামান্য মেয়ের কাজ না। বরং অত্যাচারিত না হয়ে আমায় উজাড় করে ভালোবাসা দে। যত্নে রাখব, এমন যত্নে রাখব তুই কল্পনা করতে পারবি না।
রাস্তায় এক দলা থু থু ফেলল ঝুমঝুমি। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে ছাড়তে পারছে না নিজেকে। কী করবে না করবে ভাবতে-ভাবতে ঘৃণিত এক কাজ করে বসল। মুখে থু থু জমিয়ে ওটা ছুঁড়ে দিল মেঘের মুখে। ক্ষিপ্ত হয়ে মেঘ ঝুমঝুমিকে জোরে ধাক্কা দিলো। বড় বিদ্যুৎ পিলারের সাথে ধা’ক্কা খেয়ে মাথার একপাশে প্রচণ্ড রকমের আ’ঘা’ত পেল ঝুমঝুমি। র’ক্ত ঝরছে কপাল বেয়ে। মেঘ যতক্ষণে বুঝতে পারলো ততক্ষণে দেরি হয়ে পড়ল। অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছে সে। ছুটে আসলো ঝুমঝুমির কাছে। মাথায় হাত রাখতে যাবে চিৎকার করে উঠল ঝুমঝুমি। ওর চিৎকার শুনে আশেপাশের অনেক লোক দৌড়াদৌড়ি শুরু করে এদিকে আসতে দেখে মেঘ দৌড়ে পালিয়ে যায়। লোকগুলো এতক্ষণ ঝুমঝুমির চাচার লা’শে’র পাশে ছিল। পুলিশকে খবর পাঠানো হয়েছে। অনেকক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে যার যার নিজের গন্তব্য হাঁটার সময় মেয়েদের চিৎকার শুনে আরো লোকজন নিয়ে এদিকে আসে। দেখে মাথায় হাত চেপে এক মেয়ে বসে আছে। প্রশ্ন করে এলাকাবাসী, মা কি হয়েছে তোমার? মাথা ফা’ট’ল কীভাবে?
ঝুমঝুমি মেঘের কথা বলে চাইলো না। যদি নিজে ধরা পড়ে সেজন্য। কথা এড়ানোর জন্য বলে, অন্ধকারে পিছলা খেয়ে পিলারের সাথে বারি খেয়েছি আমায় একটা রিক্সা ডেকে দিবেন প্লিজ।
লোকজন হন্তদন্ত হয়ে রিক্সা ডাকে। ঝুমঝুমি তখন রুমাল চেপে রাখে মাথায়। বাসার কাছাকাছি একটা ক্লিনিক আছে ওইটায় গিয়ে ব্যান্ডেজ করে বাসায় ফিরে।
______________
আষাঢ়ের চোখমুখ ফুলে আছে। বেচারা কান্না করেছে মুখ দেখে বলে ফেলবে যে কেউ। ঝুমঝুমির মাথার পাশে এক ধ্যানে বসে আছে সে। একটুও সরানো যাচ্ছে না। ঝিনুক তো মায়ের মাথায় ব্যান্ডেজ দেখে কেঁদে-কেঁদে মুখ লাল করে এখন ঘুমাচ্ছে।
রাত দশটা, আষাঢ় বাড়ি যেতে চাচ্ছে না। ঝুমঝুমি বার কয়েক ধমক দিলো তবুও কাজ হলো না। হালিমা খালা কিছুক্ষণ পর পর লাল চা দিয়ে যাচ্ছে। আষাঢ় এখন ঐটাই খাচ্ছে আর চেয়ে আছে আহত প্রেয়সীর পানে। গম্ভীর চোখজোড়া শান্ত হয়ে দেখছে প্রেয়সীকে। বুকের ভিতরে তীব্র এক ব্যাথার দা’বা’ন’ল জ্বলছে। অসহনীয় সেই ব্যাথা। দীঘির জলের মত চোখ জোড়া ডুবুডুবু থৈ থৈ জলে। চোখ মুছে বলে উঠল,
-” তোমার কথা বাসায় বলেছি। কারোর আপত্তি নেই।
ঝুমঝুমি হাসলো। ঠাট্টাময় সেই হাসি। কণ্ঠে তীব্র ঠাট্টা নিয়েই বলল, সত্যিই নেই?
আষাঢ় চুপ করে রইল। ওর পরিবারের কেউ ঝুমঝুমিকে মানতে নারাজ। এক মেয়ের মাকে কোনো পরিবার নিজের ছেলের বউ করে আনবে না স্বাভাবিক। অনড় হয়ে বসে থেকে থমথম কণ্ঠে বলল,
-” জীবন আমার,বিয়ে আমার, সিদ্ধান্তও আমার। যার সাথে আমি ভালো থাকবো তাকেই বিয়ে করব। অন্যরা মানলে মানুক না মানলে নাই। আষাঢ় কারো পড়ুয়া করে না। আষাঢ়ের জীবনে একমাত্র বউ হওয়ার অধিকার ঝুমঝুমির, অন্য কারো নয়।
ঝুমঝুমি কিছু বলল না। বললে লাভ নেই। এই পাগল প্রেমিক আষাঢ় মানবে না। ঝুমঝুমিকে চুপ থাকতে দেখে আষাঢ় এবার একটু রেগেই বলল,
-” আমি আগামীকাল তোমায় বিয়ে করব। সকালে রেডি থাকবে। তোমাদের দেখাশোনার জন্য আমি একাই যথেষ্ট। তুমি আমাকে এবং আমার মেয়েকে সময় দিবে শুধু। সারাদিন কাজটাজ করে,চিন্তার বস্তা মাথায় নিয়ে ঘুরে দেখছো কি অবস্থা তোমার? শরীরের যত্ন নিতে ভুলে গেছ। আজকের পর সব বন্ধ। আমি হিরণকে জানিয়েছি সবাই যেন সকাল-সকাল কাজী অফিসে চলে আসে। আমরা বিয়ে করে সোজা আমার বাংলো বাড়িতে চলে যাব। আমাদের চড়ুই পাখির সংসারে আমি কর্তা,তুমি গিন্নি,ঝিনুক রাজকুমারী,হালিমা খালা বৃক্ষ রাণী।
ঝুমঝুমি হাসতে লাগলো আষাঢ়ের বোকা-বোকা কথা শুনে। হাসি থামিয়ে বলল, অনেক এগিয়ে গেছেন দেখছি।
-” আরো আগে উচিৎ ছিল এগিয়ে যাওয়া। থাক সেসব কথা। আমি যাচ্ছি সকালে আমি চলে আসবো তৈরি থেকো। ভাজুং-ভুজুং কথা শুনছি না।
আষাঢ় উঠে দাঁড়াল। ঝুমঝুমির কপালে হালকা করে হাত রাখলো। চুলে বিলি কেটে আবারও বলল, প্লিজ আমায় ফিরিয়ে দিও না। তোমার ভালোবাসার কাঙাল আমি। ভিক্ষা চাচ্ছি। জানো, আমার এই হৃদয়ে তোমার জন্য পৃথিবীর সকল ভালোবাসাময় একটি উপন্যাস গেঁথে রেখেছি। খুব যত্নে করে লিখা প্রতিটি শব্দ,বাক্য। আমি চাই না আমার উপন্যাসের শেষ পাতাটি অসমাপ্ত কিংবা বিরহে ভরা থাকুক। আমি চাই সুন্দর একটি সম্পর্কে ইতি টানুক। তোমার সূচনাতে থাকতে চাই না আমি, তোমার উপসংহারে থাকতে চাই। মৃ’ত্যু’র আগ মুহূর্তে তোমায় ভালোবেসে,তোমার ভালোবাসা পেয়ে আমি ম’র’তে চাই। ইশ মানুষ যদি ম’র’ণ’শী’ল না হতো তাহলে আমার জীবনময় তুমি নামক নিষ্ঠুর প্রেয়সীর সাথে থাকা হতো।
-” মানুষের জন্মের সাথে যদি মৃ’ত্যু শব্দটি না থাকতো তাহলে পৃথিবী হয়ে উঠত কষ্টময়। মৃ’ত্যু’র স্বাদ গ্রহণ করতে হবে বলেই বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছা মানুষের। যদি মৃ’ত্যু না থাকতো তাহলে মানুষেরা হাত জোড় করে নিজেদের মৃ’ত্যু চাইতো। দেখেন না আজকাল আ’ত্ম’হ’ত্যা’র প্রবণতা কতখানি বেড়েছে?
আষাঢ় গাল ফোলালো। কত সুন্দর করে সে বেঁচে থাকার ইচ্ছে কামনা করছে আর এই মেয়ে তার সকল ইচ্ছেয় পানি ঢেলে দিলো। ঠোঁট উল্টিয়ে বলল, বাদ দাও সেসব কথা। সকালে আসছি আমি। ভালো থেকো আমার হৃদয়ের তেজপাতা রাণী।
আষাঢ় চলে যাওয়ার পর হালিমা খালা দরজা বন্ধ করে রুমে এসে শুয়ে পড়ল। ঝুমঝুমির চোখে ঘুম নেই। মন হাঁসফাঁস করছে ওর। কিছুতেই শান্তি মিলছে না।অজানা ভয়, অস্বস্তি কাজ করছে মনে। বাতাসে আসা অক্সিজেন বি’ষে’র মত লাগছে। দম বন্ধ হবার উপক্রম। ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে খারাপ কিছু হতে চলেছে। খুবই খারাপ ঘটতে চলেছে। আচ্ছা আষাঢ়ের বাবা তো ওদের সম্পর্ক মানতে নারাজ এখন যদি জেনে যায় ঝুমঝুমি খু’নি তখন কি আষাঢ় মেনে নিবে ওকে? যদি মানে তখনই বা ও’কে বাঁচাতে পারবে? ওর বাবা যদি পাশে না দাঁড়ায় আষাঢ় একা কি পারবে ওকে বাঁচাতে নাকি তিন-তিনটা খু’নে’র জন্য ওর ফাঁ*সি হবে। যদিও এখনো বাংলাদেশে মেয়েদের ফাঁ’সি’র আইন কার্যকর হয়নি তাহলে কি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে? যন্ত্রণার মধ্যে যন্ত্রণা বাসা বাঁধলো মাথায়। পাশে তাকিয়ে দেখলো হালিমা খালা ঝিনুককে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়েছে। ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়াল। ড্রইং রুমের কাছে গিয়ে সোফায় বসে পড়ল। দুহাত মাথার নিচে রেখে সিলিং এ তাকিয়ে রইল কিয়ৎক্ষণ। পাশ ফিরে রিমোট হাতে নিয়ে টিভি অন করতে দেখল কার্টুনের চ্যানেল সামনে। ভালো লাগছে না বলে জিরো তে চাপ দিয়ে একেরপর এক চ্যানেল পরিবর্তন করে একটি চ্যানেলে এসেই কেঁপে উঠল। ওর পুরো শরীর কাঁপছে ভয়ে। আচ্ছা ও তো জানতোই একদিন না একদিন ধরা পড়বে তাহলে আজ এত ভয় হচ্ছে কেন? আষাঢ় কে হারানোর ভয়? উত্তর আসলো হ্যাঁ। আগামীকাল সুন্দর একটি সম্পর্ক শুরু হওয়ার আগেই শেষ হতে চলল। বিপদস্ত চেহারায় টিভিতে মনযোগ দিল ঠিক তখনই দরজায় করাঘাত পড়ল। ঝুমঝুমি ভয় পেলো। কে এসেছে? পুলিশ? না মেঘ?
##চলবে,,
কেমন হলো জানাবেন। ইদ কেমন কাটলো আপনাদের?