#প্রনয়ের_দহন
#Nusrat_Jahan_Bristy
#পর্ব_১৪
আজ ইহান আর কেয়া’র বিয়ে। “ফরাজী” ভিলার চারিদিকে মানুষজন গমগম করছে আত্মীয় স্বজন আর পাড়া প্রতিবেশি দিয়ে। ছোট ছোট বাচ্চাদের চেঁচামেচির আওয়াজ, গানের আওয়াজ ভেসে বেড়াছে চারিদিক।
লিনা জেদ ধরেছে ইশান যে গাড়ি করে যাবে ও সেই গাড়িতে যাবে। কিন্তু তীর যখন থেকে জেনেছে লিনা ইশানকে পছন্দ করে তখন থেকেই প্ল্যান করে যাচ্ছে লিনাকে কি করে ইশানের কাছ থেকে দুরে দুরে রাখা যায়। মেয়েটা একটু বেশিই বেহায়াগিরি করে ইশানের সাথে। যা তীর মোটেও পছন্দ করছে না। তাই ইশা আর তীর লিনার ব্রেন ওয়াস করে অন্য গাড়িতে উঠিয়ে দিয়েছে। গাড়িটা যেতেই ইশা হাফ ছেড়ে বলে।
–উফফ! আপদ বিদায় হয়েছে।
–আপদ তো বিদায় হলো কিন্তু তর ভাই কই এখনো আসে না কেন? নাকি মেয়েদের মতো সাজুগুজো করতে ব্যস্ত এখনও।
ইশা তীরকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলে।
–কি ব্যাপার দোস্ত! ভাইয়াকে চোখ হারাছিস যেন।
তীর আমতা আমতা করে বলে।
–তর ভাইকে চোখে হারাতে বয়ে গেছে আমার।
–হুম বুঝি বুঝি প্রেমের জ্বালা বড় জ্বালা।
–একদম বাজে কথা বলবি না।
এর মাঝেই ইহান গাড়ির ভেতর থেকে বলে উঠে।
–কি রে উঠছিস না কেন তরা?
ইশা বলে।
–ইশান ভাইয়া আসুক তারপর উঠছি।
এমন সময় তীরের চোখ যায় ইশানের দিকে ব্যস্ত পায়ে হেটে আসছে এদিকটাই হাতে ঘড়ি পড়তে পড়তে। ইশান যত তাড়াতাড়ি পায়ের ধাপ পেরিয়ে তীরের কাছে আসছে তত তীরের হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। কালো শার্ট, কালো কোর্ট, কালো প্যান্ট পরিহিত লোকটাকে একটু বেশিই হ্যান্ডসাম লাগছে। তীরের মনে হচ্ছে এই কালো রঙটা ইশানের জন্যই তৈরি হয়েছে। সবকিছু কালো হওয়াতে ফর্সা মুখশ্রীটা ফুটে উঠেছে। মসৃণ চুল গুলা কপালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ফর্সা গালে খোচাঁ খোচাঁ দাড়ি, গোলাপি রাঙা ঠোট। কেমন ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে আছে তীর ইশানের দিকে। লোকটাকে ইদানিং তীরের কাছে একটু বেশিই সুদর্শন লাগছে। এটা কি লোকটার প্রেমের পড়ার জন্য নাকি লোকটা আগেই থেকেই সুদর্শন ছিলো। হয়তো মানুষ যার প্রেমে পড়ে তাকে পৃথিবীর সব মানুষের থেকেই একটু বেশিই সুন্দর লাগে। তীর লাজুক হেসে ইশানের দিকে থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়। গতকাল রাতের ঘটনাটা মনে পড়তে কান গরম হয়ে এলো তীরের। গতকাল রাতে ইশান যতক্ষন গান খেয়েছে ততক্ষন ওর দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে ছিলো। তীরের কি হলো কে জানে ও ইশানের দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে ছিলে। এখন লজ্জায় মন চাইছে মাটির নিচে চলে যেতে ইশানের দিকে বেহায়াত মতো তাকিয়ে তাকার জন্য। কিন্তু তীরের এখনও মন চাইছে সামনে থাকা সুদর্শন লোকটার দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকতে কিন্তু কিছুটা লজ্জা, ভয় নিয়ে তাকিয়ে থাকা যেন মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর তার সাথে তো আছেই ইশানের মারাত্মক চাওনি। যে চাওনিতে তীর বার বার ঘায়েল হয়।
ইশান তীরকে দেখা মাএই ভ্রু-কুচকে নেয়। এতো সাজুগুজো করার মানে কি ভেবে পাচ্ছে না ইশান। তীরকে নিচ থেকে উপর পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে নেয়। তীরের গায়ে ইশানের দেওয়া লেহেঙ্গাটা, হাতে চুড়ি, গাঢ় লিপস্টিক, গাঢ় কাজল, লম্বা চুল গুলা ছেড়ে দেওয়া আর তা বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে দোল খাচ্ছে তাতে কোনো অপ্সরার থেকে কম লাগছে না। হঠাৎ করেই রেগে যায় ইশান রাগে মাথা টগবক করছে তীরের এত ভারী সাজ দেখে। তার প্রিয়তমার এই সাজ শুধু সে দেখবে একান্তই সে দেখবে কিন্তু এখন বাইরের সবাই এই ভয়ংকর সুন্দর সাজ দেখছে। ইশান মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারছে না কারন এখনও যে মুখ ফুটে কিছু বলার অধিকার পায় নি সে। তাই দাঁতে দাঁত চেপে বলে।
–গাড়িতে উঠ তাড়াতাড়ি এভাবে দাড়িয়ে সো ওফ না করলেও চলবে।
তীর ইশানের এমন রাগী মিশ্রিত স্বরে শুনে বিচলিত হয়ে পড়ে। মনে মনে ভাবে লোকটা কি রেগে আছে কোনো কারনে কিন্তু কি কারনে। তীর আড় চোখে ইশানের দিকে তাকায় চোখ, মুখ শক্ত করে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। তীরের মনটা নিমিষেই খারাপ হয়ে গেলো এত সুন্দর করে সাজলো ও আর লোকটা কিনা তাকালো না পর্যন্ত।
তীর আর ইশা গাড়িতে উঠার সাথে সাথে ইশান ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসে আর পাশে ইহান বসে আছে বর বেঁশে। ইশান ছোট থেকে একটা কথা বলতো “ভাইয়া যখন বিয়ে করে আমার জন্য ভাবি আনতে যাবে তখন আমি গাড়ি চালিয়ে ভাইয়াকে নিয়ে যাবো ভাবির বাড়িতে”। আর আজকে সেই কথাটা বাস্তবে রুপান্তরিত করতে নিজে ড্রাইভ করে ভাইকে নিয়ে যাবে ভাইয়ের শশুড় বাড়িতে। ইশান গাড়ি স্টার্ট দিবে ঠিক এমন সময় তীর বলে উঠে।
–ইশু রে কানের দুলের ভারে কানের লতি ব্যাথা করছে হালকা।
–লেহেঙ্গার সাথে বড় দুলেই পড়তে হয় না হলে ভালো লাগবে না একটু সহ্য করে।
তীরের কথা কর্নপাত হওয়ার সাথে সাথে চকিতে চমকায় ইশান। গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার পরির্বতে গাড়ি থেকে হুড়মুড়িয়ে নেমে যায়। ইশানের এমন ভাবে গাড়ি থেকে নামাতে সবাই আবাক চোখে ইশানের দিকে তাকায়। ইশান গাড়ি থেকে বের হয়ে দৌঁড় লাগালো। ইহান গাড়ি থেকে মাথা বের করে চিৎকার করে বলে।
–ইশান কি হলোটা কি তর?
ইশান দৌড়াতে দৌড়াতে চিৎকার করে বলে।
–ভাইয়া আমি এক মিনিটে আসছি একটু বসো।
ইহান তপ্ত শ্বাস ফেলে বলে।
–ছেলেটার হলোটা কি?
তীর আর ইশা এক জন আরেক জনের দিকে আবাক চোখে তাকিয়ে আছে ইশানের এমন কান্ড দেখে।
_____
ইশানকে দৌঁড়ে আসতে দেখে নেহা বেগম আর বাকি সবাই আবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এভাবে দৌড়ে আসার মানে কি কেউ বুঝতে পারছে না। নেহা বেগম বিচলিত কন্ঠে সুধালো।
–ইশান বাবা এভাবে দৌড়াচ্ছিস কেন? আর তদের তো এতক্ষনে বের হয়ে যাওয়ার কথা ছিলো।
ইশান মায়ের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে নিজের ঘরে ছুটে চলে যায়। ঘরে ডুকেই আলমারির দরজা খুলে হন্ততন্ত হয়ে কিছু একটা খুজছে আর বিরবির করে বলছে।
–কোথায় রাখলাম জিনিসটা? কোথায়?
কিছুটা সময় খুজাখুজির পর পেয়ে গেলে ইশান তার কাঙ্গিত জিনিসটা। হলুদ রঙ এর ছোট পকেট থেকে পাথরের মাঝারি সাইজের কানের দুল রে করে বলে।
–এট লাস্ট পেলাম।
এমন সময় ঘরের বাইরে থেকে বেহা বেগমের কন্ঠ স্বর ভেসে আছে। ইশান সাথে সাথে পেকেটে কানের দুলটা রেখে কোর্টের বুক পকেটে রেখে দেয় আর আলমারির দরজা লাগিয়ে বের হতে নিবে তখনেই নেহা বেগম ঘরে ডুকে বলে।
–কি হয়েছে ইশান তর? এমন আচরন করছিস কেন তুই?
–কিছু হয় নি মা আমার।
–তাহলে এভাবে দৌঁড়ে আসলি কেন?
–মা আমি এবার আসি দেরি হয়ে যাচ্ছে।
নেহা বেগমকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে যায় ইশান। নেহা বেগম ছেলের মতিগতি দেখে স্বাভাবিক ভাবে নিচ্ছে না কিছু একটা তো হয়েছে ইশানের এ কয়েক দিনে যা দেখে বুঝলো।
______
বর যাএীরা একটু আগে কনের বাড়িতে এসে পৌঁছেছে। এখন শুধু বরের আসারা পালা। প্রায় বিশ মিনিট পরেই বরের সাজানো গাড়ি এসে থামে তালুকদার বাড়ির গেইটের সামনে চারিদিকে হইহুল্লোড় শুনা গেলো বর এসেছে, বর এসেছে বলে চিৎকার করছে সকলে।
ইহানকে কনে বাড়ির লোকজন এসে সসম্মানে ভিতরে নিয়ে গেলে। সাথে ইশান, ইশা, আর তীরকে ভেতরে যেতে বলেছে। ইশা আর ইশান নেমে গেছে গাড়ি থেকে। কিন্তু বিপত্তি বাধলো তীরের গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে ভাঙ্গা এক ইটের উপর পা রাখতে পা মচকে পড়ে যায়। তীরকে এভাবে পড়ে যেতে দেখে ইশানের আত্মা কেঁপে উঠে। ইশান তাড়াতাড়ি করে তীরকে টেনে তুলে আবার গাড়িতে বসিয়ে দেয়। ইশা চিন্তিত স্বরে বলে।
–কিরে পড়ে গেলি কি করে? আস্তে ধীরে নামবি তো।
ইশান তীরের অসহায় মুখটার দিকে তাকায়। চোখ দুটো জলে টইটম্বুর একটু নাড়া দিলেই নোনা জলটা গড়িয়ে পড়বে গাল বেয়ে। তীরের এমন করুন চেহারা দেখে ইশানের বুকটা মুচরে উঠলো। মেয়েটা কি বেশি ব্যাথা পেয়েছে পায়ে। ইশান কোমল কন্ঠে শুধালো।
–তীর! পায়ে লেগেছে খুব।
ভালোবাসার মানুষটার মুখে এমন কোমল কন্ঠ শুনে তীর ফুঁপিয়ে উঠল। মাথাটা উপর নিচ করে বুঝায় যে সে খুব ব্যাথা পেয়েছে। ইশান হাটু গেড়ে নিচে বসে বলে।
–দেখি পা’টা।
তীর পা সরিয়ে নিয়ে না করে যাতে ইশান পাটা না দেখে। ইশান আবার বলে।
–না দেখলে বুঝবো কি করে কোথায় ব্যাথা পেয়েছিস?
ইশান এক প্রকার জোর করেই তীরের পা দুটো সামনে নিয়ে এসে বলে।
–কোন পায়ে ব্যথা পেয়েছিস ডানে নাকি বামে।
তীর কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে।
–বাম পায়ে।
ইশান বাম পা’টা টেনে নিয়ে তীরকে বলে লেহেঙ্গাটা উপরে তুলতে। তীরও বাধ্য মেয়ের মতো লেহেঙ্গা উপরে তুলে। লেহেঙ্গাটা উপর তুলতে ইশান ভ্রু-কুচকে নেয় তীরের পায়ের জুতো দেখে। ও পা থেকে থেকে ওর জুতো বড়। এই এক রতি মেয়ের পায়ে কিনা এত বড় হাই হিল জুতো ভাবা যায়। এমনি এমনি তো আর পড়ে যায় নি। ইশান হুস করে শ্বাস ছেড়ে জুতো খুলে দেয় আর অন্য দিকে তীর চিৎকার করে বলে।
–প্লিজ প্লিজ ধরবেন না ব্যাথা পাই।
ইশানের ইচ্ছে করছে তীরের ওই নরম তুলতুলে গালে ঠাটিয়ে একটা চড় মারতে বেয়াদব মেয়ে। কে বলেছে এত বড় জুতো পরতে আর এই অঘটন’টা ঘটাতে। ইশান নিজের রাগটা কন্ট্রোল করে বলে।
–আচ্ছা ধরবো না তুই শান্ত হ।
ইশান পা ধরবে না ধরবে না বলে পা ধরে দিলো এক মোচর। তীর সাথে সাথে গলা ফাটিয়ে দিলো এক চিৎকার। ইশান আর ইশা কান ধরে ফেলে তীরের এই চিৎকার শুনে। ইশান এবার ধমক দিয়ে বলে।
–এই চুপ! কে বলেছিলো এত উঁচু জুতো পড়তে তকে এখন বুঝ ঠেলা।
ইশা কোনো কিছু না ভেবেই ঠাস করে বলে উঠে।
–ভাইয়া লেহেঙ্গার সাথে হাই হিল না পড়লে ভালো লাগে না।
–একটা দিবো তকে। হাই হিল! এই তদের পা কতটুকু বড় যে হাই হিল জুতা পড়তে হয়।
ইশার মুখটা চুপসে যায় ইশানের রামধমক শুনে। ইশান তীরের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে।
–নে নাম এবার।
তীরও বাধ্য মেয়ের মতো আবার জুতো পড়ে ইশানের হাত ধরে গাড়ি থেকে নামে। এবার ব্যাথাটা কম লাগছে কিন্তু খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটছে। ইশান তা দেখে ফট করে তীরকে পাঁজা কোলে তুলে নেয় সবার সামনে। আচমকা এভাবে কোলে নেওয়াতে তীর ভড়কে যায়। এতক্ষন সবাই স্বাভাবিক চোখে তাকিয়ে থাকলে এবার সবাই বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে ইশান আর তীরের দিকে। সাথে তীরও ইশানের দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। ইশান সেদিকে নজর না দিয়ে হেটে বাড়ির ভেতরে ডুকে পরে। তীর আশে পাশে চোখ বুলিয়ে দেখে মানুষজন কেমন করে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে তীরের মন চাইছে লজ্জায় মরে যেতে। ইশা আশে পাশের মানুষের এমন অদ্ভুদ দৃষ্টি দেখে মেকি হেসে বলে।
–পড়ে গিয়ে পায়ে ব্যাথা পেয়েছে তা তাই আর কি কোলে নিয়েছে।
ইশান ইশার এমন কথা শুনে ধমকে বলে।
–তকে কে বলেছে এতো ডাক’ঢোল পিটাতে। চুপচাপ হাট।
ইশা আর একটা টু শব্দও করলো না। মনে মনে ভাইকে একটা গালি দিলো। তীরকে ইশান একটা চেয়ারে এনে সাবধানে বসিয়ে দেয়।
#চলবে_______