এক_টুকরো_সুখ
#পর্ব_২১
#লেখনীতে_শুভ্রতা
“তুমি এখানে আছো বলেই তো আমিও এখানে। আসলে দিলের একটা টান আছে না!”
বলে কি রে ভাই! এখানে আবার দিলের টান কোত্থেকে এলো? নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বললাম
“ঠিক বুঝলাম না ভাইয়া।”
আমার কথার জবাব না দিয়েই তিনি পাশে বসে পড়লেন।
“জাস্ট কিডিং। কিছু মনে করো না কিন্তু।”
মুচকি হাসলাম আমি। লোকজনের মজা করার ধরণ দেখলে আজকাল পিলে চমকে ওঠে। বাবাগো বাবা।
“তা আয়না একা একা বসে আছো যে? কোনো বন্ধু টন্ধু নেই তোমার? নতুন কাউকে পাওনি?”
“তেমন নয় ভাইয়া। ক্লাসে কোনো রকম কথা বলি কিছু মেয়ের সাথে। সেভাবে কারো সাথে এখনো মিশে পারিনি। আসলে নতুন নতুন তো, খানিকটা অস্বস্তি হয়।”
আমার কথা শুনে রাফিদ ভাইয়ার অবাক হওয়ার ভান করলেন।
“বলো কি! এযুগের মেয়ে হয়েও অস্বস্তি! ভাবা যায় না। এখনকার সময়ে এসব বললে চলে না বুঝলে। যত তাড়াতাড়ি সবার সাথে মিশে যেতে পারবে ততই তোমার লাভ। আচ্ছা দাঁড়াও আমি একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই।”
এই বলেই উনি পকেট থেকে ফোন বের করে কাউকে কল করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন। আমি খানিক ভ্রু কুঁচকে থেকে জিজ্ঞেস করলাম কাকে ফোন করছেন কিন্তু কিছু বললো না ভাইয়া। উল্টো আমাকে ইশারায় চুপ থাকতে বললো। আমিও বেশ চুপ করে আবারও বইয়ে মনোযোগ দিলাম। কথা বলা শেষে রাফিদ ভাইয়া আমাকে একেকটা বইয়ের বিষয়ে বলতে শুরু করলেন। আমারও শুনতে বেশ লাগছিলো তাই কথা না বলে শুনতে থাকলাম। আমাদের কথার মাঝেই একটা ছেলে এদিকটায় এগিয়ে এলো। তাকে দেখে উঠে দাঁড়ালো রাফিদ ভাইয়া। দুইজন কোলাকুলি করে আলাপ শুরু করলো।
“হোয়াটসআপ ছোট ভাই? বড় ভাই ব্রাদার গুলোর খবরই নাও না আজকাল, ভুলে গেছো একেবারে হ্যাঁ। কোথায় কোথায় থাকো হ্যাঁ? শুধু বই বই করলেই হবে? আশেপাশেও তো একটু নজর রাখতে হবে তাই না!”
রাফিদ ভাইয়ার কথায় ছেলেটা একটু লজ্জা পেলো বোধহয়। মাথা চুলকে মুচকি হাসলো।
“কি যে বলো ভাইয়া তুমি। তোমাদের কীভাবে ভুলি বলো। কত উপকার করলে তোমরা আমার আর আমি কিনা তোমাদের ভুলে যাবো! লজ্জা দাও শুধু।”
কথা বলতে বলতেই ছেলেটার নজর আমার দিকে পড়লো। কৌতূহল নিয়ে রাফিদ ভাইয়ার দিকে চাইলো সে। তা দেখে রাফিদ ভাইয়েরও বোধহয় আমার উপস্থিতির কথা মনে পড়লো। আমাকে দেখিয়ে ছেলেটাকে বললো
“ও হচ্ছে আয়না। আমরা একই স্কুল থেকে মাধ্যমিক দিয়েছি। জুনিয়রের সাথে পুরস্কার নিয়ে ঝগড়া দিয়ে আলাপ, সে গল্প পরে শোনাবো ক্ষণ। যাই হোক আয়নাও এখানে ভর্তি হয়েছে এবার। ফার্স্ট ইয়ার।”
এরপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো
“আর জুনিয়র এ হচ্ছে নূর। ছোট ভাই আমার। তোমার যদিও সিনিয়র। ও এবার সেকেন্ড ইয়ার। তোমার কোনো সমস্যা হলে ওকে বলতে পারবে। ও নিজে সমাধান করবে আর না পারলে আমাদের জানাবে।”
আমিও সম্মতি জানালাম তার কথায়। ছেলেটাকে দেখে বেশ ভালোই মনে হচ্ছে। বেশ ভদ্র ভদ্র ভাব আরকি। আমাদের সাথে কথা বলতে বলতেই রাফিদ ভাইয়ের কাছে কল এলো। কথা বলার পর উনি যাওয়ার জন্য ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন।
“আচ্ছা তোমরা তবে কথা বলে নিজেদের মধ্যে পরিচিত হয়ে নাও। আমার ডাক পড়ে গেছে। আমাকে এখন যেতে হবে। নূর ভাই আয়নার খেয়াল রাখিস। আয়না, আসি তবে। আবার দেখা হবে।”
রাফিদ ভাই চলে গেলেন। রয়ে গেলাম আমি আর ওই ছেলেটা। ছেলেটা বেশ স্বাভাবিক ভাবেই আমার সাথে আলাপ করতে থাকলো। আমার মধ্যে প্রথম প্রথম একটু জড়তা কাজ করলেও আস্তে আস্তে তাও দূর হয়ে গেলো। আমিও স্বাভাবিক হয়ে গেলাম নূর নামের ছেলেটার সাথে। তারপর কথা বলতে বলতে এক সময় উঠতে হলো আমাকে কোচিং যাওয়ার জন্য। এরপর থেকে তার সাথে প্রায়ই কথা হতো। বেশ বন্ধুর মতো সব ব্যাপারে সাহায্য করে দিতো। আমিও ভাইয়ের নজরেই দেখতাম ছেলেটাকে।
আমাকে হোস্টেলে রেখে যাওয়ার পর থেকে আব্বা প্রতি সপ্তাহে একবার করে আসেন। যেদিন আসেন সেদিন সারাদিন আমার সাথে থেকে তারপর বাড়ি ফেরেন। হোটেলে নিয়ে গিয়ে নিজের হাতে খাওয়ান আমাকে। তবে একটা ব্যাপার আমার প্রচন্ড খারাপ লাগে আর তা হলো আম্মা কখনো আমার সাথে যোগাযোগ করেন না বা আব্বার হাতে করে আমার জন্য কখনো কিছু পাঠানও না। কিন্তু এ আর এমন কি। আমি তো ছোট থেকেই আম্মার অবহেলা, খারাপ ব্যবহার পেয়ে বড় হলাম। এটুকুও সহ্য করে নিতে পারবো। দুপুর সেই গেছে আর এখনো বাড়ি আসেনি। নিয়ম করে প্রতিদিন ফোনে কথা হয় বটে তবে দেখা আর হয়না।
ধীরে ধীরে সময় পেরোতে লাগলো। জীবন আমার একই ভাবে এগোতে থাকলো। ফার্স্ট ইয়ার শেষ করে সেকেন্ড ইয়ারে উঠলাম। এদিকে নূর ভাইও অ্যাডমিশন নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। আগের মতো দেখা সাক্ষাৎ হয় না, পড়ালেখায়ও সাহায্য করতে পারেন না। তবে মাঝে মাঝে কথা হয় বটে। খোঁজ খবর নেন। বাড়ি থেকে আব্বা জানালেন বড় আপা দ্বিতীয়বার প্রেগনেন্ট। আপা এত তাড়াতাড়ি বাচ্চা নিলো কেনো বুঝলাম না। একটু দেরি করতে পারতো, বড় হতো ছেলেটা। আর কি বলবো, যা ভালো মনে হয়েছে করেছে তাই।
সামনে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হবে। ভেবেছিলাম একবার বাড়ি যাবো পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে কিন্তু আম্মার আচরণ মনে করে আর যাওয়া হলো না। আব্বা এলেন দেখা করতে। অনেক দোয়া করে গেলেন সাথে সাহসও দিলেন। আবারও নিজের লেখাপড়া নিয়ে যখন ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম। প্রায় সারাদিনই পড়া আর মাঝে মধ্যে আব্বা, দুপুর, মিনা আপা ওদের সাথে কথা বলা। এরকমই একদিন বসে পড়ছিলাম। হঠাৎ দুপুরের নাম্বার থেকে কল এলো।
“শোনো সুন্দরী আমি জানি সামনে তোমার পরীক্ষা এবং এখন তুমি বই নিয়ে ব্যাস্ত। বিপদে না পড়লে কল করতাম না। অনেক বড় বিপদ হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি তুমি রেডি হয়ে চলে এসো। দেরি করো না কিন্তু।”
কল পিক করার পরে আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তিনি একনাগাড়ে কথা গুলো বলে ফোন রেখে দিলেন। ওনার বিপদের কথা শুনে উতলা হলাম বটে তবে বুঝতে পারলাম না আমি আসলে যাবো টা কোথায়! সেটা না বলেই তো ফোন রেখে দিলো। আন্দাজে কোথায় যাবো আমি? এগুলো ভাবতে ভাবতে তৈরী হয়ে নিচে নেমে গেলাম। অমনি হুট্ করে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো মাস্ক পড়া একটা ছেলে। হঠাৎ করে এভাবে সামনে আসার জন্য যেই না কিছু বলতে যাবো, সে আমাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে শুরু করলো।
“আরে আরে কে আপনি? এভাবে আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন, সাহস কত আপনার হ্যাঁ! হাত ছাড়ুন নইলে কিন্তু চিৎকার করবো আমি।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ যত পারো চিৎকার করো। লোকজন জড়ো হয়ে যখন শুনবে আমি তোমাকে জোর করে নিয়ে যাচ্ছি তখন তোমার হাব্বিকেই গণধোলাই দেবে। এটাই চাইছো নাকি তুমি? সেটা ভালো হবে তো সুন্দরী?”
মানে এই ছেলে দুপুর! কিন্তু উনি তো বললেন কি না কি বিপদ হয়েছে তবে? আল্লাহ ইনি তো আমাকে পাগল করে ছাড়বে।
“তারমানে ফোনে আপনি আমাকে মিথ্যে বিপদের কথা বলেছেন? আপনি কি ভালো হবেন না কখনো হ্যাঁ? বুঝতে পারছেন কেমন চিন্তা হচ্ছিলো আমার? কোনো কিছু কি আপনি সিরিয়াসলি নিতে জানেন না শুনি।”
“আরে সুন্দরী বকা পরে দিও। এখন তাড়াতাড়ি চলো। রূপসায় যাবো আমরা। দেরি হয়ে গেলে আর ঘুরতে পারবো না একটুও।চলো চলো।”
দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি। নাহ এর সাথে কথা বলে লাভ নেই। কেমন সহজে বিপদের কথা বলে তখন ঘাবড়ে দিলো আমাকে। সত্যি সত্যি যদি বিপদ হতো তবে!
“আপনার সাথে কোথাও যাবো না আমি। আপনি আমাকে মিথ্যে বলে চিন্তায় ফেলেছেন। যেখানে যাওয়ার আপনি একা একাই যান। আমি যাবোও না আর ঘুরবোও না।”
কিছু সময় কোমরে হাত রেখে চুপ করেই দাঁড়িয়ে রইলেন উনি।
“দেখো সুন্দরী আমি জানি তুমি মিথ্যে পছন্দ করো না আর চিন্তায় পড়ে গেছিলে। ভুল হয়েছে আমার তার জন্য সরি। কিন্তু এখন যদি তুমি আমার সাথে যেতে না চাও তবে আমি এই ভরা বাজারের মধ্যে তোমাকে কোলে তুলে নিতে বাধ্য হবো। তুমি কি চাও আমি তাই করি?”
ইনি যা মানুষ তাতে এই ভিড়ের মাঝেও আমাকে কোলে নিতে দুবার ভাববেন না। এরচেয়ে ভালো নিজের ইচ্ছেতেই যাই। দুপুর যখন আমার হাত ধরে সামনের দিকে ভিড় ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছিলো তখনই আমাদের সামনে দুইটা মোটরসাইকেল এসে থামে।
চলবে…?