#এক_টুকরো_সুখ
#পর্ব_২২
#লেখনীতে_শুভ্রতা
“আরে তোরা এসে পড়েছিস। আমি আরো ভাবলাম তোদের কল করবো।”
দুপুরের কথা শুনে ছেলে দুটো হাসলো।
“তুই ডেকেছিস আর আমরা দেরি করেছি এরকম হয়েছে কখনো? নে ভাই এখন তোর বাইক নে আর আমাদের মুক্ত কর।”
দুপুর ছেলেটার থেকে চাবি আর হেলমেট নিয়ে নিলো। হেলমেট পড়তে পড়তে ছেলে দুটোকে বিদায় দিলো। যাওয়ার আগে তারা বেশ সুন্দর ভাবেই আমার সাথে কথা বললো।
“যাই ভাবি। আমাদের এলাকায় তো এখনো নিলো না দুপুর আপনাকে। যাওয়ার পর আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসতে ভুলবেন না কিন্তু।”
এই বলেই অন্য মোটরসাইকেলটাতে করে চলে গেলো দুজন। এদিকে আমিও দুপুরের মোটরসাইকেলে পেছনে বসে রূপসার দিকে যাত্রা শুরু করলাম। জীবনে প্রথম কারো সাথে মোটরসাইকেলে উঠে বেশ ভয় ভয় লাগছিলো শুরুতে। এরপর দুপুরের বোদৌলতে মানিয়ে নিলাম।
সেই দিনটা আমার জন্য একপ্রকার স্বপ্নের মতো ছিলো। বিকেল অবধি দুপুরের সাথে সময় কাটিয়ে তারপর ওনার সাথেই আমাদের বাড়িতে গেলাম। আব্বা তো বেজায় খুশি আমাদের দেখে তবে আম্মার মনোভাব ঠিক বুঝতে পারিনি। রাতটা বাড়িতে থেকে দুপুর আমাকে পৌঁছে দিয়ে চলে গেলো। বিয়ের পরে যখন দুপুর আর আব্বা আমাকে রেখে গেলো তখন দুপুরের জন্য তেমন খারাপ লাগেনি। তবে কেন জানি এবার প্রচুর খারাপ লাগছে। সেই সাথে নার্ভাসও বটে। উনি বোধহয় বুঝতে পারলেন আমার অবস্থা। আমার কপালে অধর ছোঁয়ালেন আলতো করে।
“চিন্তা করো না একদম। পরীক্ষাটা হয়ে গেলেই তোমাকে ঢাকায় নিয়ে যাবো। সেখানে থেকে পড়বে। তখন রোজ দেখা করবো আমি কেমন। আর একটু নার্ভাস হতে হবে না। তুমি অবশ্যই পারবে এবং তোমার রেজাল্ট এবারও অনেক ভালো আসবে। এখন তাহলে আমি যাই?”
বাড়ি থেকে আসা থেকে এই অবধি চুপ থাকলেও এবার মুখ খুললাম আমি। কৃত্রিম রাগ দিয়ে নিজের abeআবেগ ঢাকার চেষ্টা করে বললাম
“আসি বলতে হয় জানেন না?”
উনি মুচকি হাসলেন।
“আচ্ছা আসি তবে সুন্দরী।”
“হু সাবধানে।”
দুপুর চলে গেলেন। আমিও ভেতরে চলে গেলাম। সেদিনটাতে আমার আর পড়তে বসা হলো না। একে এত দিন পর আব্বা, আম্মা, দুপুর সবাইকে একসাথে পেয়ে আবার আলাদা হওয়া, তারপর আবার দুপুরের অদ্ভুত আবদার। আমি জানিনা দুপুর আমাকে কেন পেশা হিসাবে ওকালতি বেছে নিতে বললেন কিন্তু আমি কি পারবো? ছোট থেকেই তো কখনো সেভাবে কারো সাথে তর্ক করিনি আমি। বরাবরই শান্ত স্বভাবের ছিলাম। এই কিছু দিন আগে থেকেই যা আম্মার মুখে মুখে একটু কথা বলেছি। সেটাও তো কেবল অন্যায় বলেই। তবু দুপুরকে না করতে পারলাম না কেন?
সময় গড়িয়ে গেলো। আমার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা এলো আবার ধীরে ধীরে শেষও হয়ে গেলো। এক সময় ফলাফলও বের হলো। দুপুরের কথা মিথ্যে হয়নি। আমার রেজাল্ট ভালোই হয়েছে। অন্তত আমি যা আশা করেছিলাম তার থেকে তো ঢের ভালো। দুপুরও নিজের কথা রেখেছেন আমাকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে নিজের কাছাকাছি রেখে পড়িয়েছেন। অতঃপর সময়ের স্রোতে ভেসেই একটা সময় গিয়ে উকিল হয়ে বের হলাম আমি। দুপুরের ইচ্ছেই প্রাধান্য পেলো। তাছাড়াও আমারও আলাদা করে কোনো পেশার প্রতি ঝোক ছিলো না।
লেখাপড়ার মধ্যে একপ্রকার ডুবে থাকতে গিয়েই বাড়ির দিকে তেমন যাওয়া হয়নি অনেক লম্বা একটা সময়। যাও যেতাম দুই ঈদের সময়। দুপুর নিয়ে যেত আবার সেই সাথে করে নিয়ে আসতো। আব্বার সাথেও শুধু ফোনে ফোনেই যোগাযোগ ছিল। খারাপ লাগতো আব্বাকে ছেড়ে এত দূরে থাকতে তবে কিছু করার ছিলো না। তবু যখন দুর্বল হয়ে পড়তাম তখন সাহস জোগানোর জন্য দুপুর ছিলো। দুপুরের জন্যই বোধহয় আমি এত দূর আসতে সক্ষম হয়েছি। এবার আমি গ্রামে ফিরতে পারবো।
ঠিক করা হলো আমি আর দুপুর দুইজনই কাজকর্ম বাদ দিয়ে এবার নিজেদের বাড়িতে যাবো। আব্বা, আম্মার সাথে কিছুটা সময় কাটানোর পর এবং দুপুরদের বাড়িতে আমাকে নিয়ে যাওয়ার পরে আবার একসাথে ফিরে নিজেদের কর্মক্ষেত্রে নামবো। সেই অনুযায়ী গ্রামের দিকে রওনা হলাম। দুপুর আমাকে দিয়েই চলে গেলো। বাড়িতে আর ঢুকলো না। আসতে বললে জানালো একবারে নাকি বিয়ের সময় আসবে। তা আসুক, আমার কি? আমি তো এখন আমার আব্বার কাছে যাবো। আমার খুশি আর দেখে কে! একপ্রকার চিৎকার করে আব্বাকে ডাকতে ডাকতেই বাড়িতে ঢুকলাম। কিন্তু সেটা একটু অন্য ভাবে।
“আয়নার বাপ বাড়ি আছো নাকি? ওওওও আয়নার বাপ… বলছি তোমার মেয়ে আয়না এসেছে গো। কোথায় গেলে সব?”
আমার গলা শুনে আব্বা হুড়মুড় করে বাইরে বেরিয়ে এলেন। ভুত দেখার মতো চমকে উঠলেন আমাকে দেখে। তারপর যখন বুঝতে পারলেন সত্যিই আমি এসেছি তখন ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন।
“কতদিন পর তুই সামনে আসলি আয়ু মা। তোর কি একটুও মনে পড়তো না তোর এই গরিব বাপটার কথা? উকিল হয়ে কি গরিব বলে আমাদের ভুলে গেলি? জানিস তোর কথা কত্ত মনে পড়ে আমার! তোর আম্মার সামনে বারবার তোর নাম করি বলে সে আমাকে রাগ করে। বলে মেয়ে কি মরেছে নাকি যে এতবার তার জন্য কান্নাকাটি করতে হবে! তুই বল আমার মায়ের জন্য আমার খারাপ লাগবে না?”
আব্বার এমন ছেলেমানুষি রূপ আমি আগে কখনো দেখিনি। এমন নয় যে তিনি আমাকে আগে কখনো আদর করেননি বা ভালোবাসেননি। কিন্তু এতটা আবেগপ্রবন কখনো হননি। আমারই চোখে পানি চলে এলো। নিজেকে সামলে বললাম
“আরে আরে আমাকে কি দাঁড় করিয়েই রাখবে নাকি? দুই হাত ভর্তি জিনিস পত্র। এগুলো রাখতে দাও আগে আব্বা। এখন তো আমি এসে পড়েছি তাই না। তোমাদের ভুলে কি আমি থাকতে পারি বলো। চলো বারান্দায় চলো।”
আব্বা শান্ত হলেন। একটু লজ্জাও পেলেন বোধহয়। আমার হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে আম্মাকে ডাকতে চলে গেলেন। ফুপুকে খবর দেওয়া হলো। মিনা আপাকে আসতে বলা হলো তার স্বামী সহ। আয়না উকিল হয়ে ফিরেছে শুনে গ্রামের অনেক মানুষ দেখতে এলেন। যেসব চাচিরা আমি রূপের জালে ছেলেদের ফাঁসাই বলে আমাকে কথা শোনাতেন তারাও আহ্লাদ নিয়ে কথা বললেন। আমাকে যারা সহ্যই করতে পারতো না তারাও আমার স্বাস্থ নিয়ে চিন্তা প্রকাশ করলেন।
আহা মানুষের কতই না রূপ। এই কিছু দিন আগেই বলতে গেলে আমি তাঁদের দু চোখের বিষ ছিলাম। অথচ এখন যখন আমার সুদিন এসেছে, পয়সা উপার্জন করতে শিখেছি, এখন আর তাঁদের দরদের শেষ নেই। প্রতিবেশী চাচিরা কত কি রান্না করে নিয়ে আসছেন শুধু আমাকে খাওয়ানোর জন্য। হাসি পায় এসব গিরগিটির মতো মানুষ গুলোkকে দেখলে!
দুপুর আর আমার বিয়ের দিন ঠিক করা হলো। দিনাজপুর থেকে সবাই আসবে বলে জানানো হলো। নানুও আসবেন এবং তাকে আনতে আব্বা নিজে যাবেন। কত কত দূরের আত্মীয়রা এসে বাড়ি ভর্তি করে ফেলেছে। রাতে ঘুমুতে দেওয়ার জায়গা হয় না বাড়িতে। আশেপাশের চাচি গুলো সেধে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান আমাদের বাড়ির অতিথি গুলোকে। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো বড় আপা আর দুলাভাই এখনো তাঁদের ছেলে নিয়ে আসেনি। আম্মার কাছে আপার কথা শুনতে যাবো ঠিক সেই সময়ে চোখ পড়লো উঠোনে।
জীর্ণ-শীর্ণ শরীর, চোখের নিচে কালি, দেখলে মনে হচ্ছে গায়ে জোর নেই। অনেক দিন না খেয়ে থাকলে বোধহয় এই অবস্থা হয় মানুষের। উঠোনে প্রবেশ করেই সেখানে বসে কান্নায় ভেঙে পড়লো বড় আপা। আমি ছুটে গেলাম ওর কাছে।
“আপা তোমার এরকম অবস্থা কেনো? তুমি কি অসুস্থ? আর তুমি এই অবস্থায় একা আসতে গেলে কেনো দুলাভাই কই? তোমার ছেলে কই? ওরা আসেনি কেনো আপা? কথা বলো তো। কান্না করছো কেনো কি হয়েছে?”
আপা কান্না করার কারণে আমার কথার উত্তর দিতে পারছে না। এরমধ্যে আম্মা সহ আরো অনেকেই এসে জড়ো হয়েছে সেখানে। রুবি আপা কোনোমতে কান্না আটকে বললেন
“আমার সব শেষ রে আয়না। ওরা আমাকে বাঁচতে দেবে না বলেছে। আমার ছেলেটকেও আমার থেকে দূরে করে নিয়েছে। আমি কি নিয়ে থাকবো রে আয়না?”
বলেই আবারও কান্নায় ভেঙে পড়লেন। আমি বা আম্মা কেউই কিছু বুঝতে পারলাম না আপার কথায়।
“বাঁচতে দেবে না মানে? কারা বাঁচতে দেবে না? কে তোমার ছেলেকে দূরে করেছে? দুলাভাই কোথায় আপা?”
“তোর দুলাভাই আবার বিয়ে করেছে আয়না। অনেক দিন ধরেই আমাকে মারধর করতো। বলতো আবার বিয়ে করবে, আমাকে তাড়িয়ে দেবে। আমি বিশ্বাস করতাম না। আমার শাশুড়িও বলতো উনি আছেন আমার সাথে। কিন্তু আজ সব শেষ হয়ে গেলো রে। আকাশ আজকে ওর বোনের ননদকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে। আমার শাশুড়ি আর ননদ বলেছিলো আমার নামে আম্মা যে সম্পত্তি দিয়েছে তা যদি ওদের দিয়ে দিই তবে ওরা আমাকে সাহায্য করবে, আকাশকে বিয়ে করতে দেবে না। আমার ছিলো বলেই আমি ওগুলো আকাশের করে দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন ওরা আমাকেই তাড়িয়ে দিলো রে।”
আমি থমকে গেলাম। দুলাভাই আবার বিয়ে করেছেন! আবার ছেলে, সম্পত্তি সব রেখে আপাকে বের করে দিয়েছে ওরা! এগুলো তো অন্যায়। এক স্ত্রী থাকতে আবার বিয়ে তারপর মিথ্যে বলে সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়া। আপাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভেঙে পড়েছে খুব। আম্মা আপাকে ঘরে নিয়ে গেলেন। আমিও নিজের ঘরে গেলাম কিন্তু মাথার মধ্যে দুলাভাই আর তার পরিবারের কথাই ঘুরপাক খাচ্ছিলো।
বিকেলের দিকে ঘরে শুয়ে শুয়ে দুপুরের সাথে কথা বলছিলাম। এমন সময় আপা আমার ঘরে এলো। পাশে বসলো আমার। মুখ চোখ একেবারে মলিন। আগে যেমন সবসময় তেজ নিয়ে থাকতো তার ছিটেফোঁটাও এখন আর নেই। আমি ফোন রেখে উঠে বসলাম।
“কিছু লাগবে আপা?”
আমার হাত দুটো চেপে ধরলো আপা। কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে বলতে লাগলো
“তুই তো উকিল হয়েছিস আয়না। কয়েকটা কেসও জিতেছিস শুনলাম। আমাকে একটু সাহায্য কর না রে বোন। আমার সংসারটা আমাকে ফিরিয়ে দে না দয়া করে। আমার ননদের ননদ ওর স্বামীকে ঠকিয়ে আকাশকে বিয়ে করেছে। কেস করতে পারলে আর তোর মতো ভালো উকিল পেলে ঠিক আমি আমার স্বামী, ছেলে, সংসার ফিরে পাবো। জানি অনেক কষ্ট দিয়েছি তোকে, খারাপ কথা বলেছি কিন্তু আমি তো তোর আপা বল। সব ভুলে আমার সংসারটা বাঁচিয়ে দে না বোন। দরকার হলে পায়ে ধরবো আমি তোর তবু না করিস না, ফিরিয়ে দিস না আয়ু।”
আপার কথা শেষ হতেই আম্মাও যেন কোত্থেকে এসে আমাকে চেপে ধরলেন। অনুরোধ করলেন যেন আপার কেসটা আমি নিয়ে নিই।
হায়রে নিয়তি। যে মেয়ের সুখের জন্য আম্মা সারাটা জীবন আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করলো, নিজের ভালোবাসা-আদর থেকে বঞ্চিত করলো সে মেয়ের সুখ আজ কোথায়! সেই রুবির সংসার-স্বামী বাঁচাতেই আজ তাঁদের আমার কাছে অনুরোধ করতে হচ্ছে। এজন্যই বোধহয় বলে আল্লাহ ছাড় দিলেও ছেড়ে দেন না। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আপাকে সাহায্য করবো। ওরা আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে বলে যে আমাকেও করতে হবে তা তো না। জীবনটা অনেক ছোট। রাগ, জেদ, অন্যের ক্ষতি করার চিন্তা ভাবনা দিয়ে সময়টা নষ্ট করার মানে হয় না।
সে ঘটনার পরে অনেকটা সময় পেরিয়েছে। এখন রুবি আপা তার সংসার নিয়ে বেশ আছে। আম্মাও আমার সাথে আর আগের মতো খারাপ ব্যবহার করেন না। যদিও তাঁদের কাছে আমি থাকি খুব অল্প সময়। তবু ওই অল্পতেই তৃপ্তি। আজ আমার মেয়ের চতুর্থ জন্মদিন। মেয়েটা পার্কের মধ্যে ছুটোছুটি করছে। আমি বসে আছি পাশের একটা গাছের নিচে দুপুরের কাঁধে মাথা দিয়ে। আগের সব কথা মনে আসতেই দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো চোখ থেকে।
“রাতের আম্মু এত বড় হয়েও কাঁদছে! রাত দেখলে কিন্তু খুব ক্ষেপাবে তোমাকে সুন্দরী।”
দুপুর নিজের বহুকাল পূর্বে মজা করে বলা কথাটাও রেখেছে। তার মেয়ের নাম রাতই রেখেছে। ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলাম আমি। এখন আমার জীবনে আর সুখের কোনো অভাব নেই। থাকবেই বা কি করে! দুপুরের মতো স্বামী থাকলে আর দুঃখ ছুঁতে পারে নাকি হু! উনি আমার জীবনে #এক_টুকরো_সুখ হয়ে এসেই তো বাকি সুখ গুলে খুঁজতে সাহায্য করলেন।
সমাপ্ত….
[আস্সালামুআলাইকুম। আজ শেষ করে দিলাম গল্পটা। এই গল্পে আপনাদের অনেকের ভালোবাসা পেয়েছি। সবাইকে ধন্যবাদ। যারা সাইলেন্ট রিডার আছেন আজ কিন্তু তাঁদের মন্তব্য চাই।]