#আবার_প্রেম_হোক
#নুসরাত_জাহান_মিম
১৫.
দূর থেকে ভেসে আসছে আযানের প্রশান্তিময় ধ্বনি।প্রত্যুষে সতেজ হাওয়া বয়ে বেড়ায় প্রকৃতিতে।ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটতে থাকে বলে কেউই এমন সময় নিজ কার্যের জন্য বের হয়না।থাকেনা কোনো কোলাহল।ব্যস্ত নগরী পরিণত হয় নিস্তব্ধ নগরীতে।পাখির কিচিরমিচির শব্দও যেনো তখন মনে হয় মনোমুগ্ধকর গানের ধুন!এরূপ নির্মল পরিবেশ চাঁদের নিকট খুবই পছন্দনীয়।নির্মল বায়ুর সংস্পর্শে এসে প্রাণভরে নিশ্বাস নিলে ভারী মস্তিষ্ক হালকা হয়ে যাবে ভেবেই আড়মোড়া ভেঙে হাই তুলতে তুলতে ঘুম থেকে উঠে পড়লো চাঁদ।মাথায় ঘোমটা দিয়ে খুবই ধীর গতিতে হেটে বারান্দায় প্রবেশ করলো।তাদের বারান্দার গ্রিলে ছিটকিনি আছে বিধায় সেটা খুলে হাতদুটো গ্রিলে রেখে মাথাসহ অর্ধেক শরীর বাইরের দিকে হেলে দিয়ে প্রাণভরে নিশ্বাস নিচ্ছে।
মিরা ঘুম থেকে উঠেই কল দিলো অরণকে।অরণ তখনও ঘুমে।অরণের রিংটোন বারবার বাজছে কিন্তু তার কোনো হুশই নেই।এদিকে অন্যজনের যে ঘুমের চৌদ্দটা বেজে গেছে এখন তার কি হবে?মেজাজ খারাপ করে ফোন রিসিভ করতেই সে শুনতে পায় মিরা বলছে,
“দোস্ত আজকে জলদি কলেজে আসবি বুঝেছিস?গতকাল চাঁদের সাথে দেখা হয়নি।মেয়েটা বোধহয় চলে গিয়েছিলো।আজ যাবো।আর তোকেও কিন্তু সাথে যেতে হবে।হ্যালো….অরণ?শুনছিস আমার কথা?….হ্যালো?”
গম্ভীর কন্ঠে প্রণয় বললো,
“অরণ ঘুমাচ্ছে”
মিরা অবাক হয়ে বললো,
“অরণ তোর বাসায়?”
“প্রায়ই তো আসে অবাক হচ্ছিস যেনো?”
“অবাক না।তোরা কেউই বললিনা।নাহলে দল বেধে যেতাম”
হেসে বললো মিরা।তা শুনে মৃদু হেসে প্রণয়ও বললো,
“তুমি যে মামি কেমন দল বাধতে তা ভালো করেই জানি।নে ওর সাথে কথা বল”
প্রণয় অরণকে ডাকতে ডাকতে বলছে,
“এই ডাবল ব্যাটারী?রাতভরে পড়ে দিনভরে না ঘুমিয়ে দেখ ক’টা বাজে।আজ তোর জন্য লেট হলো বলে!মিরা পর্যন্ত কল দিয়ে ফেলেছে”
মিরা প্রণয়ের কথা শুনে ঠোট চেপে হাসছে।প্রণয় নামক গম্ভীর ছেলেটা আর সবার সাথে গম্ভীর থাকলেও ওদের সামনে নিজেকে মোটেও গম্ভীর রাখতে পারেনা।আর অরণের কাছেতো সে যেনো এক খোলা বই!
অরণ ঘুমজড়ানো কন্ঠেই বললো,
“তুই বললি আর আমি বিশ্বাস করলাম?মিরাতো এমনি ই তাড়াতাড়ি উঠে।”
প্রণয় অরণের কথায় তোয়াক্কা না করে অরণকে ফোন বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
“মিরা কল দিয়েছে।নে কথা বল।আমি আবার শুচ্ছি।ডাকবিনা খবরদার!যেখানেই যেতে বলুক একা যাবি।আমায় ফাল/তু কোনো কাজে জড়াবিনা”
বলেই শুয়ে পড়লো।
অরণ ঘুমঘুম কন্ঠে ফোন কানে লাগিয়ে বললো,
“হু বল।”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে মিরা বললো,
“না ঘুমিয়ে উঠে পড়।আজ তাড়াতাড়ি কলেজ যাবো”
অরণের জবাব না পেয়ে আবারও মিরা বললো,
“এই শুনছিস?”
“হু..হু..বল”
“উফফো!অরণের বাচ্চা!তুই উঠবি নাকি আমি প্রণয়ের বাসায় আসবো?”
অরণ আ!ৎকে উঠে বলে,
“বাঘিনীর মতো গ!র্জাচ্ছিস ক্যান ভাই?তুই কেন প্রণয়ের বাসায় আসবি।আমি ই আসছি বল কোথায় আসবো”
“তার মানে তুই আবারও ঘুমাচ্ছিলি?”
“হ্যা…না মানে ঐ আসলে”
“মানে টানে রাখ।শোন কাল চাঁদের সাথে দেখা হয়নি আমার।আজ যাবো আর তুইও যাবি আমার সাথে বুঝেছিস?”
“হ্যা যাবো।কখন যাবি?”
“আজ আগেই যাবো।আমি রেডি হচ্ছি।মিরকেও ঘুম থেকে তুলে রেডি হতে বলে এসেছি।ওরও নাকি চাঁদকে ভালো লেগেছে কথা বলবে”
“কিহ!মির আবার চাঁদের দিকে নজ…”
“ধুর না।ওসব না।মেয়েটাকে নাকি ইন্টারেস্টিং লেগেছে।তাছাড়া মিরতো চাঁদকে মামি ডেকে অস্থির!”
হাসতে হাসতেই বললো মিরা।অরণও হেসে কিছু বলতে নিয়েছিলো হঠাৎ পাশে থাকা প্রণয়ের দিকে চোখ পড়তেই ভাবে প্রণয়ের সামনে এসব না বলাই ভালো।তাই অরণ মিরাকে বলে,
“আচ্ছা আমি রাখছি।বের হয়ে তোকে কল দেবো”
চাঁদ রেডি হয়ে নাস্তা খেতে বসতেই তার মা তাকে জিজ্ঞেস করলেন,
“আজ কি কলেজ তাড়াতাড়ি ই যাবি?আর তোর টিউশন?”
পরোটা চিবুতে চিবুতে চাঁদ বললো,
“আম…আরে আম্মু তেমন কিছুই…ইম….না টিউশন থেকে বাসা…আম…”
“আগে খেয়ে নে পরে কথা বল”
“হিম”
মুখের খাবার শেষ করে চাঁদ বললো,
“আমি ভেবেছি কি একবারে টিউশন থেকেই কলেজ চলে যাবো।বাসায় এসে আবার রেডি হয়ে তারপর যাওয়া একটু কষ্টসাধ্যই বৈকি!”
“হ্যা তোর যেভাবে সুবিধা ওভাবেই যা আর ধীরে সুস্থে খা”
মিরা আর মির রাস্তায় আসতেই মিরার ফোনে অরণের কল আসে।মিরা রিসিভ করেই বলে,
“বের হয়েছিস?”
“হ্যা মাত্রই হলাম।তোরা?”
“রিক্সাই নিচ্ছিলাম”
“ক্যাম্পাসে দাড়াবো?”
“না।গেটের সামনে দাড়াস”
“ঠিক আছে তোরা আয়।আর বাকিদের বলেছিস?”
“বাকিরা মনে হয়না ইন্টারেস্টেড আর ওদের ইচ্ছা হলে নিজেরাই বুঝে নেবে।তুই আয় জলদি”
“আচ্ছা সাবধানে আসিস”
মিরা হেসে বললো,
“মির আছে আমার সাথে”
“তাও”
“আচ্ছা তুইও সাবধানে আসিস”
বলেই মিরা কল কাটতে নেবে এমন সময় অরণ বলে,
“এই শোন”
“হ্যা বল”
“না থাক”
“আরে বল”
“দেখা হলেই বলবো।রাখছি।দেখে শুনে আসিস”
চাঁদ প্রায় মিনিট দশেক হেটে তার স্টুডেন্টের বাসার সামনে আসলো।যেইনা গেট দিয়ে ঢুকবে ওমনি ওপাশ থেকেও কেউ একজন বের হলো।দুজনের ধাক্কা লাগতে লাগতে বেচেছে মাত্রই!ছেলেটা মোবাইল কানে রেখেই বললো,
“সরি সরি।আসলে নেটওয়ার্ক পাচ্ছিলাম না তাই বাইরে আসছিলাম।আপনার লাগেনি তো?”
বলেই তাকালো চাঁদের দিকে।চাঁদ কিছু বলার পূর্বেই ফোনের রিংটোন বাজতেই দেখলো এ বাড়ি থেকেই ফোন আসছে।তবুও সে ধরলো।ধরে বললো,
“এক্সট্রিমলি সরি আন্টি।আসলে আজ একটু লেট হয়ে গেছি।আমি আপনাদের গেটের সামনেই আছি।আসছি এক্ষুনি”
ছেলেটা ভ্রু কুচকে চাঁদের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আপনি?”
চাঁদও ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললো,
“আপনি?”
“আপনি কি মেহুর টিউটর?”
“আ…জ্বি।আপনি কে?আর ফোনটা?”
“এক্সট্রিমলি সরি ম্যাম!আসলে আম্মু বললো আপনাকে যেনো কল করে বলি আসছেন না কেনো।আম্মু গোসল করছিলোতো।তাই ফোনটা আমি ই”
“আমিও সরি ভাইয়া চিনতে পারিনি।আসলে আপনাকে কখনো দেখিনিতো!তবে আই গেস আপনি মাহির ভাইয়া?”
“হ্যা”
“আর প্লিজ এভাবে ম্যাম বলে অপমানিত করবেন না।হয়তো আমি মেহুর টিচার ঠিকই বাট আপনার ছোটই।আপনি আমার এক ব্যাচ সিনিয়র”
“ইউ মিন তুমি…সরি আপনি ফার্স্ট ইয়ার?”
“জ্বি ভাইয়া”
“মেহুর মুখে অনেক শুনেছি আপনার নামে।চাঁদ আপু এই চাঁদ আপু সেই।আমিও আপুর মতো ডক্টর হবো আরও কতো কি!তো আপনি ই মেহুর চাঁদ আপু?”
“জ্বি ভাইয়া”
“আসলে আমিও চিনতে পারিনি।আপনাকে দেখেছি ই দু’বার।সম্ভবত বোরকাতে।তাই আরকি”
“সমস্যা না ভাইয়া।আসলে গতকাল থেকে ক্লাস শুরু হয়েছেতো তাই এখান থেকে ডিরেক্ট কলেজ যাবো।এজন্যই আরকি মানে”
“বুঝেছি।চলুন আপনার স্টুডেন্ট আবার চাঁদ আপু আসছেনা কেনো করে করে পা!গল হয়ে যাচ্ছে”
চাঁদ হেসে দিলো এ কথায়।হাসলো মাহিরও।দুজনে কথা বলতে বলতে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো।চাঁদ মেহেরুনের রুমে আসতেই মেহেরুন সেদিকে তাকিয়ে বললো,
“আপনি কে?চেনা চেনা লাগছে”
পেছন থেকে মাহির এসে বললো,
“নিজের চাঁদ আপুকে চিনতে পারিস না আবার বড় বড় কথা বলিস যে তার মতো নাকি ডাক্তার হবি?ধি!ক্কার ধি!ক্কার!”
“কি!!!”
মেহেরুনের চেচানোতে কান চেপে ধরে চেয়ারে বসতে বসতে চাঁদ বললো,
“আস্তে মেহু আস্তে।তুমিতো জানোই চুলে জট লাগলে সহজে ছাড়াতে পারিনা।বলেছিলাম না তোমায়?আমার চুল একটু বড়?তাই আরকি।এজন্যই দেরি হয়েছে।আজ ক্লাসে যেতে হবে একটু তাড়াতাড়ি ই।কি যেনো আছে।স্যার বলছিলেন সবাইকে জলদি যেতে স্পেশালি আমাকে।জানোইতো ক্যাপ্টেনদের জ্বালা বেশি?তাই একটু কম পড়াবো কেমন সোনা?”
মেহেরুন বললো,
“হ্যা হ্যা জানি আপু।সমস্যা নেই।তোমার কম পড়ানো মানেই অনেক।এই আপু দাড়াও না”
“কেনো?”
“প্লিজ?”
“আচ্ছা”
চাঁদ দাড়াতেই মেহেরুন চাঁদের পেছনে এসে চাঁদের হিজাবের নিচ দিয়ে চোখ বুলিয়ে হতাশ হয়ে বললো,
“চুলতো খোপা করা আপু।দেখবো কি করে?”
চাঁদ হেসে বললো,
“আমার চুল দেখার জন্য এতো ব্যাকুল?”
“হ্যা আপু।তোমার আইডিতে তোমার আগের অনেক ছবি দেখেছি ইশ কি সুন্দর চুল!সেটা সচক্ষে দেখার খুব ইচ্ছা”
“অবশ্যই দেখাবো।একদিন আমার বাসায় যেয়ো গেলেই দেখতে পাবে।বাইরে সবসময় হিজাব পরি জানোইতো”
“হ্যা আপু।তোমাকে পুরোই পাকিস্তানি হিরোইনদের মতো লাগছে।ওদের মধ্যে একটু বিদেশী ভাব আর তোমার মধ্যে বাঙালীয়ানা।তবুও কি মিষ্টি!কালও কি এভাবেই গিয়েছিলে?”
“হ্যা।কিন্তু গতকাল লাল আর কালো পরেছিলাম”
“আজও তো লাল আর কালোই পরেছো”
“না।আজ কালো আর লাল পরেছি”
“ঐ একই তো?”
“না।বোঝোনি তুমি।আজ জামা পরেছি কালো,পায়জামা-ওড়না লাল।আর কাল জামা পরেছিলাম লাল,পায়জামা-ওড়না কালো।”
“অন্য ড্রেস নেই?”
“আছেতো”
“অন্যটা পরতে”
“কেনো?এটায় খারাপ লাগছে?”
“হুর!অসম্ভব সুন্দর লাগছে।এজন্যইতো অন্যটা পরতে বলছি যাতে কেউ নজর না দেয়।আচ্ছা কাল কয়টা প্রপোজাল পেয়েছো বলোনা?আজও নিশ্চয়ই পাবে!”
“ছেলেদের সামনে যাইনা বোকা”
বলেই মেহেরুনের মাথায় টোকা মেরে হাত টেনে চেয়ারে বসিয়ে আবারও বললো,
“অনেক হয়েছে গল্প এবার পড়তে বসো।পরশু অনেক গল্প করবো কেমন?”
মেহেরুন মাথা নেড়ে দরজার দিকে তাকাতেই দেখতে পায় তার ভাই এখনো দাঁড়িয়ে আছে।তা দেখে সে বলে,
“এখানে কী?যাও, তোমার রুমে যাও।আমার আপু এখন আমায় পড়াবে”
মাহির অপ্রস্তুত হয়ে বললো,
“ওহ সরি মিস চাঁদ”
কথাটা চাঁদের কর্ণপাত হতেই অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটতে যাচ্ছে যা কোনোক্রমেই সে চায়না।তাই অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করলো মস্তিষ্কে।তবে কোনো লাভ হলোনা। ফলাফল শূণ্যের কোঠায় ই রয়ে গেলো।এতো দ্রুতগতিতে মাহিরের বাক্যটিকে মস্তিষ্ক ধারণ করলো যে মস্তিষ্কের নিউরণগুলো এক সেকেন্ডেরও পূর্বে সেখান থেকে স্নায়ু উদ্দীপনা নিয়ে পূর্ববতী কিছু জিনিস মেলাতে চেষ্টা করলো।অতঃপর সফলও হলো।দৃষ্টির সামনে ভেসে উঠলো সেই বিড়ালাক্ষী মানবের নেত্রদ্বয়।এমন দৃশ্য দেখতেই আ!টকে আসতে লাগলো চাঁদের নিশ্বাস!বন্ধ হলো আখিজোড়া।মস্তিষ্ক অ!সাড় হচ্ছে যেনো!কপালের রগ ফুলে উঠলো।হাত দুটো হলো মুষ্টিবদ্ধ।রাগ যেনো তরতর করে বাড়ছে তার!
To be continued…