#ফিরে_আসা
১০
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
সন্ধ্যার পর ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে। চারিদিকে কনকনে শীতল হাওয়া বইছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন বাতাসের সঙ্গে কয়েক টুকরো বরফ গুঁড়ো করে মিশিয়ে দিয়েছে। গাড়ির জানালার কাঁচগুলোতে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি জমেছে। ওয়াইপার চালু রয়েছে, সর্বক্ষণ সেগুলো ব্যস্ত রয়েছে গাড়ির সামনের কাঁচটা মুছে স্বচ্ছ রাখতে। এমন প্রলয়ংকরী বৃষ্টি ঢাকায় বিগত কয়েক বছরে দেখা যায়নি। না-কি দেখা গেছে? কয়েক বছর ধরে বৃষ্টিটাকেই ঠিকমতোই খেয়াল করা হয়নি।
ভয়ঙ্কর আওয়াজ করে বিদ্যুৎ চমকে উঠলো। কথা এ সময়ে আশেপাশে থাকলে নির্ঘাত ভয় পেয়ে জাপটে ধরতো আরশাদকে। কথার কথা মনে পড়তেই মনটা ভালো হয়ে গেল। আগামী সপ্তাহে বাবা-মেয়ে মিলে বেড়াতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্টের ফ্লোরিডাতে। সেখানেই রয়েছে কথার স্বপ্নের ‘ডিজনী ল্যান্ড’।
গাড়িটাকে আর বাড়ির সামনে দাঁড় করালো না আরশাদ। সোজা চলে গেল গ্যারেজে। শুটিং শেষে আরশাদ একাই ড্রাইভ করে বাড়ি ফেরে। দিনের শেষভাগ সবথেকে ক্লান্তিময় সময়। এ সময়টা একা কাটাতেই সাচ্ছন্দ্য বোধ করে। টিমের কাউকে সঙ্গে বয়ে নিয়ে আসার অর্থ বাড়তি মাথাব্যথা।
গাড়ি গ্যারেজে রেখে আরশাদ বেরিয়ে এলো। বৃষ্টির প্রবল থাবা থেকে নিজেকে বাঁচানোর কোনপ্রকার চেষ্টা না করেই জ্যাকেটের পকেট থেকে চাবিটা বের করলো। রাতে এই বিশাল দোতলা বাড়িতে আরশাদ একাই থাকে। দিনভর মতিউর থাকে, ঘর-টর গুছিয়ে রাখে। রাত দশটার দিকে দরজা তালাবদ্ধ করে চলে যায়।
যদিও এ বাড়িতে একা না থাকাই শ্রেয়। অনেকের ধারণা এ বাড়িতে অশরীরী কিছু থাকে। এ ধারণা স্থায়ী হয় আরশাদের নানা নিয়ামুল হোসেনের মৃত্যুর পর। আরশাদের বৃদ্ধ আত্মীয়দের মধ্যে একমাত্র এই নানাই তার সাফল্য দেখে যেতে পেরেছেন। সে বছর আরশাদ কেবল এই বাড়িটা কিনেছে। নানা ঢাকায় চিকিৎসার জন্যে এসে উঠেছেন এই বাড়িতেই।
তিনি না-কি মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে দেখতেন কালো শাড়ি পরা কেউ হেঁটে বেড়াচ্ছে। আরশাদ বিরক্ত গলায় বলেছিল, “তোমার ভূতের কস্টিউম-সেন্স নেই না-কি? সারাজীবন শুনেছি ভূত পরে সাদা শাড়ি। এই প্রথম কালো শাড়ি পরা ভূতের কথা শুনলাম।”
আরশাদের ফাজলামি গায়ে না মেখে দৃঢ় গলায় বলেন বাড়িটা ছেড়ে দিতে।
এর কিছুদিন পরপরই মৃত্যু হয় নিয়ামুল হোসেনের। ভূতের ব্যাপারটা প্রথম দিকে কেউ পাত্তা না দিলেও ধীরে ধীরে অনেকেই কালো শাড়ি পরা কাউকে দেখতে লাগলো। আরশাদের বাড়িতেই আরশাদ বাদে সবাই ভূত দেখে ফেলেছে। থাকুক গিয়ে! ভূত-প্রেত, রাক্ষস-শাকচুন্নি যা খুশি থাকুক, কেবল মানুষ না থাকলেই হলো।
নায়ক হওয়ার সুবাদে প্রতিদিন কতশত মানুষের সঙ্গে যে আলাপ করতে হয় আরশাদকে, তার হিসাব নেই। তবুও এই মানুষকেই তার সবথেকে অপছন্দ। আমাদের চারপাশে মানুষ হিসেবে আমরা যা দেখি, তা মুখোশধারী কতগুলো জীব ছাড়া কিছুই নয়। প্রত্যেকটা মানুষের কাছে নিজস্ব কতগুলো মুখোশ থাকে। সে প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ঠিক করে, আজ কোন মুখোশ পরে পৃথিবীর মুখোমুখি হবে। অবশ্য কারো দোষ দিয়ে লাভ নেই। মুখোশ আরশাদেরও রয়েছে। প্রকৃত আরশাদ সেই মুখোশের আড়ালেই লুকিয়ে থাকে।
টাওয়াল দিয়ে চুলগুলো মুছেই সোজা বাথরুমে চলে গেল আরশাদ। দীর্ঘক্ষণ সময় নিয়ে হট শাওয়ার নিলো। গোসল করার এই সময়টা বেশ আরামের। দিনের সকল ব্যস্ততা ভুলে যাওয়া যায়। নতুন দিনের নতুন চিন্তাভাবনাও করা যায়।
গোসল সেরে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো আরশাদ। টেবিলে খাবার সাজানো আছে। তার দক্ষ বাবুর্চি আব্দুল মিয়া নিজ হাতে সব রান্না করে গেছে। রাতে কী রান্না হবে তার আরশাদই বলে দেয়। আজ যেন কী রান্না করতে বলা হয়েছিল? আরশাদের মনে পড়ছে না। খেতেও ইচ্ছা করছে না। ক্লান্তিতে সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসছে।
খুব আশ্চর্যজনকভাবে অতিরিক্ত ক্লান্তিতে ঘুমও আসতে চায় না। কোথায় যেন ছুটে পালিয়ে যায় দু চোখ থেকে। আরশাদ বেশ অনেকক্ষণ এপাশ-ওপাশ করলো, ঘুম কিছুতেই এলো না। উঠে বসে বিরক্ত ভঙ্গিতে সিগারেট ধরালো আরশাদ। নিজের সঙ্গে সময় কাটানো তার সবথেকে অপছন্দের। নিজের এলোমেলো চিন্তাভাবনাগুলো এড়াতেই তো সকাল সকাল শুটিংয়ে চলে যায় আরশাদ, ফিরে গভীর রাতে। তবুও ভাবনাগুলো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে দেয় না।
ঘুম যেহেতু আসছে না, অযথা বিছনার পরে থাকার মানেও হয় না। আরশাদ বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো। ধীর গতিতে পা বাড়ালো ডাইনিং রুমের দিকে। ডাইনিং টেবিলের দিকে তাকিয়ে বিগড়ে যাওয়া মেজাজটা আরেকটু বিগড়ে গেল। তার প্রকান্ড টেবিলের পুরোটা জুড়ে সাজানো নানা ধরনের খাবার। একজন মানুষের জন্যে দশজনের রান্না করাটা আব্দুলের বদভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কালকেই কঠিন ভাষায় ধমক দিতে হবে তাকে।
এবার মনে পড়লো, আজ রাতে কী রান্না করতে বলেছিল। টমেটো দিয়ে চিংড়ি মাছের বার্বিকিউ। আব্দুল মিয়ার এই প্রিপারেশনটা বিশ্বসেরা। সে বলে এটা না-কি মেক্সিকান রেসিপি। আদতে কোন দেশের কে জানে? জিনিসটা খেতে অসাধারণ হয়, এটাই আসল কথা। এই রান্নার জন্যেই তার আগামীকালের ধমক বাতিল করলো আরশাদ।
খাওয়া-দাওয়া শেষে বাড়িজুড়ে হাঁটতে শুরু করলো। নিজের বাড়িটা দীর্ঘদিন নিজেই ঘুরে দেখা হয় না। হাঁটতে হাঁটতেই আনমনে আরশাদ এসে পৌঁছালো নিচতলার সবথেকে বড় বেডরুমটায়। আরশাদের মা সেলিনা হক ঢাকায় এলে এ ঘরটাতেই থাকেন। ঘরটা সাজানোও হয়েছে তার পছন্দ অনুযায়ী। আচ্ছা? আসফিয়া আপা কি তাহলে আজ ঠিক কথাই বলছিল? আরশাদের কী উচিত মায়ের সঙ্গে সবকিছু স্বাভাবিক করে নেওয়া? দীর্ঘশ্বাস ফেলল আরশাদ, এই প্রশ্নের উত্তর তার নিজের কাছেও নেই।
হাঁটতেই হাঁটতেই হঠাৎ চোখ পড়লো দেয়ালে ঝুলতে থাকা একটা ছবির দিকে। মেঝেতে একগাদা খেলনা নিয়ে বসে থাকা ছোট্ট আরশাদ। করুণ দৃষ্টিতে ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইল আরশাদ। এই বাচ্চাটার জন্যে খুব মায়া হয় তার। ওর সঙ্গে কোনোদিনও খারাপ ছাড়া ভালো কিছু হয়নি।
মানুষের প্রথম জীবন দুঃখ-দুর্দশায় কাটলে দ্বিতীয় জীবনে না-কি প্রশান্তি নেমে আসে। এই যেমন অরা। মেয়েটার প্রথম জীবন কেটেছে যন্ত্রণা, বঞ্চনা, অত্যাচারের মাঝে। সেই জীবন থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে সে নির্ঘাত দিন-রাত প্রার্থনা করেছে। তার প্রার্থনা সত্যিও হয়েছে। দ্বিতীয় জীবনে সে ভালো আছে।
কিন্তু একটা মানুষ প্রথম জীবন দুঃখ-দুর্দশায় কাটানোর পর যখন দ্বিতীয় জীবন পায়, আর সেই জীবনটাও যখন ডুবে যায় অন্ধকারে তখন? হতাশা ছাড়া আর কোনো অবকাশ থাকে না তার। কারণ তৃতীয় জীবন বলে প্রকৃতি আমাদের কিছু দেয় না। দিয়ে থাকলেও আরশাদের ভাগ্যে তা লেখা নেই।
আরশাদের ছেলেবেলাটা কেটেছে অন্ধকারে। নিবিড় কালো অন্ধকার। অতিরিক্ত অন্ধকারও একসময় মানুষের চোখ সয়ে যায়। তবে সেই অন্ধকারের কথা মনে করলে আজও গা শিউরে ওঠে। আরশাদের বাবা আরমান হক ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। কীসের ব্যবসা করতেন, উত্তরটা কখনোই জানা ছিল না আরশাদের। কারণ তিনি বেশিদিন এক ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারতেন না।
কখনো চালের ব্যবসা, কখনো জামা-কাপড়, কখনো বই-পত্র। এই শহরে এমন কোনো জিনিস নেই যার ব্যবসা আরমান হক করেননি। দুদিন পর পর ব্যবসায় ধস আর নতুন নতুন ব্যবসা শুরু করার কারণে চারিদিকে দেনা বাড়তে থাকে। আরমান হয়ে পড়েন দিগ্বিদিকশূণ্য। টাকার যোগান দিতে তার লোভী চোখদুটো গিয়ে পরে সেলিনা হকের বিয়ের গয়নার ওপর। বিয়ের গয়নার সঙ্গে সব নারীরই অতিরিক্ত মায়া যুক্ত থাকে। তার ওপরে ওই গয়নাগুলোই ছিল সেলিনার ছেলেমেয়েদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের একমাত্র সম্বল।
তাই গয়নাগুলোর জন্যে সামান্য প্রতিবাদ করলেই চরমভাবে অপদস্থ হন স্বামীর হাতে। আরমান ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সামনে বেল্ট খুলে স্ত্রীকে মারতে শুরু করেন। ওই ঘটনা প্রগাঢ় ছাপ ফেলেছিল আরশাদের ছোট্ট মস্তিষ্কে। শরীরের কোনো অংশ পুড়ে গেলে আজীবন সূক্ষ্ম ক্ষতচিহ্ন রয়ে যায়। তেমনি ওই ঘটনা থেকে পাওয়া ক্ষতচিহ্ন আজও রয়ে গেছে মনে।
এরপর থেকে বাবার কাছে মায়ের মার খাওয়াটা স্বাভাবিক হয়ে যায় তার কাছে। একটু কথা কাটাকাটি হলেই ধরে নিতে হবে বাবা বেল্ট খুলে শুরু করবেন মার। অদ্ভুত ব্যাপার, স্ত্রীর প্রতি হাজার অবিচার করলেও সন্তানদের সঙ্গে ঠিকই হেসে হেসে কথা বলতেন আরমান। আদর্শ পিতার ন্যায় প্রতি সপ্তাহে নতুন নতুন খেলনা এনে দিতেন ছেলে-মেয়েদের। তবুও তাদের মনে সামান্যতম জায়গা করে নিতে পারেননি।
আরশাদের বয়স যখন চৌদ্দ কী পনেরো তখন একদিন আরমান ফুরফুরে মেজাজে বাড়ি ফিরলেন। সাধারণত তিনি বাড়ি ফিরেই মেজাজ গরম করে থাকেন। তিক্ত গলায় কতক্ষণ সেলিনার সঙ্গে ঝগড়া করেন। তবে সেদিন দেখা গেল একেবারেই ভিন্ন চিত্র। আরমান বাড়ি ফিরে হাসি হাসি গলায় ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খোঁজ-খবর নিলেন, স্ত্রীকে সন্ধ্যার চা বানাতে সাহায্য করলেন। তবুও কোথায় যেন একটু খটকা লেগেই থাকলো আরশাদের মনে। বাবা কী তবে সত্যিই ভালো হয়ে গেল?
চা খেতে খেতে কথার ছলে আরমান স্ত্রীকে বললেন, “এবার এই চায়ের ব্যবসাই করবো বুঝলে সেলিনা। সিলেটের ছেলে হয়ে অন্য কোনো ব্যবসা আমাকে মানায় না-কি? সিলেটে একটা ফ্যাক্টরি ভাড়া নেবো, তিন মাসের মধ্যে আমরা কোটিপতি! এই ভাড়া বাসায় আর থাকতে হবে না।”
সেলিনা হতবাক গলায় বললেন, “মাত্র তিন মাসের মধ্যে? কী করে সম্ভব?”
“সম্ভব হবে না কেন? আমার দুই বন্ধুকে এবার সাথে নিচ্ছি। চায়ের ব্যবসায় ওরা এক্সপার্ট। এই এক ব্যবসা দিয়ে দুজনে ঢাকায় চারটা চারটা করে ফ্ল্যাট কিনেছে।”
“বলো কী?”
“ঠিকই বলেছে। এই ব্যবসাটা একবার দাঁড়িয়ে গেলেই আমাদের সব দুঃখ শেষ। নিজেদের বাড়ি হবে, গাড়ি হবে। ধার-দেনা করে আর চলতে হবে না। তোমাকেও দিন-রাত খাটাখাটনি করতে হবে না। সামান্য গ্লাসে পানি ঢেলে দেওয়ার জন্যেও লোক থাকবে।”
স্বপ্নে বিভোর হয়ে সেলিনার চোখদুটো চকচক করে উঠলো। এমন একটা দিনের প্রতীক্ষায় তিনিও বসে আছেন। রোজকার অশান্তি দূর হয়ে যদি জীবনে সুখের প্রাচুর্য আসে তবে ক্ষতি কীসের?
খুশিতে গদগদ হয়ে সেলিনা বললেন, “তাহলে তুমি এই ব্যবসাটাই শুরু করো।”
“শুরু করো বললেই তো আর শুরু করা যায় না। ফ্যাক্টরি ভাড়া নিতে হবে, মেশিনারিজ কিনতে হবে, কর্মচারী ঠিক করতে হবে – কত কাজ! এসব কাজ কী আর ফ্রি ফ্রি করা যায় বলো? প্রায় লাখ দশেক টাকা তো লাগবেই।”
“দশ লাখ? এত টাকা তুমি কোথায় পাবে?”
আরমান চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, “তুমি জোগাড় করবে।”
“আমি? আমি এতগুলো টাকা কোথায় পাবো?”
“তোমার ভাইদের কাছে চাইবে। এমনিতেও বিয়ের পর তাদের কাছে কোনো সাহায্যই তো চাওনি।”
“তাই বলে দশ লাখ টাকা চাবো? চাইলেই কি ওরা দিয়ে দেবে?”
“আচ্ছা দশ লাখ লাগবে না। তিন ভাইয়ের কাছ থেকে তিন লাখ করে নয় লাখ টাকা জোগাড় করো আপাতত। আর দেবে না কেন? বলবে তিন মাসের মধ্যে আমি ফেরত দিয়ে দেব।”
তিন ভাইয়ের কাছ থেকে ছয় লাখ টাকার মতো জোগাড় করতে পেরেছিলেন সেলিনা। অন্ধের মতো বিশ্বাস করে সেই টাকা তুলে দিয়েছিলেন স্বামীর হাতে। চোখে ছিল একটাই মাত্র অপেক্ষা, সুদিনের অপেক্ষা।
সেলিনার যত্নে গড়া বিশ্বাসের পাহাড় নিমিষেই ভেঙে চুরমার করে দেন আরমান। ছয় লাখ টাকা নিয়ে এক ভোর বেলা তিনি যে বেরিয়ে গেলেন, আর কোনোদিন ফিরে এলেন না। পরবর্তীতে খবর এলো তিনি অবস্থান করছেন অস্ট্রেলিয়াতে, তার দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে। বাংলাদেশে থাকতেই প্রথম স্ত্রীর অজ্ঞানে দ্বিতীয়বারের মতো বিয়ে করেছিলেন তিনি। আরমান সুদিনের স্বপ্ন ঠিকই দেখেছিলেন, তবে সেই স্বপ্নে ছিল না প্রথম পরিবারের কেউই।
আসফিয়া চোখের সামনে পুরুষ বলতে বাবাই দেখেছ। ভাই তখনো অনেক ছোট। তার বারবার মনে হতে থাকে পৃথিবীর সকল পুরুষ এতটাই খারাপ, এতটাই নিকৃষ্ট। সেই চিন্তাভাবনা থেকেই আসফিয়া এখনো বিয়ে করেনি। কখনো করবে বলেও মনে হয় না। আরশাদ সকল পুরুষকে বাবার মতো মনে করেনি। বরং নিজেকে বুঝিয়েছে, কোনো ক্রমেই বাবার মতো হওয়া যাবে না। এত শক্ত মনোবলের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও ভেজালে ভরপুর এই শৈশব গভীরভাবে নাড়িয়ে দেয় তাকে। আরশাদ ক্রমেই আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলতে শুরু করে। সবসময় তার মনে হতে থাকে, সে যেখানেই যাবে সাথে করে অশান্তি বয়ে নিয়ে যাবে।
ছেলেবেলার এই ট্রমা দীর্ঘদিন ভুগিয়েছে আরশাদকে। শেষ করে দিতে চেয়েছে তিলে তিলে, তবে পারেনি। এর আগেই তার আগমন ঘটে রূপালী পর্দার সোনালী জগতে। জীবনটা বদলে যেতে শুরু করে স্বপ্নের মতো করে। তবে শরীরের কোনো ক্ষত শুকানোর আগেই যদি দ্বিতীয়বার সেই একই জায়গায় ক্ষত এসে স্থান দখল করে, ব্যাথার তখন কোনো অবকাশই থাকে না।
মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো আরশাদ। প্রথম জীবনের যন্ত্রণাদায়ক স্মৃতিগুলো তার মস্তিষ্ক এখন আর সঙ্গে নিয়ে বয়ে বেড়ায় না। তবে দ্বিতীয় জীবনের যন্ত্রণাগুলোর জাত আলাদা। এরা গেঁথে রয়েছে মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষের সঙ্গে। এদের ভুলে যাওয়ার কোনো উপায় নেই।
দ্বিতীয় জীবনের ট্রমার সূচনা হয় ডিভোর্সের পর থেকে। তবে ডিভোর্সকে কেন্দ্র করে নয়। ওই বিচ্ছেদ নিয়ে আরশাদের মনে এক ফোঁটাও অনুশোচনা বা আক্ষেপ নেই। বরং যা আছে তা হলো গর্ব। এতটা গর্ব নিজের অঢেল সাফল্যের ওপরেও হয় না।
ঘটনা শুরু হয় আনুষ্ঠানিকভাবে ডিভোর্সের ঘোষণা করার পরপর। আগে থেকেই আরশাদ ঠিক করে রেখেছিল তাদের ডিভোর্সের প্রকৃত কারণ কেউ জানবে না। পত্র-পত্রিকার সাংবাদিকও না, ভক্তকূলও না। হুট করে কোনো কারণ ছাড়া ডিভোর্সের ঘোষণা আসায় ভক্তরা হয়ে গেল ক্ষুব্ধ।
অলিতে-গলিতে, চায়ের দোকানে শুধুমাত্র একটাই আলোচনা – কেন হলো আরশাদ-নওশীনের ডিভোর্স? তাদের মধ্যে কী ভালোবাসার কমতি ছিল? একেবারেই না। বরং নবদম্পতিদের কাছে তারা ছিল আদর্শের মতো।
ভক্তদের এই অসীম আগ্রহকে কেন্দ্র করে শুরু হলো গল্প লেখা। সাংবাদিকেরা প্রতিবেদন থেকে সরে এসো কাল্পনিক বেড়াজালে শব্দগুলোকে আবদ্ধ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কোনো কোনো গল্পে আরশাদের জীবনে আবির্ভাব ঘটেছে নতুন এক নারীর। যে নারী আরশাদের মনে জায়গা দখল করে সুকৌশলে সরিয়ে দিয়েছে তার স্ত্রীকে নওশীনকে। কোনো কোনো গল্পে সকল দোষ নওশীনের। সে না-কি এক বড়লোক ব্যবসায়ীর প্রেমে পড়ে আরশাদকে ডিভোর্স দিয়েছে।
হাজারো কাল্পনিক গল্পের ভীড়ে কোনটা সত্যি তা কেউ জানে না। আরশাদ চাইলেই পারতো গণমাধ্যমে এসে নওশীনের নামে একগাদা বাজে কথা বলতে। ডিভোর্স মানেই তো কাদা ছোড়াছুড়ির প্রতিযোগিতা। ভক্তকূল এতে দারুণ বিনোদন পেলেও একটা সময় সেই লেখাগুলো গিয়ে পড়তো কথার চোখে। মাকে সকলের সামনে হেও করার জন্যে কথা কি কোনদিনও পারতো বাবাকে ক্ষমা করতে? পারতো না, যেমন আরশাদ পারেনি তার বাবাকে ক্ষমা করতে।
মেয়ের অকারণ ঘৃণা থেকে বাঁচতে মুখে কুলুপ এঁটে থেকে লাভটা হলো কোথায়? বড় হয়ে কী দেখবে কথা? তার বাবাকে দোষী করে লেখা হাজারখানেক কাল্পনিক গল্প। কথাও হয়তো দিনশেষে অন্যান্য সকলের মতো বিশ্বাস করে নেবে বাবার চরিত্রহীনতার কারণেই তার জীবনে আদর্শ সুখী পরিবারের এত অভাব।
আর বেশি কিছু ভাবতে পারলো না আরশাদ। মাথাটা ধরে আসছে। আর বেশিক্ষণ এসব চিন্তা করলেই শুরু হয়ে যাবে তীব্র মাথাব্যাথা। মনটাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিতেই টিভির সামনে বসলো আরশাদ। বহুদিন টিভি দেখা হয় না। গভীর রাতে তেমন কোনো ভালো প্রোগ্রাম থাকে না। বেশির ভাগ চ্যানেল জুড়ে বিজ্ঞাপন আর দিনে দেখানো অনুষ্ঠানের পুনঃপ্রচার।
বেশ অনেকটা সময় জুড়ে চ্যানেল ঘোরাচ্ছে আরশাদ। সে জানে এই সময়ে দেখার মতো কিছুই পাবে না, তবুও সময় কাটানোর জন্যে চ্যানেল ঘোরানো। হঠাৎ একটা চ্যানেলের ওপর স্থির হয়ে রইল তার চোখদুটো।
পুনঃপ্রচার করা হচ্ছে নওশীনের এক ইন্টারভিউ। নওশীনের চেহারা দেখারও বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার নেই। তবুও থেমেছে ইন্টারভিউতে নিজের নামটা শুনে।
উপস্থাপিকা কৌতূহলের সঙ্গে নওশীনকে জিজ্ঞেস করলো, “আপনার এবং আরশাদ হকের মধ্যকার বর্তমান সম্পর্ক কেমন?”
নওশীন হাসিমুখে বলল, “আমি আরশাদকে রেসপেক্ট করি। একজন ভালো মানুষ হিসেবে, আমার কো-অ্যাক্টর হিসেবে আর অবশ্যই আমার সন্তানের বাবা হিসেবে।”
“আরশাদও কি একই কথা বলবেন?”
“সেটা তো আরশাদই ভালো বলতে পারবে। আমি সবসময় চেয়েছি আমাদের মধ্যে স্বাভাবিক একটা সম্পর্ক রাখতে। ইভেন এখনো চাই। আমি চাই না, আমার মেয়ে বাবা-মায়ের তিক্ত সম্পর্ক দেখে বড় হোক। ডিভোর্স হয়েছে তো কী হয়েছে? ডিভোর্সের পেছনে তো অনেক কারণ থাকে। তাই বলে কী ডিভোর্সের পর মানুষটার সঙ্গে সম্মান দিয়ে কথা বলা যাবে না?”
উপস্থাপিকা বাড়তি আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার আর আরশাদ হকের কি ভবিষ্যতে এক হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে?”
নওশীনের উত্তরটা আর শোনা গেল না। তার আগেই আরশাদের সমানে থাকা কাঁচের আস্ট্রে এসে আঁচড়ে পড়লো টিভির ওপর। ঝনঝন শব্দ করে ভেঙে পড়লো দেওয়ালের সঙ্গে ঝুলন্ত টিভিটা।
রাগ ক্রমেই বাড়তে শুরু করেছে আরশাদের মাঝে। রাগে তার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। কানের দুপাশ দিয়ে যেন বাষ্প বের হচ্ছে। যেদিকে আরশাদ তাকাচ্ছে, সেদিকেই অগ্নি ঝরে পড়ছে।
পকেট থেকে ফোনটা বের করলো আরশাদ। ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তে ফোনটাকেও আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেলতে। তবুও বহুকষ্টে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে ডায়াল করলো নওশীনের নম্বর। এই মানুষটার সঙ্গে সে এ জীবনেও কথা বলতে চায় না। তবুও বারবার পরিস্থিতি নওশীনের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়ে দেয় তাকে।
দুটো রিং বাজার সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা রিসিভ হলো। নওশীনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আরশাদ ক্রুদ্ধ গলায় বলল, “সমস্যা কী তোমার? বলেছি না ইন্টারভিউতে আমার ব্যাপারে কোনো কথা বলবে না? তাও বারবার আমার টপিক নিয়েই পড়ে থাক কেন?”
অপরপ্রান্ত থেকে নওশীন কাতর স্বরে বলল, “শাদ আমার কথাটা শোনো…”
আরশাদ হুংকার দিয়ে বলল, “Don’t you dare to call me that!”
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে নওশীন শান্ত স্বরে বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে, ডাকবো না। আমার কথাটা একবার শোনো। আমি তোমার ব্যাপারে কথা বলতে চাইনি। ওরা জিজ্ঞেস করলে আমার কী-ই বা করার আছে? আমি তো আর তোমার মতো সিন ক্রিয়েট করতে পারি না।”
“আমি সিন ক্রিয়েট করছি না। পরিষ্কার বলে দিয়েছি তুমি আমাকে নিয়ে ইন্টারভিউতে কোনো কথা বলবে না, তার মানে বলবে না।”
“তুমি শুধু শুধু রেগে যাচ্ছো। নিজেকেই একবার জিজ্ঞেস করে দেখো, আমি কি ভুল কিছু বলেছি? ডিভোর্স হয়ে গেছে তো কী হয়েছে? আমি কি সামান্যতম সম্মান পেতে পারি না তোমার কাছ থেকে। তোমার বাচ্চার মা আমি।”
আরশাদ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “নাটক না? নাটক করছো তুমি সবার সামনে? তোমার এসব নাটক খুব ভালো করে জানা আছে আমার। ভাবছো এভাবে বাচ্চার দোহাই দিয়ে ভিকটিম কার্ড প্লে করলে মানুষের সিম্প্যাথি পাবে? ভুলে যেও না আমি একবার চাইলেই তোমার আসল চেহারাটা সবাই দেখে ফেলবে।”
“আমার কোনো আসল-নকল চেহারা নেই। সবাই যা দেখে তাই আমার আসল চেহারা। তোমার মতো দুই চেহারার মানুষ আমি নই। মনে নেই বিয়ের দিন কী বলেছিলে আমাকে? বলেছিলে যত যাই হয়ে যাক না কেন, সবসময় পাশে থাকবে আমার। তাহলে শেষ পর্যন্ত থাকলে না কেন আমার পাশে?”
“লজ্জা করে না তোমার? কোন মুখে বড় বড় কথা বলছো তুমি? আমি দুই চেহারার মানুষ? নিজের দোষ আড়াল করার জন্যেই তো আমাকে দুই চেহারার মানুষ বানিয়ে রেখেছো।”
“আমার কোনো দোষ ছিল না…”
নওশীনকে থামিয়ে দিয়ে আরশাদ বিরক্ত গলায় বলল, “তোমার সাথে কথা বলতে আমার রুচিতে বাঁধছে। ভালো ভাবে বলছি ফারদার আমাকে নিয়ে ইন্টারভিউতে কোনো কথা বলবে না। আমার নাম ব্যবহার করে ফেম পাওয়ার অভ্যাসটা এবার বন্ধ করো।”
(চলবে)
[কিছু কিছু পাঠক প্রশ্ন করেন, “আপু গল্পের নায়িকা কে?” তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, লেখক-লেখিকারা প্রথম পর্ব থেকে নায়ক-নায়িকাদেরকেই বেশি ফোকাস করে। আমিও তাই করে আসছি। এই গল্পের প্রথম নয়টা পর্বের বেশির ভাগ অংশ অরার দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা। আজকেই হয়তো অরাকে ছাড়া প্রথম পর্ব লিখেছি। ওকেই বলবো গল্পের প্রধান চরিত্র। আমি এখনো লেখিকা হয়ে উঠতে পারিনি, পাঠিকা হয়ে শিখে শিখে লিখছি। ভুল-ক্রটি হলে ছোট বোন হিসেবে ক্ষমা করে দিবেন। আর আগামীকাল আমার এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দিবে, সবাই দোয়া করবেন আমার জন্যে।]