ফানাহ্ 🖤 #পর্বসংখ্যা_৩৭ #হুমাইরা_হাসান

1
1057

#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৩৭
#হুমাইরা_হাসান

স্নিগ্ধ চেহারা, খিলখিল হাসি, মাধুর্যময়ী চেহারা, আর তাতে ছলকে পড়া আনন্দ লজ্জামিশ্রিত হাসিমাখা মুখটা চোখের সামনে বারংবার ভেসে উঠছে মোহরের, বাবা-মা হীনা আশ্রমে বড়ো হওয়া মেয়েটা বড়ো হওয়ার পর মোহর বাদে একটা মানুষকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করেছিলো শ্রীতমা। সেই মানুষটাকেও ভুল হতে হলো! প্রথমবারের মতো যাকে ঘিরে স্বপ্ন দেখতে লাগলো যাকে নিজের সর্বস্বটুকু ঢেলে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসলো সেই কি না এতো বড়ো বিশ্বাসঘাতকতা করলো! এতো বাজে ভাবে ঠকালো! একটা বহুরূপী! এতো বড়ো ধাক্কা টা কি করে সামলাবে শ্রীতমা,মেয়েটা যে ভীষণ নরম, দূর্বল স্বভাবের। যে মেয়ে মোহরের একটু কিছু না হতেই কেঁদে ভাসিয়ে দেয় সে কি করে এতো বড়ো আঘাতটা সহ্য করবে!

ভাবতেই মোহরের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। রক্তের বাইরে কারো সাথে যদি রক্তের মতোই টান থাকে সে হলো শ্রীতমা।জন্ম দুটো গর্ভের হলেও বোন ও মোহরের। ওর এতটুকু কষ্ট যে মোহরের সহ্য হচ্ছে নাহ। নিজের উপরেই সবচেয়ে বড়ো ক্ষুব্ধতা টা এসে পড়ছে, ও কেনো আটকালো না আগে থেকেই। কেনো বাড়তে দিলো সম্পর্কের বাঁধন। সেদিন অরুণের বার্থডে উপলক্ষে মলে নিয়ে গেছিলো শ্রীতমা সেদিনই ও অরুণকে দূর থেকে আসতে দেখে ইচ্ছে করেই চলে এসেছিলো। তাথই এর স্বামী আর শ্রীতমার প্রেমিকের জন্মদিন একইদিনে কি করে হতে পারে! এটা যদিও খুব জোর খাটিয়ে মনকে বুঝিয়েছিলো ঠিক তখনই মলে অরুণ কে আসতে দেখে হুট করেই মোহরের মাথায় একটা কথা তরঙ্গের ন্যায় ত্বরান্বিত হয়ে ওঠে, তাথই এর মেয়ে তোয়ার চেহারা আর অরুণের চেহারা হুবহু একই রকম, যেনো কার্বন কপি। দুজনেরই একই রকম থুতনির মাঝখানের ভাগ চিহ্নটা আরও কড়াভাবে সন্দেহের বীজ বুনে দেয় মোহরের মনে।
খুব সাবধানে,সংগোপনে, নীরবে তল্লাশি চালিয়ে যেতে থাকে মনে মনে। সাঞ্জের কাছ থেকে অরুণের ব্যাপারে সবটা শুনলেই নাম দুটো আর ধর্ম নিয়েই দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছিলো। অবশেষে সকল উৎকণ্ঠা, জহুরি তালাশের অবসান ঘটিয়ে দিলো পার্টির দিন। অরুণের চেহারাটা মোহরকে বুঝিয়ে দিলো একটা মানুষ কতটা ঠক, বহুরূপী হতে পারে। কতটা নিচে নামতে পারে।

কাঁধের উপরে একটা হাতের প্রগাঢ় স্পর্শের উপস্তিতির অনুভূতি পেয়ে চোখ দুটি বুজে নিলো মোহর। হাতটার মালিক মোহরের একদম সামনা-সামনি বসে ওর থুতনিতে হাত রেখে মুখটা তুলে নিজের চোখের সামনে লম্বদূরত্বে রাখলো, ধীমি গলায় বলল

– মন খারাপ মোহ?

প্রচন্ড মায়াভরা গলায় ডাকটা কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারলো নাহ। চোখ দু’টো সটান করলে মেহরাজের স্নিগ্ধ শুকনো মুখের চাহনিটায় নজর আঁটকালো। এ চোখে না আছে কোনো অভিযোগ নাইবা অসন্তুষ্টি,, এক সমুদ্র প্রেম দেখতে পাই মোহর। এ কথা কোন ভাষায় ব্যাখা করা যাবে! মোহর যতবার মেহরাজের চোখ দুটিতে তাকায় যেনো এক জীবন স্নেহ,পরশের আশ্রয়াস্থল দেখতে পাই, যে চোখ ওকে ক্ষণে ক্ষণে মনে করিয়ে দেয় সে আছে পাশে,যতো যাই হোক।

– আপনিও কি আমায় ভুল বুঝছেন রুদ্ধ? চাচীর মতো কি আপনিও মনে করছেন আমি ইচ্ছে করে সবটা লুকিয়েছি কারণ অরুণ আমার বান্ধবীর সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে, আপনিও কি এটাই ভাবেন যে নিজের বান্ধবীকে বড়োলোক ছেলের ঘাড়ে চাপাতে আমি ষড়যন্ত্র করে তাথই আপার ঘর ভেঙেছি? আপনিও কি…

বাকিটা শেষ করার আগেই অস্থিরভাবে কম্পমান ঠোঁট দুটো একটা দৃঢ় আঙুলের চাপে থমকে গেলো। ধরা গলায় বলা কথাগুলো পুরোপুরি শেষ করতে পারলো নাহ। মেহরাক নিজের তর্জনীটা মোহরের ঠোঁটে চেপে রেখেই ভীষণ নরম গলায় বলল

– শুধু একজন কেনো, পুরো দুনিয়াটাও যদি আপনার ব্যাপারে অভিযোগ আনে তবুও আমি আপনাকেই বিশ্বাস করি আমি। কারণ আমি জানি আমার মোহ, আমার অদ্বিতীয়া কখনো ভুল করবে না।

ঠোঁটের উপর চেপে রাখা মেহরাজের হাতটা মোহর নিজের হাতের মুঠোয় ঝাপটে ধরে বলল

– আপনি এভাবেই আমায় সারাজীবন বিশ্বাস করবেন তো? আমায় ঠকাবেন না তো রুদ্ধ?

মেহরাজ নিশ্চুপ, অনড় চোখে তাকিয়ে রইলো মোহরের মুখের দিকে আচমকাই মোহরকে এক টানে বুকের মাঝে এনে ফেললো, দুটি হাতে সজোরে পাজরের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বলল

– রুদ্ধ শুধুমাত্র তার মোহের জন্যেই, তাকে ছাড়া,তাকে ছেড়ে কোথায় যাবে বলুন। আপনার দু চোখে আমি নিজেকে খুঁজে পাই,নিজের আয়নাকে কেও ঠকাতে পারে বলুন!

মেহরাজের নিয়মমাফিক এই ছোট্ট আদর, একটু সহানুভূতি, আর এক বুক সিদ্ধিময় কথাগুলো মোহরের অন্তরে প্রশান্তি ঢেলে দেয়। বুক থেকে মাথা তুলে তাকালে মেহরাজ দুহাতে মোহরের গাল বয়ে গড়িয়ে পরা অশ্রুবিন্দু মুছিয়ে দিলো।মোহর দাবা গলায় বলল

– শ্রীতমার হয়তো আমাকে ভুল বুঝবে, কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি যা করেছি ওর ভালোর জন্যেই করেছি, যেই মানুষটা ওকে দিনের পর দিন ঠকাচ্ছিলো তাকে আমি কি করে ওর জীবনে থাকতে দেই বলুন

– আপনি যা করেছেন একদম ঠিক করেছেন মোহ। আর তাই করা উচিত। আমি যতদূর জানি শ্রীতমা আপনাকে খুব ভালোবাসে, আর যারা ভালোবাসে তাদের মান অভিমান হয় একটু,কিন্তু ভুল বোঝে না।

মোহর তবুও শান্ত করতে পারলো না নিজেকে। তখন শ্রীতমার পিছু পিছু বেরোলেও বেশি দূর যেতে পারেনি। গাড়ির গেট পর্যন্ত গিয়েই আঁটকে গেছিল। ততক্ষণে শ্রীতমা চক্ষুর অগোচরে পালিয়ে গেছে। এদিক ওদিক খুঁজেও পাইনি। বাড়ির এই অসমীচীন পরিস্থিতি ছেড়ে বাইরে যাওয়া টা বিঁবেকহীনের মতো ঠেকেছিলো ওর কাছে৷ তাই উপায়ন্তর না পেয়ে ঘরে ফিরে এসেছে। এখন বেশ বুঝতে পারছে শ্রীকে একা ছাড়া মোটেই উচিত হয়নি।
মোহর নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সরে এলো, দুপুর গড়িয়েছে অথচ শ্রীয়ের সাথে কথা হয়নি। ফোনটা বারবারই সুইচড অফ দেখাচ্ছে।
খাট থেকে নেমে এগিয়ে এসে ফোনটা হাতে ধরলেই বিকট শব্দে কেঁপে ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করা নামটা দেখে ঠোঁটের কোণে আলতো হাসি ফুটে উঠলো মোহরের। উদ্বিগ্নতার সাথে ফোনটা ধরে কানে ধরলেও অপরপাশের অপরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে হাসিটুকু নিমিষেই হারিয়ে গেলো। কান থেকে ফোনটা নামিয়ে আবারও স্ক্রিনে তাকালো। এটা তো শ্রীতমারই নাম্বার, তাহলে..

– হ্যালো শুনতে পাচ্ছেন?

অপরপক্ষের ব্যস্ত গলাতে ভ্রম ছুটে যায় মোহরের, কানে ধরে বলল

– জ্বী?

– আমি যেই নম্বর থেকে ফোন করেছি সে আপনার কি হয়? আপনার পরিচিত হলে এক্ষুনি সিটি হসপিটালে চলে আসুন প্লিজ উনার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।

বলে উত্তরের অপেক্ষা না করেই খট করে লাইনচ্যুত করলো কলটা। অনাকাঙ্ক্ষিত বার্তাটির মর্মার্থ বুঝতে মুহূর্ত কয়েক লেগে গেলো মোহরের, অ্যাক্সিডেন্ট! শ্রীতমার! মানে! উদ্ভ্রান্তের মতো আরও কয়েকবার ফোন করলো কিন্তু কিছুতেই আর যোগাযোগ করা সম্ভবপর হয়ে উঠলো নাহ মোহরের বিচলিত, শ্বাসরুদ্ধকর চেহারাটা দেখে মেহরাজ এগিয়ে এসে বলল

– কি হয়েছে মোহ? সব ঠিক আছে?

– অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে রুদ্ধ। শ্রী…শ্রী ও ওর অ্যাক্সি..

বাকিটা বলার চেষ্টা করেও ভীষণ করুণ ভাবে ব্যর্থ হলো মোহর। কান্নার হিড়কে কথাগুলো দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। টলটলে অশ্রুপূর্ণ চোখে মেহরাজকে ধরে অস্থির গলায় বলল

– আমাকে নিয়ে চলুন মেহরাজ, আমাকে এক্ষুনি শ্রী এর কাছে নিয়ে চলুন

.

হসপিটালের করিডরে পায়চারি করছে মেহরাজ, চেহারায় আতঙ্কের ছাপ না থাকলেও স্পষ্ট চিন্তার কালো মেঘ জড়ো হয়েছে। আর চিন্তার অধিকাংশই মোহরকে ঘিরে। শ্রীতমার অ্যাক্সিডেন্টের কথা শোনার পর থেকেই কেঁদে যাচ্ছে মেয়েটা, মেহরাজ কতশত কথা বলেও থামাতে পারেনি এক মুহুর্তের জন্য। বাঁ হাতের কালো ইলেকট্রনিক ডিভাইস টাতে টিপটিপ আলো জ্বলে সময়টা জানান দিলো বিকেল চারটা বেজে তিন মিনিট৷ সারাটা দিন না খেয়ে মোহরের চোখ মুখ শুকিয়ে আছে যা নিজ চোখে দেখা টা নিজের ওপরেই অত্যাচার স্বরুপ মনে হচ্ছে মেহরাজের। পায়চারি থামিয়ে এগিয়ে গিয়ে বসলো মোহরের সামনে, ওর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় আগলে নিয়ে মুখটা ঝুকিয়ে নিয়ে বলল

– আপনি যাবেন না ওকে দেখতে?

– আমি ওকে ওই অবস্থায় কি করে দেখবো, আমি পারবো না। আমার জন্যেই ওর আজ এই অবস্থা

বলেই ফুঁপিয়ে উঠলো। মেহরাজ ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ক্লান্ত চোখে তাকালো বিবিজানের পানে। কি অদ্ভুত মেয়েটা! এতদূর অস্থির হয়ে ছুটে এলো,অথচ হসপিটালে এসে যখন জানতে পারলো শ্রীতমার খুব একটা ক্ষতি হয়নি এখন আগের তুলনায় ভালো আছে ওমনিই বাচ্চাদের মতো জেদ ধরে বসে রইলো। এতদূর পারি দিয়ে আসলো অথচ সামনে গিয়ে দাঁড়াতে ভয় পাচ্ছে।
মেহরাজ শুকনো ঠোঁট এলিয়ে মৃদু হাসলো, ধীমি গলায় বলল

– আমি হসপিটালের বেডে শুয়ে থাকলেও কি আপনি এভাবে বাইরে বসে কাঁদবেন মোহ? তাহলে কিন্তু এক যুগ পার হয়ে গেলেও আমি সুস্থ হতে পারবো না, যতক্ষণ না বিবিজান এসে তার নরম হাত দুটো আমার ক্ষতস্থানে ছুঁয়ে দেয়।

এইরকম মুহুর্তেও মেহরাজের এই কৌতুকপূর্ণ কথাটা বলা খুব দরকার ছিলো? মোহর টলমল চোখে তাকিয়ে কান্নামিশ্রিত কণ্ঠে বলল

– আপনি কেনো হসপিটালের বেডে শুয়ে থাকবেন বলুন

কান্না থামাতে গিয়ে বরং আরও বাড়িয়ে দিলো মেহরাজ। হেরে যাওয়ার ন্যায় ফোঁস করে দম ছাড়লো। মোহরের হাত ধরে দাঁড় করিয়ে বলল

– আপনি যদি এভাবেই আমাকে ক্ষত বিক্ষত করতে থাকেন তাহলে আইসিইউ তে চলে যেতে দেরী হবে নাহ

মোহরের প্রশ্নবোধক চাহনিতে নজর দিলো না মেহরাজ, ওর হাতটা চেপে ধরে কেবিনের নব মুচড়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই এক জোড়া উৎসুক চাহনি ধাতস্থ হয়ে দাঁড়ালো। মোহর এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো শ্রীতমার সিঁথানের কাছে। চেয়ার টেনে নিয়ে নিঃশব্দে বসলো চোখ বুজে পরে থাকা অসাড় শরীর টার দিকে।

– সব কিছু ঠিকঠাক আছে অভি?

অভিমন্যু ঘনঘন মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। মেহরাজ আড়চোখের তীক্ষ্ণ চাহনিতে তাকালো অভিমন্যুর দিকে, বসের এরূপ চাহনির মর্মার্থ ঠাওর করে অভিমন্যু ভীত গলায় অস্থিরভাবে বলল

– স্যার আমি স্পীড এ্যাভারেজে রেখেছিলাম। উনি হুট করেই ওয়ান বাই ওয়ান সাইড ক্রস করে রাস্তার মাঝখানে এসে পড়েছিল। আমি সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি তবুও ভিক্টিমের চেয়ে মিটার খানেক দূরত্ব থেকে এস্কেলেটরে চাপ দিয়ে আর কতটুকুই বা নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।

নিজের হয়ে সাফাই গেয়ে নিজেই শান্ত হতে পারলো না হয়তো। মুখটা কেমন চুপসে বিব্রতি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো মাথা ঝুকিয়ে।
হুট করে এমন রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলো অভিমন্যু। যথাসাধ্য চেষ্টা করেও শ্রীতমার ধাক্কা লেগেছে ফ্রন্টে। ওই তুলে এনেছে হসপিটালে। প্রথমে কাওকে ইনফর্ম করার ব্যাপারটা মাথায় আসেনি অস্থিরতায়। যতটা অস্থিরতা আর উৎকণ্ঠিত ভীত হয়েছিলো উপরওয়ালার নাম জপে জপে ওইটুকু প্রশান্তি পেয়েছে যে মেয়েটার ক্ষতি হয়নি খুব একটা। না তো যদি কেস ঠুকে দিতো ওর নামে, পাক্কা সাতদিন হাজতের ভাত গিলতে হতো।

– তুমি এমন চেহারা কেনো করে রেখেছো যেনো মানুষ খু’ন করে ফেলেছো

মেহরাজের কথায় ধ্যান ভাংতেই অপ্রতিভ দৃষ্টিতে তাকালো অভিমন্যু। থেকে থেকেই কিসব গম্ভীর ধ্যানে ডুবে যাচ্ছে ও সেটা শুরু থেকেই লক্ষ্য করে যাচ্ছে মেহরাজ। ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে ক্রুর ভাবে। অভিমন্যু মেহরাজের এহেন তির্যক চাহনিতে বিব্রত হয়ে বলল

– হ্যাঁ? মানে? খু’ন! না না। আমি আমি কিভাবে। আমি কোনো খু’ন করিনি স্যার।

মেহরাজ প্রচন্ড রকম বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে রইলো অভিমন্যুর দিকে। অভি আগামাথা না বুঝেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো এক কোণায়।

– এমন চো’রের মতো মুখ করছো কেনো তুমি? কি হয়েছে সত্যি করে বলো তো!

মেহরাজের প্রশ্নটা চাইলেও এড়িয়ে যেতে পারলো না অভি, আমতা-আমতা করে ভীষণ নিচু গলায় বলল

– এই মেয়েটার সাথেই সেদিন ধাক্কা লেগে কেক পরে গেছিলো। এখন যদি জ্ঞান ফিরে আবারও ধাক্কা দেওয়ার দোষে চেঁচামেচি শুরু করে? আই সুয়্যার স্যার আমি ইচ্ছে করে কিছু করিনি এইবার ও ও নিজেই এসেছিলো আমার সামনে।

মেহরাজ এগিয়ে এসে কিছু বলতে গেলেও দরজার দিকে তাকিয়ে থেমে গেলো। একজন নার্স এলো শ্রীতমার চেকাপের জন্য। হাতে লাগানো স্যালাইনের নলটা খুলে দিলো, মোহর চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো

– ওর রিপোর্ট এসেছে? দেখি?

নার্সের থেকে হাত বাড়িয়ে রিপোর্ট টা হাতে নিলো। শ্রীতমার শরীরের অবস্থা খুব একটা খারাপ না, শুধু পায়ে আর কপালে একটু চোট লেগেছে। প্রেসার টা হুট করেই ফল করার কারণে পানিশূন্যতা রোধে স্যালাইন দেওয়া হলেও শরীরে বেশ কিছু ইমব্যালান্স তৈরি হয়েছে। মোহর রিপোর্ট টা ভালো মতো দেখে নার্সের হাতে দিলো। আপাতত রেস্ট ছাড়া অন্য কোনো সিরিয়াস ইস্যু নেই।

সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত মোহর ওভাবেই বসে রইল শ্রীতমার সিঁথানের কাছটাতে। মাথার ক্ষতটা ছোট হলেও পায়ের কাছটাতে ভালো মতই জখম হয়েছে, ব্যথার ওষুধের সাথে কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ দিয়ে রাখায় ও গভীর তন্দ্রাচ্ছন্ন।
ওকে রেখে আসতে ইচ্ছেও করছিলো না, কিন্তু সারা রাত থাকাও সম্ভব না। মেহরাজ অথোরিটিকে বলে একটা নার্স আজকে সারারাত টার জন্যে এ্যাপোয়েন্ট করেছে শ্রীতমার জন্যে। তবুও মোহরের মনের খুসখুস কমছে না। হসপিটাল থেকে বের হওয়ার সময় অভিমন্যুর সামনে দাঁড়িয়ে মোহর বলল

– তোমাকে কি বলে ধন্যবাদ বললে যথাযথ হবে আমার জানা নেই, আজ তুমি না থাকলে শ্রীতমার অনেক বড়ো কিছু হয়ে যেতে পারতো।আমি কৃতজ্ঞ থাকবো তোমার কাছে।

প্রত্যুত্তরে অভিমন্যু অপ্রস্তুত হেসে মাথা নাড়ালো বার দুয়েক। মোহর সামনের দিকে হাঁটা ধরলে মেহরাজ অভিমন্যুর কাছে এসে চাপা স্বরে বলল

– বেশি মাথা নাড়ানোর দরকার নেই, ম্যাডাম যদি জানতে পারে তার বান্ধবীকে তুমি নিজেই ধাক্কা দিয়ে হসপিটাল এনেছো তাহলে মাথা টা ধর থেকে একদম আ’লাদা করে ফেলবে।

অভিমন্যুর শঙ্কিত নজরকে অগ্রাহ্য করে মেহরাজ কথাটুকু বলেই গটগট করে বেড়িয়ে গেলো।

___________________________

নির্জন, নিস্তব্ধ রাতে ঘড়ির টিকটিক শব্দটা খুব স্পষ্ট ভাবে কানের পর্দা অব্দি পৌঁছাচ্ছে। বারান্দা পেরিয়ে রূপালী আলোটা হামাগুড়ি দিয়ে ঘরে এসে উপচে পড়েছে। বিছানায় নিঃশব্দে পড়ে আছে মোহর। ধপ করে ল্যাপটপের সাটার নামিয়ে দিলো মেহরাজ। রাতের প্রথম অচিরেই বাড়ছে, নিস্তব্ধতার খেলায় মেতে উঠেছে ঝিঁঝি পোকার ডাক। আধো অন্ধকারেও সুপ্রসারিত নয়ন মেলে তাকালো বিছানায় নিশ্চুপ শুয়ে থাকা মোহরের পানে। কোল থেকে ল্যাপটপ টা নামিয়ে উঠে দাঁড়ালো। রোমন্থন পা ফেলে এগিয়ে এলো বিছানার কাছে, শরীর টা ঝুকিয়ে এনে ধীর গলায় ডাকলো

– মোহ?

অকস্মাৎ ডাকে ধপ করে চোখ খুলে তাকালো মোহর। এক ঘন্টা ধরে বিছানায় শুয়ে থেকেও ঘুম আসছিলো নাহ। কিন্তু শব্দহীনায় পড়ে ছিলো অসাড় হয়ে। চোখ খুলেই হালকা আলোতে স্পষ্ট মেহরাজের শুভ্র চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। ঝুকে এগিয়ে আছে মোহরের দিকে, মোহরের নিরুত্তরতা কে উৎসাহ না নিয়ে মেহরাজ নরম গলায় বলল

– বারান্দায় যাবেন মোহ?

মোহর মুহূর্ত খানেক নিশ্চল হয়ে তাকিয়ে থেকে উঠে বসলো। এমনিতেও তো ঘুম আসছিলো না, লোকটা কি করে বুঝলো তা ওর জানা নেই। কিন্তু এই সময়টাতে বারান্দায় বসলে মন্দ হয়না। মেহরাজ হার হামেশার ন্যায় বউয়ের আঙুলের ভাজটায় নিজের আঙ্গুক অবলীলায় মিশিয়ে নিলো, বারান্দায় গিয়ে মোহরকে ডিভানে বসিয়ে দিয়ে নিজেও পাশে বসলো। ঘরের লাইট নেভানো। বারান্দাতেও লাইটের বিন্দুমাত্র অস্তিত্ব নেই। কৃত্রিমতাকে ছাড়িয়ে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক আলোটা মনের ভেতরের সুপ্ত সৌন্দর্য গুলোকেও উপচে দিচ্ছে যেনো। রূপালী আলোয় স্নান করে সবুজ গাছ গাছালিতে অন্যরকম ঝিলিক ধরেছে। চারিপাশে ফুলের গন্ধে মো মো করছে। বুক ভরে নিঃশ্বাস টেনে নিলো মোহর, এই মুহূর্তে ঠিক এইটার ই প্রয়োজন ছিলো হয়তো, ভেতরটায় ভীষণ হালকা লাগছে, মেহরাজ খানিক নীরবতা পালন করে বলল

– আপনি এখনো আপসেট মোহ?

মোহর ডায়ে বাঁয়ে মাথা নাড়িয়ে না বলল। মেহরাজ খানিক স্তব্ধ চেয়ে থেকে বলল

– সত্যি?

– জ্বী

প্রসারিত নয়নে তাকালো রূপালী আলোতে ফুলের চেয়ে বেশি দৃষ্টিকার্ষিত কালচে টি-শার্ট জড়ানো শুভ্র পুরুষের দিকে। ইদানীং মোহরের মনটা ভীষণ বেপরোয়া, বেহারা হয়ে গেছে। হুটহাট এই মানুষ টাকে ছুঁয়ে দিতে মন চাই, প্রশস্ত বুকটাতে মাথা রেখে মিষ্টি ঘ্রাণ টা বুক ভরে শুষে নিতে ইচ্ছে করে। এই যে এখন যেমন খুব করে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে, খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে আবৃত গালটাতে ওর নরম হাতটা রেখে বলতে ইচ্ছে করে

– আপনি এ কোন মায়ায় জড়াচ্ছেন আমায়, নিজের সাথে নিজেই অষ্টপ্রহর কো কানামাছি খেলায় মত্ত হয়েছি,চোখে কাপড় বেঁধে জেতার নাম করে আপনাকে ছুঁয়ে দেওয়ার প্রবল ষড়যন্ত্রে মেতেছে আমারই চিত্ত। আপনাকে ভালোবাসতে চাওয়ার এতগুলো কারণের মাঝে একটা কারণ দেখিয়ে দিন যাতে ভালো না বাসি, আর কতটা দূর্বল হবো আমি বলুন তো, আপনি ছাড়া তো আমার ঘুমটাও ধরা দিচ্ছে না

– মোহ?

মোহরের নিস্তব্ধতায় বুকের মাঝে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা আন্দোলন গুলোকে এক শব্দে দমিয়ে দিলো মেহরাজের বাক্যটুকু। আবছা আলোতেও যেনো ওর চোখের নেশাটা পরিপূর্ণ ভাবে আচ্ছন্ন করছে মোহরকে। যেনো মোহরের ভেতরটা পড়ে ফেললো মেহরাজ, আরেকটু কাছে সরে এলো মোহরের, নিকষ আচ্ছদিত রাতে মেহরাজের মুখ হতে নিঃসৃত হলো একটা আস্তো ভালোবাসা

– জড়িয়ে ধরবেন মোহ?
.
.
.
চলমান

#হীডিংঃ রিচেইক করা হয়নি, শব্দের ভুল থাকলে মার্জনা স্বরূপ দেখবেন।

©Humu_❤️

1 COMMENT

  1. এই গল্প টা এতো প্রিয় হয়ে উঠেছে তাই অন্য গল্প পড়তে ইচ্ছে হয় না.. গল্প tar জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকি.. লেখিকা কে অনেক ধন্যবাদ এতো সুন্দর গল্প দেয়ার জন্য.. পরের পর্ব গুলো তাড়াতাড়ি দেবেন আশা করছি নিরাশ করবেন না

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here