ফিরে_আসা ১১ লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

0
486

#ফিরে_আসা
১১
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ নিয়ে টিভির সামনে বসলো নওশীন। তার সকালটা কেটে যায় সংবাদ দেখতে দেখতে। এ বাড়িতে সর্বক্ষণ আলো-বাতাস খেলা করে বেড়ায়। তবুও যেন আজ মনে হচ্ছে বিচিত্র এক অন্ধকারে ছেয়ে আছে পুরো বাড়ি। এর প্রধান কারণ কথার অনুপস্থিতি। দুদিন হলো বাবার সঙ্গে ছুটি কাটাতে গেছে যুক্তরাষ্ট্রে গেছে কথা। তাকে ছাড়া নওশীনের সবকিছুই নিষ্প্রাণ, সে নিজেও তো প্রাণহীন।

মনোযোগটা আবারও টিভির দিকে ফিরিয়ে নিলো নওশীন। টিভি স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে আজকের শীর্ষ সংবাদ। রাজধানীতে অবাধে চলছে মাদক বেচা-কেনা ও মাদক সেবন। দিনের আলোয় নির্ভয়ে মাদক সেবন করছে রাস্তার ভাসমান মানুষেরা। পুলিশ বাহিনী এসব মাদক সেবীদের বিরুদ্ধে তৎপর হতে শুরু করেছে। নওশীনের গা বেয়ে শীতল হাওয়া বয়ে গেল। এই মাদক জিনিসটা যে কতটা ভয়ঙ্কর, সে তা জানে। একটা মানুষের জীবনকে ধ্বংসের মুখোমুখি এনে দাঁড় করানোর জন্যে অতি ক্ষুদ্র এই জিনিসই যথেষ্ট।

অতীতে…

রাত একটা দশ, কুয়াশার চাদরে ঢেকে আছে চারপাশ। শীতটা এবার একটু বেশিই অনুভূত হচ্ছে। প্রচন্ড শীতে আরশাদের দাঁতে দাঁত লেগে শিরশির করে ওঠে। হাত দুটো অবশ হয়ে আসে। গাড়ি থেকে বেরিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো আরশাদ। সারা বাড়ি অন্ধকারে ছেয়ে আছে। অদ্ভুত ব্যাপার! এ বাড়ির আলোগুলো কখনো নিভিয়ে রাখা হয় না। অন্ধকার নওশীনের একেবারেই অসহ্য।

কিছুটা অবাক হয়েই শোবার ঘরের দিকে পা বাড়ালো আরশাদ। সে ঘর থেকে অবশ্য ক্ষীণ আলোর আভা আসছে। কথার বয়স সবে তিন মাস। মেয়েটা মাকে বড্ড বিরক্ত করে। সারারাত কেঁদেকেটে একাকার অবস্থা, আর সারাদিন ঘুমে আচ্ছন্ন। কয়েক দিন আগেই আরশাদের নতুন সিনেমাটার শুটিং শুরু হলো। তবুও বেচারা যতটা পারে নওশীনকে সাহায্য করে। মেয়ে যখন তাদের দুজনের, রাত জাগাটাও দুজনেরই কর্তব্য।

ঘরে ঢুকে আরশাদ দেখতে পেলো কথা তার গভর্নেন্সের কোলে উঠে হাত-পা নেড়ে খেলা করছে। এই গভর্নেন্স কথার সাত দিন বয়স থেকে বাড়িতে রয়েছে। তার প্রধান দায়িত্ব বাচ্চার দেখাশোনায় নওশীনকে সাহায্য করা। বাবাকে দেখেই তার দিকে হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে দিলো কথা। মেয়েটা হয়েছে প্রখর বাবাভক্ত। বাবা আশেপাশে থাকলে তার কাউকে প্রয়োজন হয় না। দিনভর ক্লান্তির পর মেয়ের মুখটা দেখে প্রচ্ছন্ন হাসি ফুটে উঠলো আরশাদের ঠোঁটেও।

মেয়েকে কোলে নিয়ে কিছুটা সময় তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিলো আরশাদ। এরপর নিচু গলায় কথার গভর্নেন্সকে বলল, “তোমার ম্যাম কোথায়?”

“ম্যাম তো সেই সন্ধ্যা বেলায় বাবুকে আমার কাছে রেখে গেছে।”

“কোথায় গেছে?”

“ম্যাম তো বললেন পাশের ঘরেই আছেন।”

চিন্তার ভাঁজ পড়লো আরশাদের কপালে। আজ সন্ধ্যার পর থেকে তারও ফোনে কথা হয়নি নওশীনের সঙ্গে। এতটা দীর্ঘ সময় তাকে ফোন না করে থাকে না মেয়েটা। আজ হঠাৎ কী হলো কে জানে?

আরশাদ কথাকে গভর্নেন্সের কোলে দিয়ে বেরিয়ে পড়লো নওশীনের খোঁজে। প্রথম গন্তব্য পাশের ঘরে। নাহ! পাশের ঘরে নওশীন নেই। এমনকি আশেপাশের কোনো ঘরেই নেই। অদ্ভুত ব্যাপার! মেয়েটা হুট করে অদৃশ্য হয়ে পড়ল না-কি? আচ্ছা, নওশীন বাইরে যায়নি তো? সে সুযোগ নেই। বাইরে গেলে নওশীন সবসময় আরশাদকে বলেই যায়।

ওপরের তলায় কোনো খোঁজ না পেয়ে আরশাদ নেমে এলো নিচতলায়। এখানেও কোথাও পাওয়া গেল না নওশীনের দেখা। দুশ্চিন্তাটা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। এমনিতেও মেয়েটার শরীর ভালো যাচ্ছে না। তার সঙ্গে আবার যুক্ত হয়েছে নানা প্রকার উদ্ভট চিন্তাভাবনা। কথার পৃথিবী আসার মাস খানেক আগে থেকেই নওশীনের মাথা ভরে যায় আজগুবি সব ভাবনায়।

আরশাদ এবার ছাদের দিকে পা বাড়ালো। ছাদটা নওশীনের বড় শখের। দেশী-বিদেশী কত রকম গাছ যে সেখানে লাগানো হয়েছে, তা হিসাবের বাইরে। নওশীন সেখানে থাকলেও থাকলে পারে।

ছাদে নওশীনকে পাওয়া গেল না। তবে ছাদের পাশে এক চিলতে স্টোর রুমের মতো আছে। অপ্রয়োজনীয় টব, খুরপি এসব হাবিজাবি রাখা হয় সেখানে। আরশাদ কী যেন মনে করে একবার উঁকি দিলো ঘরটায়। ভাগ্যিস দিয়েছিল! অন্ধকারাচ্ছন্ন, অপরিষ্কার স্টোর রুমের মেঝেতে হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে নওশীন। তার রুক্ষ এলোমেলো চুলগুলো মুখের ওপরে পরে আছে। দৃশ্যটা এক পলক দেখেই বুকটা ধ্বক করে উঠলো আরশাদের। কী হয়েছে এই মেয়েটার? এমন বিধ্বস্ত ভঙ্গির কারণ কী?

আরশাদ এক মুহুর্তও অপচয় না করে ঢুকে পড়লো স্টোর রুমে। নওশীনের সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “নওশীন? কী হয়েছে তোমার? এখানে বসে আছ?”

নওশীন হাঁটু থেকে মুখ তুলে তাকালো আরশাদের দিকে। তার দৃষ্টিতে ভর করছে একরাশ শূণ্যতা। কয়েক মুহূর্ত এভাবেই শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। অতঃপর নীরবতা ভঙ্গ করে করুণ কণ্ঠে বলল, “শাদ তুমি এসেছ? এতক্ষণ পর এসেছ? আমি সেই কখন থেকে তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি।”

আরশাদের দুশ্চিন্তার পাল্লা আরেকটু ভারী করে দিলো নওশীনের এই কণ্ঠস্বর। আরশাদ চিন্তিত গলায় বলল, “কী হয়েছে তোমার নওশীন?”

“কিছু হয়নি তো। কী হবে আমার? তোমার কী হয়েছে? আমার ফোন রিসিভ করছিলে না কেন? জানো কতবার ফোন করেছি তোমাকে। এক কোটিবার ফোন করেছি।”

নওশীন একেবারেই উল্টোপাল্টা কথা বলছে। সন্ধ্যার পর থেকে সে একবারও ফোন করেনি আরশাদকে। উল্টো আরশাদই একবার ফোন করে বন্ধ পেয়েছে। অথচ নওশীন কিনা বলছে, “এক কোটিবার ফোন করেছি।”

ফোনের ব্যাপারটা নিয়ে আর কোনো কথায় গেল না আরশাদ। সে বেশ বুঝতে পারছে স্বাভাবিকতার লেশমাত্র নেই নওশীনের মাঝে।
অস্বাভাবিকভাবে টলছে মেয়েটা। টলতে টলতে এসে পড়লো আরশাদের বুকে। অসহায় গলায় বলল, “কেন বারবার আমাকে একা রেখে চলে যাও শাদ? তুমি জানো না, তোমাকে ছাড়া থাকতে আমার প্রচন্ড কষ্ট হয়।”

অবুঝের মতো চেয়ে রইল আরশাদ। স্বাভাবিকের থেকে বেশি অস্বাভাবিক আচরণ করছে কেন নওশীন? মেয়েটা চিরকালই হাস্যোজ্বল। কথা পৃথিবীতে আসার পর সেই স্বভাবে কিছুটা ভাটা পড়লেও প্রকৃত মানুষটার তো একেবারে বদলে যাওয়ার কথা নয়।

আরশাদ কিছু একটা বলতে যাবে, ঠিক তখনি তার চোখ পড়লো মেঝেতে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে কিছু জিনিস। নিজ চোখে এই জিনিস এর আগে কখনো না দেখলেও চিনতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হলো তার।

আরশাদ ভীত গলায় বলল, “নওশীন? তুমি ড্রাগস নিয়েছ?”

নওশীন আঁতকে উঠে বলল, “কই না তো? আমি কেন ড্রাগস নিতে যাবো? তোমার কি আমাকে এতটা খারাপ মনে হয় শাদ?”

আরশাদ লক্ষ করলো নওশীন ভীষণভাবে কাঁপছে। তার নিঃশ্বাসও ভারী হয়ে এসেছে। আরশাদের মাথাটা আর কিছুতেই কাজ করছে না। সব হিসাব যেন কেমন এলোমেলো হয়ে আসছে। যে মানুষটা সবসময় মাদকের বিরুদ্ধে সোচ্চার, সে নিজেই আজ ড্রাগস নিয়ে পড়ে আছে? কথাকে গর্ভে ধারণ করার পর থেকে খুব স্বাভাবিকভাবেই নওশীন বদলে গেছে। তাই বলে এতটা বদলে যেতে হবে?

আরশাদ আরও কয়েকবার নওশীনকে ডাকল। কিন্তু কোনো সাড়া-শব্দ পাওয়া গেল না। আরশাদ মেয়েটাকে কোলে তুলে সাবধানে নিয়ে গেল দোতলায়। এই অবস্থায় নওশীনকে কথার কাছে রাখাটা ঠিক হবে না। তাই তাকে নিয়ে শুইয়ে দিলো পাশের ঘরটায়। ডাক্তারকে খবর দিতে হবে। কথাকে গিয়ে দেখে আসতে হবে। সামনে একটার পর একটা কাজ। কোনটা আগে কোনটা পরে করবে, তা ভাবতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে আরশাদকে।

এতসব ভাবনার মাঝেই হঠাৎ বেজে উঠলো আরশাদের ফোন। স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে ফারুকের নাম। ফারুক আরশাদের ম্যানেজার। লোকটার বয়স ষাটের কাছাকাছি। তবুও তার মধ্যে দায়িত্বজ্ঞানের কোনো অন্ত নেই। আরশাদ ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই ফারুক আছে তার ম্যানেজার হিসেবে। বয়সের ভারে ন্যুব্জ ফারুক আগামী বছর কাজ থেকে অবসর নেবেন বলে আরশাদের হতাশার শেষ নেই। নতুন ম্যানেজার কীভাবে কাজ করবে কে জানে!

ফোন রিসিভ করতেই শোনা গেল ফারুকের চিন্তিত কণ্ঠস্বর, “স্যার, একটা ঝামেলা হয়ে গেছে।”

বিরক্তির প্রবল স্রোত বয়ে গেল আরশাদের ওপর দিয়ে। একে তো বেচারা নওশীনের এই ঝামেলায় জর্জরিত, তার ওপরে আবার কী ঝামেলা বেঁধেছে?

আরশাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “কী হয়েছে?”

ফারুক ইতস্তত করে বলল, “ম্যাম আজ সন্ধ্যায় জাগরণ পত্রিকার এডিটরকে ফোন করে বলেছেন তিনি ড্রাগ নিচ্ছেন।”

আরশাদ হকচকিয়ে গিয়ে বলল, “What?”

“জি স্যার। সাথে আবার একটা ছবিও পাঠিয়েছেন। বলে দিয়েছেন, কালকে সকালে যেন বড় বড় হেডলাইনে খবরটা ছাপা হয়।”

তর্জনি দিয়ে কপাল ঘষতে ঘষতে গভীর চিন্তায় ডুবে গেল আরশাদ। কেন এমন পাগলামি করছে নওশীন? খবরটা একবার পত্রিকায় ছাপা হলে তো সর্বনাশ! দর্শকেরা নওশীনের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। যার অর্থ ক্যারিয়ারের ভরাডুবি। আরশাদ চোখের সামনে নিজের সবথেকে প্রিয় মানুষটার ক্যারিয়ারের ক্ষতি সহ্য করতে পারে না।

বেশ খানিকটা সময় চিন্তা করে আরশাদ বলল, “ওদের মুখ বন্ধ করতে হবে।”

“নিজেদের মুখ বন্ধ করার জন্যে নিজেরাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে স্যার। ওই এডিটর আমাকে ফোন করে টাকা চাইছে।”

“কত চেয়েছে?”

“পাঁচ লাখ।”

কোনো মানে হয়? সামান্য একটা নিউজ না করার জন্যে পাঁচ লাখ টাকা? যদিও একে সামান্য নিউজ বলা যায় না। দেশের সবথেকে বড় সুপারস্টারের স্ত্রী হওয়ার সাথে সাথে সিনেমা জগতের জনপ্রিয় একটি মুখ নওশীন। সে সেচ্ছায় মাদকের দুনিয়ায় গা ভাসিয়ে দিচ্ছে, এই খবর যে পত্রিকা পাবে সেই লুফে নেবে। টাকাটা দিয়ে আপাতত ওদের মুখটা বন্ধ করতে হবে।

আরশাদ বলল, “বাসায় এসে চেক নিয়ে যান ফারুকভাই।”

পরবর্তী কয়েক ঘন্টা কাটলো প্রবল ব্যস্ততার মাঝে। ডাক্তার এসে নওশীনকে প্রাথমিক কিছু চিকিৎসা দিলেন। যদিও জ্ঞান ফেরার আগ পর্যন্ত সঠিক চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফারুক এসে চেক নিয়ে গেল। চেকটা জাগরণের অফিসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে লেগে গেল আরও এক ঘন্টা।

দিনভর শুটিং শেষে ক্লান্তি ছেয়ে গেছে আরশাদের সমস্ত শরীরে। তবুও চোখে একবিন্দু ঘুম নেই। তার উদ্বিগ্ন চোখদুটো স্থির হয়ে আছে নওশীনের ওপর। ডাক্তার কী একটা ইনজেকশন পুশ করে গেছেন তার শরীরে। মেয়েটা এখন শান্তির ঘুম দিচ্ছে। নওশীনের অপরূপ সুন্দর মুখটা জুড়ে খেলে বেড়াচ্ছে বিচিত্র এক স্নিগ্ধতা। গোটা একটা জীবন নির্বিঘ্নে এই মুখটার দিকে তাকিয়েই কাটিয়ে দেওয়া যায়। পুরোটা রাত দুচোখের পাতা এক করতে পারলো আরশাদ। নওশীনের হাত ধরে তার পাশেই বসে রইল।

রোদের তীব্রতা চোখের ওপরে পড়তেই উঠে বসলো নওশীন। মাথাটা তেজী ঘূর্ণির ন্যায় ঘুরপাক খাচ্ছে। চোখটা কচলে আশপাশটায় তাকাতেই সংবিৎ ফিরে পেলো নওশীন। মনে পড়ে গেল কাল রাতের কথা। মুহূর্তেই ধ্বক করে উঠলো বুকটা। হৃদস্পন্দন ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। জীবনের সবথেকে বড় ভুলটা সে করে ফেলেছে কাল রাতে। আচ্ছা আরশাদ কী কোনোভাবে জানতে পেরেছে ভুলটার কথা? জানলে নির্ঘাত কোনোদিনও ক্ষমা করবে না তাকে। আরশাদকে আশেপাশে কোথাও দেখা যাচ্ছে না? কোথায় আছে ছেলেটা? কাল রাতে তো নওশীন স্টোর রুমে ছিল। সেখান থেকে এখানে এলো কী করে? কথা কোথায়? কথা ঠিক আছে তো?

একসঙ্গে হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তার মস্তিষ্কে। লম্বা এক শ্বাস নিয়ে নওশীন বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। সর্বপ্রথম খোঁজ নিতে হবে কথার। ছোট্ট মেয়েটা জন্মের পর থেকে এতটা দীর্ঘ সময় মাকে ছাড়া থাকেনি।

পাশের ঘরে প্রবেশ করতেই দেখা পাওয়া গেল হাস্যোজ্জ্বল কথার। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেল নওশীন। গভর্নেন্সের কোলে উঠে বিস্মিত দৃষ্টিতে ঘুর্ণয়মান সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে কথা। নওশীন ছুটে গিয়ে কোলে তুলল মেয়েকে। অনবরত চুমুতে ভরিয়ে দিলো তার মুখ।

কিছুটা শান্ত হয়ে গভর্নেন্সকে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “ও রাতে কিছু খায়নি।”

“স্যার এসে পাউডার মিল্ক বানিয়ে দিয়েছেন ম্যাম। বাবু ওটাই খেয়েছে।”

অনুতপ্ততায় কেঁপে উঠলো নওশীনের সমস্ত অন্তরাত্মা। জন্মের সময় কথার ওজন ছিল স্বাভাবিকের চাইতে কম। ডাক্তার কড়া ভাষায় বলে দিয়েছিলেন, বাচ্চাকে যেন পাউডার মিল্ক না দেওয়া হয়। তার সঠিক বৃদ্ধির জন্যে প্রথম ছয় মাস অন্তত মায়ের দুধ প্রয়োজন। আর যেখানে নওশীন বাড়িতে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও মেয়েটাকে পাউডার মিল্ক খেতে হলো।

নিজে হাতমুখ ধুয়ে মেয়ের যত্নে অনেকটা সময় ব্যয় করলো নওশীন। নিজ হাতে গোসল করিয়ে দিলো, খাইয়ে দিলো। দুপুর বারোটা-একটার দিকে কথা গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। মায়ের কোলে উঠে বসতেই কিছুক্ষণ বাদে ঘুমিয়ে পড়লো কথা।

নওশীন এবার বের হলো আরশাদের খোঁজে। আরশাদ বসার ঘরে টিভির সামনে বসে ছিল। নওশীন গিয়ে পাশে বসতেই ফোন নিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিমায় উঠে চলে গেল। এতটা মর্মাহত নওশীন এ জীবনে হয়নি। একটা ভুলই না হয় করেছে। তাই বলে তাকে এভাবে এড়িয়ে যাবে তার সব চাইতে প্রিয় মানুষটা।

কিছুক্ষণ বাদে আবারও আরশাদকে পাওয়া গেল বাগানে। এ বাড়ির বাগানে প্রকান্ড এক দোলনা আছে। দোলনায় বসে সুইমিং পুলের স্বচ্ছ নীলাভ জলের দিকে তাকিয়ে আছে আরশাদ। নওশীন গিয়ে বসলো তার পাশে। তবুও আরশাদ চোখ তুলে তাকাচ্ছে না তার দিকে। তার দৃষ্টি এখনো আবদ্ধ হয়ে আছে জলের দিকেই।

নওশীন আহত গলায় বলল, “তুমি কি আমার ওপরে রাগ করেছ শাদ?”

আরশাদ গম্ভীর গলায় বলল, “না।”

“তাহলে কথা বলছো না কেন?”

আরশাদ শুকনো গলায় বলল, “কথা বলার কোনো কারণ নেই, তাই বলছি না।”

নওশীন অসহায় গলায় বলল, “শাদ প্লিজ, আমার ওপর রাগ করে থাকলে রাগটা প্রকাশ কর। আমাকে বকাঝকা করো। কিন্তু প্লিজ আমার সঙ্গে না বলে থেকো না।”

“তুমি ড্রাগস নিয়েছ কেন?”

“I’m sorry.”

“Sorry cannot be an answer.”

“আমি জানি শাদ…”

নওশীনকে থামিয়ে দিয়ে আরশাদ অবিশ্বাসের সঙ্গে বলল, “আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না নওশীন। তুমি? তোমার মতো একটা মানুষ ড্রাগস নিচ্ছে? যেখানে তুমি সবসময় ড্রাগসের বিরুদ্ধে কথা বলো।”

“আমি এখনো ড্রাগসের বিরুদ্ধে শাদ। কিন্তু…”

কথার মাঝপথেই থেমে গেল নওশীন। কেমন অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে রইল মাটির দিকে। আর কিছু বলার মতো ভাষা যেন তার জানা নেই।

আরশাদ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “তোমার কাছে এসবের কোনো ব্যাখ্যা নেই, তাইনা?”

“আছে শাদ। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। নিজের মধ্যে নেই আমি। I think I need help.”

“মানে?”

নওশীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে পরিষ্কার গলায় বলল, “ইদানিং আমার খুব ডিপ্রেসড লাগে। একা একা থাকতে কষ্ট হয়। এমনটা সবসময় হয় না। তুমি যখন আশেপাশে থাক, সব তখন ঠিকঠাক। এই যেমন এখন। আমার কোনো কষ্টই নেই। কিন্তু তুমি শুটিংয়ে চলে গেলেই কষ্ট হয় আমার। দমবন্ধ লাগে। নিজের মধ্যে থেকেও হারিয়ে যাই আমি।”

গর্ভাবস্থার পরবর্তী সময়ে কিছু মায়েদের ডিপ্রেশনের মুখোমুখি হতে হয়। হতে পারে এই ডিপ্রেশন সাময়িকী। আবার কখনো কখনো তা হতে পারে দীর্ঘ সময়ের জন্যে। পরিবারের নতুন সদস্যকে নিয়ে আমরা এতটাই আনন্দে থাকি যে মায়ের মানসিক অবস্থার কথা চিন্তা করার কোনো অবকাশই থাকে না আমাদের মাঝে। নওশীনের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম কিছু হয়নি।

নওশীন আবারও ভীত গলায় বলল, “কাল বিকেল থেকেই প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছিল। আমার হাত-পা সব যেন অবশ হয়ে আসছিল। আমি বুশরাকে ফোন করে বললাম, আমার খারাপ লাগার কথা। বুশরাকে মনে আছে? আমার স্কুল লাইফের ফ্রেন্ড।”

এতক্ষণ আরশাদ মনোযোগী শ্রোতার ন্যায় তাকিয়ে ছিল নওশীনের দিকে। যেন তার বলা একটা শব্দও না শুনলে অনর্থ হয়ে যাবে। কথার মাঝে নওশীনের এই প্রশ্নে আরশাদ কেবল হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো।

নওশীন আবারও বলল, “প্রেগন্যান্সির পরবর্তী ডিপ্রেশন না-কি খুব নরমাল। ওরও এমনটা হয়েছিল। বাচ্চার দিকে কোনো মনোযোগ দিতে পারতো না। তখন বুশরা ওই জিনিস নিয়েছিল। দুই-তিনবার নিয়েই কাজ হয়েছে। ও আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছে। বুশরাই তো ওর ড্রাইভারকে দিয়ে জিনিসটা পাঠিয়ে দিলো।”

আরশাদ ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “এসব কথা আমাকে আগে বলোনি কেন নওশীন?”

“এমনিতেই তুমি অনেক ব্যস্ত, তার ওপরে আবার…”

নওশীনের কথা শেষ হবার আগেই আরশাদ তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “তোমার জন্যে কখনো আমার সময়ের অভাবে হয়েছে?”

নওশীনও দু হাতে পরম আবেগে জড়িয়ে ধরলো আরশাদকে। তার সকল শূন্যতা যেন পূর্ণতা পায় এই মানুষটার বুকে।

“বলো হয়েছে?”

“না।”

আরশাদ বলল, “তাহলে? তোমার কোনো কষ্ট হলে সেই কথা সবার আগে জানার অধিকার আমার।”

“বললাম তো ভুল হয়ে গেছে।”

আরশাদ নওশীনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “আচ্ছা, এক কাজ করি। আগামী সপ্তাহের শুটিং ক্যানসেল করে, আমরা কোথাও ঘুরতে চলে যাই।”

“এই সময়ে?”

“হুঁ, অসুবিধা কী? ঠিক করে ফেলো, কোথাও যাবে!”

“না শাদ, তোমার শুটিংয়ের অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে।”

“সেটা নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না, আমার বউয়ের প্রায়োরিটি সবার আগে।”

বর্তমানে…

পুরনো দিনের কথাগুলো ভেবে শিউরে উঠলো নওশীন। জীবনটা এত সুখময় ছিল! ভাবলেই নিজের প্রতি নিজের হিংসা হয়। আরশাদের ভালোবাসা ছিল তার সবথেকে বড় সম্পদ। সে তো চাইলেই পারতো ওই সময়টায় নওশীনের পাশে না থেকে তার বিপক্ষে চলে যেতে। নওশীনের এই বিরাট ভুলটা নিয়ে তার সঙ্গে তুমুল ঝগড়া বাঁধিয়ে দিতে। ভুল বোঝাবুঝির পাল্লা ভারী করে তার ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে।

এসবই ভালোবাসার পরিপন্থী বলে আরশাদ নওশীনের পাশে থাকে। এত বড় সত্যিটা দুনিয়ার থেকে আড়াল করে রাখতে সর্বোচ্চটা করে। ডিপ্রেশন থেকে বেরিয়ে আসতে সর্বোচ্চ সহায়তা তাকে আরশাদই করেছে। যেকোনো সম্পদকেই পরম যত্নে আগলে রাখতে হয়। অবহেলায় ফেলে রাখলে তা ক্ষয় হয়ে যায়। নওশীনের এই সবচাইতে দামী সম্পদটার বেলায়ও তাই হয়েছে। এ জন্যেই তো, নওশীনকে জীবনের থেকে বেশি ভালোবাসা মানুষটা আজ তাকে দেখতেই পারে না।

(চলবে)

[জিপিএ ৫ পাওয়ার খুশিতে এবারও লিখতে দেরি হয়ে গেল। এখন থেকে রেগুলার গল্প পাবেন ইনশাল্লাহ। কখন গল্প দিলে আপনাদের সুবিধা হয়? সকালে না বিকেলে? আমার লেখা রাতেই শেষ হয়ে যায়। বিকেলের দিকে রিচেক দিয়ে পোস্ট করি। আপনারা চাইলে সকালে পোস্ট করতেও আমার সমস্যা নাই। ❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here