ফিরে_আসা ১২ লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

0
431

#ফিরে_আসা
১২
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

বেলের শব্দ কর্ণকুহরে পৌঁছানোর সাথে সাথে কলমের কালি থেমে গেল অরার। পরীক্ষাটা শেষ করতে ঠিক দুঘন্টাই সময় লেগেছে। এক সেকেন্ড বেশিও নয়, কমও নয়। আজকের পরীক্ষার জন্যে খুব একটা পড়াশোনা করতে হয়নি তাকে। দুয়েকবার বইয়ের পাতায় চোখ বুলাতেই অরার কাছে মনে হয়েছে, পরীক্ষায় যা আসবে তাই সে পারবে। হলোও ঠিক তাই। পড়শোনা আর কাজের বেলায় নিজের প্রতি ষোলো আনা ভরসা আছে অরার।

আরশাদ এ সময়ে কথাকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার বেশ সুবিধাই হচ্ছে। নির্বিঘ্নে পরীক্ষাগুলো দেওয়া যাচ্ছে। আরশাদ না থাকলেও অরার কাজ থাকে। এই যেমন পরবর্তী শুটিংয়ের শিডিউল তৈরি করা, শিডিউল অনুযায়ী কস্টিউম ডিজাইনারকে কস্টিউম জোগাড় করতে বলা। আবার যে সকল প্রযোজক-পরিচালকেরা আরশাদের সঙ্গে নতুন সিনেমার ব্যাপারে মিটিংয়ে ইচ্ছুক, তারাও যোগাযোগ করে অরার সঙ্গে। তাদের সঙ্গে একদফা কথা বলে অরা আরশাদকে জিজ্ঞেস করে, তাদের সঙ্গে মিটিংয়ে সে আগ্রহী কিনা। আরশাদের তরফ থেকে সবুজ বাতি দেখা দিলে তবে ঠিক করা হয় মিটিং।

অরার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো আরশাদের ফেসবুক আর ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করা। সেলিব্রিটিরা নিজেদের চর্চায় রাখতে ব্যক্তিগত জীবনের খানিকটা তুলে ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাতায়। দেশের সবথেকে বড় সুপারস্টার সেই দৌড়ে পিছিয়ে থাকবে কেন? আরশাদ নিজের ব্যক্তিগত জীবনের ছবি অরাকে পাঠিয়ে দেয়। সেগুলোয় ক্যাপশন দিয়ে পোস্ট করা অরার মাথাব্যথা।

অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীরা পরীক্ষা শেষে নিজেদের মধ্যে খানিকক্ষণ আড্ডা দেয়, ক্যাম্পাসজুড়ে ঘুরে বেড়ায়, তৃপ্তিভরে ক্যান্টিনের সিঙ্গাড়া খায়। অরার সে সুযোগ নেই। তাকে এক্ষনি বাসায় ফিরতে হবে। এক প্রযোজকের সঙ্গে মিটিংয়ে বসতে সম্মতি দিয়েছে আরশাদ। তার সঙ্গে মিটিংয়ের তারিখ নির্ধারণ করতে হবে।
সীমা ক্লাস থেকে বেরিয়ে অপেক্ষা করছে অরার জন্যে।

অরা ক্লাস থেকে বেরিয়ে ক্লান্ত গলায় বলল, “চাবি দে।”

সীমা হতাশ গলায় বলল, “এখনি ফিরে যাবি?”

“হ্যাঁ, তোকে বলেছি না কাজ আছে।”

“একটু থেকে গেলে কী হয় অরা? আমরা সবাই মিলে আজ মুখোশের কাজটা শেষ করবো। তুই দেখবি না?”

“দেখতেই তো চেয়েছিলাম। কিন্তু আজকের মধ্যে মিটিংটা ফিক্স না করলে স্যার আমার খবর করে দেবেন।”

সীমা ব্যাগ থেকে বাসার চাবি বের করে অরার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বিরস কণ্ঠে বলল, “এমন রসকষহীন মেয়েমানুষ আমি জীবনে দেখিনি।”

আগামী সপ্তাহেই আসছে বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। বর্ষবরণ উপলক্ষে ভার্সিটিতে বিশাল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। নানা গণ্য-মান্য ব্যক্তিদের আগমন ঘটে সে সময়। অনুষ্ঠানকে সামনে রেখে ভার্সিটির শিক্ষার্থীরা দিন-রাত কাজ করছে। সীমাও তাদের মধ্যে একজন। সেচ্ছাসেবক দলে নিজের নাম দেওয়ার পর থেকে দিন-রাত এক করে সেবা দিয়েই যাচ্ছে। অরাকে কয়েকবার জোরাজুরি করা হয়েছিল। বেচারি কাজের পর পড়াশোনা সামলাতেই হিমশিম খায়। সে আবার সেচ্ছাসেবী হবে কী করে?

অরা ক্যাম্পাস থেকে মূল দরজার কাছে যাবে, এমন সময় তার পথ আটকালো খুব কাছ থেকে ভেসে আসা এক কণ্ঠস্বর।

“অরা! অরা দাঁড়াও!”

পেছন ফিরে তাকাতেই গা বেয়ে শীতল হাওয়া বয়ে গেল অরার। সাবের। এই ছেলেটার কারণে আজকাল ভার্সিটিতে আসাও দুঃসহ হয়ে পড়েছে। যখন তখন পথ আটকে বলবে, “আমাকে আরেকটা সুযোগ দাও অরা।” সুযোগ যেন ছেলের হাতের মোয়া। চাইলো, আর পেয়ে গেল।

সাবেরের অনাকাঙ্ক্ষিত ডাকটা গায়ে না মেখে অরা এগিয়ে গেল সামনের দিকে। এই ছেলেটাকে ভদ্রভাবে বহুবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে অরা। অনেকবার তাকে বলা হয়েছে এভাবে হুটহাট বিরক্ত না করতে। কথাগুলো সম্ভবত তার কর্ণকুহরে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে। সে কারণেই বারবার উড়ে আসে বিরক্ত করতে। এমন মানুষকে এড়িয়ে চলাই সর্বোত্তম।

অরার পিছু নিয়ে সাবের ছুটতে ছুটতে একেবারে তার কাছে চলে এসেছে। অনবরত ডেকেই যাচ্ছে তার নাম। অরা এমন একটা ভাব করলো যেন তার পেছনে কেউ নেই। সাবের এবার এমন একটা কাজ করলো যার জন্যে অরা মোটেও প্রস্তুত ছিল না।

সাবের অরার হাত ধরে টেনে বলল, “অরা! একটাবার আমার কথা শোনো।”

অরার মাথায় যেন রক্ত উঠে গেল। কানের দুপাশ থেকে ইতোমধ্যে বাষ্প বের হতে শুরু করেছে। অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো সাবেরের দিকে। এমনিতে অরা খুবই শান্তশিষ্ট একটি মেয়ে। তবে কোনো কারণে তাকে রাগিয়ে দিলেই আর রক্ষা নেই।

অরা নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে কড়া গলায় বলল, “এই তোমার সাহস কী হয় আমার হাত ধরার?”

মিষ্টভাষী অরার এমন কণ্ঠস্বর শুনে সাবের কিছুটা হকচকিয়ে গেল। ইতস্তত করে বলল, “না মানে অরা…”

“না মানে কী? তোমাকে কখনো কিছু বলি না বলে ভেবেছো লিমিট ক্রস করে যাবে? কী বলার জন্যে পথ আটকেছ? সুযোগ চাওয়ার জন্যে? কোনো সুযোগ তুমি পাবে না। কারণ তুমি বিশ্বাসঘাতক। আর আমি বিশ্বাসঘাতকদের ঘৃণা করি।”

“অরা, বিশ্বাস করো ওটা শুধুমাত্র একটা ভুল ছিল।”

অরা কঠিন গলায় বলল, “আমার কী মনে হয় জানো? তুমি এখনো নাটক করছো আমার সঙ্গে। অনুতপ্ত হওয়ার নাটক। মনে মনে এখনো তুমি আমাকে কাজে লাগিয়ে ভালো একটা চাকরি পেতে চাও, তাই না?”

“না অরা, কখনো না।”

“আমার অত ক্ষমতা নেই সাবের। আমি চাইলেই কাউকে ভালো চাকরি দিতে পারি না। কথাটা মাথায় রেখে আমাকে বিরক্ত করা বন্ধ করো। ফরদার যদি তুমি আমার সামনে পড়ো, তাহলে অথরিটির কাছে তোমার নামে কমপ্লেইন করতে বাধ্য হবো আমি।”

অরা আর এক মুহুর্তও অপেক্ষা না করে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে একটা রিকশায় উঠে বসে। রাগে এখনো তার গা থরথর করে কাঁপছে। সারাজীবন মেয়েটা নিজের ওপর হওয়া অন্যায়গুলো মুখ বুজে সহ্য করে গেছে। প্রতিবাদ করেনি, কিংবা হয়তো প্রতিবাদ করার মতো সাহস করে উঠতে পারেনি। সেই থেকে বদভ্যাস হয়ে গেছে। এখনো অন্যায়কে প্রশয় দেওয়ার অভ্যাস রয়ে গেছে তার মধ্যে।

তবে আর নয়। আজকের মতো করে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রতিবাদ করতে হবে তাকে। দুনিয়াকে বুঝিয়ে দিতে অরা সর্বংসহা কোমল পদ্মফুল নয়। নিজের ওপর হওয়া অন্যায়কে এক মুহূর্তের জন্যও প্রশয় দেবে না সে। তেজী সূর্যের মতো সেও জ্বলে উঠে আলো ছড়াতে পারে বহুদূর।

বাসায় ফিরে ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করতে চিন্তার ভাঁজ পড়লো অরার কপালে। নওশীনের মিসড কল। অরা বেশি কিছু চিন্তা না করলো কলব্যাক করলো।

দুয়েকটা রিং বাজতেই কল রিসিভ করে নওশীন অপরপ্রান্ত থেকে বলল, “অরা, তোমাকে ফোন করেছিলাম কিছুক্ষণ আগে।”

অরা বিনয়ী গলায় বলল, “সরি ম্যাম। আমি ক্লাসে ছিলাম বলে ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখেছিলাম, তাই শুনতে পাইনি।”

“আরে বাবা, কোনো ব্যাপার না। তোমার ক্লাস কি শেষ হয়েছে? এখন কথা বলা যাবে?”

“জি ম্যাম, আমি বাসায় ফিরে এসেছি। আপনি বলুন।”

নওশীন উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “সেই সকাল থেকে কথাকে ফোন করছি। মেয়েটা ফোন রিসিভ করছে না। ওখানে তো এখন রাত, ঘুমিয়ে পড়লো কিনা কে জানে। চিন্তা হয় না, বলো?”

“জি ম্যাম, চিন্তা হওয়াটাই তো স্বাভাবিক।”

“তুমি একটু শাদকে ফোন করে কথার খোঁজ নেবে প্লিজ?”

অরা আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “আমি কোনো চিন্তা করবেন না ম্যাম। আমি এক্ষনি স্যারকে ফোন করছি।”

দুজনের মধ্যকার এই যোগাযোগের মাধ্যম হতে আর ভালো লাগে না অরার। এসবই আরশাদের পাগলামি। ডিভোর্স তো রোজ রোজ কত মানুষেরই হচ্ছে। তাই বলে কি প্রাক্তন স্ত্রীর সঙ্গে ফোনে কথাও বলা যাবে না? কথাকে নিয়ে সেই যুক্তরাষ্ট্রে ছুটি কাটাতে গেছে আরশাদ। মায়ের মন তো! সন্তানের জন্যে চিন্তায় আচ্ছন্ন থাকবেই। সন্তান নিজ থেকে এতটা দূরে অবস্থান করছে বলে চিন্তার গভীরতা আরেকটু বেশি।

কথার কাছে নিজস্ব একটা ফোন আছে ঠিকই, তবে সবসময় সেই ফোনের কাছে থাকা হয়ে ওঠে না তার। মা ফোন করলে তাই অনেক সময় চোখে পড়ে না। আরশাদ কি পারে না, এই সময়টায় নওশীনের অশান্ত হৃদয়কে শান্ত করে। ফোন করে বলতে, “কথা ঠিক আছে।”

তিন অক্ষরের এই বাক্যটা বললে নিশ্চয়ই মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। কিন্তু আরশাদ তো আরশাদই। জেদের প্রশস্ত প্রাচীর ভেঙে এপাড়ে আসা তার পক্ষে যেন অসম্ভব।

অতীতে…

দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অনবরত পা দুলিয়ে যাচ্ছে নওশীন। তার পা দোলানোর গতি কাগজে-কলমে হিসাব করলে হবে মিনিটে নিরানব্বইবার। ছোটবেলা থেকেই তার বদভ্যাস দুশ্চিন্তায় হাতের নখগুলো কামড়ে খেয়ে ফেলা। নায়িকা হওয়ার সুবাদে সেই অভ্যাস ত্যাগ করে তাকে বড় বড় নখ রাখতে হয়েছে। তবে আজ হঠাৎ পুরনো এই বদভ্যাস ফিরে এসেছে। নিজের অজান্তেই ডান হাতের নখগুলো কামড়াচ্ছে নওশীন।

ঘড়িতে বাজছে কাটায় কাটায় দেড়টা। এই গভীর রাতে ব্যস্ততম ঢাকা কেমন যেন নিশ্চুপ হয়ে ওঠে। দিনের অন্যান্য সময় এই বসার ঘরে বসলে রাস্তা থেকে নানান শব্দ ভেসে আসে। কখনো হকারদের হাক ডাকার শব্দ, রিকশার বেলের শব্দ, গাড়ির হর্নের শব্দ। এখন কোনো শব্দই আসছে না। চারিদিকে পিনপতন নীরবতা।

নওশীনের চোখে এক ফোঁটাও ঘুম নেই। কথার সঙ্গে রাত জাগতে জাগতে তার চোখ থেকে ঘুম-টুম সব উড়ে গেছে। আশ্চর্য্যজনকভাবে কথা আজ তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছে। জীবনের এই প্রথম এগারো মাসে মেয়েটা কখনো রাত তিনটার আগে ঘুমায়নি।

নওশীন দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছে আরশাদের জন্যে। ছেলেটাকে সেই কখন থেকে ফোন করে যাচ্ছে, রিসিভ করার কোনো নাম-গন্ধ নেই। আরশাদ ঠিক আছে তো? দুশ্চিন্তার প্রবল স্রোত বয়ে গেল নওশীনের গা বেয়ে। নওশীন ওড়না দিয়ে সাবধানে কপালের ঘাম মুছল। ঠিক তো অবশ্যই আছে। শুটিং থাকলে আরশাদ এমন রাত করেই বাড়ি ফেরে। এ আর নতুন কী? তবুও কেন দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে তার সমস্ত অন্তরাত্মা।

এতসব চিন্তার ভীড়ে হঠাৎ নওশীন সংবিৎ ফিরে পেলো কলিংবেলের আওয়াজে। এক মুহূর্তও অপচয় না করে সে ছুটে গিয়ে দরজা খুলল। দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে ছিল তার কাঙ্ক্ষিত মানুষটা। আরশাদকে দেখতে আজ বেশ ক্লান্ত লাগছে। মনে হচ্ছে যেন বেচারার শরীরের এক বিন্দু শক্তি অবশিষ্ট নেই। তবুও সারাদিন পর নওশীনের মুখটা দেখে ঠোঁটে জোরপূর্বক হাসি টানলো আরশাদ।

নওশীনকে জড়িয়ে ধরে কোমল গলায় বলল, “এখনো জেগে আছ তুমি?”

নওশীন আকস্মিক আলিঙ্গনে কোনপ্রকার সাড়া না দিয়ে বলল, “কোথায় ছিলে তুমি?”

আরশাদ নওশীনকে ছেড়ে ঘরের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “এটা কী ধরনের প্রশ্ন? তুমি খুব ভালো করেই জানো আমি কোথায় ছিলাম।”

দরজাটা ধাম করে বন্ধ করে দিয়ে নওশীন কড়া গলায় বলল, “শাদ তোমার শুটিং দশটায় শেষ হয়েছে।”

“পুবাইল থেকে ঢাকায় ফিরতে তিন ঘন্টা লাগে নওশীন, এটাও তোমার জানা কথা। হঠাৎ এসব জিজ্ঞেস করছো কেন?”

“কারণ তুমি আমাকে ইগনোর করছো।”

আরশাদ হতবাক গলায় বলল, “আমি?”

“হ্যাঁ, তুমি। কোনো কারণ ছাড়াই দিনের পর দিন ইগনোর করে যাচ্ছো আমাকে। আমি ফোন করলে রিসিভ করো না, টেক্সটের রিপ্লাই দাও না। কেন শাদ? আমাকে আর আগের মতো অ্যাট্রাক্টিভ লাগে না তাই না?”

আরশাদ ক্লান্ত গলায় বলল, “নওশীন, আমি প্রচুর টায়ার্ড। এই মুহূর্তে তোমার এসব কথা শুনতে ভালো লাগছে না।”

নওশীন আক্ষেপের সুরে বলল, “আমার কথা তো আর ভালো লাগবেই না। আমি তো পুরনো হয়ে গেছি। নতুন মানুষদের নতুন নতুন কথা এখন ভালো লাগবে তোমার।”

“তুমি কি বাই এনি চান্স আমাকে সন্দেহ করছো?”

“সন্দেহ না করার কোনো উপায় তো তুমি রাখনি শাদ। তোমার সব সময় বাইরের মানুষের জন্যে। আমার জন্যে তো কোনো সময়ই নেই তোমার। এমনটা তো ছিল না আগে। তোমার মোট সময়ের বেশি সময় ছিল আমার জন্যে। হুট করে তুমি বদলে গেছ।”

আরশাদ বিরক্ত গলায় বলল, “আমি বদলে যাইনি নওশীন, তুমি পাগল হয়ে যাচ্ছ। তুমি খুব ভালো করেই জানো আমাকে সারাদিন শুটিং করতে হয় আর শুটিংয়ের সময় কল রিসিভ করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাছাড়া আমি তো এই প্রথম শুটিং করছি না। এর আগেও বহুবার শুটিং করেছি, বহুবার তোমার কল মিস করেছি। তখন তো এমন করনি তুমি।”

“কারণ এখন আমার তোমাকে প্রয়োজন শাদ।”

নওশীন কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে দোতলায় উঠে গেল। আরশাদের সঙ্গে এই কথোপকথন চালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। সারা শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিচিত্র এক ক্লান্তি। এই ক্লান্তি সহজে দূর হওয়ার নয়। নওশীন খুব ভালো করেই জানে আরশাদের কোনো দোষ নেই। দেশের সবথেকে বড় সুপারস্টার হওয়া মুখের কথা নয়। অবিরাম নিজের জায়গাটা ধরে রাখার জন্যে পরিশ্রম করে যেতে হয় তাকে। তবে দোষটা নওশীনেরও নয়। ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে একটু সময় সবাই আশা করে। সেই একবিন্দু সময়ের জন্যে নওশীন ছটফট করেই চলেছে।

বর্তমানে…

রাত দশটা বত্রিশ। বাবার গায়ের ওপর হাত-পা তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে কথা। সাধারণত এত তাড়াতাড়ি সে ঘুমায় না। আজ সারাদিন বেচারির ওপর দিয়ে প্রচুর ধকল গেছে। ক্লান্ত হয়ে তাই আগেভাগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। সফরের তৃতীয় দিনে আজ তারা ঘুরতে গিয়েছিল ‘ডিজনী স্প্রিংস’-য়ে। প্রথম দুদিন পুরোটাই ব্যয় করেছে কথার স্বপ্নের ‘ডিজনী ল্যান্ডে’। নিজের সবথেকে পছন্দের চরিত্রদের সামনাসামনি দেখে, এবং পছন্দের সব রাইডে চড়ে মেয়েটা যেন পাগলপ্রায়।

‘ডিজনী স্প্রিংস’ ডিজনী ল্যান্ডের আদলে তৈরি করা একটি শপিং মল। মূলত বাচ্চাদের জন্যেই পুরো শপিং মলটা তৈরি করা হয়েছে। ডিজনীর সকল কার্টুনের থিমে বাচ্চাদের পোশাক, খেলনা, খাবার আরও কত যে হাবিজাবি আছে তার হিসাব নেই! শপিং মলটা সাজানোও হয়েছে ডিজনীর থিমের আদলে। কথা চোখের সামনে যা পেয়েছে, যা পছন্দ করেছে, তাই কিনেছে। আজ তাকে বাঁধ সাধার ক্ষমতা যেন কারও নেই। আরশাদও আদর্শ বাবার ন্যায় পূরণ করেছে মেয়ের প্রতিটি শখ।

কথার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো আরশাদ। মেয়েটা সর্বক্ষণ তার আশেপাশে থাকলে ভালোই হতো। তার অশান্ত হৃদয়টা শান্ত থাকার একটা উপায় খুঁজে পেতো। আরশাদ চাইলেই পারতো ডিভোর্সের সময় কথার কাস্টাডির আপিল করে মেয়েকে নিজের কাছে রাখতে। তবে তাতে কেবলই তিক্ততা বাড়ত মেয়ের জীবনে।

মাকে ছাড়া একটা সন্তানের জীবন অপূর্ণ, এ সত্য আরশাদও স্বীকার করে। একটা মেয়ে মা হয়ে যাওয়ার পর তার চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকে তার সন্তান। এই যেমন কিছুক্ষণ আগে অরার ফোন এসেছিল। কথা ফোন রিসিভ করছে না বলে নওশীন চিন্তা করছে। কাস্টডি নিয়ে মেয়েকে নিজের কাছে রাখলে নওশীন নেহায়েত পাগল হয়ে যেত। অযথা একটা বাচ্চাকে তার মায়ের কাছ থেকে আলাদা করে দেওয়ার কোনো অর্থ নেই। আরশাদ এই হৃদয়হীন কাজটা করতেও চায় না। তবে ভবিষ্যতে যদি প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়, তবে সর্বোচ্চ হৃদয়হীন হওয়ার জন্যে প্রস্তুতি তার নেওয়া আছে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here