পরিণয়_প্রহেলিকা #লেখিকা_সিনথীয়া #পর্ব_২৫

0
992

#পরিণয়_প্রহেলিকা
#লেখিকা_সিনথীয়া
#পর্ব_২৫

ঠিক সন্ধ‍্যা ছয়টা সতের মিনিটে শৈলীর ঘুম ভাঙে। ও ছয়টা বিশের এলার্ম দিয়েছিল। খাটে উঠে বসে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। নিজেই নিজের পরিবর্তনে তাজ্জব সে,
– বাহ্ শৈলী, তুই দেখি বেশ পাঙ্কচুয়াল হয়ে গিয়েছিস। নয়তো পরিবারের লেট লতিফ খেতাব পাওয়া ব‍্যক্তি এ‍্যালার্ম বাজার আগেই উঠে পরেছে? বেশ বেশ!

খাট ছাড়তেই মাগরিবের আজানের মধুর ধ্বনি কানে আসে ওর। আজানের উত্তর দিয়ে ছোটে প্রথমে ওজু করতে। তারপর সুন্দর ভাবে নামাজে বসে। নামাজ শেষে একেবারে পরিপাটি হয়ে বের হয় রুম থেকে।

মাত্র সন্ধ‍্যা নেমেছে বিধায় বাসাটা এখনো অন্ধকার। সব লাইট জ্বালানো হয়নি। শৈলী ডাইনিং হলের লাইট টা জ্বালিয়ে দিল। বাসাটা কেমন চুপচাপ হয়ে আছে। বাবা তো আসতে আসতে রাত। নিপুণও মনে হয়ে কোচিং এ গিয়েছে। মায়ের রুমে যেয়ে দেখলো কেবল অজু করে বের হলেন তিনি।

শৈলীকে দেখে রেহানা মুচকি হাসলেন।
-কি রে মা, ঘুম হয়েছে?
-হমম। ভালো ঘুম দিয়েছি আম্মু। নামাজে বসছো নাকি?
– হ‍্যা। তুই পড়েছিস?
– হ‍্যা আমার পড়া শেষ। আচ্ছা আম্মু… তুমি নামাজ পড় তাহলে..আমি একটু ছাদ থেকে হেটে আসি।

রেহানা ভ্রু কুচকান,
– এই ভর সন্ধ‍্যায় ছাদে যাবি কেন? এই সময় খোলা আকাশের নিচে যেতে নেই।
– মা প্লিস একটু যাই না। বাসায় নিপুণও নেই, তোমারও নামাজ পড়তে সময় লাগবে। আমি একদম বোর ফিল করবো। আর আমিতো ছয় তলার ছাদে যাব। ওটা তো পুরা খোলা না। পুলের পাশে একটু বসবো আর কফি খাব। যাই মা? প্লিস?

মেয়ের বাচ্চামো আবদার শুনে রেহানা না হেসে পারলেন না।
– আচ্ছা যা। তবে জলদি চলে আসিস।
-থ‍্যাঙ্কস মা। লাভ ইউ।
– যাওয়ার সময় দরজা ভিড়িয়ে যাস।
-আচ্ছা।

শৈলীকে আর পায় কে। দৌড়ে রান্না ঘরে ঢুকে গরম পানি বসালো চুলায়। একটা নতুন মগ বের করলো শো কেস থেকে। সেটা ভালো করে ধুয়ে মুছে, তাতে কফি পাউডার, কফি মেইট ঢাললো। তবে চিনি দিতে গিয়ে পরলো বিপাকে,
– আচ্ছা উনি চিনি কতোটুকু খান, সেটাতো জিজ্ঞেসই করা হয়নি। তাহলে কি করবো? নিজের আন্দাজে দিয়ে দেব? অবশ‍্য যেই গুরুগম্ভীর থাকেন সবসময় আর ত‍্যাড়া কথা বলেন তাতে মনে হয়না চিনি বেশী খেয়েছেন কখনো। তিতাই থাকে তার মুখ মনে হয়।

এরকম এক উদ্ভট চিন্তা কেন শৈলীর মাথায় আসলো ও জানে না। তবে নিজেই পেট কাপিয়ে হেসে ফেললো ও। ওদিকে পানি গরম হয়ে গিয়েছে দেখে কাজে তৎপর হলো আবার। অল্প পরিমাণে পানি নিয়ে আর একটু চিনি দিয়ে প্রথমে বেশ কিছুক্ষণ পুরো কফির মিশ্রণটাকে ফেটে নিল ও চামচ দিয়ে। যখন পুরো রান্নাঘর জুড়ে কফির সুন্দর ঘ্রাণটা ছড়ালো, তখন পরিমানমত পানি ঢেলে আবার একটু মিশিয়ে সেটা একটা কোস্টার দিয়ে ঢেকে নিল।

কিচেন কাউন্টার টা ঝটপট পরিষ্কার করে, কফি নিয়ে বের হয়ে গেল ও ছাদের উদ্দেশ‍্যে।
…………………..

গতকালের মতন বৃষ্টির কোনো আগমন না থাকলেও ছাদে বাতাস বইছে প্রচুর। শৈলী পা রাখতেই ওর ওড়না সামলাতে বেগ পেতে হলো। কি করবে ও? এক হাতে কফির মগ, আরেক হাতে মোবাইল। তৃতীয় হাত তো নেই। থাকলে নাহয় সেটা দিয়ে সামলাতো।

শৈলী আবার পিছায়। সিড়ির ঘরে ঢুকে মিহরানকে একটা ফোন দেয়। দ্বিতীয় রিঙেই অপর পাশ থেকে শোনা যায় সেই ভারী পুরুষালি কন্ঠ,
– হ‍্যালো শৈলী।
– হ‍্যালো, আপনি কি রুমে?
– হ‍্যা। আপনি কোথায়?
-আমি… ছাদে এসেছি। তবে এতো বাতাস যে…
– দাড়ান আমি আসছি।

শৈলী ফোন কেটে নিচেও নামাতে পারেনি কান থেকে, ওর পাশের দরজাটা খুলে প্রকোট হলো মিহরান। চোখের চিরচারিত গম্ভীরতা নিয়েই এক পাশে সরে দাড়ালো শৈলীকে ঢুকতে দেওয়ার জন‍্য। কিন্তু শৈলী ঢুকলো না,

– ছাদে বসি?

মিহরান এক পলক চুপ রইলো। তারপর নিজে বের হয়ে এসে বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে দিল। শৈলী মনে মনে স্বস্তি পেল। এভাবে একজন পুরুষের রুমে যেতে ওর কেমন যেন অস্বস্তি লাগছিল, হোক না সেটা ওর স্বামীর, তারপরেও। আর এই বিষয়টা বোধহয় মিহরানও বুঝেছে। এটাই শৈলীর শান্তি, মানুষটা ওকে বোঝে। ওর চিন্তা কে প্রাধান‍্য দেয়। আগেও খেয়াল করেছে ও।

মিহরান বের হতেই শৈলী কফির মগটা বাড়িয়ে দেয়,
– আপনার কফি।

মিহরান শুধু একটু ঠোট চওড়া করে মগটা হাতে নিয়ে নেয়। এবার হাত ফ্রি হওয়াতে শৈলী নিজের ওড়নাটা ঠিক করে নেয়। মগে চুমুক দিতে দিতে মিহরান সবই লক্ষ করে। কফিটা খেয়ে ভীষণ তৃপ্তি পায়। কালকেরটা থেকেও বেশী মজা হয়েছে।

সদ‍্য রাত নেমেছে। অনেকে হয়তো জানে না তবে এই সময়টারও কিন্তু একটা রং আছে আকাশের। গলে যাওয়া সূর্যের লালচে আভাটা মিশে যেয়ে আঁধার নামার মাঝামাঝি সময়টার রঙ। খুব মায়াবী একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয় তখন। আর সেটার মাঝেই এক নতুন জোড়া ছাদে একসাথে পা রাখে।

শৈলীর এই ছাদের পছন্দের জায়গা হলো পুলের পাশের বিচ চেয়ার গুলো। সেখানেই সবসময় এসে বসে ও। আজও তাই করলো। মিহরান দাড়ালো ওর সামনে, পুলের পাশে, এক পা আরেক পায়ের সাথে ক্রস করে পিলারে হ‍্যালান দিয়ে। এক হাত পকেটে, আরেক হাতে মগ। কফিতে অবিরাম চুমুক পরছেই। শৈলী বসেই এদিক ওদিক চঞ্চল নয়ন বোলাচ্ছে। আবার আড়চোখে মানুষটাকেও দেখছে। সেই প্রথম সন্ধ‍্যার মতন আজও একটা টিশার্ট আর ফুল ট্রাউসার পরা সে। এটাই মনে হয় তার রাতের পোষাক। শৈলী না মেনে পারলোই না যে এইরকম পেটানো শরীরে এই কাপড়েও ছেলেটাকে ভীষণ রকম আকর্ষণীয় লাগে।
নিজের মাঝেই ঢোক গিলে শৈলী। এইসব কি কুচিন্তা মাথায় আসছে ওর? ছি ছি ছি। বিয়ের বয়স চব্বিশ ঘন্টাও হলো না আর ও কতো দূর এগিয়ে যাচ্ছে? আচ্ছা ওনার শরীর পেটানো, ও জানলো কেমনে? দেখেছে নাকি? দেখেনি তো, তাহলে? নিজেকে কড়া একটা বকা দিয়ে দমালো ও,
– শৈলী বেশী বাড় বেরেছিস তুই। এই ছেচড়ামো বন্ধ কর্।

-শৈলী আর ইউ ওকে?

ঘাবড়ে ওঠে শৈলী। আবার ঢোক গিলে। স‍্যার সব শুনে ফেলেনি তো আবার? গোল গোল চোখ করে তাকায়,
– আআ আই এ‍্যাম ফাইন।

মিহরান একটা রহস‍্যময়ী হাসি দেয়, তবে অবশ‍্যই খনিকের জন‍্য। শৈলী বোঝার আগেই সেটা মিলিয়ে যায়। অন‍্য কথায় গড়ায় মিহরান।

– আজ সকালে খামারবাড়ির বাইরে আমি কোথায় গিয়েছিলাম, আপনি জানতে চেয়েছিলেন তাই না?

মিহরানের প্রশ্নে শৈলী চোখ তোলে কিন্তু কিছু বলে না। ততক্ষণে মিহরান নিজের পকেট থেকে একটা এনভেলপ বের করে শৈলীর দিকে বাড়িয়ে দেয়। শৈলী প্রবল কৌতুহল নিয়ে সেটা নেয়,
– এটা কি?

মিহরান ভ্রু জোড়া উঁচিয়ে কফিতে এক চুমুক দেয়,
– খুলেই দেখুন।

কপালে ভাজ টেনে খামের দিকে মনোযোগ দেয় শৈলী। ওপর থেকে খুলে হাত ভেতরে দেয়। একটা কাগজের স্পর্ষ পায়। টেনে বের করতেই কপালের ভাজ সিধা হয়। মুহূর্তেই চেহারার রঙ বদলায়। লালচে ভাব ফোটে ওঠে। ওদের কাবিন নামার এক কপি দিয়েছে মিহরান ওকে।

মিহরান আবার কথা শুরু করলো,
-কাল এতো কিছুর মধ‍্যে এই কাবিন নামা ওদের থেকে নেওয়ার কথা মাথাতেই আসেনি। রাতেই অবশ‍্য রুমে যেয়ে মনে পরেছিল। তাই সকাল সকালই গিয়েছিলাম সেই হুজুর চাচার কাছে যিনি আমাদের বিয়ে পড়ালেন। তার কাছ থেকে আসল কপি চাইলে সে তো সেটা দিলেন না কারণ তার রেকর্ডসে রাখতে হবে। এতো সকালে ফটোকপির দোকানো খোলা পেলাম না। তাই ভালো মতন একটা স্ক্রিনশট নিয়ে এসেছিলাম। ঢাকায় এসে সেটা প্রিন্ট করিয়েছি।

শৈলী ভীষণ রকম লজ্জা পায়। ওদের বন্ধনের প্রমান ওর হাতে। কেমন একটা অনুভূতি সারা গায়ে ছড়িয়ে গেল ওর। কাঁপা হাতে কাগজটা আবার ফেরত দেয় মিহরানের কাছে তবে মিহরান সেটা নেয় না,
– এই কপিটা আপনার জন‍্যই। আমি আরেক কপি বানিয়ে নিজের কাছে রেখেছি।

বিনা বাক‍্যে শৈলী কাগজটা আবার নিজের কাছে ফিরিয়ে আনে। স্বযত্নে খামে ভরে ফেলে সেটা। নিজের কোলের ওপর রাখে।

মিহরানের এই মুহূর্তে শৈলীর মুখটা ভীষণ রকমের আদুরে মনে হয়। ফর্সা গালগুলো এই নিকস আঁধারেও স্পষ্ট জ্বলে আছে। আত্মসন্মানী ও আত্মবিশ্বাসী এই মেয়েটি ওর সামনে, ওর দুষ্টুমিতে কেমন যেন মিইয়ে যায়। তখন মন চায় ঐ গালগুলো টেনে দিতে। নিজের খেয়ালে মনে মনে নিজেই হাসে মিহরান। আপনাতেই কফিতে চুমুক দিতে গিয়ে চোখ পরে মগে। আর তারপর শৈলীর ওপর,
– আপনি কফি খান না শৈলী?

শৈলী নড়ে ওঠে। চিন্তামগ্ন থাকায় একটু চমকায় আর কি।
– হ‍্যা খাই তো।
– তাহলে আপনার মগ কই?

শৈলী আমতা আমতা করে,
-আসলে….দুইটা মগ আনলে মা প্রশ্ন করতো, আরেকটা কার জন‍্য…তাই…

মিহরান হঠাৎ নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। শৈলী অবাক,
-কোথায় যাচ্ছেন?
– বসুন, আসছি।

কিছুক্ষণের মাঝেই মিহরান আরেকটা মগ হাতে নিয়ে আসলো। শৈলীকে সেটা বাড়িয়ে দিতেই শৈলী ব‍্যস্ত হয়ে পরলো,
-আরে, আপনি আমাকে আবার কফি দিলেন কেন? আমি বাসায় যেয়ে আরেক মগ বানিয়ে খেয়ে নিতাম।
– আমার একা একা খেতে ভালো লাগছিল না।
-আপনার কম পরে গেল তো।
– কাল পুষিয়ে দিলেই হবে।

শৈলী আর কথা বলতে পারে না। লজ্জায় মুখে কুলুপ আটে। কিন্তু মিহরান ওকে চুপ থাকতে দিলে তো!

– কফি বানানো কোথা থেকে শিখেছেন?

শৈলী ওপরে চায়। বোঝার চেষ্টা করে প্রশ্নটা কম্প্লিমেন্টের সুরে আসছে না কম্প্লেইনের সুরে। বুঝতে ব‍্যর্থ হয়,
– নিজে থেকেই… ইউটিউব ঘেটে।
-হমম।
-কেন? ভালো হয়নি খেতে?

মিহরান বাঁকা হাসে,
– যদি বলি না, ভালো হয়নি?

ওমনি দৃষ্টি নামে শৈলীর। ভেতর থেকে কেন যেন বেশ খারাপ লাগে। কম্প্লিমেন্টই কি পেতে চাইছিল ওর মন? না পেয়েই কি এই হতাশা?

নিজের মাঝেই এমন ডুবে ছিল যে কখন মিহরান এসে ওর পাশে বসেছে ও খেয়াল করে নি।
– আপনার কফি তো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে শৈলী। খাবেননা?

শৈলী চকিতে পাশে তাকায়। মিহরান কে একই চেয়ারে বসতে দেখে একটু হকচকায়।
– হমম? ওও…খাচ্ছি।
– আগামীকাল থেকে আপনি আর কফি বানিয়ে আনবেন না।

কফিতে চুমুক দিতে গিয়েও থেমে গেল শৈলী। ওর এখন রীতিমতো কান্না পাচ্ছে। আচ্ছা লোকটা এতো বদ্ কেন? খারাপ হয়েছে কফি, মানলাম। তাই বলে সেটা বারবার বলতে হবে? কতো কষ্ট করে মা কে মিথ‍্যা বলে ও এসেছে এখানে। কতো যত্ন নিয়ে কফিটা বানিয়েছে। কিসের জন‍্য? এই অপমান শুনতে?

শৈলীও কন্ঠে গভীর অভিমান টেনে আনে,
– ঠিকাছে, বানাবো না আর কফি। হয়েছে?
– কেন বানাবেন না?

শৈলী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। মনে মনে বলে,
– গিভ মি আ ব্রেক। এই মানুষটার সমস‍্যা কি?
তারপর তাকায় রাঙা চোখে,
– আপনিই তো বললেন না বানাতে?
– আমি মোটেও সেটা বলিনি।
-মানে?
– আমি বানিয়ে আনতে না করেছি।
– একই তো হলো।
-মোটেও না।

শৈলী এবার বিরক্ত হয়। এতো ঘুরানোর কি আছে বাবা? সুরে ঝাঝ নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে,
– তাহলে আপনি কি বলতে চান?

মিহরান শৈলীর একটু কাছে আসে। কন্ঠ খাদে নামিয়ে ওর কর্ণকুহুরে শুধায়,
– এতো সুস্বাদু কফি আপনি নিচে থেকে বানিয়ে আনবেন না। এখানে এসে এই এ‍্যাপার্টমেন্টের কিচেনে বানাবেন। রোজ সন্ধ‍্যায়। এবং অবশ‍্যই সেটা দু মগ। আজ আমার আসলেই কম পরে গিয়েছে।

শির দ্বারা চিকন ঘাম বেয়ে পরলো শৈলীর। শীতল ঘামের রেখা সেটা। শ্বাস নিতে তো ভুলে গিয়েছে কবেই। চক্ষু জোড়া স্থির পুলের জলরাশিতে। দু হাত মগে চেপে ধরে না পারছে ভেঙে ফেলতে।

শৈলীর মুখের প্রতিটা ইঞ্চি যে লজ্জায় ঢেকে যাচ্ছে সরাসরি না দেখতে পারলেও একটুও বুঝতে বাকি নেই মিহরানের। ও নিজেও দাঁত দিয়ে ঠোট কামড়ে ধরে নিজের। অনুভূতি গুলো যেন খেলছে দুজনের মাঝে।

তখনই মিহরানের একটা ফোন আসায় দুজনের মধ‍্যকার এই নিস্তব্ধতা কেটে যায়। মিহরান এক্সকিউজমি বলে ওখান থেকে উঠে যায় ফোনটা রিসিভ করতে। ও যেতেই বন্ধ করা শ্বাস ফোস করে ছাড়ে শৈলী। আনমনেই মুখে ছড়িয়ে পরে তৃপ্তির হাসি। সাথে একটু কপট রাগও মেশানো তাতে,
কম্প্লিমেন্ট যখন দিবেই তো এমনেই বলতো। এভাবে শৈলীকে টেনে হিচড়ে লজ্জার কুপে ফেলে দেওয়ার মানে কি। যদি ও সেখান থেকে না উঠতে পারতো তখন?

শৈলী চোখ ঘুরিয়ে দূরে দাড়ানো পাঁচ ফিট দশ ইঞ্চি লম্বার মানবটার দিকে চোখ টেকায়। গতকাল সকালেই ও বুঝতে পেরেছিল এই মানবের প্রতি ওর ক্রাশ প্রেমে রুপান্তরিত হয়েছে। তখনও কি ও জানতো দিন গড়াতেই যার প্রেমে পরেছে সে ওর জীবন সাথীতে পরিনত হবে? জানতো না। আজও কেমন যেন বিশ্বাস হচ্ছে না ওর। কেমন এক পরিণয়ের প্রহেলিকায় আটকে পরেছে দুজন।

মিহরান কথা শেষ করে আসতেই শৈলী উঠে দাড়ায়,
– আমার এখন যাওয়া উচিত। আম্মু তাড়াতাড়ি ফিরতে বলেছিলেন।

মিহরান শৈলীর দিকেই তাকিয়ে বলে
– কাল ক্লাস আছে তো?
-হমম।
-কয়টায়?
– ১০ টা থেকে।
-মাহিরাদেরও কি একই সময়?
-জ্বী। আমরা তিনজন ক‍্যাম্পাসে একসাথেই যাই। চেষ্টা করি কোর্সের সময়টা মিলিয়ে নিতে।
-আচ্ছা। ঠিক আছে তাহলে আমি সাড়ে নয়টায় নিচে থাকবো।

শৈলী ঘাড় কাত করে সম্মতি বোঝায়। এরপর দুজনেই আবার একসাথে ছাদ থেকে বের হয়। মিহরানের দরজার কাছে এসে শৈলী নিজের হাতের মগের দিকে চেয়ে হঠাৎ ব‍্যস্ত হয়ে পরে,
– আরে এই মগটা ধোয়া হয়নি।

বলেই আবার ছাদে ফিরতে গেলে সেই মগের আরেক প্রান্তে টান পরে। শৈলী ফিরে তাকাতে তাকাতেই মিহরান মগটা ওর হাত থেকে নিয়ে নেয়, আর ওর হাতের মগটা যেটা শৈলী ওর বাসা থেকে নিয়ে এসেছিল সেটা ফেরত দেয়।
– আমি এটা ধুয়ে ফেলবো। আপনি এটা নিয়ে যান।

শৈলীর অলরেডি অনেক শিক্ষা হয়েছে। দেখা যাবে বাধা দিলেই আবার লজ্জায় ডুব দেয়ার ন‍্যায় কোনো কথা শুনতে হবে ওকে। কোনো দরকার নেই বাবা। চুপচাপ থাকাই ভালো।
এই চিন্তা অবলম্বন করেই মিহরানকে শৈলী আর বাধা দিল না।
-আসি?
-হমম। গুড নাইট।
-গুড নাইট।
– শৈলী আরেকটা কথা।
– জ্বী?

মিহরান হঠাৎই শৈলীর বেশ কাছে এসে পরে। শৈলী রিয়‍্যাক্ট করার পূর্বেই নিজেকে ঝুকিয়ে ওর ঠোট জোড়া নিয়ে যায় শৈলীর কানের কাছে। ফিসফিসানো কন্ঠে আওড়ায়,
– গতকাল রাতের পর থেকে আজীবনের জন‍্য আমাকে সরাসরি দেখার পুরো পারমিশনই আপনি পেয়ে বসে আছেন। তাই কষ্ট করে লুকিয়ে ছাপিয়ে দেখার প্রয়োজন নেই। চোখের কষ্ট হবে।

এই বলে সরে আসে মিহরান। শৈলীর গোলগোল চোখ আর পুরা লাল হয়ে যাওয়া মুখ দেখে ভীষণ মজা লাগে ওর। পুলের পাশে বসে যে শৈলী ওকে চেকআউট করছিল সেটা তখনই সে বুঝেছিল। মেয়েটার মনে এখন নিশ্চয়ই ঝড় চলছে। চলুক। এই ধরনের ঝড় তুফানের দরকার আছে।

শৈলী কোনমতে নিজের পা দুটোকে আদেশ করে ঘুরে সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে। রোবটের মতন এক তালে নেমে গেল ও। কোথাও থামলো না। এক মিলি সেকেন্ডের জন‍্যও না।

মিহরান বিচক্ষণতার সাথে দেখছে মেয়েটাকে। শৈলী কাবিন নামার খামটা এক হাতে ধরে ওড়নার নিচে লুকিয়েছে। সেটা দেখেই নিঃশব্দে হেসে দিল মিহরান। বেচারি নিশ্চয়ই নিজের রুমে পৌছানোর আগে আর ওই হাতটা সরাবে না।
……………….

যখন নিজেদের ফ্লোরের সিড়ির ঘরে পৌছালো শৈলী তখন নড়েচড়ে উঠলো ও। সাথেসাথেই আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে এক সিড়িতে ধপাশ করে বসে পরলো।

আয় হায় হায়! স‍্যার সব দেখে ফেলসে। শৈলীর ছ‍্যাছড়ামো বুঝে ফেলসে। ছি ছি কি লজ্জা! এখন ও কিভাবে যাবে এই মানবের সামনে? এমনিতেই লোকটা শৈলীর কোন কথা মাটিতে পরতে দেয় না। তার আগেই ধরে ফেলে। আর এখন?

শৈলী উঠে পরে। নিজের ওপর ভীষণ হতাশ হয়।
– নাহ! তোর দ্বারা কিচ্ছু সম্ভব না। তুই ফেইল শৈলী, ফেইল।
………………….

বাসায় ঢুকেই শৈলী এদিক ওদিক তাকিয়ে প্রথমে দেখে নেয় কেউ আছে কি না। নিজের বাড়িতেই চোরের মতন প্রবেশ করতে ওর বড্ড খারাপ লাগে। কিন্তু কিছুই করার নেই। সিচুয়েশন ডিমান্ড্স। কাউকে সামনে না পেয়ে শৈলী হাপ ছেড়ে বাঁচে। এক দৌড়ে নিজের রুমে ঢুকে দরজা লক করে ভেতর থেকে। দরজায় ঠ‍্যাশ দিয়ে দাড়িয়ে হাপায় কিছুক্ষণ। সারা শরীর কাঁপছে ওর ধরা পরে যাওয়ার ভয়ে। ওড়নার নিচ থেকে কাবিননামা টা বের করে। চোখের সামনে খামটা ওঠায়। এটা যদি পরিবারের কারও হাতে পরে তাহলে শৈলী শেষ। ওকে কেউ বাঁচাতে পারবে না, বাঁচাতে আসবেও না।

শৈলী সারা রুম জুড়ে চোখ বুলায়। লুকানোর যতার্থ স্থান খোজার চেষ্টা করে। নিজের আলমারি খোলে কিন্তু পছন্দ হয় না কোনো জায়গা। সবই খোলা এখানে, লুকানোর মতন কোনো স্পেস নেই। ড্রেসিংটেবিলের কোথাও রাখবে? না না। ওটা তো ও আর নিপুণ মিলে ব‍্যাবহার করে। ওখানে রাখার প্রশ্নই আসে না। খাটে জাজিমের তলায়ও রাখতে পারবে না। মা সপ্তাহে সপ্তাহে সব জাজিম তোষক নামিয়ে ঝাড়া দেয়। পরলে তখন সয়ং জমের হাতে পরবে এই বিয়ের সনদ। তাহলে কই রাখা যায়?

হঠাৎ শৈলীর কপাল টানটান হলো। নিজের ভার্সিটির ব‍্যাগটা ওঠালো ও। ওটাকে নিয়ে বিছানায় বসলো। এই ব‍্যাগটাকে ও আর ওর বান্ধবীরা কুয়া ডাকে, এতো গভীর জায়গা ভেতরে এই জন‍্য। সেই আশাতেই একদম ভেতরের সাইডে একটা পকেটের চেইন খোলে শৈলী। জায়গাটা দেখে সন্তুষ্ট হয়। এরপর খামটা ভালো করে ভাজ করে সেই পকেটে ঢুকিয়ে দেয়। তারপর চেইনটা শক্ত করে আটকায়। যাক! ভালো একটা লুকানোর স্থান পাওয়া গিয়েছে। এইখানে থাকলে শৈলীর আর কোনো চিন্তা নেই। সবসময় জিনিসটা ওর সাথেই থাকবে, ও গার্ড করে রাখতে পারবে।

ফোঁস করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে শৈলী। তারপর খাটে টান টান হয়ে শুয়ে পরে। ঠোট জোড়ায় ছেয়ে যায় স্নিগ্ধ হাসি। একটু পর সেটা খিলখিলানো হাসিতে রুপ নেয়। শৈলী নিজেও জানে না ও কেন হাসছে, তবে মনে এক সুখের জোয়ারের আগমনের টের পাচ্ছে ও। মিহরান নামক সুখের জোয়ার।

চলবে।

আজ পুরোটুকুই শুধু মিহরান-শৈলী কে নিয়েই লিখলাম। আমার পর্বটা ভালো লেগেছে। এবার আপনাদের অনুভূতি জানতে ইচ্ছে করছে। আমায় নিশ্চয়ই নিরাশ করবে না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here