বুকে_যে_শ্রাবণ_তার #পর্ব_১৪

0
237

#বুকে_যে_শ্রাবণ_তার
#পর্ব_১৪
#নিশাত_জাহান_নিশি

“একদম না। তুই আমার কাছে আসবিনা! যে ছেলের মায়ের প্রতি কোনো দায়িত্ব কর্তব্য নেই সেই ছেলেকে আমি ছেলে হিসেবে মানিনা! আজ থেকে তুই আমার শত্রু।”

বড়ো সড়ো এক ধাক্কা খেলো মিশাল। তবুও তার জায়গা বা দায়িত্ব থেকে একরত্তি টললনা! কাল রাতে সে যা করেছে সত্যিই ভারী অন্যায় কাজ করেছে। সব কাজ ফেলে রেখে তার প্রথমেই উচিত ছিল তার মায়ের ঔষধের ব্যবস্থা করা। এমনটা যদিও মিশালের মনে হচ্ছে! বিবেকের কাছে সত্যিই সে প্রশ্নবিদ্ধ। দায়িত্বহীনতা গ্রাস করছে তাকে। আর সেক্ষেত্রে তার মায়ের রাগ করাটাও তার কাছে নিতান্ত স্বাভাবিকই মনে হলো! জোর করে অধিকার খাটালো মিশাল। দু’হাতের শক্ত বন্ধনে তার মাকে তার বাহুডোরে চেপে ধরল! শক্ত গলায় বলল,

“আপনি শান্ত হোন মা। আগে নিজেকে ঠিক করুন। সুস্থ হওয়ার পর না হয় আমাকে যেভাবে খুশি সেভাবেই শাস্তি দিবেন! এই অবস্থায় আপনার উত্তেজিত হওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকর।”

ইতোমধ্যেই শাহনাজ বেগম মিশালের গাঁয়ে গড়গড়িয়ে বমি করে দিলেন! শরীরের সমস্ত শক্তি খুইয়ে তিনি মিশালের গাঁয়ে ঢলে পরলেন। তবুও বেশ ঝাজ দেখিয়ে অস্ফুটে গলায় বললেন,

“সুস্থ হওয়ার পর আমি তোকে এই বাড়ি থেকে বের করব মিশাল! আমার বাড়িতে আমি কোনো শত্রু রাখবনা।”

সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলনা মিশাল। কারণ, এসব হৃদয় ভাঙা কথা তার নিত্যদিনের পরিচিত। ব্যস্ত হয়ে পরল মিশাল অবচেতন শাহনাজ বেগমকে বিছানায় শুইয়ে দিতে। বমির গন্ধে যদিও মিশালের দম বন্ধ হয়ে আসছিল তবুও সে নিঃশ্বাস আটকে রাখার চেষ্টা করে তার মায়ের পাশে বসল। শুকনো একটি নেকড়া ভিজিয়ে এনে তার মায়ের চোখমুখ মুছে দিতে লাগল। সমস্ত শরীর আগুনের ন্যায় গরম হয়ে আছে শাহনাজ বেগমের। অবেচতন অবস্থায় তিনি মিশালের যত্ন টের পাচ্ছেননা! ইতোমধ্যে তেঁতুলের বাটি হাতে নিয়ে রুমকি ছুটে এলো তার মায়ের কাছে। মিশাল ততক্ষণে ভেজা নেকড়াটি তার মায়ের ঘাড়ে ভার করে পেচিয়ে দিলো। যেন হাই প্রেশার থেকে ঘাড়ে কোনো সমস্যা না হয়। জায়গা থেকে ওঠে মিশাল ব্যস্ত স্বরে রুমকিকে বলল,

“কাপড়টা চেঞ্জ করে দে মায়ের। আর তেঁতুলটা খাইয়ে দে। ততক্ষণে আমি ফার্মেসী থেকে ঔষধ নিয়ে আসছি। যদিও এতো সকাল ফার্মেসী খোলা পাবনা। দেখি কী করা যায়।”
“তুমিও ফ্রেশ হয়ে নাও ভাইয়া। চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে গতকাল তুমি রাতে ঘুমাওনি। চাইলে একটু ঘুমোতেও পারো।”
“কী বলিস? মায়ের এই অবস্থা আর আমি ঘুমোবো? কবে একটু বুদ্ধিসুদ্ধি হবে তোর বলতো?”

মলিন হেসে রুমকির মাথায় আলতো হাত ছুঁইয়ে মিশাল রুম থেকে বের হয়ে গেল। মিশালের যাওয়ার পথে সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রুমকি। পরক্ষণে বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল,

“তুমি কার জন্য কী করছ ভাইয়া? শত্রুকে আপন ভেবে নিজের ক্ষতি ডেকে আনছ?”

মিশাল তার রুমের দিকে এগিয়ে যেতেই সামান্তার মুখোমুখি হয়ে গেল! তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সামান্তা বিচলিত মিশালের দিকে তাকিয়ে রইল। ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বলল,

“চাচীকে বললেনা কেন কাল তুমি কোন কারণে চাচীর ঔষধ আনতে পারোনি?”

কলিজা মোচড় দিয়ে উঠল মিশালের! সামান্তা আবার হাঁটে হাঁড়ি ভাঙবেনা তো? এমনিতেই বাড়ির পরিস্থিতি ভালোনা৷ বিশেষ করে তার মায়ের শরীর ভালোনা। এর মাঝে এসব অশান্তি কার ভালো লাগবে? যদিও সামান্তার সাথে কোনো বিশ্বাস নেই! ভীত গলায় মিশাল শুধালো,

“মানে? কোন কারণে আনতে পারিনি?”
“আরে এতো ভয় পাচ্ছ কেন? বাইক রেইস সম্পর্কে কিছু বলতে বলিনি চাচীকে! কাল রাতে আমাদের বাসায় গিয়ে কিন্তু তুমি চাচীর জন্য ঔষধ আনতে পারোনি মিশাল ভাই। তখন তো অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল তাইনা?”

স্বস্তির শ্বাস ফেলল মিশাল। নিশ্চিন্ত গলায় বলল,

“ওহ্ আচ্ছা! এই ব্যাপার? একচুয়েলি মা এমনি অসুস্থ তাই কথা বাড়াতে চাইনি। তুই এক কাজ কর তো। আমার জন্য এক কাপ গরম গরম চা করে নিয়ে আয়। মাথাটা অনেক ধরেছে। চা টা খেলে হয়তো একটু রিলাক্স লাগবে।”

শুকনো ঢোঁক গিলল সামান্তা! মিশাল যে তাকে মহা অসাধ্য কাজ করতে বলল! ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে মিশালের দিকে তাকালো সামান্তা। অপারগ গলায় বলল,

“চা তো আমি বানাতে পারি ঠিকই। কিন্তু তুমি খেতে পারবে কি-না সন্দেহ!”

একগালে হাসল মিশাল! সামান্তার মাথায় গাড্ডা মারল। যেতে যেতে তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,

“হাহ্! তোর না-কি আবার বিয়ে ঠিক হয়েছিল! যে মেয়ে কি-না এক কাপ চা ঠিকঠাকভাবে বানাতে পারেনা সে না-কি আবার বিয়ে করতে চেয়েছিল। হাউ ফানি ইয়ার। দুনিয়ার কোনো ছেলেই তোর মতো অলস আর রান্নাবান্নায় অপারদর্শী মেয়েকে বিয়ে করবেনা কথাটা মিলিয়ে নিস!”

সামান্তাকে ক্ষ্যাপিয়ে দিয়ে রুমে ঢুকে মিশাল দরোজার ছিটকিনি আটকে দিলো! অপমান সইতে না পেরে সামান্তা তেতে গেল। একরোঁখা ভাব নিয়ে মিশালের দরোজার মুখোমুখি দাড়ালো। গলা উঁচিয়ে বলল,

“আমাকে চ্যালেঞ্জ করা তাইনা? এই সামান্তাকে চ্যালেঞ্জ করা? দাড়াও মিশাইল্লা আজ আমি তোমাকে এমন পার্ফেক্ট চা খাওয়াবো না? তুমি এই চায়ের স্বাদ জীবনেও ভুলতে পারবেনা! আজীবন এই চায়ের স্বাদ তোমাকে তাড়া করে বেড়াবে।”

হনহনিয়ে হেঁটে সামান্তা রান্নাঘরে চলে গেল। মনের মাধুরী মিশিয়ে চা বানাতে লাগল। আজ মিশালকে ভিন্ন চায়ের স্বাদ দিবে সামান্তা! কিন্তু চা-পাতা কতটুকু দিতে হবে বুঝতে পারছিলনা। স্বাদমতো চা-পাতা না হলে চা-টা যদি তেঁতো হয়ে যায়? তবে তো মিশাল তাকে কথা শুনাতে একতোলাও ছাড়বেনা! এমনকি তার থোতা মুখটাও তখন ভোঁতা হয়ে যাবে! কী যে করবে এখন সে। তখনি জেনিয়া যেন কোথা থেকে টপকে এলো। সামান্তার পাশে এসে দাড়ালো। মুখ টিপে হেসে বলল,

“আপু তুমি কী চা বানাচ্ছ?”

বিরক্তি নিয়ে সামান্তা ব্যঙ্গ করে বলল,

“না। একটু নুডলস বানাচ্ছি। খাবে তুমি?”
“নুডলসের মতোই তো মনে হচ্ছে! সেই কখন থেকে তুমি শুধু পানিই সিদ্ধ করে যাচ্ছ। না দিচ্ছ চা-পাতা, না দিচ্ছ চিনি!”

হকচকিয়ে উঠল সামান্তা৷ জেনিয়া তার দুর্বলতা বুঝে গেলনা তো? নিজের অপারদর্শীতা বুঝাতে চাইলনা সামান্তা! কোমরে হাত গুজে জেনিয়ার মুখোমুখি দাড়ালো। রগচটা গলায় বলল,

“আমাকে এতো জ্ঞান দিতে আসবেনা ওকে? আমি জানি চা কীভাবে বানাতে হয়। আজকের চা টা একটু ভিন্ন হবে! তুমি এসব বুঝবেনা। এভাবে মাথার উপর দাড়িয়ে না থেকে তুমি বরং তোমার খালামনিকে একবার দেখে এসো। হুট করেই অসুস্থ হয়ে গেছেন তিনি।”

ঘাবড়ে উঠল জেনিয়া। ঘুম থেকে ওঠেই এই মর্মান্তিক খবর তাকে শুনতে হবে তা কল্পনাও করতে পারেনি জেনিয়া। চিন্তিত সুরে সে শুধালো,

“কী হয়েছে খালামনির?”
“প্রেশার বেড়ে গেছে। যাও একটু সেবা যত্ন করে এসো খালামনিকে।”
“আমি এক্ষুণি যাচ্ছি।”

হুড়োহুড়ি করে রান্নাঘর থেকে প্রস্থান নিলো জেনিয়া। স্বস্তির শ্বাস ফেলল সামান্তা। পুনরায় চা বানানোতে মনোযোগ দিলো। নিশ্চিত হয়ে বিড়বিড় করে বলল,

“ভাগ্যিস এই বাঁচাল মেয়েটাকে আমি তাড়াতে পেরেছি। নয়ত পকপক করে আমার মাথা খেয়ে নিতো। শুধু কী তাই? আমার গোপন রেসিপিও মেয়েটা জেনে যেতো! তার স্বপ্নে চাওয়া বফ মিশালকে সব বলে দিতো!”

বলেই দেঁতো হাসল সামান্তা! চায়ের সাথে কিছুক্ষণ খুটিনাটি করে সে বড়ো কাপে এক কাপ চা ঢালল। চোখ বুজে চায়ের স্মেল নিয়ে বলল,

“আহ্। কী সুন্দর ঘ্রাণ! আজ তো মিশাল ভাইয়া আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হবেই হবে! এতই অবাক হবে, এতই অবাক হবে, এতই অবাক হবে যে…. থাক বাকিটা আর না-ই বা বললাম!”

ফুরফুরা মন নিয়ে সামান্তা বিড়বিড় করে গান গাইতে গাইতে মিশালের রুমে প্রবেশ করল। দরোজা ভেজিয়ে মিশাল ঔষধ আনতে যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছিল। শার্টগুলো নোংরা হয়ে আছে মিশালের! সময়ের অভাবে ধুঁতেও পারছেনা। সামান্য গাঁয়ের গন্ধও তার সহ্য হয়না। শাওয়ার নেওয়ার পরেও বমির গন্ধে তার গাঁ গোলাচ্ছে। শার্টের সবকটা বোতম লাগিয়ে মিশাল গাঁয়ের গন্ধ দূর করার জন্য পারফিউম স্প্রে করতেই সামান্তা এসে মিশালের পাশে দাড়ালো। চায়ের কাপটি মিশালের দিকে ধরল। মিটিমিটি হেসে বলল,

“এই দেখো। তোমার চা তৈরী!”

পাশ ফিরে মিশাল ভ্রু উঁচিয়ে সামান্তার দিকে তাকালো। পারফিউমটা গাঁয়ে স্প্রে করে সে ড্রেসিং টেবিলের উপর পারফিউমটি রাখল। সামান্তার হাত থেকে চায়ের কাপটি নিলো। চা টা ঠিক আছে কি-না তা যাচাই করার জন্য নাক টেনে চায়ের স্মেল নিলো। মনে হলো সব ঠিকঠাক আছে। ঘ্রাণটাও বেশ মজাদার আসছে। তবুও যেন সামান্তাকে বিশ্বাস হচ্ছিলনা তার! পুনরায় ভ্রু কুঁচকে সে সামান্তার দিকে তাকালো। শক্ত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“লবণ টবন মিক্স করে আনিস তো চায়ের সাথে? অথবা অতিরিক্ত চাপাতা?”
“এসব তুমি কী বলছ মিশাল ভাইয়া? আমার উপর কী একটুও বিশ্বাস নেই তোমার? কসম লাগে আমি লবণ টবন মিক্স করিনি চায়ের সাথে! বিশ্বাস না হয় তো তুমি একবার চুমুক দিয়ে দেখো।”

সামান্তার ভোলাভালা চেহারা, নাজুক চাহনি ও বিশ্বাস তৈরী করার মতো কথাবার্তা শুনে মিশাল সত্যিই বিশ্বাস করে নিলো সামান্তাকে! চুমুক দিয়ে দেখল, না সব ঠিকঠাক আছে! চায়ের টেস্টটাও অসাধারণ! পরিতৃপ্ত হয়ে মিশাল পুরো এক কাপ চা খেয়ে শেষ করল। সামান্তা এতো ভালো চা বানাতে পারে সত্যিই জানা ছিলনা তার! চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বরং সে ভালোই করল। অন্তত একটা জিনিস তো শিখল। খালি চায়ের কাপটি সামান্তার দিকে এগিয়ে দিলো মিশাল। সামান্তার একটু প্রশংসা করতে যাবে অমনি দেখল সামান্তা কদাচিৎ হেসে মিশালের দিকে তাকিয়ে রয়েছে! ছ্যাবলার মতো চাহনি তার! বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল মিশালের। সামান্তার হাসিকে কিছুতেই তার সুবিধার মনে হলোনা! আফসোস হতে লাগল কেন সে সামাস্তাকে দিয়ে আগে চায়ের টেস্টটা করালোনা! খারাপ কিছু করে তো তখনি ধরা পরে যেতো সামান্তা। নাকমুখ কুঁচকে মিশাল চ্যাচিয়ে বলল,

“এই? কী মিশিয়েছিস তুই চায়ের সাথে?”

অট্ট হেসে সামান্তা বলল,

“কেমন লাগল আমার চায়ের রেসিপি? থুরি! এটা তো শুধু চায়ের রেসিপি নয়। তেলাপোকার চায়ের রেসিপি!”

#চলবে…?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here