#হৃদয়_জুড়ে_তার_ছায়া
#পর্বঃ২৪
#আদওয়া_ইবশার
নিস্তব্ধ রজনী। রাস্তার কিনারা ঘেষে দুজন নর-নারী অজানা গন্তব্যে হেঁটে যাচ্ছে একে অপরের হাত ধরে। নিয়ন বাতির স্বল্প আলোয় চারিদিক আলোকিত। শুনশান নিরব পরিবেশটাকে হঠাৎ হঠাৎ দুই-একটা গাড়ি এসে স্বশব্দে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। একটা সময় দুজনের চলার গতি রোধ হয়। রাস্তার এক পাশে ছোট একটা কাঠের বেঞ্চে গিয়ে বসে দুজন।,
“তো কি ডিসিশন নিলেন?”
মৌনতা ভেঙ্গে প্রশ্ন করে ওঠে পাপড়ি। এমন প্রশ্নের কারণ বুঝতে না পেরে ভ্রু দ্বয় কিন্চিৎ কুঁচকে নেয় নাহিদ। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে জানতে চায়,
“কিসের ডিসিশন?”
“এই যে, আমার আজ এমন পরিস্থিতি। এখন তো শুধু শুধু আমার পিছনে ঘুরে আপনার সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। ছেড়ে যাবেন কবে?”
“হঠাৎ ছেড়ে যাবার কথা আসছে কেন?”
শুকনো হাসে পাপড়ি।। মাঝ রাস্তায় অবিরত ছুটে চল গাড়ি গুলোর দিকে দৃষ্টি রেখে জবাব দেয়,
“আমার মতো একটা ক্যান্সারের রোগীর সাথে থেকে নিজের জীবন নষ্ট করার মতো বোকামি নিশ্চয়ই আপনি করবেন না। আর কতদিনই বা বাচব আমি! বড়জোর ছয় মাস কি এক বছর। আমি এখন পুরো পৃথিবীর কাছে দুদিনের অতিথি। আজ অথবা কাল সবাইকে ছেড়ে এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যাব। আমার মতো এক মরিচিকার পিছনে ঘুরে আমি চাইনা আপনি আপনার মূল্যবান সময় টুকু নষ্ট করুন।”
এতোক্ষণের ধরে রাখা শান্ত মেজাজটা কিছুতেই আর ঠিক রাখতে পারলনা নাহিদ। রাগের তীব্রতায় মাথার দুপাশের শিরা ছিড়ে যাবার যোগাড়। পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে। দুহাত মুঠ করে রাগটাকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করল কতক্ষণ। কিন্তু সফল হলনা। কানের পাশে এখনো কেউ যেন পাপড়ির কথা গুলো রিপিট করে যাচ্ছে। রাগ সংবরণ করতে না পেরে এক সময় চেচিয়ে ওঠে,
“আর একবার মুখ দিয়ে ঐ শব্দ উচ্চারণ করলে জ্বিভ টেনে ছিড়ে ফেলব একদম। অ্যাই! আমি বলেছি একবারও ছেড়ে চলে যাব? কি মনে হয় আমাকে তোমার? প্লে-বয় আমি? মেয়েদের নিয়ে ফুর্তি করার স্বভাব আমার? এই হাত নিশ্চয়ই ছেড়ে যাবার জন্য ধরিনি। সেই দুপুর থেকে একের পর এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সম্মুখে পরে ভিতরটা আমার ঝাঝড়া হয়ে যাচ্ছে। প্রতিটা সেকেন্ড পেরোনোর সাথে সাথে আমি একদম এলোমেলো হয়ে যাচ্ছি। আমি আর নিতে পারছিনা। ঐ কথা গুলো যত সহজে বলে দিলে বিশ্বাস করো। ততটা সহজে আমি একদম হজম করতে পারছিনা। কথা গুলো একদম কাটা ঘায়ে নোনের ছিটার মতোই লেগেছে আমার।দয়া করে ঐসব কথার আঘাতে আর এলোমেলো করনা আমাকে।”
“আপনার ভালোর জনই বলছি এসব। আমি আপনাকে কিচ্ছু দিতে পারবনা। আমার থেকে কষ্ট ছাড়া কিছুই পাবেন না। মানুষ বছরের পর বছর সম্পর্কে জড়িয়ে থেকে সেই সম্পর্ক থেকেও একদিন মুক্তি নিয়ে চলে যায় অবলীলায়। আমাদের তো দেড় মাসের সম্পর্ক। তাহলে আপনি কেন পারবেন না? বিশ্বাস করুন! আমি চাইনা আপনি কখনো কষ্টে থাকুন। আমি সবসময় চাই আমার ভালোবাসার মানুষটা সুখে থাকুক। হোক সেটা আমার সাথে কিংবা অন্য কারো সাথে। দিন শেষে আপনাকে সুখী দেখতে পারলেই আমিও ভালো থাকব। আপনার কাছে আমার দুটো চাওয়া। এর আগে কখনো কিছুই চাইনি আমি। আজকে চাইব। আপনি যদি আমাকে একটুও ভালোবেসে থাকেন তাহলে সেই চাওয়া গুলো পূরণ করবেন আশা করি।”
কথাগুলো শেষ করে একটু থামে পাপড়ি। ঢোক গিলে শুকনো গলাটা ভিজিয়ে দেয়। নিচের দিকে ঝুকে আবারো বলতে শুরু করে,
“আমার প্রথম চাওয়া, আপনি নাজিম ভাইয়ের সাথে সব ঠিকঠাক করে নিবেন। মানুষ মাত্রই ভুল। একটা বয়সে এসে প্রায় ছেলে-মেয়েরাই মজার ছলে একাধিক সম্পর্কে জড়ায়। পরিণত বয়সে এসে কিন্তু সেই ছেলে-মেয়ে গুলোও অন্য সবার মতোই যেকোনো একজনকে ভালোবেসে তাকে আকড়ে ধরেই পুরোটা জীবন পার করে। নাজিম ভাইকে আমার থেকে ভালো আপনি চিনেন। আমার মনে হয় ওনি হয়তো সত্যিই নাদিয়াকে ভালোবাসে। না হয় সে কখনো আপনার বোনের সাথে অন্যসব মেয়ের মতো সাময়িক সম্পর্কে জড়াতো না। কথা গুলো একবার ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখবেন তাহলেই বুঝতে পারবেন। আপনি জানেন কি না জানিনা। নিজের বন্ধুর জন্য নাজিম ভাই তার ভালোবাসা বলিদান দিতেও প্রস্তুত। বন্ধু ভাগ্য সবার হয়না। হলেও খুব কম সংখ্যক মানুষই নিঃস্বার্থভাবে বন্ধুকে ভালোবাসতে পারে। আপনি সেই ভালোবাসার মানুষ গুলোকে পেয়েও দূরে ঠেলে দিচ্ছেন। এটা কি ঠিক করছেন?”
“আর দ্বিতীয় চাওয়াটা কি তোমাকে ছেড়ে যাওয়া?”
অত্যন্ত শীতল কন্ঠে জানতে চায় নাহিদ। পরিবর্তে অসহায় চোখে তাকিয়ে উপর নিচ মাথা নাড়ায় পাপড়ি। একটু একটু করে জলে পরিপূর্ণ হয় মায়াবী আক্ষিকুঠোর। কান্নামিশ্রীত কন্ঠে কাঁপা স্বরে বলে,
“আমি আপনার ভালো চাই।”
“কিন্তু আমি চাইনা। একটা কথা স্পষ্ঠ ভাবে শুনে রাখ যতদিন মাটির উপর থাকবে, ঠিক ততদিন আমি তোমার পিছু ছাড়বনা। যেদিন শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করবে সেদিনও কিন্তু আমার থেকে মুক্তি পাবেনা। যতদিন আমি বেচে থাকব। ঠিক ততদিন আমার ভালোবাসাও আমার স্বপ্নে বেচে থাকবে। সেই সাথে আজকে ছেড়ে যাবার কথা বলে যে কথার আঘাত টুকু দিলে সেটুকুও তাজা হয়ে থাকবে আমৃত্যু।”
***
পাপড়ির বাবা নজরুল ইসলাম মেয়ের অসুখের কথা জেনে দূর প্রবাসে বুক ফাটা আর্তনাদে লুটিয়ে পরেন। যে মেয়ে দুটোর নিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে নিজের জীবন-যৌবন পুরোটাই উৎসর্গ করল দেশ, পরিবার পরিজন ছেড়ে সুদূর প্রবাসে। সেই মেয়ে দুটোর থেকেই এক মেয়ের এমন কঠিন রোগের কথা শুনে নিজেকে কি আর স্থির রাখা যায়? দুদিনের ভিতর সব কিছু ছেড়ে চলে চলে দেশের মাটিতে। দিন রাত এক করে যে যেই ডাক্তারের কথা বলেছে সেখানেই ছুটছেন একটু আশার আলো খোঁজতে। সঙ্গে ছিল নাহিদ। সবশেষে ডাক্তার মনিরুজ্জামানের কথায় এবং সহযোগীতায় এক সপ্তাহের মাঝে পার্শ্বতর্বী দেশ ভারতের চেন্নাই তে অ্যাপোলো ক্যান্সার স্পেশালিটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় পাপড়িকে। দেশ ছেড়ে যাবার আগে রাফিন, লাবিব, নাজিম সহ নাহিদের পুরো পরিবারের সকলেই এসে দেখা করে যায় পাপড়ির সাথে। দেশ ছেড়ে চিকিৎসার জন্য ভিনদেশে যাবার সময়টাতেও পিছু ছাড়েনা নাহিদ। শত পাগলামি করে সবার নিষেধ অমান্য করে চাকরি ছেড়ে পারি জমায় পাপড়ির সাথে। দেশ ছাড়ার আগের পুরোটা সময় নাহিদের বাবা-মা, বন্ধুমহলের সকলেই পরিচিত হয় নাহিদের ভিন্ন এক রূপের সাথে। যে রূপ তার প্রেমিক সত্বার। সাইদুর রহমান, শাহিনূর অবগত হয় ছেলের বেপরোয়া প্রেমিক পুরুষ হয়ে ওঠা সম্পর্কে। যে ছেলে বড় হবার পর কখনো তার চোখে শত কষ্টেও অশ্রু দেখেনি। সেই ছেলের চোখেই প্রিয়তমার কষ্টে তারা অশ্রু দেখেছে। দেখেছে ভালোবাসা হারানোর ভয় কিভাবে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে তাদের ছেলেটাকে। সর্বদা হাস্যজ্জ্বল ছেলেটার মুখ থেকে কিভাবে হাসি বিলীন হয়ে গেছে সেটাও দেখেছে খুব কাছ থেকে। দুদিনের একটা মেয়ের জন্য ছেলের এমন অধঃপতন শাহিনূর প্রথমে মানতে না পারলেও চোখের সামনে নারী ছেলেটাকে মূর্ছে যেতে দেখে একসময় তার মনেও মায়া জাগ্রত হয় পাপড়ির জন্য। অনুমতি দেয় নাহিদকে সাথে যেতে। প্রতিটা মোনাজাতে দৃষ্টিকর্তার নিকট আকূল আবেদন জানায় ছেলের ভালোবাসার জয় দিতে।
চলবে…..
(এই গল্পের সবথেকে ছোট পর্ব এটা। অনেকটা এলোমেলো হয়েছে আজকের লেখা। লেখা শেষে দ্বিতীয়বার পড়ে রি-চেক দেবার মানসিকতাও পাচ্ছিনা। একটু মানিয়ে নিবেন কষ্ট করে। কথা দিচ্ছি আগামী কাল বড় একটা পর্ব পাবেন।)