#হৃদয়_জুড়ে_তার_ছায়া
#অন্তিম_পর্ব
#আদওয়া_ইবশার
মধ্য রাতের নিরবতাকে চূর্ণ করে স্ব-শব্দে দানব গতিতে ছুটে যাচ্ছে এম্বুলেন্স। ভিতরে থাকা এক নিস্তেজ প্রাণকে কেন্দ্র করে চলছে কিছু আপন মানুষের হাহাকার। ঘড়ির কাটা তখন এক এর কোঠা পেরিয়েছিল। পালক তখন বোনের মুখে হৃদয়বিদারক কথা গুলো শুনে কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে একসময় ঘুমের দেশে তলিয়ে যায়। ঘুম ছিলনা শুধু পাপড়ির চোখে। বড্ড অস্থির লাগছিলো তার। কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করেও ঘুম আসছিলো না। মনে হচ্ছিল মাথা দিয়ে আ’গুন বের হচ্ছে। ঘাম ছুটছিল পুরো শরীরে। ভেবেছিল চোখে-মুখে পানি দিলে হয়তো একটু ভালো লাগবে। তাই নিঃশব্দে ওঠে যায় বিছানা ছেড়ে। দু-কদম বাড়াতেই ধপ করে পরে যায় মেঝেতে। কিছু একটা পরার শব্দে ঘুম ছুটে যায় পালকের। পাশে বোনকে দেখতে না পেয়ে এদিক-ওদিক তাকাতেই দেখতে পায় মুখ থুবড়ে নিস্তেজ হয়ে মেঝেতে পরে আছে পাপড়ি। সাথে সাথেই শরীরের পুরো শক্তি দিয়ে চিৎকার করে ওঠে। পাশের রুম থেকে ছুটে আসে নজরুল ইসলাম, রওশন আরা। মেয়েকে মেঝেতে পরে থাকতে দেখেই বুঝে যায় খারাপ কিছু একটা ঘটে গেছে। কোনোমতে পাপড়িকে বিছানায় তুলে এম্বুলেন্স ফোন করে। আধ ঘন্টার মাঝেই পৌঁছে যায় হাসপাতালে। এম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে স্ট্রেচারে করে পাপড়িকে ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয়। পাপড়ি তখন নিভু নিভু চোখ মেলে একটু একটু চাইছে। পিটপিট চোখের পাতা মেলতেই দৃষ্টিগোচর হয় পাগলের মতো দৌড়ে আসা বিধ্বস্ত নাহিদকে। অসাড় হয়ে আসা শরীরে প্রাণপণ চেষ্টায় ডান হাতটা বাড়িয়ে ধরে দৌড়ে আসা নাহিদের দিকে। মনের কোণে ক্ষিণ একটু আশা। প্রণয় পুরুষের আলতো ছোঁয়া পাবে তার বলহীন হাতটুকু। হাজারটা অপূর্ণতার মাঝে পূর্ণতা পায় পাপড়ির সেই আশা টুকু। ছুটে এসে আকড়ে ধরে নাহিদ পাপড়ি র হাতটুকু। আঙুলে আঙুল স্পর্শ করেই জানান দেয়, “আমি আছি। ভয় নেই তোমার। আমাদের দুজনের ধীর বন্ধন কেউ কখনো ছিন্ন করতে পারবেনা।” পাপড়ির ফ্যাকাশে ঠোঁটের কোণে বুঝি একটু হাসির দেখা দেয়। ঠোঁট দুটো ফাঁক করে কিছু একটা বলে। শুনতে পায়না কেউ। তার আগেই তাকে নিয়ে যাওয়া হয় আইসিইউ এর ভিতর। আলগা হয়ে যায় পাপড়ি-নাহিদের হাতের বন্ধন। জড় বস্তুর মতোই থমকে দাঁড়ায় সেখানেই নাহিদ।
অপেক্ষা শব্দটা যে কতটা যন্ত্রণার সেটা একমাত্র তারাই জানে যারা কিছু একটা নিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে। কিন্তু শেষ হয় না সেই অপেক্ষার প্রহর। মনে হয় কতশত বছর পেরিয়ে গেছে। এখনো একটা নতুন দিনের সূচনা হচ্ছেনা। দীর্ঘ তিন ঘন্টা যাবৎ আইসিউ এর সামনে নজরুল ইসলাম, রওশন আরা, নাহিদ, পালক ধুকপুক হৃদয়ে অধীর অপেক্ষায় প্রহর গুণছে, কখনও ডাক্তার বেরিয়ে আসবে। কখন পজেটিভ কিছু বলবে। কিন্তু সেই অপেক্ষার অবসান আর হচ্ছেনা। তাদের অপেক্ষার প্রহর বাড়িয়ে দিয়ে ডাক্তার এখনো ভিতরেই রয়ে গেছে। মাঝে মাঝে দুই-একজন নার্স ছুটাছুটি করে বেড়িয়ে এস আবার ঢুকে যাচ্ছে। তাদের কাছে কিছু জানতে চাইলেও তারা বলতে পারছেনা কিছুই।
চারিদিকে তখন ফজরের আজান শোনা যাচ্ছে। কাছের দূরের সব গুলো মসজিদ থেকে এক সুরে আবহ্বান জানাচ্ছে ঘুম থেকে ওঠে সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য লাভের জন্য প্রার্থনায় মশগুল হতে। চারিদিকে একটু একটু আলো ফুটতে শুরু করেছে। কিন্তু ঘন কুয়াশার আস্তরণে সেটা বোঝা যাচ্ছেনা। মধ্যে হচ্ছে এখনো রাতের সেই তিমিরাচ্ছন্ন অন্ধকার গ্রাস করে রেখেছে প্রকৃতিকে। কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকার মাড়িয়েই পাপড়ির দুই মামা ছুটে আসে হাসপাতালে। দু-ভাই মিলে দুই পাশ থেকে রওশন আরা’কে আকড়ে ধরে বিভিন্ন কথায় শান্তনা দিয়ে যাচ্ছে। পাশেই মাথা নত করে নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছেন নজরুল ইসলাম। বাবার পাশে বসে পালক ফুপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। তাদের থেকে একটু দূরেই নাহিদ উদ্ভ্রান্তের মতো এলোমেলো বেহাল দশায় দাঁড়িয়ে আছে দেয়ালে ঠেস দিয়ে।
সকলের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে একসময় আইসিইউ থেকে বেড়িয়ে আসে ডাক্তার মারিয়ম এর সাথে আরও দুজন স্পেশালিস্ট। তীর্থের কাকের মতো কিছু একটা শুনতে ছুটে যায় সকলে। ঘিরে ধরে চারপাশ থেকে স্বজনেরা ডাক্তারকে। উৎকন্ঠা নিয়ে তাকিয়ে থাকে শুধু মুখের দিকে। কারো মুখ দিয়ে এক বিন্দু শব্দও উচ্চারণ হচ্ছেনা। তাকিয়ে আছে শুধু ফ্যালফ্যাল নয়নে।একে একে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে ডাক্তার মারিয়ম একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কিছু সময় চুপ থেকে বলে,
” ওর অনেক আগেই ইস্কিমিক স্ট্রোক হয়েছিল। যার কারণে মস্তিষ্কের রক্ত সরবারহে বিঘ্ন ঘটে। উই আর স্যরি। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। কিন্তু কিছুই করতে পারিনি। সি ইজ নো মোর।”
মাত্র কয়েকটা শব্দ। এই শব্দ গুলোই যথেষ্ট ছিল উপস্থিত প্রতিটা মানুষের মাথায় আকাশ ভেঙে দিতে। রওশন আরা সেখানেই এক চিৎকারে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পরে। তাকে ধরাধরি করে একজন নার্সের সহায়তায় পাপড়ির বড় মামা কেবিনে নিয়ে যায়। স্বজন হারানোর আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে হাসপাতালের চারপাশ। আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে পরে একটা শরীর থেকে প্রাণপাখি উড়ে যাবার খবর। পাপড়ি আর নেই। পাপড়ি নামক আদুরে মেয়েটার আর কোনো অস্তীত্ব নেই এই পৃথিবীর বুকে। প্রাণহীন নিথর যে শরীরটা আইসিইউ এর ভিতর সাদা কাপড়ে ঢাকা পরে আছে সেই দেহটাকে আর কেউ পাপড়ি নামে ডাকবেনা। সাড়ে তিন হাত মাটির নিচে সায়িত করার আগ পযর্ন্ত মানুষের মুখে উচ্চারিত হবে লা’শ নামটা। কেউ বলবেনা ঐখানে পাপড়ি ঘুমিয়ে আছে। সবাই বলবে ঐখানে পাপড়ির লা’শ পরে আছে। প্রথম যে সন্তানের মুখে বাবা নামক আদুরে ডাকটা শুনতে পেয়েছিলো নজরুল ইসলাম আজ সেই আদরের টুকরোটা চলে গেছে তাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে। যে মেয়েটার আঙুল ধরে হাঁটা শিখিয়েছিল, শিখিয়েছিল ছোট ছোট হাজারো বুলি সে আজ পরিণত হলো লা’শে। এর থেকে কষ্টে এক বাবার জীবনে আর কি হতে পারে? যে বোন ছিল পালকের একমাত্র খেলার সাথী, ছোট-বড় সমস্ত শখ, আহ্লাদ পূরণের উৎস। সেই বোনটাই আজ নেই। পাপড়ি তো জানতো পালক একা রাতে ঘুমাতে পারেনা। তবুও কিভাবে তাকে একা করে চলে গেল? এখন কাকে রাতে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবে পালক? কার কাছে বলবে পেটের ভিতর জমে থাকা এক একটা কথা? এই বোনটা ছাড়া তো পালক’কে এতো ভালো করে কেউ বোঝেনা। সেই বোনটাকে কেন সৃষ্টিকর্তা এভাবে কেড়ে নিল তার থেকে? বুকের ভিতরটা যে ছিড়ে যাচ্ছে পালকের। মনে হচ্ছে দুখের অতল সমুদ্রে ডুবে সে শ্বাস নিতে না পেরে দম বন্ধ হয়ে মা’রা যাচ্ছে। আর নাহিদ! সে তো মনে হয় এই পৃথিবীতেই নেই। কেমন ঝিম ধরে এখনো ঠাই দাঁড়িয়ে আছে। তার মস্তিষ্ক পাপড়ি নেই, এই কথাটা বোধহয় এখনো ধারণ করতে পারছেনা। অবাক দৃষ্টিতে বোবার মতো শুধু চারিদিকে তাকিয়ে সকলের কান্না দেখে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর দেখতে পায় আইসিইউ থেকে তিন-চারজন মিলে একটা স্ট্রেচার বের করে আনছে। যেটাতে সাদা কাপড়ে আপাতমস্তক ঢেকে রাখা হয়েছে একটা দেহ। কি যেন একটা ভেবে জড় বস্তুর মতোই স্ট্রেচারে রাখা দেহটর কাছে গিয়ে এক হাতে সাদা কাপড়টা একটু সরিয়ে নেয়। সাথে সাথেই চমকে ওঠে দু-কদম পিছনে সরে যায়। ছোট্ট একটা ঢোক গিলে অবাক, বিস্ময়ে ওয়ার্ডবয়’কে প্রশ্ন করে,
“ওকে এভাবে সাদা কাপড়ে ঢেকে রেখেছেন কেন? কমন সেন্স নেই আপনাদের? যদি দম বন্ধ হয়ে কিছু একটা হয়ে যায়! এমন কেয়ারলেস মানুষদের কে চাকরি দেয় হাসপাতালে?”
সকলের বিস্ময় দৃষ্টি স্থির হয় নাহিদের দিকে। এক পলক তার দিকে তাকিয়ে আবারও সকলেই দৃষ্টি ফিরিয়ে চোখ ভরে দেখে নেই পাপড়ি নিথর, প্রাণহীন মুখটা। কেমন নীল হয়ে একপাশে বেঁকে আছে! সহ্য হয়না কারো ঐ মুখটা। তাকিয়ে থাকতে পারেনা বেশিক্ষণ। ম’র’ন যন্ত্রণায় ছটফট করে ওঠে প্রতিটা স্বজনের প্রাণ। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতেই পালক আহাজারি করে নাহিদকে বলে,
“আমার আপু আর নেই ভাইয়া। আমার আপু আর নেই। আল্লাহ আমার আপুটাকে নিয়ে গেছে ভাইয়া। আমি এই য’ন্ত্র’ণা তো সহ্য করতে পারছিনা। কলিজাটা ছিড়ে যাচ্ছে আমার। আল্লাহ! আল্লাহ তুমি কেন আমাকে আপুর সাথে নিলে না? আমি কিভাবে থাকব আপুকে ছাড়া? ও আপু তুমি কেন চলে গেলে আমাকে ছেড়ে? কিভাবে থাকব আমি তোমাকে ছাড়া! একটুও ভাবলেনা আমার কথা! তুমি ছাড়া যে আমাকে আর কেউ বোঝেনা! এতোটা স্বার্থপর কেন হলে তুমি? কেন চলে গেলে! কেন!”
পাশ থেকে নজরুল ইসলাম এক টানে নিজের বুকে আগলে নেয় পালক’কে। বাবার বুকে পরে গলা কা’টা মুরগির মতো ছটফট করে পালক। তবুও মেয়েকে ছাড়েনা নজরুল ইসলাম। এই তো এই মেয়েটাই তার শেষ সম্বল। বেঁচে থাকার শেষ ভরসা। এক মেয়েকে হারিয়ে অর্ধ প্রাণ হারিয়েছেন। বোনের শোকে এখন যদি পালকের কিছু হয়ে যায় তাহলে তিনি আর বাঁচতে পারবেনা এই বিষাক্ত পৃথিবীতে।
চোখের সামনে থেকে যখন পাপড়ির দেহটা নিয়ে চলে যেতে শুরু করে ওয়ার্ডবয়। ঠিক তখনই সম্ভিত ফিরে পায় নাহিদ। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গিয়ে পাগলের মতো পাপড়ির মুখটা দুহাতে আকড়ে ধরে বলতে থাকে,
“এই পাপড়ি, এই! এভাবে শুয়ে আছো কেন? ওঠো। আরে ওঠো না! সবাই কি সব উল্টাপাল্টা বলছে শুনতে পাচ্ছোনা তুমি! পাপড়ি ! পাপড়ি চোখ খুলো। তাকাও আমার দিকে। ম’র’তে পারোনা তুমি। এভাবে আমাকে ছেড়ে যেতে পারোনা। এতো তাড়াতাড়ি তো তোমার যাবার কথা ছিল না! এতো নিষ্ঠুর কিভাবে হলে তুমি? আমাকে কেন একটু সময় দিলে না? আর দুটো দিন দিতে আমাকে। আমি তো আমাদের স্বপ্ন গুলো পূরণ করতে চেয়েছিলাম। তবে কেন এভাবে আমাকে নিঃস্ব করে চলে গেলে? কেন আমাকে একটু বাঁচার অবলম্বন দিয়ে গেলে না! কি নিয়ে বাঁচব এখন আমি? কিভাবে বাঁচব! চলে যাবেই যখন তবে কেন এতো মায়ায় জড়িয়ে দিলে আমাকে? এই মায়া কিভাবে কাটিয়ে উঠব আমি? আমি যে একেবারে নিঃস্ব। আমাকে একটু বেঁচে থাকার অবলম্বন দিয়ে গেলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেতো তোমার? এতো বড় অন্যায় কিভাবে করলে আমার সাথে তুমি?”
বিধ্বস্ত নাহিদ ভালোবাসার মানুষটাকে হারিয়ে পাগল প্রায়। উন্মাদের মতো চিৎকার করে ডেকে যাচ্ছে অনবরত পাপড়িকে। কোনো সারা নেই পাপড়ির। দেহের ভিতর প্রাণটা থাকলে তো সারা দিবে! প্রাণ পাখিটা যে এই নশ্বর পৃথিবীর মায়া ছেড়ে অনেক আগেই দেহ ছেড়ে পালিয়ে গেছে। কে বোঝাবে এই কথা পাগল নাহিদকে? আজ যে নাহিদ সত্যিই একা। একদম একা সে এই এতো বড় শহরে। কেউ নেই তার পাশে, যাকে আকড়ে ধরে নাহিদ প্রিয়তমার চিরতরে হারিয়ে যাবার শোক পালক করবে।
****
হাসপাতাল এরিয়া ছেড়ে মেইন রাস্তায় পাশাপাশি দুটো গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে গাজীপুরে নজরুল ইসলামের বাড়ির দিকে। লা’শবাহী ফ্রিজিং গাড়িটা পাপড়ির লা’শ বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। পিছন পিছন আরেক গাড়িতে যাচ্ছে সদ্য প্রিয় মানুষ হারিয়ে জীবন্ত লা’শে পরিণত হওয়া কিছু স্বজন। যোহর বাদ পাপড়ির জানাজার সময় ঘোষণা করা হয়েছে। ইতিমধ্যে আত্মীয় স্বজন সব লা’শ আসার আগেই বাড়িতে ভীড় জমিয়েছে। মহিলারা বাড়ির ভিতর কোরআন খতম দিচ্ছেন। পুরুষেরা ক’ব’র খোড়ার বন্দোবস্থা করছেন। লাবিব, রাফিন, নাজিম ঘুম থেকে উঠেই এমন একটা খবর পেয়ে ফাঁকা মস্তিষ্কে কিছুক্ষণ পুরো ঘটনা বোঝার চেষ্টা করে পরপরই যে যার কর্মস্থলে ফোন করে ছুটি নিয়ে বেরিয়ে পরে। একটাই চিন্তা তিন বন্ধুর মাথায়। না জানি নাহিদটা কেমন পাগলামি করছে! লাবিব নিজ দায়িত্বে রাজশাহী নাহিদের বাড়িতে খবর পৌঁছে দিয়েছে। সেখানেও সকলেই এমন একটা খবর পেয়ে হতবাক হয়ে যায়। যে মেয়েকে বিয়ে করবে বলে নাহিদ গতকাল বাবা-মায়ের সাথে এক প্রকার ঝামেলা করে বেড়িয়ে গেছে। আজ ভোর সকালেই কি না সেই মেয়েটার মৃত্যুর সংবাদ এলো! সকালের বাস না পেয়ে রিজার্ভ মাইক্রো ভাড়া করে ওরাও বেড়িয়ে পরে ঢাকার উদ্দেশ্যে।
যে উঠোনে একটা সময় পাপড়ি হেসে-খেলে পার করেছে। আজ সেই উঠোনেই পাপড়ির লা’শ রাখা হয়েছে। রওশন আরা’র বৃদ্ধ বাবার কড়া নির্দেশে খুব কাছের কয়েকজন পুরুষ ছাড়া গায়রে মাহরাম কোনো পুরুষকেই আর পাপড়ির লা’শ দেখার সুযোগ দেওয়া হয়নি। লাবিবরা এতো দূর থেকে ছুটে এসেও একটা নজর দেখতে পায়নি পাপড়ির নিষ্পাপ মুখটুকু। নাহিদকেও আর লা’শের আশেপাশেও থাকতে দেওয়া হয়নি। ছেলেটা নিদারুণ আর্তনাদে উপস্থিত প্রতিটা মানুষের পা জড়িয়ে পযর্ন্ত অনুরোধ করেছে আর একটা বার তার প্রিয়তমার মুখটা দেখার সুযোগ পাওয়ার আশায়। কিন্তু কেউ তার প্রতি একটু সদয় হয়নি। এক ভঙ্গুর হৃদয়ের ব্যর্থ প্রেমিকের বুক ফাঁটা আর্তনাদ কারো মন গলাতে পারেনি। বন্ধুর এমন করুন দশায় লাবিব, নাজিম, রাফিন কেউ ঠিক থাকতে পারেনা। তিনজনই নাহিদের কেঁদে ওঠে নিঃশব্দে।একটা সময় হাল ছেড়ে দেয় নাহিদ। যখন বুঝতে পারে তার আর কিছুই করার নেই। কেউ তাকে বুঝবেনা। দিবেনা শেষবারের মতো প্রিয়তমার মুখটা দেখার সুযোগ। তখন একদম পাথর বনে যায় নাহিদ। আর কোনো উচ্চবাচ্য করেনা। বহু কষ্টে রওশন আরা’কে একবার শুধু মেয়ের মুখটা দেখাতে সক্ষম হয় সবাই মিলে। এক নজর দেখে আবারও জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পরেন তিনি। পালকের শরীরটাও আর নিজের আয়ত্বে নেই। বল হারিয়ে নিস্তেজ হয়ে পরে। গলা দিয়ে আর কোনো শব্দ উচ্চারণ হয়না। পাপড়িকে শেষ গোসল করিয়ে সাদা কাপড়ে আবৃত করে নিয়ে যাওয়া হয় ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার ইট-পাথরের দালান-কোঠা রেখে চিরসাথী কবর নামক ঘরটাতে জানাযা শেষে রেখে আসার জন্য। নাহিদের পরিবার ঢাকায় পৌঁছনোর আগেই পাপড়ি নামক মানুষটার অস্থিত্ব একেবারে মুছে যায় পৃথিবীর বুক থেকে।
****
আকাশটা মেঘলা।ঘন ঘন বজ্রপাত হচ্ছে। এই বুঝি আকাশ কাঁদবে। অসহায় পালকের করুন নিনাদে বুঝি আকাশটারও মন খারাপ হয়েছে। তাকে সঙ্গ দিতে একটু পরেই হয়তো পুরো পৃথিবী ভাসিয়ে দিবে কেঁদে। অতীতের স্মৃতি হাতরে বোন হারানোর ক্ষতটা যেন আবারও তাজা হয়ে উঠেছে পালকের। চারটা বছরে এখনো বোনের সরল মুখটা ভুলতে পারেনা পালক। ভুলতে পারেনা তাকে বলা বোনের শেষ কথা গুলো। যার কারণে আজও বেহায়ার মতো পরে আছে নাহিদের পিছনে। বোনের কথা রাখতে গিয়ে এই নিষ্ঠুর মানবের পিছনে ঘুরে কবে যে পাষাণ পুরুষটাকে পালক মন দিয়ে বসেছে এই কথা সে নিজেও জানেনা।
ইতিমধ্যে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পরা শুরু করেছে। পিছন ঘুরে থাকা নাহিদ এতোক্ষণে মুখ খুলে।
“ঘরে যাও। বৃষ্টি আসছে।”
রাগ হয় পালকের। কেমন পাষাণ এই পুরুষ! কোন ধাতুর তৈরী! সে যে এতোক্ষন পযর্ন্ত অতীত বিচরণ করে কাঁদল তখন তো একটাবার তাকে একটু শান্তনা অব্দি দিলনা। তবে এখন কেন এতো আহ্লাদ হচ্ছে তার জন্য? বৃষ্টিতে ভিজলে কি পালক ম’রে যাবে? ম’র’তে পারলে তো আরও ভালো হয় তার জন্য। এই পৃথিবীর কেউ তো তাকে বুঝেনা। সবাই শুধু কষ্টই দেয়। যে মানুষটা বুঝতো সে’ও ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে চার বছর আগে। কন্ঠে জেদ নিয়ে পালক ত্যাড়া জবাব দেয়,
“যাবনা। যার শত কষ্টেও মৃ’ত্যু নেই তার বৃষ্টিতে ভিজেও কিছু হবেনা।”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে কান্নার ঢোক চেপে আবারও বলে,
“নাহিদ ভাই! আর কত? আর কত অপেক্ষা করিয়ে রাখবেন আমাকে? একটুও কি মন গলেনা আমার জন্য?”
“এক কথা কতবার বলতে হয় তোমাকে?”
তাচ্ছিল্য হাসে পালক। নিস্তেজ কন্ঠে বলে,
“হয়তো যতদিন বেঁচে আছি ততদিনই বলতে হবে। যেদিন আপুর মতো আমিও চলে যাব সমস্ত পিছুটান ছেড়ে সেদিন আর কেউ আপনাকে বিরক্ত করবেনা। কিন্তু আমার কি মনে হয় জানেন? সেদিন আপনি খোঁজবেন আমাকে। এখন যেভাবে আপুকে খোঁজে বেড়ান। ঠিক সেভাবেই পাগলের মতোই খোঁজে বেড়াবেন আমাকে। কিন্তু সেদিন শত খোঁজেও কোথাও পাবেন না আমায়। তবে কি জানেন! এমনটা হোক তা আমি চাইনা। আমি চাই মৃত্যুর আগেই আপনি আমাকে একটু বুঝোন। একটু আগলে দিন। সেই অপেক্ষাতেই আমি প্রহর গুণছি। সবসময় সবার ভাগে শুধু খারাপই হয়না। আমি বিশ্বাস করি আমার খারাপ দিন পেরিয়ে খুব শিগ্রই নতুন ভোর আসবে। যে ভোরে আপনি আমার হবেন।”
আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না পালক। এক ছুটে চলে যায় বাড়ির ভিতর। থমকে দাঁড়ায় নাহিদ সেখানেই। এতো গুলো বছরেও যে মেয়েটা তার মন গলাতে পারেনি। সেই মেয়েটার কিছু কথায় আজ তার মনে কেমন ঝড় সৃষ্টি হয়েছে! বুকের বা-পাশ দ্রিম দ্রিম করে কেমন শব্দ তুলছে।অদ্ভুত নয়নে কথা গুলো ভাবতে ভাবতেই নাহিদ ফিরে তাকায় পালকের যাবার পানে। তবে কি নাহিদের হৃদয় জুড়ে পাপড়ি ব্যতিত অন্য কারো ছায়া পরবে! পরলে পরুক নতুন কোনো নারীর ছায়া। ক্ষতি কি তাতে? পাপড়ি থাকুক পাপড়ির জায়গায়। পালকের জন্য নাহিদের মনের এক কোণে একটু জায়গা হোক। দ্বিতীয়বার ভালোবাসা আসুক নাহিদের জীবনে। ভালো থাকুক সকল ভালোবাসা। বেঁচে থাকুক আজীবন নিভৃতে যতনে।
সমাপ্তি
( ২৫ পর্ব থেকেই চেষ্টা করছিলাম গল্পের ইতি টানার জন্য। অবেশেষে আজকে তা সম্ভব হলো। শেষটা হয়তো অনেকের ভালো লাগবেনা। তবে আমার কিছুই করার নেই। আমি আমার আত্মতৃপ্তির জন্য লেখি। গল্পের সমাপ্তিটা যেভাবে ভেবে রেখেছিলাম আমি ঠিক সেভাবেই দিয়েছি। তবে হ্যাঁ। একটা আশা আছে। পরবর্তীতে আবারও কোনো একসময় নাহিদ পালক’কে নিয়ে লিখব। যারা যারা নাহিদ পালকের ভালোবাসার পূর্ণতা দেখার অপেক্ষায় ছিলেন তাদের জন্য কোনো একসময় আবার লেখব। এই গল্পের সিরোনামেই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ আসবে। তবে সেটা এখন না। নতুন একটা গল্প শেষ করে তারপর। যারা যারা শুরু থেকে গল্পটার পাশে ছিলেন তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞ আমি।)