#পরাণ_দিয়ে_ছুঁই (২য় পরিচ্ছেদ)
#পর্বঃ২৩
#Jhorna_Islam
ইসরাতের কেন জানি মনে হচ্ছে এখনই মারা যাবে।নিশ্বাস কেমন বন্ধ হয়ে আসছে।হাত পা কেমন অসার হয়ে আসছে। আজ অনেক দিন পর চোখ দিয়ে পানি ঝড়ছে, হয়তো ভালোবাসার মানুষকে অন্যের হয়ে যাওয়া দেখে। কি সুন্দর হাসছে প্রাণ খুলে মনে হচ্ছে পৃথিবীতে তার থেকে বেশি খুশি আর কেউ নেই। ভালোবাসার মানুষকে হাসি-খুশি দেখে তো সবচেয়ে বেশি খুশি হওয়া দরকার কিন্তু ইসরাত কেন পারছে না? কেন কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে তার? কেন ভালোবাসা নামক মরণ ব্যাধীতে সে আক্রান্ত হতে গেলো।মাথা কেমন শূন্য হয়ে গেছে। ওদের কাছে যাওয়ার আর মেয়ে টা কে দেখার শক্তি জুগিয়ে উঠতে পারছে না ইসরাত। মনে মনে একটাই দোয়া করে চলেছে আল্লাহ আমাকে শক্তি দাও। হাত থেকে পার্স টা অনেক আগেই পরে গেছে ঐটা বহন করার ও শক্তি নেই। অনেক কষ্টে ঘুরে দাঁড়ায় ইসরাত। এখানে আর এক মুহূর্ত থাকলে সে নিশ্চিত মা’রা যাবে। ঘুরে হাঁটা ধরার আগে পিছনে ঘুরে আরেকবার তালহার দিকে তাকায়। তালহার দিকে তাকাতেই আবার শব্দ করে কান্না বের হয়ে আসে। তারাতাড়ি দুই হাতে মুখ চেপে ধরে অনেক কষ্টে ঐখান থেকে দৌড়ে অন্য পাশে চলে আসে। এই দিকটা নির্জন লোক সমাগম নেই তেমন।ইসরাতের মনে হতে লাগলো এখন জোরে কান্না না করলে সে দ’ম বন্ধ হয়ে মা-রা যাবে। মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে জোরে শব্দ করে কান্না করে দেয়। নিজেকে আর সামলাতে পারে না নিজের চুল খা’মচে ধরে কান্না করতে লাগে। খালি একটা কথাই বিরবির করে আল্লাহ আমি যা দেখেছি তা ভুল প্রমান করে দাও গো। সব যেনো ভুল হয়। আমি ভুল দেখেছি তাই না? আল্লাহ আমার এতো কেন কষ্ট হচ্ছে।
“তোমার পৃথিবীতে কি অক্সিজেনের ঘাটতি হচ্ছে গো,আমার নিশ্বাস নিতে কেন কষ্ট হচ্ছে? ”
নিজের গালে নিজেই থাপ্পড় দিয়ে বলে,,সে এড়িয়ে যাওয়ার পর ও কেন আমি তার সাথে এমন করে আঁটকে পরলাম,কেন এমন করে জড়িয়ে গেলাম? তার সাথে অন্য মেয়ে কে দেখলেই আমার ভিতর কেন ঝড় উঠে? আরো নানান ধরনের প্রলাপ বকতে থাকে ইসরাত।নিজের হুঁশ যেনো সে হারিয়ে ফেলছে। কি বলছে কি করছে নিজেও জানে না।সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে চলল ইসরাত একই ভাবে বসে আছে। চোখের পানি শুকিয়ে গালে দাগ হয়ে আছে।খুশি মনে সেজে আসা সবকিছু চোখের পানির সাথে ভেসে গেছে। সাজ সব নষ্ট হয়ে গেছে। এখন আর চোখ দিয়ে পানি ঝড়ছে না মাঝে মাঝে শুধু এতক্ষন কান্না করার জন্য নিশ্বাস বেড়ে যাচ্ছে। চোখ গুলো ফুলে ঢোল হয়ে আছে। হুট করে কারো হাতের স্পর্শ পায় কাঁধে কিন্তু তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে না ইসরাতের।
“কি হইছে তোমার মা? তুমি কি অসুস্থ? অনেকক্ষন ধরে দেখতাছি বইসা আছো, কোনো বিপদে পরছো?”
এতো প্রশ্ন শুনে ইসরাত ঘুরে তাকায়। একটা মহিলা কাঁধে সাদা বস্তা ইসরাত বুঝতে পারলো মহিলাটা ফেলে দেওয়া বোতল-টোতল সংগ্রহ করে। মহিলা টা মনে হয় ইসরাতের মুখ দেখে আঁতকে উঠে। কাঁধের ব্যাগ মাটিতে রেখে ইসরাতের কাছে বসে পরে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,,, চোখ, মুখের কি অবস্থা! তোমার মনে কি অনেক দুঃখ?
মহিলাটার কথায় ইসরাত উত্তর দিতে পারলো না। সে চুপ করে এদিক ওদিক তাকায়।মহিলা টা বোধয় বুঝতে পারছে ইসরাত কিছু বলতে চায় না তাই মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,, বাড়ি যাও মা এমন করে কষ্ট পেতে হয় না। নিজের মন রে শক্ত করো। আমার বয়স তো কম হলো না কিছুটা হলেও বুঝতে পারি। মায়ের বুকে ফিরে যাও শান্তি মিলবে।বলেই মহিলা টা ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে চলে যায়। ইসরাত মহিলাটার যাওয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়।
মনে মনে বিরবিরায়,,,,
❝কেহ জানিবে না মোর গভীর প্রণয়
কেহ দেখিবে না মোর অশ্রুবারিচয়
ভেবেছিনু মনে মনে দূরে দূরে থাকি
চিরজন্ম সঙ্গোপনে পূজিব একাকী।❞
রবীন্দ্রসঙ্গীত
তারপর উঠে দাঁড়ায়। একটা রিকশা নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দেয়।
রিকশা থেকে নেমে ভাড়া দেওয়ার কথা ও মাথায় নেই আর হাতে না আছে পার্স।পার্স তো ঐখানেই ফেলে এসেছে। ইসরাত কে চলে যেতে দেখে রিকশা চালক ডাকতে থাকে ভাড়া দেওয়ার জন্য। ইসরাতের কোনো পাত্তা নেই সে বাড়ির ভিতর চলে গেছে। রিকশা চালকের চিল্লানিতে ইসরাতদের পাশের বাড়ির এক লোক এসে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে? রিকশা চালক জানায় তার ভাড়া না দিয়েই চলে গেছে। লোকটা ইসরাতদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবে হয়তো ভাংতি নেই তাই আনতে গেছে। লোকটা নিজের পকেট থেকে টাকা বের করে রিকশাচালক কে দিয়ে বিদায় করে দেয়। রিকশা চালক ইসরাত কে কথা শুনাতে শুনাতে চলে যায়।
ইসরাত বাড়িতে ঢুকে দেখে মা সোফায় বসে কাঁথা সেলাই করছে। ইসরাত গিয়ে কিছু না বলে মায়ের কোলে মুখ লোকায়।
” কিরে কি হয়েছে? আজ হঠাৎ মায়ের কাছে আসতে ইচ্ছে হলো যে। শরীর ঠিক আছে তোর?
ইসরাত কোনো উত্তর দেয় না। ইসরাতের মা উত্তর না পেয়ে কপাল কোঁচকায়। ভাবে বের হলো কি ফুরফুরে মেজাজে এখন আবার কি হলো। ইসরাত মায়ের কোলে শুয়ে কেন জানি একটুও কাঁদতে পারলো না। কান্না তার আসছে না ঘুমে চোখ বুঁজে আসছে তার।কিছুতেই চোখ খোলা রাখতে পারছে না তারউপর মা আবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। এক সময় ইসরাত ঘুমিয়ে যায়।
*********
সৌন্দর্য স্টপ বলেই মহিলাটার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকায়। কিছু বলতে যাবে তার আগেই মহিলাটার হাসবেন্ডের ডাক আসে। সৌন্দর্য আর নূরের দিকে তাকিয়ে চলে যায় এখান থেকে। নূরের খুব রাগ হলো ফাতিহা সম্পর্কে জানতে পারতো কিন্তু সৌন্দর্যের জন্য পারলো না। একেই তো নিজেরা কেউ কিছু বলছে না তার উপর অন্য কেউ বললে কেন আটকাবে? ফাতিহার মা বানিয়েছে অথচ মেয়ের সম্পর্কে সবকিছু এরা জানতে দিচ্ছে না।
“কি সমস্যা কি আপনার? ” জোরে বলে উঠে নূর।
নূরের এমন ভয়েস শুনে সৌন্দর্য বেশ অবাক হয়। এই পর্যন্ত এমন দ্বারা কখনো দেখেনি।
আমিকি মানুষ? একটার পর একটা আমার থেকে লুকিয়ে রেখেছেন। অসয্য হয়ে গেছি এসবে।আপনারা এসব লুকোচুরি প্লিজ বন্ধ করুন।একটা মানুষকে আর কতো ধোঁয়াশায় রাখবেন বলতে পারেন? আমি কি আদৌ নিজের মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছি আপনাদের?
নূর এসব কেমন বিহেভ?
দেখতে পারছেন না কেমন বিহেভ? আমি দেখে এখনও ভালো বিহেভ করছি বলেই চিল্লিয়ে উঠে। নূরের চিল্লানিতে আশেপাশের সকলেই ওদের দিকে তাকায়। ফাতিহা নিজেও দৌড়ে আসে ম্মামার কি হয়েছে দেখার জন্য। সৌন্দর্য পরিস্থিতি সামলানোর জন্য নূরের হাত ধরে বলে চলো আমার সাথে। নূর সৌন্দর্যের হাত ঝটকা মেরে ফেলে দিয়ে বলে,,,কোথাও যাবো না সব সত্যি না জানা অবদি।সব জানতে চাই আমি।ফাতিহার সম্পর্কে এ টু জেড সব।রাগে এটাও ভুলে গেছে ফাতিহা পাশেই আছে।
সৌন্দর্য নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে দাঁতে দাঁত পিষে বলে,,এটাই বলতে নিয়ে যাচ্ছি আসো আমার সাথে। নূর আগে আগে হাঁটা দেয়। সৌন্দর্য হাঁটতে গিয়ে দেখে তার হাতের আঙুল ছোট্ট হাতের আঙুল দিয়ে আঁকড়ে ধরা। ফাতিহার কাছে বসে বলে,,কিছু হয়নি মাম তুমি গিয়ে খেলা করো আমরা আসতেছি।
ফাতিহা ছলছল চোখে তাকিয়ে বলে,,মি. ওয়াহিদ মাম্মা কি আমাকে ফেলে আবারও চলে যাবে?
সৌন্দর্যের বুকে কথা টা তীরের মতো গিয়ে বিঁধে। ফাতিহাকে নিজের কাছে নিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বলে একদম না। মাম্মা এবার কোথাও যাবে না, যেতে চাইলেও দিবো না। আমরা বাপ বেটি মিলে ভালোবাসা দিয়ে আঁটকে রাখবো ঠিক আছে?
ফাতিহা মাথা নাড়িয়ে জানায় ঠিক আছে। সৌন্দর্য ফাতিহা কে খেলতে বলে নূরের কাছে যায়।
“বলো কি জানতে চাও।”
আপনি জানেন না কি জানতে চাই? ফাতিহার সম্পর্কে জানতে চাই। কে এই ফাতিহা? কি তার পরিচয় আপনার মেয়ে তো না। আর তিহা বলায় এতো কিসের বাঁধা। সব জানতে চাই সব।
ফাতিহা আমার ভাই আইমিন বড় আব্বুর ছেলে রূপের মেয়ে। রূপ ভাই আমার থেকে পাঁচ বছরের বড়।আমার ছোট বোন সোহানা আর রূপ ভাই স্বামী স্ত্রী। একে অপরকে ভালোবেসে বিয়ে করে। অবশ্য ছোট থেকেই ওদের বিয়ে ঠিক করা ছিলো। ফাতিহা তাদেরই একমাত্র আদরের মেয়ে। হ্যাপি ফ্যামিলি ছিলো দেশের বাইরে থাকতো রূপ ভাই আর সোহানা ফাতিহা কে নিয়ে। ফাতিহার সাথে অবশ্য প্রতিদিন আমার ফোনে কথা হতো।মেয়ে টা আমি বলতে পা/গল। ফাতিহার মা বাবা তাকে আদর করে তিহা বলে ডাকতো। একদিন হুট করেই সোহানা আমায় ভিডিও কল দিয়ে বলে,ভাইয়া তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে বলোতো কি?
আমি মুচকি হেসে বলি বিডিতে এসেছিস আমার মাম কে নিয়ে।
সোহানা মুখ গুমড়া করে বলে উফফ ভাইয়া তুমি কি করে বুঝে যাও বলোতো?
তোর পিছনে তাকিয়ে দেখ গা/ধী। সোহানা পিছনে তাকিয়ে দেখে একটা দোকানে লিখা রহমত চাচার পানের দোকান। তারপর নিজেই নিজের কপাল চাপড়ায়। সৌন্দর্য হেসে বলে,, লোকেশন সেন্ড কর আমি আসছি।সোহানা লোকেশন সেন্ড করে। তিনজনের হাসি মাখা মুখ দেখে আমি কল কাটি তবে বুঝতে পারিনি ঐখানে গিয়ে দুইজনের রক্তাক্ত মুখ দেখতে হবে। রাস্তা পার হতে গিয়ে এক্সিডেন্ট,,,, আর বলতে পারে না সৌন্দর্য নিজের মুখ ঢেকে চুপ হয়ে যায়। শরীর কেমন নরে উঠছে।
নূর ভেবে নিলো হয়তো লোকটা কাঁদছে চোখের পানি দেখাতে চাইছেনা বলে মুখ ঢেকে রেখেছে। নূর সৌন্দর্যের কাঁধে হাত রাখে।
আমি ঠিক আছি বলেই মুহূর্তের মাঝে নিজেকে সামলে নেয় সৌন্দর্য। তারপর আবার বলা শুরু করে।
রাস্তা পাড় হতে গিয়ে ট্রাকের নিচে,,, ওরা নিজেদের বাঁচাতে না পারলেও নিজেদের অংশ কে বাঁচিয়ে দিয়ে যায়। ফাতিহা কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়ায় সে বেঁচে যায়। হয়তো নিজেরা ও সরে পরতে পারতো কিন্তু ঐযে বিপদের সময় মাথা কাজ করে না। ওদের মাথায় হয়তো এটাই ছিলো ফাতিহা কে বাঁচাতে হবে। আমি গিয়ে দেখতে পাই ফাতিহা বাবা মায়ের কাছে চুপচাপ বসে আছে। আমাকে দেখে কোলে উঠে বলল,,মি. ওয়াহিদ আমার ভয় করে ব্লাড দেখলে। ঐ মুহূর্তটায় আমি কিভাবে কি করেছি নিজেও জানি না। প্লিজ আর কিছু জিজ্ঞেস করো না।
নূর বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় তারপর দৌড়ে সেখান থেকে চলে আসে। সৌন্দর্য বসে বসে নূরের চলে যাওয়া দেখে উদাস ভঙ্গিতে আবার অন্য দিকে তাকায়।
চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে ধরা দেয় পুরনো দিনের সেই স্মৃতি। সৌন্দর্য সোহানার খুনশুঁটি। সকলে মিলে হেসে খেলে জীবনের অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়া। বিভীষিকা ময় সেইদিন যেদিন বোন ভাই এক সাথে হারিয়েছে। ভাবতে ভাবতে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
#চলবে?,,,,