#ফিরে_আসা২
৮
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
পরপর কতগুলো বিজ্ঞাপনের শুটিং নিয়ে ব্যস্ত থাকায় নওশীনের ব্যাপারটা একেবারে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল আরশাদ। কাজের ব্যস্ততা তাকে অযাচিত সব চিন্তাভাবনা থেকে দূরে রাখে। তবে গভীর চিন্তা থেকে এখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি অরা। ভেতরে ভেতরে এক ক্ষীণ অপরাধবোধ তাকে শেষ করে দিচ্ছে।
একজন জন্মদাত্রী মা শুধুমাত্র তার কারণে নিজের মেয়েকে দেখতে পারছে না।
যদিও অরা নিজেকে বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করছে। এতে তার অপরাধবোধে ভোগার কিছু নেই। কাগজে-কলমে কথার একমাত্র অভিভাবক তার বাবা। আরশাদের একমাত্র সিদ্ধান্ত, কথা দেখা করবে না নওশীনের সঙ্গে।
নিজের দাঁড়ানো যুক্তি মেনে নিতে নিজেরই কষ্ট হচ্ছে অরার। কাগজে-কলমে কথার একমাত্র অভিভাবক আরশাদ হলে কী হবে? মেয়েটার জীবনের বেশির ভাগ সিদ্ধান্তই নেয় অরা। কথা স্কুলের অ্যানুয়াল প্রোগ্রামে গান করবে না-কি বিতর্ক, ছবি আঁকার অনুষ্ঠানে কোন টপিকের ওপরে ছবি আঁকবে, বাইরে ঘুরতে গেলে কোন জামাটা পরবে – কথার জীবনের ছোট ছোট এই সমস্ত বিষয়গুলো ঠিক করে দেয় অরা। আর সেখানে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণের বেলায় হাত গুটিয়ে বসে থাকবে সে?
আজ অফিসে যায়নি অরা। তেমন কোনো কাজ নেই, তাছাড়া শরীরটাও ভালো নেই। ক্লান্তিতে জড়িয়ে আছে পুরো শরীর। এই অজুহাতে কথাও ঘোষণা দিয়েছে, আজ সে স্কুলে যাবে না। দুজনে মিলে পুরোটা সকাল বাগানেই কাটিয়ে দিলো।
ঘরে ফিরতেই বেজে উঠলো অরার ফোনের রিংটোন। স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নামটা পড়তেই অরার চোখমুখ রক্তশূন্য হয়ে উঠলো। ইয়াসমিন বেগম। ভদ্রমহিলা গতকাল অরার ফোন নম্বর নিয়ে গিয়েছিলেন।
অরা ফোনটা রিসিভ করতেই ইয়াসমিন বেগম অপরপ্রান্ত থেকে আন্তরিক কণ্ঠে বললেন, “মা ভালো আছো?”
অরা যথাসম্ভব স্বাভাবিক গলায় বলল, “জি আন্টি। আপনি ভালো আছেন?”
ইয়াসমিন বেগম হতাশার সুরে বললেন, “ভালো আর থাকি কী করে মা? তুমি তো সবটাই জানো। এতদিন পর জেল থেকে বেরিয়েই শান্তিতে নেই নওশীন। ঠিক মতো খাচ্ছে না, ঘুমাচ্ছে না। সারাদিন তার মুখে শুধু একটাই প্রশ্ন, কথা কোথায়?”
অরা কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। একবার ভাবলো মুখের ওপর বলে দেয়, আরশাদ তার মেয়েকে নওশীনের সঙ্গে দেখা করতে দেবে না। তবুও শেষ মুহূর্তে ভেতর থেকে কী যেন একটা এসে আটকে দিলো তাকে।
ইয়াসমিন বেগম আবারও বললেন, “তুমি একটু দেখো না মা। আমরা বেশিক্ষণ সময় নেবো না। মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যাপার।”
অনেকটা সময় চুপ করে থেকে অরা শুকনো গলায় বলল, “আমি দেখছি আন্টি।”
মুখে দেখছি বললেও, আসলে দেখার কিছুই নেই। আরশাদের কথার অবাধ্য হয়ে কথাকে নওশীনের সঙ্গে দেখা করাতে নিয়ে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। মনটাকে শক্ত করতে হবে। মানুষের কষ্টে মনটাকে মোমবাতির মতো গলিয়ে ফেলার কোনো অর্থ নেই। আর যেই মানুষটা তাকে এবং আরশাদকে কষ্ট দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি, তার কষ্টে ব্যস্ত হয়ে পড়ার অর্থ নিতান্তই বোকামি।
আরশাদ ঠিকই তো বলে। নওশীন অসম্ভব ভয়ঙ্কর। কথাকে নিয়ে মনে মনে কোনো কুবুদ্ধি আটা তার পক্ষে অসম্ভব নয়। অরা ঠিক করলো ব্যাপারটাকে পুরোপুরি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলবে। ইয়াসমিন বেগমের ফোন আর রিসিভ করা যাবে না। তিনি দেখা করতে এলেও নানান অজুহাতে এড়িয়ে যেতে হবে।
কয়েকটা দিন এভাবেই কেটে গেল। ইয়াসমিন বেগম প্রথম কয়েকদিন অনেকবার করে ফোন দিলেও অরা সেই ফোনগুলো এড়িয়ে গেছে বারবার। এখন অবশ্য ফোন-টোন আর করেন না তিনি। ভালোই হয়েছে। উটকো এক দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পাওয়া গেল।
সকাল সকাল কথার স্কুলের রুটিন মিলিয়ে বই গোছাচ্ছে অরা। কথার ঘরে তার ছোটখাটো একটা বুকশেলফ আছে। তার স্কুলের বইখাতাগুলো এখানেই সাজিয়ে রাখা। এছাড়াও একটা তাক জুড়ে রয়েছে তার ড্রয়িং খাতাগুলো।
বাচ্চারা তাদের মনের কথাগুলো ছবির মাধ্যমে প্রকাশ করে। কথাও তার ব্যতিক্রম নয়। দূরে কোথাও ঘুরতে যেতে ইচ্ছে হলো তার ছবিতে ফুটে ওঠে সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা কথা, বাবা আর অরার ছবি। তার মনে জমে থাকা স্বপ্নগুলোও প্রকাশ পায় ছবির মাধ্যমে। এই যেমন তার সারাজীবনের স্বপ্ন আকাশে উড়ে বেড়ানোর। আকাশে উড়ে বেড়াবে ঠিকই, তবে তার কোনো ডানা থাকবে না। প্রায়ই তাই তার পেন্সিলে দেখা মেলে আকাশে উড়ন্ত ডানাহীন কথার।
কথা তার অঙ্কিত প্রত্যেকটা ছবি দেখায় আরশাদ এবং অরাকে। তাদের মতামত জানতে চায়। যে ছবিগুলো আরশাদ এবং অরার সবথেকে ভালো লাগে, সেই ছবিগুলো তার ঘরের দেয়ালে ঝুলিয়ে দিতে বলে। সে কারণেই হয়তো কথার সবগুলো ড্রয়িং খাতার সঙ্গে পরিচিতি আছে অরার। শেলফে সবগুলো খাতার ওপরে অপরিচিত মলাটের একটা খাতা দেখে তাই অবাক না হয়ে পারলো না অরা। খাতাটা হাতে নিয়ে দেখলো, শুধু মলাটই নয়। ভেতরের ছবিগুলোও তার অপরিচিত।
অরা অবাক গলায় বলল, “এই ছবিগুলো আগে দেখাসনি তো!”
কথা চট করে খাতাটা অরার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বলল, “এগুলো পচা ছবি। তাই দেখাইনি।”
এমনিতেই স্কুলের জন্যে দেরি হয়ে যাচ্ছে। তাই আর খাতার ব্যাপারটা নিয়ে আপাতত মাথা ঘামালো না অরা। কথাকে তৈরি করে দিয়ে, নিজেও চলে গেল তৈরি হতে।
অফিসে আজ কাজের চাপ অসম্ভব। সকাল সকাল অরাকে মিটিংয়ে বসতে হয় পরিচালক এহসান আহমেদ এবং তার সিনেমার প্রোডাকশন ম্যানেজারের সঙ্গে। গাজীপুরে এহসানের সিনেমার শুটিং চলছিল। কে ফিল্মসের প্রযোজনায় এটি তার দ্বিতীয় সিনেমা। যদিও সিনেমার নাম এখনো ঠিক হয়নি।
শুটিংয়ের জন্যে গাজীপুরে গোটা একটা গ্রামের সেট তৈরি করা হয়। সে কারণে খরচও হয়েছে প্রচুর। তবে সমস্যা বাঁধে দুইদিন আগে। প্রলয়ঙ্করী ঝড়ে নষ্ট হয়ে যায় সেটটি। যেকোনো ব্যবসাতেই ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। সিনেমার ব্যবসাও তার ব্যতিক্রম নয়। এই ক্ষতিটার কারণে এখন সিনেমার সেটের পেছনে নতুন করে খরচ করতে হবে। সিনেমার বাজেট বেড়ে যাবে। লাভের আকাঙ্ক্ষাও বেড়ে যাবে।
মিটিং সেরে অরা এসে বসলো নিজের কেবিনে। সঙ্গে সঙ্গে দরজায় টোকা পড়লো। অদ্ভুত ব্যাপার! এই অফিসে কেউ তার দরজায় টোকা দেয় না। সবাই ডোরবেল বাজিয়ে প্রবেশের অনুমতি চায়।
অরা দরজার বাইরে সিসিটিভির দিকে তাকিয়ে দেখলো, অপরপ্রান্তে মাহমুদ দাঁড়িয়ে। এই ছেলেটা অফিসের সঙ্গে এখনো মানিয়ে নিতে পারেনি নিজেকে।
অরা উঁচু গলায় বলল, “Come in!”
মাহমুদ ছেলেটা হাসি হাসি মুখে প্রবেশ করলো। তার হাতে নীল রঙের একটা ফাইল।
হাসি হাসি মুখেই ডেক্সের কাছে এসে অরার বিপরীতে থাকা চেয়ারদুটোর একটায় বসে পড়লো।
অফিসে প্রচলিত আদব-কায়দাগুলোও এখনো আয়ত্ব করতে পারেনি ছেলেটা। কারও কেবিনে চেয়ারে বসার আগে তার অনুমতি চাইতে হয়। আর সেটা যদি হয় অফিসের সিইও তাহলে তো কথাই নেই। নিজের আদব-কায়দার ঘাটতির জন্যে মাহমুদ ইতোমধ্যে নিজের ঊর্ধ্বতন যুথীর কাছে ধমক খেয়েছে। অরা নেহায়েত কড়া প্রকৃতির মানুষ হলে তার কাছেও ধমক খেত নির্ঘাত।
মাহমুদ ফাইলটা অরার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “ছাই সিনেমার স্ক্রিনপ্লের ওপর একটা রিপোর্ট চেয়েছিলেন না ম্যাম? এটাই সেটা।”
অরা ফাইলটা হাতে নিয়ে ভদ্রভাবে বলল, “Thank you. আমি পরে চেক করে নেবো।”
মাহমুদ অবাক গলায় বলল, “আপনি এখনো আমাকে আপনি ডাকছেন ম্যাম? প্রথম দিন তো বলেছিলেন হুট করে কাউকে তুমি ডাকতে পারেন না। কিন্তু এখন তো দশ দিন হয়ে গেল আমি এখানে কাজ করছি। তাছাড়া আমি কিন্তু আপনার চেয়ে ছয়মাসের ছোট। আপনার জন্ম সাতানব্বইয়ের মার্চে আর আমার সেপ্টেম্বরে।”
অরা কৌতূহল নিয়ে বলল, “আমার জন্মসাল, জন্মমাস জানলেন কী করে?”
“গুগল থেকে! কত বড় মাপের মানুষ আপনি! আপনাকে নিয়ে প্রত্যেকটা ইনফরমেশন গুগলে পাওয়া যায়।”
অরা সামান্য হেসে বলল, “বাহ্! বেশ ভালো। তবে আমাকে নিয়ে রিসার্চ করাটা কিন্তু আপনার কাজের অংশ নয়।”
মাহমুদ আহত গলায় বলল, “এখনো আপনি ডাকছেন ম্যাম।”
অরা ছেলেটার ছেলেমানুষীর সঙ্গে পেরে না উঠে বলল, “আচ্ছা, এর পরের দিন থেকে তুমিই ডাকবো।”
মাহমুদ লজ্জিত ভঙ্গিতে হেসে বলল, “Thank you mam. আচ্ছা ম্যাম, আপনাকে একটা রিকুয়েস্ট করবো?”
“রিকুয়েস্ট?”
“জি ম্যাম। আগামী সপ্তাহে এই নতুন সিনেমার লোকেশন দেখতে যাওয়া হবে। ডিরেক্টর, ডিরেক্টরের টিমের সাথে ক্রিয়েটিভ টিমের অনেকেই যাচ্ছে। আমি যুথী ম্যাডামকে বলেছিলাম আমাকেও সঙ্গে নিতে। তিনি এক ধমক দিয়ে বললেন, আমার না-কি ওখানে গিয়ে কোনো কাজ নেই।”
একটা সিনেমার স্ক্রিপ্ট, অভিনেতা-অভিনেত্রী চূড়ান্ত হয়ে গেলে পরবর্তী কাজ লোকেশন দেখা। পরিচালক দলবল নিয়ে শুটিংয়ের আগে যে জায়গাগুলোতে শুটিং হবে, সেখানে ঘুরে আসেন। এতে শুটিংয়ের ছক কষতে সুবিধা হয়। স্ক্রিপ্টে লেখা দৃশ্যগুলো কল্পনায় আনতেও কোনো অসুবিধা হয় না।
অরা অবাক হয়ে দেখছে মাহমুদের কান্ড। এই অফিসে হাজারটা বিশাল বিশাল ঝামেলা সামাল দিতে হয় তাকে। আর সেখানে এই ছেলেটা প্রতিদিনই এমন ছোটখাটো সমস্যা নিয়ে আসছে তার কাছে। অরা না পারছে ধমক দিতে, না পারছে ফিরিয়ে দিতে।
মাহমুদ ইতস্তত করে বলল, “আমার অনেক দিনের শখ ম্যাম। বাইরে লোকেশন দেখতে যাবো। প্লিজ ম্যাম, মানা করবেন না।”
অরা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “ঠিক আছে। আমি যুথীকে বলে রাখবো।”
মাহমুদ চলে যেতেই অরা আবারও ডুব দিলো কাজের মাঝে। দুপুরের পর তার আরও একটা মিটিং ছিল অন্য এক সিনেমার পরিচালকের সঙ্গে। এই লোকের নাম সাদমান সাইদ। তিনি যে সিনেমাটি নির্মাণ করতে যাচ্ছেন, তার নাম ‘ছাই’। গ্রামের মানুষের জীবনধারা নিয়ে সিনেমা। এই সিনেমার লোকেশন দেখতে যাওয়ার জন্যেই ছটফট করছে মাহমুদ।
সাইদের সঙ্গে মিটিং শেষে অরা মিটিংয়ে বসলো কে ফিল্মসের পিআর টিমের সঙ্গে। পিআর টিমের দায়িত্ব একটা সিনেমা প্রচারণায় অভিনব সব কৌশল খুঁজে বের করা। সিনেমাকে মুক্তির আগেই দর্শকের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
মুক্তির অপেক্ষায় থাকা আরশাদের সিনেমা ‘দূরে হারিয়ে’র প্রচারণায় কোনপ্রকার কমতি নেই। সিনেমা মুক্তি পেতে যাচ্ছে এ মাসের একুশ তারিখে। শেষ মুহূর্তের প্রচারণার একটা ছক সাজাতেই তাদের সঙ্গে আজ মিটিংয়ে বসা।
অরা নিজের কেবিনে অবশেষে ফিরতে পারলো সন্ধ্যা মিলিয়ে যাওয়ার পর। ফোনটা হাতে নিতেই তার চোখে পড়লো আরশাদের মিসড কল। সর্বনাশ! কাজের ব্যস্ততায় এতটাই ডুবে গিয়েছিল সে আরশাদের কলটা খেয়াল পর্যন্ত করেনি অরা। অনুতাপের দমকা হাওয়া বয়ে গেল অরার গা বেয়ে।
সঙ্গে সঙ্গে অরা কল ব্যাক করলো আরশাদের নম্বরে। অপরপ্রান্ত থেকে কোনো জবাব এলো না। নির্ঘাত সেও ব্যস্ত এখন। আজ আরশাদের বিজ্ঞাপনের শুটিং রয়েছে। এমন কিছু মুহূর্ত থাকে, যখন অরার ইচ্ছে হয় সব কাজ বাদ দিয়ে কেবল আরশাদের আশেপাশে পড়ে থাকতে। এই যেমন, এই মুহূর্তটা।
এই ব্যস্ততা কি ক্রমেই দূরত্ব সৃষ্টি করছে দুজনের মাঝে? দীর্ঘশ্বাস ফেলল অরা। এত ব্যস্ততা কেন তাদের জীবনে? ব্যস্ততাগুলো নিমিষেই কেটে গিয়ে যদি প্রশান্তিময় একটা সময়ের সৃষ্টি হতো! যদি কোনো চিন্তা না করে দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে পারতো দুজনে! বেশ হতো।
অরার ভাবনায় ছেদ পড়লো দরজার শব্দে। চোখ তুলে তাকাতেই বুজে ছোটখাটো একটা ধাক্কা খেল অরা। ধাক্কা খাবে নাই বা কেন? এতক্ষণ তার এলোমেলো ভাবনায় যে ঘোরাফেরা করছিল, তাকে চোখের সামনে দেখে তো ধাক্কা খাওয়ারই কথা।
অরা উচ্ছ্বাসে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আরশাদ তুমি!”
ঠোঁটে রহস্যের এক হাসি বজায় রেখে দরজাটা আবারও বন্ধ করে দিতে দিতে বলল, “কেন বিরক্ত করলাম?”
প্রশ্নটার জবাব আর দিতে পারবো না অরা। ছুটে গেলো তার প্রিয় মানুষটার কাছে। আরশাদও এক মুহুর্ত অপচয় না করে বুকে টেনে নিলো অরাকে। আরশাদের বুকে মাথা রাখতেই বিচিত্র এক প্রশান্তি খেলে গেল অরার সমস্ত শরীরে। দিনের সমস্ত ক্লান্তি যেন নিমিষেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
আরশাদ কোমল স্পর্শে অরার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে কৃত্রিম অভিমান নিয়ে বলল, “এত ব্যস্ত আপনি? সারাটা দিনে একবারও মনে পড়লো না আমার কথা?”
অরা আরশাদের দিকে তাকিয়ে অনুতাপমাখা কণ্ঠে বলল, “I’m so sorry Arshad! আজ একটু বেশিই ব্যস্ত ছিলাম।”
আরশাদ অন্যরকম গলায় বলল, “এত ব্যস্ত থাকলে তো চলবে না ম্যাডাম।”
আরশাদ তার ডান হাতের দুটো আঙুল অরার মাথার একপাশে রেখে বলল, “আপনার এখানে…”
আঙুলদুটো নামিয়ে আরশাদ ঠিক অরার হৃদয়ের ওপরে রেখে বলল, “আর এখানে। শুধুমাত্র আমারই বিচরণ। আর কাউকে তো আমি আমার জায়গাটা দেবো না।”
অরা কিছুই বলতে পারলো না। আরশাদের আকস্মিক এমন স্পর্শে যেন পাথরের ন্যায় জমে গেল সে। চোখদুটো প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে। আরশাদ অরার চিবুক ছুঁয়ে মুখটা তুলে ধরলো তার চোখের দিকে।
আরশাদের চোখে অরা স্পষ্ট নিজের জন্যে একরাশ ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছে। সে ভালোবাসা পৃথিবীর সকল ভয়কে দূর করে দেয়। কোনপ্রকার ব্যস্ততার সাধ্য নেই এই ভালোবাসার মাঝে দুরত্বের মতো ঠুনকো জিনিস সৃষ্টি করার।
আরশাদ যেন আর নিজের মাঝে নেই। ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে তার বাহুডোরে আটকা পড়ে যাওয়া মানুষটার মাঝে। তার চোখদুটো এখন আবদ্ধ হয়ে আছে অরার ঠোঁটের দিকে। একটু একটু করে সেদিকেই অগ্রসর হচ্ছে আরশাদ।
অরা আঁতকে উঠে বলল, “আরশাদ দরজা…”
অরার ঠোঁটের ওপর একটা আঙুল রেখে তাকে চুপ করিয়ে দিলো আরশাদ। তার কপালে কপাল ঠেকিয়ে নিচু গলায় বলল, “আমার বউয়ের ঘরে কখনো দরজা লক না করে ঢুকি না। বুঝলেন ম্যাডাম?”
আরশাদের এমন কথায় লজ্জায় লাল হয়ে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো অরা। মেয়েটার এই লজ্জারাঙা মুখটা দেখার লোভ আরশাদ কোনোকালেই সামলাতে পারেনি। কোনো কারণে অরা লজ্জা পেলেই সে ব্যস্ত হয়ে যায় তাকে আরেকটু লজ্জা পাওয়াতে।
সেই উদ্দেশ্যেই আরশাদ অরার কানের সাথে ঠোঁট মিশিয়ে বলল, “তাহলে আমার কাজটা শুরু করি?”
আরশাদের মনের আশা পূর্ণ হলো। আরও দ্বিগুণ লজ্জায় অরার গালদুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। লজ্জায় তার মুখ থেকে টু শব্দ পর্যন্ত বের হলো না।
আরশাদ আবারও তার মোহনীয় স্বর বলে উঠলো, “করবো না?”
লজ্জাসরমের মাথা খেয়ে অরা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো। আর কোনোকিছুই থামাতে পারলো না আরশাদকে। ব্যস্ত ভঙ্গিমায় তার শীতল ঠোঁটদুটোর স্পর্শ পেলো অরার ঠোঁট। প্রশান্তিময়, কোমল কোনো স্পর্শ নয়। ব্যাকুলতায় ভরা তৃষ্ণার্ত এক স্পর্শ। এই স্পর্শ পাওয়ার জন্যে যেন হাজার বছর ধরে অপেক্ষায় ছিল আরশাদ।
আরশাদ ঠিক এভাবে থেকেই অরাকে নিয়ে এগিয়ে গেল এই কেবিনে থাকা প্রকান্ড সাদা সোফাটার দিকে। অরার ঠোঁটদুটোকে নিতান্ত কয়েক মুহূর্তের জন্যে ছেড়ে দিয়ে আগে নিজে বসলো সোফায়। তারপর অরার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে তাকে বসালো নিজের কোলে। আবারও আরশাদ হারিয়ে অরার ঠোঁটের ভাঁজে। নিজের অজান্তেই তার হাতদুটো চলে গেল অরার চুলে। একটানে বাঁধনমুক্ত করতেই চুলগুলো তার পিঠের ওপরে ছেয়ে গেল।
সময়ের হিসাব কারও কাছেই নেই। কতক্ষণ পেরিয়ে গেছে কে জানে? বেশ অনেক সময় পর অরার ঠোঁটদুটো ছেড়ে দিলো আরশাদ। রীতিমত হাপাচ্ছে অরা। তবে বিন্দুমাত্র ক্লান্তি নেই আরশাদের মাঝে। মোহাগ্রস্ত ভঙ্গিতে সে মুখ ডুবিয়ে দিলো অরার ঘাড়ে। শিহরণে দিশেহারা হয়ে অরা খামচে ধরলো আরশাদের টি-শার্ট।
অরা লজ্জায় জড়সড় হয়ে বলল, “এত অসভ্য কেন তুমি? কথা নেই বার্তা নেই, সারাদিন শুধু অসভ্যতা!”
অরার ঘাড় থেকে মুখ না সরিয়েই আরশাদ বলল, “আমি অসভ্য না হলে দুদিন পর মা ডাক শুনতে কীভাবে?”
অরা মিইয়ে গিয়ে বলল, “ছিহ!”
আরশাদ এবার অরার ঘাড় থেকে মুখ তুলে ঠিক তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “শুধু আমিই অসভ্য না? তুমিও তো আমার সাথে কত অসভ্যতা করে এসেছো। মনে নেই? দাঁড়াও মনে করিয়ে দিচ্ছি!”
আরশাদ কিছু বলতে যাবে তার আগেই অরা নিজেকে আর সামলাতে না পেরে মুখ লুকালো তার বুকে।
আরশাদ অরার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে মুচকি হাসি হেসে বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে। বাসায় গিয়ে মনে করিয়ে দিবো।”
বাসায় ফিরে দুজনেই কথাকে অনেকটা সময় দিলো। দুদিন পর মেয়েটার হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষা। এতটুকু একটা বাচ্চা, অথচ পরীক্ষার গুরুত্ব বেশ বুঝতে পারে। তাই নিজেই গেম-টেম একটু কমিয়ে দিয়ে মন দিয়ে পড়াশোনা করছে। কথার গভর্নেন্স পায়েল বলল, আজ না-কি স্কুল থেকে ফেরার পর সে কোনপ্রকার বিশ্রাম নেয়নি। শুধু পড়ে গেছে।
আরশাদ আর অরা বাড়ি ফেরার পর অবশেষে উঠলো পড়ার টেবিল থেকে। ব্যস্ত হয়ে তার অংকগুলো দেখালো আরশাদকে। আরশাদও প্রায় পঞ্চাশটার মতো অংক ধৈর্য ধরে দেখলো। ভুলগুলো ধরিয়ে দিলো, সুধরেও দিলো।
কথাকে ব্রাশ করিয়ে দিয়ে আরশাদ তাকে ঘুম পাড়াতে নিয়ে গেল। তবে কথা না-কি এখন ঘুমাবে না। আধ ঘন্টা টিভি দেখে তারপরে ঘুমাবে। আরশাদও তাই ফিরে এলো নিজেদের ঘরে।
অরা বিছানার ওপরে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে। আরশাদ ঘরে ঢুকেই ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে গেলো তার ব্যাগটার দিকে। এই বাদামি রঙের লেদারের ব্যগটাতে তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র থাকে। এটা নিয়েই সাধারণত সে শুটিংয়ে যায়। ব্যাগের চেন খুলে কী যেন খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো আরশাদ।
খুঁজতে খুঁজতেই বলল, “অরা? বলো তো, পৃথিবীর সবথেকে রোমান্টিক গয়না কী?”
অরা হাসিমুখে বলল, “গয়না আবার রোমান্টিক হয় না-কি?”
“হয় তো! ভেবে বলো রোমান্টিক গয়নাটা কী?”
অরা খানিকক্ষণ চিন্তা-ভাবনা করে বলল, “আংটি?”
“না।”
ধাঁধায় পড়ে গেল অরা। আংটি দিয়েই তো ছেলেরা মেয়েদের প্রোপজ করে। দ্বিতীয়বার সকলের সামনে বিয়ে করার জন্যে প্রোপজ করে আরশাদও তাকে একটা হীরার আংটি পরিয়ে দিয়েছিল। যে আংটি আজও তার আঙুল থেকে অবিচ্ছেদ্য। আংটি যদি সবথেকে রোমান্টিক গয়না না হয়, তাহলে কী?
অরা আরেকটু চিন্তা করে বলল, “চুড়ি?”
ব্যাগ থেকে কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা খুঁজে পেয়ে আরশাদ অরার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, “উহুঁ।”
“তাহলে?”
“নূপুর।”
চোখের সামনে আরশাদ মেলে ধরলো অসম্ভব সুন্দর এক রূপার নূপুর। ওপরের সারিতে চকচক করতে থাকা কতগুলো পাথর, আর নিচের দিকে ঝুলন্ত ছোট ছোট রূপার পাতা।
অরা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল জিনিসটার দিকে।
“নূপুর রোমান্টিক কীভাবে?”
আরশাদ তার মোহনীয় গলায় বলল, “এই নূপুর পরে যতবার তুমি পা ফেলবে, ততবারই ঝনঝন শব্দ হবে। যে শব্দটা বারবার তোমাকে আমার কথা মনে করিয়ে দিবে। রোমান্টিক না?”
অরা প্রচ্ছন্ন এক হাসি হেসে তাকিয়ে রইল আরশাদের দিকে। এই মানুষটার পাগলামি কি কখনোই শেষ হবার নয়?
আরশাদ অরার পায়ের কাছে হাঁটু মুড়ে বসে তার পায়ে স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে অরা ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “কী আশ্চর্য! পায়ে হাত দিতে হবে কেন?”
অরার ব্যস্ততার কোনপ্রকার তোয়াক্কা না করে আরশাদ বলল, “পায়ে হাত না দিলে পরাবো কীভাবে?”
“আমি নিজে পরে নিতে পারতাম না?”
“না। আমার বউকে শুধু আমিই পরিয়ে দিবো!”
যত্ন নিয়ে আরশাদ নূপুরটা পরিয়ে দিলো অরার পায়ে। তাদের এই সুন্দর মুহূর্তে বাঁধ সাধলো দরজায় টোকার শব্দ। আরশাদ এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই দেখলো কথা দাঁড়িয়ে আছে। তার ছোট্ট হাতে আবদ্ধ হয়ে আছে একটা টেডি বিয়ার।
আরশাদ চট করে মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল, “কী হয়েছে বাবা?”
কথা আরশাদের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “আমি আজ এখানে ঘুমাই?”
“অবশ্যই।”
আরশাদ কথাকে বিছানায় নামিয়ে রাখতেই অরা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “ভয় পেয়েছিস সোনা?”
কথা শুকনো গলায় বলল, “না। এমনিই এখানে ঘুমাতে ইচ্ছা করছিল।”
আরশাদ ব্যস্ত হয়ে পড়লো মেয়েকে ঘুম পাড়াতে। কথাও বাধ্য মেয়ের মতো গুটিশুটি মেরে বাবার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে রাজ্যে তলিয়ে গেল। চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার মতো একটা দৃশ্য। মানুষের সুখী হতে খুব বেশি কিছুর প্রয়োজন হয় না। ছোট্ট একটা সখময় পরিবারই যথেষ্ট।
(চলবে)