ফিরে_আসা২ ১৬ লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

0
519

#ফিরে_আসা২
১৬
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

বাড়ির সকলের মধ্যে চাপা এক ধরনের অস্থিরতা। আরশাদের খালা আর দুই মামী ব্যস্ত রান্নার প্রস্তুতি নিতে। লম্বা লম্বা লিস্ট লিখে তারা ধরিয়ে দিচ্ছেন খালু আর মামাদের। জন্মদিনের সকালে তারাই বাজার করতে যাবেন। দিশা আর মেহের সেই সকাল থেকে কাগজ-কলমে একের পর এক কেকের ডিজাইনের খসড়া এঁকেই যাচ্ছে। শেষমেশ কোনো ডিজাইনই পছন্দ হচ্ছে না নিজেদের। ওদিকে রনি আর আকাশের মাথায় হাত। দিনভর ইউটিউব ঘেঁটে তারা বেশ বুঝতে পারছে, কেক বানানো তাদের সাধ্যে নেই।

অরা ঘুরে ঘুরে সকলের ব্যস্ততা উপভোগ করছে। ভেতরে ভেতরে মনটা কিঞ্চিৎ ভার হয়েও আছে। বাড়িসুদ্ধ সকলের এত ব্যস্ততা। অথচ সে বাড়ির বৌ হয়ে কোনো কাজ করতে পারছে না। এমন তো নয় যে, কোনো কাজ করতে গেলে তার ভীষণ কষ্ট হবে। তবুও শুধুমাত্র আরশাদের কারণে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হবে তাকে।

আরশাদ কবে যে অফিসে যাওয়ার ওপর কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করে, তাই ভেবে দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছে অরা। তিন দিনের জন্যে বেড়াতে এসেছে কেবল, এতেই অফিসের সকলে ফাঁকিবাজির চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছে গেছে। কয়েক মাসের জন্যে মেটার্নিটি লিভে গেলে না জানি কী অবস্থা হয়!

অরা উঠানে বসে আরশাদের খালা এবং দুই মামীর লিস্ট করা দেখছে। তখনই ছুটে এলো দিশা এবং মেহের। দিশার হাতে বড়সর একটা ডায়েরী।

ডায়েরীটা দিশা অরার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “ভাবি দেখো! আমরা যে কেকটা বানাবো, তার ডিজাইন।”

ডায়েরীটা হাতে নিয়ে কয়েক মুহূর্ত মুগ্ধ দৃষ্টিতে ডিজাইনের দিকে তাকিয়ে রইলো অরা। একজন বয়স্ক মহিলার মুখের আদলে বানানো হবে কেকটা। তার চোখে চশমা, পাকা চুল আর ঠোঁটে প্রচ্ছন্ন হাসি। বোঝাই যাচ্ছে, তারা কেকের মাধ্যমে সেলিনা হককে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছে।

অরা প্রশংসার সুরে বলল, “বাহ্! চমৎকার হয়েছে দিশা। কোন ফ্লেভারের হবে কেকটা?”

দিশা ফূর্তির ভঙ্গিতে বলল, “সেটা নিয়েই তো মেহেরের সঙ্গে এক দফা ঝগড়া করলাম। ও চাইছে চকলেট আর আমি চাইছি ভ্যানিলা।”

মেহের পাশ থেকে চিন্তিত গলায় বলে উঠলো, “তুমিই বলে দাও তো ভাবি, কোন ফ্লেভারের কেক বানালে ভালো হয়?”

অরা খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, “এক কাজ করো বরং! ভ্যানিলা ফ্লেভারের কেকের ভেতর চকলেট ফ্রস্টিং উইজ করো।”

দিশা আর মেহেরের মুখভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে বুদ্ধিটা দুজনেরই মনে ধরেছে।

দিশা উৎফুল্ল গলায় বলল, “দারুণ আইডিয়া তো! ইউ আর গ্রেট ভাবি!”

অরা হাসিমুখে বলল, “গ্রেট তো তোমরা। এত সুন্দর একটা ডিজাইন কার মাথায় এলো বলো তো!”

মেহের দিশার দিকে আঙুল তাক করে বলল, “পুরো ক্রেডিটই দিশার।”

প্রশংসায় কিঞ্চিৎ বিগলিত হয়ে দিশা বলল, “আসলে ভাবি, ভাইয়া কড়া ভাষায় নিষেধ করে দিয়েছে ফুল-লতা-পাতার ডিজাইন করতে। তাই সারাদিন বসে এই ইউনিক ডিজাইনটা করলাম।”

অরা বলল, “তোমরা দুজনেই কেক বানাবে? রনিরা বানাবে না?

অরা কী এমন হাসির কথা বলল কে জানে? দিশা আর মেহের যেন অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। হাসতে হাসতে একে অপরের গায়ে মৃদু ধাক্কায় দিয়ে ফেলল।

অরা কিছু বুঝে উঠতে না পেরে বলল, “নিজেরাই হেসে যাবে? হাসির কারণটা আমাকে বলবে না?”

মেহের হাসি না থামিয়েই বলল, “বলছি ভাবি।”

বলতে আর পারলো কোথায়? আরেকদফা হাসিতে লুটিয়ে পড়লো দুজনে। অরা ভেবে পাচ্ছে না, রনির কেক বানানোর সঙ্গে এমন অট্টহাসির সম্পর্ক কোথায়?

কিছুটা সময় পর দিশা কোনমতে হাসি থামিয়ে বলল, “ভাইয়া আমাদের দুজনকে দুটো গ্রুপে ভাগ করেছে। দুই গ্রুপ দুটো কেক বানাবে। আমি আর মেহের এক গ্রুপে, আরেক গ্রুপে ওই দুই ফেলুরাম।”

মেহের হাসতে হাসতেই বলল, “দেখ না, কেমন অসহায়ের মতো রেসিপি খুঁজে বেড়াচ্ছে!”

অরা তাদের দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখল, বাংলাঘরের উঠানে বসে চিন্তিত ভঙ্গিতে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে রনি এবং আকাশ। দুজনের চোখেমুখেই বিভ্রান্তির ছড়াছড়ি।

দিশা হঠাৎ কী যেন মনে করে ভ্রু কুঁচকে বলল, “আমি না একটা রহস্যের সমাধান কিছুতেই করতে পারি না।”

“কোন রহস্য?”

দিশা গম্ভীর গলায় বলল, “তোমার গায়ে হলুদে ভাবি! রনির দল এত ভালো নাচলো কী করে? অত সুন্দর একটা কোরিওগ্রাফি ওর মাথায় এসেছে? আমার তো বিশ্বাসই হয় না।”

মনে মনে হেসে উঠলেও বাস্তবে সেই হাসির প্রকাশ ঘটালো না অরা। রনির দলের জয়ের রহস্য যে তার বেশ ভালো করেই জানা।

বাড়ির উঠানে বিশাল চাদর বিছিয়ে সকলে একসঙ্গে রাতের খাবার খেলো। পুরো পরিবারটা এক হলে হাজারো সুন্দর মুহূর্তের সৃষ্টি হয়। এই মুহূর্তটা ঠিক তেমনই। সেলিনা হকসহ বাড়ির অন্যান্য বয়োজ্যেষ্ঠরা স্মৃতি রোমন্থন করে আরশাদের ছেলেবেলার গল্প করছেন।

ছোটবেলায় আরশাদ কতটা বিচ্ছু ছিল, তবুও পরীক্ষায় ভালো নম্বর করে আসতো, তখন থেকেই কেমন ভয়ানক রাগী ছিল – প্রত্যেকটা গল্প আগ্রহ নিয়ে শুনছে অরা। মানুষ যখন কাউকে ভালোবাসে, তখন তার সমস্তটা জুড়েই ভালোবাসার আবর্তন ঘটে। আরশাদের ছোটবেলার ওই ছোট ছোট গল্পগুলোকেও নিজের একান্ত ব্যক্তিগত বলে মনে হচ্ছে তার।

রাতের খাবারের পর পর সেলিনা হক কেন যেন দুই ছেলেমেয়েকে নিজের ঘরে ডেকে পাঠালেন। কথা ওদিকে দিশা আর মেহেরের সঙ্গে হইচই করছে। কথাকে পেলে নিমিষেই ওরা দুজন শিশুতে পরিণত হয়। নিজের ঘরে বসে অরা মনোযোগ দিয়ে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে আছে। আজ সারাদিনে অফিস থেকে যে গুরুত্বপূর্ণ মেইল এসেছে, সেগুলোই নিরীক্ষা করতে ব্যস্ত সে।

আচমকা রনি এসে দরজা থেকে মাথা বের করে বলল, “ভাবি আসবো?”

অরা ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “এসো রনি।”

রনি ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে ইতস্তত করে বলল, “বিরক্ত করলাম না-কি?”

অরা আন্তরিক ভঙ্গিতে বলল, “কী যে বলো!”

রনি অরার বিপরীতে থাকা চেয়ারটায় বসতে বসতে বলল, “কী করছিলে?”

“এই তো, অফিসের কিছু কাজ করছিলাম।”

“অফিসে কাজের অনেক চাপ না?”

অরা হাসিমুখে বলল, “কাজের চাপ একটু-আধুটু তো থাকবেই। তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে?”

রনি হতাশ গলায় বলল, “পড়াশোনা আর চলছে কোথায় ভাবি? চলছে তো শুধু ফেইল।”

অরা অবাক গলায় বলল, “সে কী?”

রনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “গত সেমিস্টারে ফেইল করলাম। বাসায় কাউকে জানাইনি। নতুন সেমিস্টারের কথা বলে আবারও পুরনো সেমিস্টারে ভর্তি হয়ে এসেছি। তুমি আবার মাকে এটা বোলো না কিন্তু!”

“সে না হয় না-ই বললাম। কিন্তু ব্যাপারটা মামা-মামীর কাছ থেকে গোপন করা তোমার মোটেও ঠিক হয়নি রনি। কোনো না কোনোদিন তো তারা জেনেই যাবেন। তখন?”

রনি মাথা চুলকে বলল, “তখনেরটা তখন দেখা যাবে। কিন্তু ভাবি, বাসায় ফেইলের কথা জানালে আমার ওপর দিয়ে রীতিমত স্টিমরোলার চলতো। জানোই তো, বড়রা কিছুই বুঝতে চায় না।”

অবাক হয়ে রনির কথা শুনছে অরা। কে বলবে এই ছেলে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।
তার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে নিতান্তই বাচ্চা।
এভাবে তো কথা গম্ভীর গলায় বড়দের কোনো কিছু বুঝতে না চাওয়া নেই অভিযোগ করে।

রনি হঠাৎ দুর্বলভাবে জোর দিয়ে বলল, “এই যেমন আরশাদ ভাইয়াকেই দেখো!”

অরা কৌতূহলী গলায় বলল, “আরশাদ? সে আবার কী করলো?”

রনি ব্যথিত ভঙ্গিতে বলল, “ভাইয়া প্রত্যেকবার একটা না একটা উদ্ভট অ্যাসাইনমেন্ট ধরিয়ে দেয়। সেই অ্যাসাইনমেন্টের মাথামুন্ডু কেউ পারলো কিনা এ নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই।”

অরা মুগ্ধ ভঙ্গিতে বলল, “আমার তো বেশ ভালোই লাগে ব্যাপারটা। তোমরা সব কাজিনরা এক হয়ে যখন কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকো, দেখার মতো হয় দৃশ্যটা। গত শীতে কী মজা করে মাছ ধরলে সকলে!”

রনি বিড়বিড় করে বলল, “মাছ তো চাইলেই ধরা যায়। কিন্তু কেক ধরবো কী করে?

বিড়বিড় করে বললেও ঠিকই শুনতে পেলো অরা।

তবুও নিশ্চিত হওয়ার জন্যে বলল, “হ্যাঁ?”

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে রনি ব্যাকুল ভঙ্গিমায় বলল, “ভাবি আমাদের বাঁচাও! আমরা কেক বানাতে পারি না। কোনোদিন পারবো বলেও মনে হয় না। আমি তো কেকের ক ও জানি না। আর আকাশ শুধু ক কেন? ক, খ, গ, ঘ কিছুই জানে না। জন্মদিনে কেক যদি না বানাতে পারি, দিশাদের সামনে কী বেইজ্জতিটা হবে একবার চিন্তা করো!”

অরা তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে বলল, “তুমি শুধু শুধুই টেনশন করছো রনি। কেক বানানো একেবারেই সহজ।”

রনি গম্ভীর গলায় বলল, “তোমার কাছে সহজ হতে পারে ভাবি। কিন্তু ওই জিনিস শিখতে আমাদের কমপক্ষে দশ-পনেরো বছর লাগবে।”

রনির এমন শিশুসুলভ কান্ডে অরা খিলখিল করে হেসে উঠলো।

রবি আহত ভঙ্গিতে বলল, “ভাবি তুমি হাসছো?”

অরা হাসি থামিয়ে বলল, “সরি, সরি। তোমরা বরং এক কাজ করো, আরশাদকে গিয়ে বলো কেক-টেক তোমরা বানাতে পারবে না। তোমাদের যেন অন্য কোনো কাজ দেয়।”

রনি ভীত কণ্ঠে বলল, “তুমি আরশাদ ভাইয়াকে চেনো নাম এই কথা যদি বলি, আস্ত গিলে খাবে আমাদের দুজনকে।”

অরা চিন্তিত গলায় বলল, “তাও অবশ্য ঠিক।”

অরাকে চিন্তিত দেখে রনি আর এক মুহুর্ত অপচয় করলো না। হড়বড় করে বলল, “এখন আমাদের বাঁচার একটাই মাত্র উপায়।”

“কী?”

“তুমি!”

অরা হতবাক গলায় বলল, “আমি?”

রনি আকুতির সুরে বলল, “হ্যাঁ ভাবি! প্লিজ না বোলো না। তুমি না বললে আমরা একদম মাঠে মারা যাবো। আমাদের কেকটা তুমি বানিয়ে দাও না! প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ!”

অরা ভেবে পাচ্ছে না কী বলবে। এ জীবনে অরা বহুবার কেক বানিয়েছে। তেমন কোনো কঠিন কাজই নয় তার পক্ষে। তার বানানো কেক দেখতে বরং দোকানের মতোই হয়। আর এদিকে রনিরা না-কি কেকের ‘ক’ও জানে না। সে যে রনির হয়ে কেকটা বানিয়েছে, এটা আবার কেউ টের পেয়ে যাবে না তো?

অরা চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, “আমি যে বানিয়েছি, এটা যদি কেউ টের পেয়ে যায়?”

রনি কোনো উত্তর খুঁজে না পেয়ে বলল, “একটু খারাপ করে না হয় বানালে?”

আবারও চিন্তায় পড়ে গেল অরা। আরশাদ যে তাকে অতিরিক্ত ধকল নিতে নিষেধ করে দিয়েছে! যদিও কেক বানানো মোটেও ধকলের কাজ নয়। তবে অরার চিন্তা একটা জায়গাতেই। আরশাদ যদি রেগে যায়? ছোট ছোট বিষয় নিয়ে রেগে যাওয়া তো আজকাল তার মুদ্রাদোষে পরিণত হয়েছে।

রনি উদগ্রীব কণ্ঠে বলল, “বানাবে ভাবি? প্লিজ!”

বেচারার ওপর এবার সত্যিই মায়া হলো অরার। মাথার ওপরে এত বড় একটা দায়িত্ব, অথচ দায়িত্ব পালনের লেশমাত্র ধারণা নেই তার মাঝে। অরা তার এতটুকু উপকার করলে নিশ্চয়ই মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। তাছাড়া আরশাদও নিশ্চয়ই অতটা রেগে যাবে না।

অরা আশ্বাস দিয়ে বলল, “আচ্ছা বাবা! বানাবো।”

সেলিনা হকের ঘরে ছোট একটা গোলাকার টেবিল রয়েছে। সঙ্গে বেতের একটা চেয়ার। সকাল সকাল এখানে বসেই তিনি খবরের কাগজ পড়েন। খাবার ঘর থেকে চেয়ার এনে সেই টেবিলের দুপ্রান্তে বসে আছে আরশাদ এবং আশফিয়া। মধ্যিখানে সেলিনা হক। আরশাদ আর তার আপার মাঝে একটা না একটা বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি লেগেই যাচ্ছে। তাদের এই খুনশুটি সেলিনা হকের মাঝে তেমন একটা প্রভাব ফেলতে পারছে বলে মনে হচ্ছে না। গভীর চিন্তাভাবনায় ডুবে আছেন তিনি।

সেলিনা হক হঠাৎ তার নীরবতা ভঙ্গ করে বললেন, “একটা জরুরি কথা বলবো বলে ডেকেছি তোদের দুজনকে।”

আরশাদ হালকা গলায় বলল, “বেশি সময় দিতে পারবো না কিন্তু মা। আমার কাজ আছে।”

দিশা আর মেহের জন্মদিনের ডেকরেশনের একটা নকশা সাজিয়ে ফেলেছে। মায়ের কথা শেষ হলেই ওদের নকশা দেখতে যাবে আরশাদ।

“এত তাড়া কীসের বাবা? তোদের দুটোকে তো বলতে গেলে একসঙ্গে কাছেই পাই না। যতটুকু কথা হয়, সবই ফোনে। সব কথা কি আর ফোনে বলা যায়?”

আশফিয়া ভেংচি কেটে বলল, “তুমি কী বলবে বলো তো মা। এই বাঁদরের তো সারা বছরই তাড়া থাকে।”

আরশাদ ভ্রু কুঁচকে তাকালো তার আপার দিকে। সেই ছোটবেলা থেকেই আশফিয়ার বদভ্যাস আরশাদকে হয় বাঁদর না হয় গাধা ডাকা। আজ এতগুলো দিন পেরিয়ে গেল। সেই ছোট্ট আরশাদ, আজ কোটি ভক্তদের মনে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী সুপারস্টার আরশাদ হক। তবুও আশফিয়ার বদভ্যাস আর গেল না। বড় বোনদের চোখে তাদের ভাইয়েরা চিরকালই একইরকম থাকে।

সেলিনা হক ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে শুকনো গলায় বললেন, “তোদেরকে আসলে একটা জিনিস দেবার ছিল।”

আরশাদ কিঞ্চিৎ বিরক্ত স্বরে বলল, “এত সাসপেন্স ক্রিয়েট না করে আসল কথাটা বলবে মা?”

সেলিনা হক কিছুই বললেন না। আঁচলের আড়াল থেকে বের করে আনলেন একটা কাগজ।

আরশাদ সন্দেহযুক্ত স্বরে বলল, “কী এটা?”

“পড়ে দেখ।”

আশফিয়া কী যেন মনে করে হঠাৎ বলল, “আমাকে দাও। আমি আগে পড়বো।”

“তুমি আগে পড়বে কেন?”

আশফিয়া পাল্টা যুক্তি দেখিয়ে বলল, “কারণ আমি বড়।”

আরশাদ থমথমে গলায় বলল, “কিন্তু মা তো আমাকে আগে পড়তে বলল।”

সেলিনা হক অতিষ্ট ভঙ্গিতে বললেন, “থামবি তোরা? তুই পড় আশু।”

কাগজের ভাঁজ খুলে তাতে লেখা অক্ষরগুলোয় মন দিলো আশফিয়া। মুহূর্তের মাঝে বদলে গেল তারও মুখভঙ্গি। আশফিয়ার চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে যেন একখন্ড কালো মেঘ নেমে এসেছ এ ঘরে।

যথেষ্ট বুদ্ধিমান ছেলে আরশাদ। আশফিয়ার মুখভঙ্গি দেখে অনায়াসেই আন্দাজ করতে পারছে, কাগজটায় সুখকর কোনো বার্তা লেখা নেই।

আরশাদ চিন্তিত কণ্ঠে বলল, “কী এটা?”

আশফিয়া কিছুই বলল না। শূন্য দৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে।

আরশাদ আবারও উদগ্রীব গলায় বলল, “আপা কী এটা?”

আশফিয়া কম্পিত স্বরে বলল, “থাক না মা। এসব নিয়ে না হয় আমরা পরে আলোচনা করবো।”

আরশাদ বেশ বুঝতে পারছে, তার অজান্তেই পরিবারে বড় কোনো অঘটন ঘটে গেছে।

তাই এক মুহূর্তও অপচয় না করে বলল, “কাগজটা আমাকে দাও তো আপা।”

“আরশাদ…”

“দাও আমাকে!”

আশফিয়া কাগজটা বাড়িয়ে দিলো ভাইয়ের দিকে। লেখাগুলো প্রথমবার পড়ে বিশ্বাস হলো না আরশাদের। দ্বিতীয়বার চোখ বুলালো। তবুও যেন অবিশ্বাস্য লাগছে সবটা। ভয়ানক রাগের এক স্রোত বয়ে গেল আরশাদের ওপর দিয়ে। অসম্ভব রাগ হচ্ছে ঠিকই, তবে রাগটা যে কার ওপরে হচ্ছে নিজেই বুঝতে পারছে না আরশাদ।

আরশাদ থমথমে গলায় বলল, “এই জিনিস এ বাড়িতে ঢুকলো কী করে মা?”

চুপ করে রইলেন সেলিনা হক।

আরশাদ আবারও অগ্নিকণ্ঠে বলে উঠলো, “সেটা আবার তুমি আমাদের দিচ্ছো কী করে?”

সেলিনা হক অসহায় ভঙ্গিতে বললেন, “তাহলে কী করতাম?”

আরশাদ দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “ছুঁড়ে ফেলে দিতে ডাস্টবিনে।”

লম্বা লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করছে আরশাদ। তবে সমস্ত চেষ্টাই যেন এই মুহূর্তে বিফলে যাচ্ছে।

আরশাদ গাম্ভীর্যে ভরা কণ্ঠে বলল, “এ বিষয়ে আমার সাথে আর কোনো কথা বলতে আসবে না মা।”

সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল আরশাদ।

আশফিয়া নিচু স্বরে মায়ের উদ্দেশ্যে বলল, “তুমি পারোও বটে মা। ছেলেটা ভালো মেজাজে ছিল। কী দরকার ছিল, আজই এই জিনিসটা দেবার?”

সেলিনা হক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “একদিন না একদিন তো দিতেই হতো।”

যে কাগজ নিয়ে এতকিছু, সেই কাগজটা উইলের। আরশাদের বাবা আরমান হকের করা উইল। উইল অনুসারে তার মৃত্যুর সাত বছর পর তার সমস্ত সম্পত্তি আরশাদ এবং আশফিয়ার মাঝে সমানভাবে ভাগ করে দেওয়া হবে।।

আরমান হক ছিলেন নিতান্তই স্বার্থপর একজন মানুষ। সেলিনা হকের সরলতার সুযোগ নিয়ে তার ভাইদের কাছ থেকে জোগাড় করা ছয় লাখ টাকা নিয়ে তিনি পালিয়ে যান আরেক দেশে, আরেক নারীর হাত ধরে। বলতে গেলে কিছুই রেখে যাননি দুই ছেলেমেয়ের জন্যে।

বিচিত্র এক অনিশ্চয়তায় মাঝে বেড়ে ওঠা আরশাদ এবং আশফিয়ার। প্রত্যেকটা রাতেই তাদের মনে হতো, আর বুঝি সকাল আসবে না। মাসের শেষ এলেই মনে ভয় ধরতো, পরের মাসের এত এত খরচ তারা সামাল দেবে কী করে?

বিভীষিকাময় ওই জীবনটার কথা কল্পনা করলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে এখনো। আরশাদ আর আশফিয়া সেসবের কিছুই মনে রাখেনি। বড় হয়ে নিজেদের যোগ্যতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দুজনে। বাবা নামক ওই মানুষটার ওপরে দীর্ঘদিন রাগ-ক্ষোভ পুষে রাখলেও, তার মৃত্যুর পর সেটাও অদৃশ্য হয়ে যায়।

তবে এই উইলের অর্থ কী? যে সময়ে তাদের ওই মানুষটাকে সবথেকে বেশি প্রয়োজন ছিল, সেই সময়ে তিনি পাশে থাকেননি। আজ এত এত বছর পর কেন তাদের মাঝে নিজের সম্পত্তি বিলি করছেন? করছেন তো আর না, করতে চেয়েছিলেন।

অস্ট্রেলিয়ায় ব্যাবসা-বাণিজ্য করে বেশ লাভবান হয়েছিলেন আরমান হক। তার সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় দশ কোটি বাংলাদেশী টাকার কাছাকাছি। সেই সম্পত্তির একবিন্দুও তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে না দিয়ে, পুরোটাই দিয়ে গেলেন তার ছেলেমেয়েদের? মৃত্যুর আগ দিন অব্দি যে ছেলেমেয়েদের খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি তিনি।

উঠানে দাঁড়িয়ে ধুম্রজালে ঠোঁট কালো করছে আরশাদ। রাগের লেশমাত্র কমেনি তার মধ্যে থেকে। আরমান হক আশা করলেন কী করে তার সম্পত্তি বিনা বাক্য ব্যয়ে গ্রহণ করে নেবে তার সন্তানেরা?

আশফিয়া এসে দাঁড়ালো আরশাদের পাশে। সঙ্গে সঙ্গে হাত থেকে সিগারেটটা ফেলে দিলো আরশাদ। তবে মধ্যকার রাগ এখনো স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠছে।

আশফিয়া শুকনো গলায় বলল, “এত রিয়্যাক্ট না করলেও পারতি।”

আরশাদ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “এ কথা তুমি বলছো? অথচ আমার থেকে তুমি ওই মানুষটাকে বেশি ঘৃণা করতে।”

আশফিয়া দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “করতাম। কিন্তু একটা মৃত মানুষের ওপর ঘৃণা পুষে রেখে লাভ কী?”

“ঘৃণা তো আমিও পুষে রাখিনি আপা। শুধুমাত্র সে মৃত বলে তার সমস্ত পাপ ক্ষমা করে দিয়েছি। কিন্তু তাই বলে লোভীর মতো তার সম্পত্তির ওপর হামলে পড়তে হবে? সরি, সেটা আমি পারবো না। তোমাকেও পারতে দেবো না। তাছাড়া আমাদের ওই সম্পত্তির দরকারটা কীসের?”

“কোনো দরকার নেই। তো কী করতে বলছিস?”

আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “কী আবার করবে? কাগজটা যেখান থেকে এসেছে, সেখানে পাঠিয়ে দেবে।”

আশফিয়া মৃদু ধমকের সুরে বলল, “বোকার মতো কথা বলবি না তো আরশাদ। উইলে নাম লেখা তোর আর আমার, ওই কাগজ ফেরত পাঠিয়ে দিয়ে কী হবে? যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আমাকে আর তোকেই নিতে হবে।”

আরশাদ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “তাহলে আমার সিদ্ধান্ত হলো, উইলের কাগজটাকে কুটিকুটি করে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া।

আশফিয়া কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে চিন্তিত গলায় বলল, “আমাদের সম্পত্তি না নেওয়া নিয়ে মা একটা ঝামেলা বাঁধাবে দেখিস।”

“তোমার তাই মনে হয়?”

“হুঁ।”

আরশাদ তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, “একটা মানুষের মধ্যে বিন্দুমাত্র সেলফ রেসপেক্ট না থেকে পারে কী করে?”

“ভালোবাসা আরশাদ। ভালোবাসার কাছে সব
সেলফ রেসপেক্ট হেরে যায়।”

(চলবে)

[মানুষের জীবন হয় আলোয় আলোকিত। আর আমার জীবন প্যারায় প্যারাকিত। কলেজের প্যারা, পরীক্ষার প্যারা, বাসার প্যারা! গতকাল পরীক্ষার প্যারা শেষ করে বাসায় আসতেই শুরু হয় নতুন প্যারা। আমার ভাইকে সামনের বছর নতুন স্কুলে ভর্তি করাতে চাচ্ছি। গতকাল লটারির রেজাল্ট দিলো। কোন স্কুলে ভর্তি করালে সুবিধা হবে এই নিয়েই বাবা-মায়ের সাথে মিটিং চলছে। তিন জনেই তিন রকম কথা বলছি বলে মিটিং আর আগায় না। ওদিকে যাকে নিয়ে এত মিটিং, সে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এতসবের মধ্যে এই সপ্তাহে লেখার সময়ই পাইনি। অনেক অনেক অনেক সরি!!! শনিবার পর্যন্ত টানা লিখবো। পড়াশোনা, মিটিং-মিছিল জাহান্নামে যাক! 😩]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here