ফিরে_আসা২ ১৮ লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

0
491

#ফিরে_আসা২
১৮
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

গাড়ির কালো কাঁচগুলোতে মাথা ঠেকিয়ে প্যাসেঞ্জার সিটে বসে রয়েছে অরা। এই গাড়িটা আরশাদ এবং তার অসংখ্য সুন্দর মুহূর্তের সাক্ষী। এই গাড়ির ছাদটা ঘুরে রাখা যায়। ছাদ খোলা গাড়িতে বসে একবার তারা দুজনে গভীর রাতে জোছনাবিলাস করতে বেরিয়েছিল। দিনের আলোয় সে সুযোগ নেই। সুপারস্টার আরশাদ হক ছাদখোলা গাড়ি নিয়ে বের হলে ঢাকার ব্যস্ত রাস্তার ব্যস্ততা বহুগুণ বেড়ে যাবে।

ড্রাইভ করতে করতে আড়চোখে অরাকে পর্যবেক্ষণ করে নিলো আরশাদ। তারা ঢাকায় ফিরেছে গতকাল। সেই থেকে লক্ষ্য করছে মেয়েটা কেমন গম্ভীর হয়ে আছে। ঠিক গম্ভীরও বলা চলে না। স্বাভাবিকভাবেই হাসছে, গল্প করছে – তবে হঠাৎ হঠাৎ ডুব দিচ্ছে কোনো অজানা এক ভাবনায়।

আরশাদ হালকা গলায় বলল, “মন খারাপ?”

অন্যমনস্ক অরা আচমকা সংবিৎ ফিরে পেয়ে বলল, “কার আমার? কই না তো!”

“তাহলে এমন গম্ভীর হয়ে কী ভাবছো?”

অরা সহজ ভঙ্গিতে বলল, “তেমন কিছু না।”

আরশাদ ভ্রু ওপরে তুলে বলল, “তেমন কিছু না হলেও কিছু একটা। যেটা আমার বউকে ভাবাচ্ছে। আর আমার বউয়ের মস্তিষ্কে তো আমি ছাড়া অন্য কোনো চিন্তা থাকার কথা নয়। ব্যাপারটা কী?”

অরা হেসে ফেলে বলল, “সত্যিই আরশাদ, বলার মতো কিছু না।”

আরশাদ কৃত্রিম সন্দেহ দেখিয়ে বলল, “বলার
মতো কিছু না না-কি বলতে চাইছো না?”

এই ছেলেটা নিয়ে আর পারা যায় না! অরার মাঝে কোনো উদ্বেগের ছড়াছড়ি হলে, সেই উদ্বেগে নিজে গা না ভাসানো পর্যন্ত শান্তি নেই আরশাদের। যে ভাবনাগুলো অরাকে ভাবাচ্ছে, তা নেহায়েত তুচ্ছ। তুচ্ছ হলেও জানা চাই আরশাদের। না হলে আজ সারাদিন জ্বালাবে। ফোন করে করে বলবে, “মন খারাপ কেন বললে না তো?”

অরা কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে বলল, “আমরা যখন ও বাড়িতে ছিলাম, তখন বড় মামী…”

চিন্তার মৃদু স্রোত বয়ে গেল আরশাদের ওপর দিয়ে। প্রত্যেকটা পরিবারে এমন কিছু আত্মীয় থাকে, যাদের আশেপাশের প্রতিটা মানুষের জীবনে নাক না গলালে চলে না। ভালো-মন্দ না বুঝলেও তাদের মানুষের জীবন নিয়ে একটা না একটা মন্তব্য করতেই হবে। সে দলের বিশিষ্ট এক সদস্য আরশাদের বড় মামী। ছোটবেলায় এই মানুষটা তার আর তার কাজিনদের জীবন বলতে গেলে অতিষ্ট করে ফেলেছিলেন।

যখনই বাড়িতে আসতেন আগ্রহ নিয়ে পরীক্ষার নম্বর জিজ্ঞেস করতেন। পরীক্ষায় তারা যে নম্বরই পেয়ে থাকুক না কেন, তিনি মুখ বিকৃত করে বলতেন, “এটা কোনো নম্বর হলো? লেখাপড়া তো দেখছি কিছুই করিস না। সারাদিন করিসটা কী? তোর মাকে বলে দেবো যেন তোকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দেয়।”

এখন অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। ওরা কেউই আর স্কুলপড়ুয়া শিশু নেই। তবে উনার স্বভাব এখনো আগের মতোই আছে। কাজিনরা অবশ্য এখন আর তাকে তেমন একটা পাত্তা দেয় না। এই বড় মামী আবার অরাকে উল্টো-পাল্টা কিছু বলে বসেননি তো? অরাকে তার এই উদ্ভট বৈশিষ্ট্যের ব্যাপারে বলা হয়নি। বললে হয়তো মেয়েটা আগেভাগেই সাবধান হয়ে যেতে পারতো।

আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “বড় মামী কী?”

অরা কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “না থাক।”

আরশাদ থমথমে গলায় বলল, “অর্ধেক কথা বলে থেমে যাবে না তো অরা। কী বলেছে মামী?”

অরা ইতস্তত করে বলল, “জিজ্ঞেস করেছেন, আমরা এত তাড়াতাড়ি বাচ্চা কেন নিলাম?”

আরশাদ বিস্মিত এবং কিঞ্চিৎ বিরক্ত স্বরে বলল, “হ্যাঁ?”

বিস্ময়ে রীতিমত হকচকিয়ে গেছে আরশাদ। এটা আবার কেমন প্রশ্ন? বাচ্চা নেওয়াটা একেবারেই স্বামী-স্ত্রীর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। এ নিয়ে অন্য কেউ প্রশ্ন করেই বা কী করে?

অরা আমতা আমতা বলল, “না মানে, তুমি এখন ক্যারিয়ারের পিকে। আমিও কেবল প্রোডাকশন হাউজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। এখনই কেন…?”

বিস্ময় যেন শেষই হচ্ছে না আরশাদের। তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে এত চিন্তা কীসের মানুষের? ক্যারিয়ারের পিকে থাকার সাথে বাচ্চার সম্পর্ক কী? বাচ্চা এলে কি তার ক্যারিয়ারের পিক শেষ হয়ে যাবে? এমন উদ্ভট চিন্তা-ভাবনা কোথা থেকে যে মানুষ খুঁজে পায়?

অরা শুকনো গলায় বলল, “আমি বলেছি, আমরা কোনোকিছুই সেভাবে প্ল্যান করেনি।”

অরা হয়তো আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। তবে তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে আরশাদ তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, “এক সেকেন্ড, এক সেকেন্ড! আমরা প্ল্যান করেছি কি করিনি সেটার কৈফিয়ত তাকে দিতে হবে কেন?”

অরা চুপ করে রইলো। নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে সেও এত কথা বলতে চায়নি বড় মামীকে। কিন্তু তিনি এমনভাবে চেপে ধরলেন যে, না বলে আর পারাই গেল না।

আরশাদ বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, “সমাজের মানুষদের নিয়ে আর পারা যায় না। বাচ্চা না নিলে বলবে বাচ্চা নিচ্ছো না কেন? আর বাচ্চা নিয়ে ফেললে বলবে, এত জলদি নিলে কেন? আমি বুঝি না বাচ্চা নেওয়ার মতো একটা সেনসেটিভ বিষয় নিয়ে কেউ কীভাবে নিজের কমেন্ট পাস করতে পারে?”

অরা গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল, “তুমি মামীকে ভুল বুঝো না আরশাদ। রনি আসলে তাদের আনপ্ল্যানড চাইল্ড ছিল। মামা-মামী দুজনেই তখন নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিল। হঠাৎ করে রনি এসে যাওয়ায় তাদের সম্পর্ক আর আগের মতো থাকে না। ভালবাসাটাও না-কি হারিয়ে যায়। আমি ভাবছিলাম, আমাদের সাথেও যদি এমনটা হয়?”

অরার কথাগুলো মন দিয়ে শুনলো আরশাদ। মাঝে টু শব্দ পর্যন্ত করলো না। কথাগুলো শেষ হতেই আরশাদ রহস্যের ভঙ্গিতে হেসে উঠলো।

অরা আহত গলায় বলল, “তুমি হাসছো?”

আরশাদ কোনোক্রমে হাসি থামিয়ে বলল, “হাসির কথা বললে হাসবো না?”

“হাসির কথা কখন বললাম?”

“তোমার মনে হয় বাবু আসলে আমাদের সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাবে?”

অরা এবার নিজেই লজ্জা পেয়ে গেল। এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। আরশাদের ভালোবাসার প্রতি তার অগাধ ভরসা আছে। কোনোক্রমে, কোনো অবস্থাতেই তা ফুরিয়ে যাবার নয়।

অরা লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, “না মানে…”

আরশাদ হেসে হালকা গলায় বলল, “সিরিয়ালি ভেবে দেখো! তোমার কি মনে হয় বাবু এসে গেলে আমি তোমাকে কোনো অংশে কম ভালোবাসবো? না-কি তুমি আমাকে কম ভালোবাসবে?”

অরা গাল ফুলিয়ে বলল, “না। সেটা কি করে সম্ভব?”

আরশাদ আদুরে ভঙ্গিতে অরার গাল টিপে দিয়ে বলল, “প্রত্যেকটা সম্পর্কই আলাদা, বুঝলেন ম্যাডাম। প্রত্যেকটা সম্পর্কের ধরণ আলাদা, গভীরতাও আলাদা। একটা সম্পর্ক দিয়ে অন্যান্য সম্পর্কগুলোকে জাজ করা ঠিক না।”

মুগ্ধ দৃষ্টিতে আরশাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। প্রত্যেকটা পরিস্থিতিতে এই মানুষটা এত পজিটিভ থাকে কী করে?

“বুঝলাম।”

আরশাদ কোমল স্বরে বলল, “এখন একটু হাসুন!”

নিজের অজান্তেই প্রসন্ন হাসি ফুটে উঠলো অরার ঠোঁটজুড়ে। অরা যখন হাসে তখন কেবল তার ঠোঁটই নয়, চোখদুটোও হেসে ওঠে। নির্ঘাত তার অন্তরটাও হেসে ওঠে একইভাবে।

“কাল চেকআপ আছে। মনে আছে তো?”

অরা অবাক ভঙ্গিতে বলল, “ওহ! একদমই ভুলে গিয়েছিলাম। কাল তো আমি সীমাকে বলে রেখেছি ওর বাড়িতে যাবো।”

“চেকআপের পর চলে যেও।”

“আমি তো সীমাকে বলে রেখেছি সকাল সকালই ওর বাড়িতে হাজির হবো।”

“এ ব্যাপারে কোনো ফাঁকি-ঝুঁকি চলবে না অরা। কালকের দিনটা নিয়ে আমি কতটা এক্সসাইটেড তুমি জানো?”

“কেন? কাল কী?”

আরশাদ মজার ছলে বলল, “এটাও ভুলে গেছ? তোমার কি বুড়ো মানুষের মতো ভুলে যাওয়ার রোগ হলো?”

অরা হাসিমুখে ভ্রু কুঁচকে বলল, “হ্যাঁ হয়েছে। এখন বলবে কাল কী?”

আরশাদ উদগ্রীব ভঙ্গিতে বলল, “কাল আমরা বাবুর হার্টবিট শুনতে পারবো।”

দুসপ্তাহ আগেই বাবুর হার্টবিট এসেছে। সেবার কেন জানি ডক্টর শোনেননি, তাদেরকে শোনাননি। তবে আগামীকালের চেকআপে তারা দুজনেই শুনতে পারবে ওই কাঙ্ক্ষিত ধ্বনি।

মনে পড়ায় অরা উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বলল, “তাই তো!”

আরশাদ একরাশ উচ্ছাস নিয়ে বলল, “ওর হার্টবিট রেকর্ড করে নিয়ে আসবো, বুঝলে। সারাদিন কানে ইয়ারপড গুঁজে ওটাই শুনতে থাকবো কেবল।”

সিনেমাজগৎ নিয়ে একটা গুজব প্রচলিত আছে। বাইরের জগৎটাই না-কি থাকে সেলিব্রেটিদের প্রাধান্যের শীর্ষে। পরিবার নিয়ে এরা বেশি একটা মাথা ঘামায় না। এ কারণে সেলিব্রেটিদের বড় একটা অংশের সংসার ভেঙে যায়। নিতান্তই গুজব বটে।

পরিবার যে একটা মানুষের আছে কতটা গুরুত্বের, আরশাদকে না দেখে বোঝার উপায় নেই। বাবুর হার্টবিট রেকর্ড করে আনার কথা যখন বলছিল, তার চোখদুটো জ্বলজ্বল করে উঠেছিল।

“আরশাদ?”

“হুঁ?”

অরা মোহনীয় কণ্ঠে বলল, “তোমার ভালোবাসা এত সুন্দর কেন?”

আরশাদ রহস্যের হাসি হেসে বলল, “তোমার কমপ্লিমেন্টগুলো এত সুন্দর কেন?”

আসলেই তো! এত সুন্দর কেন তাদের ভালোবাসা? এমন শুভ্র-সুন্দর ভালোবাসা না-কি হারিয়ে যাবে বাবু এলে। মনে মনে হেসে উঠলো অরা। শুধু শুধুই দুশ্চিন্তা করছিল সে।

অফিসে আজ বিন্দুমাত্র অবসর নেই অরার। একে তো তিনদিনের জমে থাকা কাজ, তার ওপরে আবার নতুন নতুন সব ঝামেলা। দু মিনিট পর পর কেউ না কেউ আসছে তার কেবিনে কিছু একটা অ্যাপ্রুভ করাতে অথবা সাইন করাতে। আবার কেউ আসছে ফাইল চেক করাতে। ইতোমধ্যেই মাথা ধরে গেছে অরার। মাথা ধরিয়ে দেওয়ার মতো মিটিংগুলো তো এখনো পড়েই আছে।

এ মাসের মাঝামাঝিতে কালিয়াকৈরে শুরু হয়েছে কে ফিল্মসের পরবর্তী সিনেমা ‘ছাই’য়ের। কালিয়াকৈর জায়গাটা গাজীপুরের থেকে বেশ দূরে। সেখানেই একটা গোটা গ্রামের সেট তৈরি করা হয়েছে। সিনেমায় গল্পটা শুরু হয় এক অগ্নিকান্ডের মাধ্যমে। একদিন হুট করে গোটা গ্রামে আগুন লেগে যায়। শত শত পরিবার ঘরছাড়া হয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে।

আজকাল অগ্নিকান্ডের দৃশ্যগুলো ভিএফএক্সের মাধ্যমে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়। তবে পরিচালক এতে রাজি হননি। তিনি চেয়েছেন পর্দায় আগুন যাতে দর্শক হলে বসে অনুভব করতে পারে। তার ইচ্ছা অনুযায়ীই প্রয়োজনীয় দৃশ্যধারণ শেষে পুরো সেটে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

সবকিছু পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেকই চলছিল। আগুনের দৃশ্যগুলো সুন্দরভাবেই কোনপ্রকার ঝামেলা ছাড়া ধারণ করা গেছে। ঝামেলা বেঁধেছে পরবর্তীতে। শুটিংয়ের জন্যে সেট হিসেবে যে বাড়িঘর তৈরি করা হয়েছিল, ওগুলো ছিল মূলত ক্ষণস্থায়ী, কার্ডবোর্ডের তৈরি। তবে ওই বাড়িঘরগুলোর মধ্যে না-কি আসল কয়েকটা বাড়ি ছিল। আগুন সেসব বাড়িতেও লেগেছে।

আসল বাড়িঘরের বাসিন্দারা ক্ষেপে গেছে। শুটিং করতে দিচ্ছে না। পুলিশ আনবে বলে হুমকি-ধামকি দিচ্ছে। তাদের ক্ষতিপূরণ চাই। অরা ভেবে পায় না শুটিং সেটের মাঝে আসল বাড়িঘর থাকবে কেন? যারা সেট বানিয়েছে এটা কি তাদেরই অবহেলার ফল?

ফোনে অনেকটা সময় ধরে কথা হলো ‘ছাই’ সিনেমার পরিচালকের সঙ্গে। তাকে বেশ কিছু নির্দেশনা দিলো অরা। যদিও এই ঝামেলা সহজে মিটবে বলে মনে হচ্ছে না।

দুপুরের দিকে মিটিংয়ে ঢুকলো অরা। কে ফিল্মসের ক্রিয়েটিভ টিম এদিকে নতুন ঝামেলা বাঁধিয়ে বসেছে। গত মাসে পরিচালক আদনান রহমানের সঙ্গে একটি নতুন সিনেমা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে কে ফিল্মসের। একটা সিনেমার গল্প চূড়ান্ত হয়ে গেলে প্রথম চুক্তিটা পরিচালকের সঙ্গেই সম্পাদন করে কে ফিল্মস।

গল্প চূড়ান্ত হয়ে গেলে পরিচালককে স্ক্রিপ্ট জমা দিতে হয় এখানে। তার স্ক্রিপ্ট যাচাই-বাছাই করে ক্রিয়েটিভ টিম। কোনো ভুল-ভ্রান্তি থাকলে তা সংশোধন করতে বলে। আদনানের স্ক্রিপ্ট পড়ার পরও একগাদা সংশোধন দেয়। তবে আদনান স্ক্রিপ্টে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন আনতে নারাজ।

ক্রিয়েটিভ টিম তাই অরাকে পরামর্শ দিয়েছে এই সিনেমাটা একেবারেই বাতিল করে দিতে। স্ক্রিপ্টে গোঁজামিলের কারণে কিছুদিন আগেই ‘নক্ষত্র’ সিনেমাটাকে রিশুটে পাঠিয়েছে আরশাদ। একই ভুল যাতে আবার না হয়, তাই এই সিদ্ধান্ত।

ক্রিয়েটিভ টিমের হেড যুথী। এছাড়াও এই টিমের গুরুত্বপূর্ণ সদ্য হাবিব এবং কেয়া। ক্রিয়েটিভ টিমে আরও অনেক সদস্য রয়েছে। তবে যেকোনো জরুরি মিটিংয়ে এই তিনজনই থাকে। আজ কীভাবে যেন মিটিংয়ে ঢুকে গেছে মাহমুদ। তার অতিরিক্ত কথার কারণে এমনিতেই যুথীর অপছন্দের তালিকায় চলে গেছে। এমন গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে তাই মাহমুদের উপস্থিতি মোটেও স্বস্তি দিচ্ছে না তাকে।

অরা চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, “আমি বুঝলাম না। তোমাদের সাথে বসেই তো গল্পটা ফাইনালাইজ করলাম। হঠাৎ কী এমন হলো যে সিনেমাই বাতিল করে দিতে বলছো?”

যুথী ভদ্রভাবে বলল, “ম্যাম আপনি একবার প্লিজ সময় নিয়ে গল্পটা পড়ে দেখুন।”

“পড়েছি যুথী। সমস্যাটা কোথায় সেটাই তো বুঝতে পারছি না।”

“সমস্যাটা স্ক্রিনপ্লেতে ম্যাম। গল্পটা শুনতে যতটা ভালো লাগছিল, স্ক্রিপ্টে সাজানোর পর তার মান ততটা ভালো নেই। আরশাদ স্যার তো এই স্ক্রিনপ্লের সমস্যার কারণেই নক্ষত্র সিনেমাটা রিশুটে পাঠালেন। এজন্যে শুরু থেকেই আমরা ঝামেলা এড়িয়ে যেতে চাচ্ছি।”

অরা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, “একটা সিনেমার এগ্রিমেন্ট সাইন হয়ে গেছে। ডিরেক্টরকে আমরা কমিটমেন্টও দিয়ে ফেলেছি। চাইলেই তো আর সেই সিনেমা বাতিল করে দেওয়া যায় না। স্ক্রিপ্টে চেঞ্জ করতে বলো। দরকার হলো পুরো স্ক্রিপ্টটাই বদলে ফেলুক!”

হাবিব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “এটাই তো সমস্যা ম্যাম। ডিরেক্টর স্ক্রিপ্ট চেঞ্জ করতে রাজি না। তিনি একচুলও চেঞ্জ করবেন না তার স্ক্রিপ্টে।”

দুশ্চিন্তার দমকা হাওয়া বয়ে গেল ঘরের মাঝে। নীরবতায় সকলেই গম্ভীর হয়ে মনে মনে সমাধান খুঁজে বেড়াতে ব্যস্ত।

আচমকা নীরবতায় ছেদ ফেলল মাহমুদের উৎফুল্ল কণ্ঠস্বর, “ম্যাম আমার একটা সাজেশন ছিল!”

অরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই যুথী চোখ রাঙিয়ে বলল, “মাহমুদ! নো!”

মাহমুদের অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল যুথীর
দিকে। এই অফিসে দেখি তার মত প্রকাশের কোনো স্বাধীনতাই নেই! ক্রিয়েটিভ টিমের একজন সদস্য যদি নির্ভয়ে নিজের ক্রিয়েটিভি প্রকাশে না আনতে পারে, তাহলে আর এই চাকরি করে লাভ কী?

কেয়া শুকনো মুখে বলল, “আমরা তাও ডিরেক্টরকে একটা অপশন দিয়েছি ম্যাম। কোনো চেঞ্জ না করতে চাইলেও তাকে বলেছি কয়েকটা দৃশ্য ফেলে দিতে। তিনি তাতেও রাজি না।”

অরা তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, “ডিরেক্টরের সাথে এগ্রিমেন্ট সাইন হয়ে যাওয়ার পর একটা সিনেমা বাতিলের মানে নিশ্চয়ই জানো? তার সঙ্গে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও শেষমেশ কাজটা না করা। এটা তো অন্যায়। তিনি চাইলেই পারেন সাংবাদিকদের কাছে গিয়ে এই নিয়ে কথা বলতে। সাংবাদিকরাও রঙ-চং মাখিয়ে লেখালিখি করবে। এতে আমাদেরই গুডউইল নষ্ট হবে।”

মাহমুদ আবারও লাফিয়ে পড়ে বলল, “ম্যাম!”

তাকে আবারও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে হাবিব বলল, “আর উনি যেটা করছেন সেটা অন্যায় না ম্যাম? পৃথিবীর কোনো স্ক্রিপ্টই তো পারফেক্ট নয়। আমরা তাকে তার স্ক্রিপ্টটা পারফেক্ট করে নেওয়ার সুযোগ দিচ্ছি। তাকে নতুন সাজেশন দিচ্ছি। আমাদেরও যে ক্রিয়েটিভিটি আছে এটা সে মানতেই রাজি নয়।”

মাহমুদ হাল না ছেড়ে দিয়ে আবারও চেঁচিয়ে উঠে বলল, “আমার একটা সাজেশন ছিল ম্যাম!”

অরা একপ্রকার বিরক্তি হয়েই বলল, “কী সাজেশন মাহমুদ?”

মাহমুদ হাসি হাসি গলায় বলল, “এখন থেকে আমরা একটা গল্প সিলেক্ট করার পর ডিরেক্টরকে বলবো তিন থেকে চারটা স্ক্রিপ্ট দিতে। একই গল্প নিয়ে বিভিন্ন স্ক্রিপ্ট লিখবে। একটার সাথে কোনো আরেকটার মিল থাকবে না। তাহলে আমাদের এমন ঝামেলাও পোহাতে হবে না।”

ঘরজুড়ে নীরবতায় হাওয়া বয়ে গেল। এতটা সময় সকলে এই ঝামেলা নিয়ে ভাবতে ব্যস্ত থাকলেও ক্ষণিকের জন্যে তাদের মনে জায়গা করে নিয়েছে বিরক্তি। জরুরি মিটিংয়ের মাঝে মাহমুদ এমনভাবে লাফালাফি করছিল, অরা ভেবেছিল তার কাছে কোনো জোরালো সাজেশন থাকেলও থাকতে পারে।

প্রকৃতি রাগ জিনিসটা তিলপরিমাণ দেয়নি অরার মাঝে। তবুও এমন জটিল পরিস্থিতিতে মাহমুদের অহেতুক সাজেশন শুনে তার মাঝে রাগের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে।

অরা কঠিন গলায় বলল, “এই সাজেশন দেওয়ার জন্যে এতক্ষণ লাফাচ্ছিলে তুমি?”

অরার এমন প্রশ্নে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল মাহমুদ। মনে মনে সে ধরেই নিয়েছিল তার সাজেশনে রীতিমত মুগ্ধ হয়ে যাবে এ ঘরে উপস্থিত সকলে।

মাহমুদ আমতা আমতা করে কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই অরা বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, “মাহমুদ এখানে একটা সিরিয়াস মিটিং চলছে। Stop being a child!”

যুথী পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্যে বলল, “মাহমুদ! Out!”

মাহমুদ কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। দীর্ঘ মিটিং শেষে সিদ্ধান্ত হলো আদনান সাহেবকে অফিসে ডেকে তাকে বুঝিয়ে বলা হবে, যাতে স্ক্রিপ্টে পরিবর্তন আনতে তিনি রাজি হয়ে যান।

মিটিং শেষে খানিকটা বিশ্রাম পেলো অরা। বেচারির ওপর দিয়ে আজ প্রচুর ধকল গেছে। এতটা ধকল নেওয়া মোটেও ঠিক হচ্ছে। ধকল তো আর তার একার ওপর পড়ছে না, তার ভেতর লুকিয়ে থাকা ছোট্ট সুপারস্টারের ওপরেও পড়ছে।

বিশ্রাম পেয়েও মনের মাঝে একপ্রকার অস্বস্তি রয়েই গেল। বকাঝকা অরার স্বভাবে নেই। আজ পর্যন্ত অফিসের কারও সঙ্গে উঁচু গলায় কথা বলেনি সে। কেউ ভুল করলে তাকে বুঝিয়ে বলেছে। আজ তবে কেন মাহমুদকে ওভাবে বকতে গেল সে?

একই নাম তাহলে মুড সুইং! প্রেগন্যান্সির বড় একটা সময় জুড়েই মুড সুইংয়ের বিচরণ। চোখের পলকের আগেই না-কি মনের অনুভূতি বদলাতে থাকে। আগেভাগেই এ ব্যাপারে তাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন ডক্টর।

একপ্রকার অনুশোচনা থেকেই মাহমুদকে নিজের কেবিনে ডেকে পাঠালো অরা।

অরা অনুতপ্ত স্বরে বলল, “I’m sorry, আমি অফিসে কাউকেই এভাবে বকাঝকা করি না। কিন্তু আজ…”

মাহমুদ ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “আপনি সরি বলছেন কেন ম্যাম? আপনার মতো মানুষ আমাকে সরি বলবে? এটা কোনো কথা? বকাটা তো আমার প্রাপ্য ছিল। আপনার বকা খেয়ে বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার পরেই তো বুঝতে পারলাম, কী বোকার মতো কাজ করেছি! একটা মানুষ একই গল্প নিয়ে তিন-চারটা স্ক্রিপ্ট কী করে লিখবে? এটা আবার সম্ভব না-কি?”

অরা কিঞ্চিৎ হাসি হেসে বলল, “সম্ভব তবে সেটা একজন ডিরেক্টরকে বলা যায় না। তার ওপরে অনেক চাপ পড়বে। তুমি তো নতুন, এখনো সব শিখে উঠতে পারেনি। এভাবে আইডিয়া দিতে দিতে আর ভুল করতে করতেই তো শিখবে। আমারই উচিত হয়নি তোমাকে চুপ করিয়ে দেওয়া।”

“সমস্যা নেই ম্যাম। আমার অভ্যাস আছে। ছোটবেলা থেকেই বাড়িতে সবাই আমাকে চুপ করিয়ে দিয়ে আসছে। আমি সবার ছোট তো, আমার যে কোনো মতামত থাকতে পারে এটা বাড়ির কারোর মনেই হয় না।”

নিজের মতো করেই অনেকটা সময় গল্প করে গেল মাহমুদ। অরা আজ উপলব্ধি করলো, এই ছেলেটার মধ্যে বিচিত্র এক সরলতা আর শিশুসুলভতা রয়েছে।

(চলবে)

[সসসসসসসসরি!!!! অনেক দেরি করে ফেললাম এবার। এ সপ্তাহটা যে কী পরিমাণ ব্যস্ততার মাঝে কেটেছে, বলে বোঝানো সম্ভব না। সারাদিনই আমার মাথায় গল্প ঘুরে বেড়ায়। তবে এ সপ্তাহে গল্প নিয়ে ভাবনার সময় পর্যন্ত পাইনি। পরীক্ষা আর পড়াশোনার মাঝেই কেটেছে আমার জীবন। এমনকি এখনও বই সামনে রেখে পোস্ট দিচ্ছি। ভাবেন কতটা ব্যস্ত ছিলাম যে, আপনাদের বকাঝকা খেয়েও লিখতে বসার অবকাশ পাইনি। জানি আজকেও বকা খাবো। তবে প্রমিজ এখন থেকে এতটা দেরি আর হবে না। ভালোবাসায় রাখবেন আমাকে। ❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here