#ফিরে_আসা২
১৯
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
“এটা তো হার্টবিটের শব্দ না। মনে হচ্ছে যেন প্লেন চলছে। মানুষের হার্টবিট তো এমন হয় না।” বিভ্রান্ত গলায় বলল কথা।
আরশাদ অবাক হয়ে বলল, “মানুষের হার্টবিটের শব্দ তুই কীভাবে চিনিস রে?”
“কার্টুন থেকে। কার্টুনে টেনশনের মোমেন্টে হার্টবিটের আওয়াজ শোনায়।”
আরশাদ আর অরা দুজনেই হেসে ফেলল মেয়ের যুক্তি শুনে। মেয়েটা তার বাবার মতোই বুদ্ধির অধিকারী হয়েছে। তাকে বোকা বানানো নেহায়েত সহজ কাজ নয়।
অরা হাসিমুখে বলল, “আমার কথা কত স্মার্ট দেখেছো?”
আরশাদ বিস্মিত ভঙ্গিতে বলল, “তাই তো দেখছি।”
আজ সকালে অরাকে চেকআপের জন্যে হসপিটালে নিয়ে গেছিল আরশাদ। আল্ট্রাসাউন্ডে আজই প্রথম বাবুর ছোট্ট হৃদপিন্ডের ধুকপুক শোনে তারা। সেই থেকে আরশাদের উচ্ছাসে কোনোপ্রকার কমতি নেই। রেকর্ড করে আনা ওই হৃদস্পন্দের ধ্বনি অনবরত শুনেই যাচ্ছে। শুনবে নাই বা কেন? এই ধ্বনি যে তার কাছে পৃথিবীর সবথেকে সুন্দরতম ধ্বনি।
হসপিটাল থেকে তারা দুজনেই গেল কথাকে স্কুল থেকে তুলতে। কথার মনের মাঝেও আজ তাই আনন্দের ছড়াছড়ি। সবসময় তাকে অরাই স্কুল থেকে তুলতে আসে। মাঝেমধ্যে আরশাদও আসে। তবে দুজনেই যখন একসঙ্গে আসে, তার দিনটা যেন একটু বেশিই আনন্দের হয়ে ওঠে। এ কথাটা সে আরশাদ বা অরা কাউকেই জানায়নি। জানালে তারা ইচ্ছে করে কথাকে আনন্দ দেওয়ার জন্যে মাঝেমধ্যেই একসঙ্গে তুলতে যাবে। আনন্দটা আগের মতো থাকবে না তখন আর।
কথাকে স্কুল থেকে বাড়িতে নিয়ে এলো আরশাদ আর অরা। আজ আরশাদের শুটিং শুরু হবে দুপুরের পর। তাই তেমন একটা তাড়া নেই। বাড়ি ফিরেই বসার ঘরের সোফায় বসে আরশাদ আয়োজন করে মেয়েকে অনাগত অতিথির হৃদস্পন্দন শোনাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
আরশাদ আর অরা আগে একবার কথাকে জানিয়েছিল, খুব শীঘ্রই সর্বক্ষণ তাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্যে কেউ একজন আসছে। সেবার কথা বিশ্বাস করেনি তাদেরকে। আজ বাবুর হৃদস্পন্দন শোনার পরও যেন ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না। তাই তো তার হৃদস্পন্দনকে প্লেনের আওয়াজের সঙ্গে তুলনা করছে। যদিও আল্ট্রাসাউন্ডে শিশুর হৃদস্পন্দন খানিকটা উড়ন্ত প্লেনের মতোই শোনায়।
আরশাদ সুন্দরভাবে মেয়েকে বুঝিয়ে বলল, “একদম ছোট্ট বাবুর হার্টবিট এমন প্লেনের আওয়াজের মতোই হয় বাবা। তোর ভাই বা বোন যে আসছে, সে তো অনেক ছোট। তোর থেকেও ছোট!”
কথা কৌতূহলভরা গলায় বলল, “ও এখন কোথায় বাবা?”
আরশাদ অরার পেটের ওপরে হাত রেখে বলল, “এই যে এখানে। আর কয়েকটা দিন পরেই আমাদের কাছে চলে আসবে।”
কথা গভীর আগ্রহ আর কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে রইল অরার পেটের দিকে। কোনো মানুষ এখানে কী করে থাকতে পারে? বাবার কথাগুলো একেবারেই বিশ্বাস হচ্ছে না তার। আবার অবিশ্বাসও করতে পারছে না একেবারে। একটা ভাই বা বোনের স্বপ্ন তার বহুদিনের। তার স্কুলের বেশিরভাগ বন্ধুদেরই হয় ভাই, না হয় বোন রয়েছে। তার নেই কেবল। এবার কি তবে সেই স্বপ্ন সত্যি হতে যাচ্ছে?
কথা চিন্তিত গলায় বলল, “আচ্ছা বাবা, আমার ভাই আসবে না-কি বোন?”
আরশাদ আদুরে গলায় বলল, “সেটা তো এখন বলতে পারছি না। আর কয়েকদিন পর ও এলেই বোঝা যাবে।”
“ও কবে আসবে?”
কথার জিজ্ঞেস করার ভঙ্গিতে মনের অজান্তেই হেসে ফেলল অরা। ভাই বা বোনের জন্যে বেচারি এতটাই উদগ্রীব হয়ে পড়েছে যেন আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করাও তার পক্ষে কষ্টসাধ্য।
আরশাদ সহজভাবে বলল, “বেশিদিন না। মাত্র ছয় মাস পর।”
“আমি কি ওর সাথে খেলতে পারবো?”
“কেন পারবি না?”
“ও কি আমার সাথে কার্টুন দেখবে?”
অরা আশ্বাস দিয়ে বলল, “অবশ্যই দেখবে সোনা। তুই যা বলবি তাই করবে।”
কথার এই কৌতুহল দেখে আরশাদ আর অরা দুজনেই মজা পাচ্ছে। তাদের দুজনের পাশাপশি এখন কথাও বাবুকে নিয়ে নতুন নতুন স্বপ্ন সাজাতে শুরু করেছে।
কথা এবার হাজির হলো নতুন কৌতূহল নিয়ে, “আচ্ছা অরা, ও আমাকে কি ডাকবে? আপা না-কি আপি?”
অরা হাসিমুখে বলল, “তুই কী চাস?”
“আপি?”
“তাহলে তাই ডাকবে। কথা আপি!”
বাবুটা একটু বেশিই ভাগ্যবান। পৃথিবীতে আসার আগেই এত মিষ্টি একটা আপি পেয়ে গেল সে। যে আপি ইতোমধ্যেই অসম্ভব ভালোবাসে তাকে।
কথার গভর্নেন্স পায়েল তাকে নিয়ে গেল তৈরি করে দেবে বলে। আজ সীমার বাড়িতে যাবে অরা। কথাকে তো একা আর রেখে যাওয়া যায় না, তাকেও সঙ্গে নিয়ে যাবে।
কথা চলে যেতেই আরশাদ অরার কোমর জড়িয়ে নিজের কাছে টেনে আনলো।
অরা আঁতকে উঠে বলল, “কী করছো আরশাদ! বাড়ি ভর্তি স্টাফ, কেউ দেখে ফেললে?”
আরশাদ তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, “ফেলুক তো।”
অরা ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “ফেলুক মানে? ছাড়ো আরশাদ।”
আরশাদ দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল, “এমন ভাব করছো যেন তুমি আমার বউ না, গার্লফ্রেন্ড। আমাদেরকে এভাবে কেউ দেখে ফেললে বিরাট পাপ হয়ে যাবে!”
অরা কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। এই ছেলের লাগামছাড়া কথাবার্তার সঙ্গে সত্যিই পেরে ওঠা মুশকিল।
আরশাদ কোমল স্বরে বলল বলল, “আজ আমি অনেক খুশি।”
অরা আরশাদের বুকে মুখ লুকিয়ে বলল, “আমিও।”
আরশাদ অরার চুলের মাঝে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “তোমাকে অনেক অনেক থ্যাংকস।”
অরা আরশাদের বুক থেকে মুখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে কৌতূহলী ভঙ্গিতে বলল, “থ্যাংকস কেন?”
“এই যে আমার বাবুটাকে তোমার ভালোবাসার আশ্রয় বড় করে তুলছো, সেজন্যে।”
অরা ব্যঙ্গাত্মক স্বরে বলল, “হ্যাঁ সেটাই। বাবু তো তোমার একার আমার তো আর কেউ না।”
আরশাদ আর অরা দুজনেই একসঙ্গে হেসে ফেলল।
আরশাদ তার শীতল ঠোঁটের স্পর্শ অরার কপালে দিয়ে বলল, “খেয়াল রেখো।”
“কার?”
“নিজের আর এই দুই বিচ্ছুর।”
অরা আবারও আরশাদের বুকে মাথা রেখে বলল, “তুমিও খেয়াল রেখো।”
“রাখি তো। যতটুকু পারি তোমাদের খেয়াল রাখি।”
“ধুর! আমি তোমার কথা বলছিলাম। নিজের খেয়াল রেখো আরশাদ।”
“সেটার প্রয়োজন হয় না।”
“কেন?”
আরশাদ দৃঢ় ভঙ্গিতে বলল, “তুমি আছ না? আমার খেয়াল রাখবে বলে।”
প্রচ্ছন্ন এক হাসি ফুটে উঠলো অরার ঠোঁটজুড়ে। জীবনটা আজকাল রূপকথার গল্পের মতো হয়ে যাচ্ছে। রূপকথার গল্পের প্রতিটা পাতায় যেমন কেবলই মুগ্ধতার ছড়াছড়ি, জীবনের প্রতিটা দিনও ঠিক তেমনই। প্রকৃতির কাছে কেবল একটাই প্রার্থনা অরার। জীবনের প্রতি এই মুগ্ধতা যেন কোনোকালেই ফুরিয়ে না যায়।
আরশাদ শুটিংয়ের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাওয়ার পর পরই অরাও কথাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো সীমার বাড়ির উদ্দেশ্যে। ওর বিয়ের পর মাত্র একবারই অরা গিয়েছে ও বাড়িতে। সীমা বেশ কিছুদিন ধরেই ফোনে জোরাজুরি করছিল যাওয়ার জন্যে। যদিও অফিসে কাজে ভয়ানক চাপ। তবুও চাপের মাঝ থেকে ঠিকই সময় বের করে নিলো অরা।
তার তেমন কোনো বন্ধু নেই। বন্ধু বলতে সারাজীবন যাকে চিনেছে, সেই সীমা। বন্ধুত্ব এমনই একটা সম্পর্ক, যত্ন ছাড়া একে টিকিয়ে রাখা একেবারেই মুশকিল। তাই তো অরা হাজার ব্যস্ততার ভীড়েও সময় বের করে নিলো সীমার জন্যে।
সীমার বাড়িতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে তীব্র অ্যাপায়নের মধ্য দিয়ে যেতে হলো অরাকে। সীমা ঠিকই বলে। তার শাশুড়ি সাবিহা বেগম অতিরিক্ত মিষ্টি। তার কথাবার্তা আর আচার-আচরণের মধ্য দিয়েই অতিরিক্ত মিষ্টতার প্রকাশ ঘটে। অরাকে তিন-চারবার জিজ্ঞেস করে গেলেন, “রাস্তায় কোনো অসুবিধা হয়নি তো মা?” এমন একটা ভাব যেন অরা আরেক শহর থেকে বেড়াতে এসেছে তাদের বাড়িতে।
সীমার ননদ বর্ষা অরাকে ঘুরে ঘুরে তাদের বাড়িটা দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সীমার বিয়ের পর থেকে সাবিহা বেগম তাকে নিজের সংসার সাজানোর পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন। সীমা নিজের পছন্দ মতোই বসার ঘরটা সাজিয়েছে।
বসার ঘরের একটা দেয়ালে ফ্রেমে বাঁধাই করা আরশাদের অটোগ্রাফ। সীমা প্রথম যেদিন আরশাদের সঙ্গে দেখা করেছিল, সেদিন নেওয়া এই অটোগ্রাফ। ফ্রেমটা চোখে পড়তে মনের অজান্তেই হাসি ফুটে উঠলো অরার ঠোঁটে। ভালোবাসার মানুষকে কোনো না কোনোভাবে স্পর্শ করে এমন সকল কিছুই তার ভালোবাসার।
সীমাদের পাশের বাড়ির ছোট্ট একটা মেয়ে এসেছে। কথা মুহূর্তেই মাঝে তার সঙ্গে ভাব করে ফেলেছে। দুজনে মিলে এখন বর্ষার ঘরে বসে হইচই করছে। বাচ্চাদের এই এক দারুণ ক্ষমতা। সম্পর্ক গড়ে তুলতে তাদের খুব একটা সময় লাগে না।
এনায়েত আর তার বাবা বাড়িতে নেই। দুদিনের জন্যে না-কি গ্রামের বাড়িতে গেছে। অরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো, এই এনায়েত কখনোই বাসায় থাকে না। সীমার সঙ্গে যখনই দেখা হয় বা ফোনে কথা হয়, তখনই শোনা যায় সে বাইরে আছে।
দুপুরের খাবারের ব্যাপক আয়োজন করেছেন সাবিহা বেগম। বিশাল ডাইনিং টেবিল যে কতপ্রকার খাবার-দাবার দিয়ে সাজানো, তাই গুনতে হিমশিম খাচ্ছে অরা। অরা, সীমা আর বর্ষা তিনজনই বসে পড়লো। সাবিহা বেগমকে হাজার জোরাজুরি করা সত্ত্বেও তিনি বসলেন না। বাড়ির সকলের খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত না-কি তিনি খেতে পারেন না।
কথাকে হাজার ডাকাডাকি করেও ডাইনিং টেবিল পর্যন্ত আনা গেল না। নতুন বন্ধুর সাথে সে বর্ষার ঘরেই টিভি দেখছে আর খাচ্ছে।
সাবিহা বেগম পরম যত্নে তিনি একেকটা আইটেম তুলে দিচ্ছেন সকলের প্লেটে।
অরা ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “এত রান্নাবান্নার কোনো দরকার ছিল না আন্টি।”
সাবিহা বেগম আন্তরিক গলায় বললেন, “কী যে বলো মা! কিছুই তো করতে পারলাম না। ইচ্ছা ছিল মুড়িঘন্ট করবো, কিন্তু সময়ই করে উঠতে পারলাম না।”
অরা হাসিমুখে বলল, “আমি এমনিতেও মুড়িঘন্ট খাই না আন্টি।”
সাবিহা বেগম শুকনো মুখে বললেন, “এটা তো আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে বলছো।”
অরা সত্যিই মুড়িঘন্ট খেতে পারে না। এই প্রসঙ্গে কথা বাড়ালেই তর্ক বেঁধে যেতে পারে। অরা তাই নিঃশব্দে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো।
সাবিহা বেগম অবাক ভঙ্গিমায় বললেন,“তুমি তো কিছুই খাচ্ছো না মা। আরেকটু পোলাও দিই?”
অরা ইতোমধ্যেই অনেক খেয়ে ফেলেছে। এমনিতেই সে কম কম খায়। কনসিভ করার পর তবুও আরশাদের ধমকা-ধমকিতে খাদ্য তালিকা বাড়িয়েছে। তবুও, এতটা খাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়।
অরা আঁতকে উঠে বলল, “আন্টি আমি আর খেতে পারবো না সত্যি!”
সাবিহা বেগম জোর দিয়ে বললেন, “পারবে না মানে? পারতেই হবে।”
অরাকে আর কোনপ্রকার কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সাবিহা বেগম তার প্লেটে চামচভর্তি পোলাও তুলে দিলেন। অরা অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো সীমার দিকে।
সীমা মজার ছলে বলল, “এটা হলো আমার শাশুড়ি মায়ের খাবারের অত্যাচার। তুই একদিন বেড়াতে এসেছিস বলে এই অত্যাচার করছে এমনটা কিন্তু না। আমাদের সবাইকে প্রতিদিন ঠিক এভাবেই অত্যাচার করে।”
সাবিহা বেগম হতাশ ভঙ্গিতে বললেন, “তোমরা আজকালকার মেয়েরা কীসব ডায়েটিং-টায়েটিং করো। আমার মেয়েটাকেই দেখো না! নিজেকে ফিট রাখবে বলে না-কি ডায়েটিং করে। আরে বাবা, কম খেয়ে আবার নিজেকে ফিট রাখা যায় না-কি?”
বর্ষা গোমড়া মুখে বলল, “তাই বলে কি বেশি খেয়ে নিজেকে ফিট রাখবো?”
“থাম তো তুই! অরা মা শোনো, এ সময়ে কিন্তু একেবারেই ওসব ডায়েটিং করবে না। ডায়েটিংয়ের জন্যে সারাজীবন পড়ে আছে। আগে বাচ্চার ভালোটা দেখতে হবে তো, না-কি?”
অরা হাসিমুখে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো। মায়েরা সত্যিই অসাধারণ। নিজের ভালোর পরোয়া না করে সন্তানের ভালোটা করতে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই অসাধারণত্বের তালিকায় আর কদিন পর তার নামটাও যোগ হতে যাচ্ছে। ভাবতেই ভালো লাগে।
খাওয়া-দাওয়া শেষে অরা আবারও তাদের বসার ঘরটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তার বান্ধবীর রুচির প্রশংসা না করে উপায় নেই। চমৎকার সব পেইন্টিং আর শোপিস দিয়ে সাজিয়েছে ঘরটাকে। ও ঘর থেকে কথার চেঁচামেচির আওয়াজ আসছে। আনন্দময় চেঁচামেচি। আজ বহুদিন পর মেয়েটাকে এত আনন্দিত লাগছে।
অরা উঁচু গলায় বলল, “আস্তে কথা!”
সীমা পাশ থেকে তাকে বাঁধা দিয়ে বলল, “থাক না অরা। স্কুলের বাইরে তো সারাদিন বেচারি একা একাই থাকে। সার্বক্ষণিক সঙ্গী তো এখনও নেই ওর।”
অরা হঠাৎ কী যেন মনে করে বলল, “আজ আরশাদ কথাকে বাবুর হার্টবিট শোনাচ্ছিল জানিস? বাবুকে নিয়ে ওর কত যে কৌতূহল।”
সীমা মুগ্ধ গলায় বলল, “Picture Perfect!”
“কী?”
“তোর পরিবার। তোর গল্পের একটা হ্যাপি এন্ডিং হলো তাই না?”
“হয়তো। বাস্তব কী আর সিনেমা, যে একটা না একটা এন্ডিং থাকতেই হবে?”
সীমার দিকে আড়চোখে তাকালো অরা। মেয়েটা আজ অন্যরকম লাগছে। সীমা মানেই তো প্রাণবন্ত-হাস্যোজ্বল একটি মেয়ে। কথায় কথায় যার ঠাট্টা করা চাই। আজ হঠাৎ তাকে এত নিষ্প্রভ লাগছে কেন? অরা জিজ্ঞেস করতে চাইছে, তবে ঠিক সুযোগটা যেন পাচ্ছে না।
ব্যস্ত ভঙ্গিতে বসার ঘরে প্রবেশ ঘটলো সাবিহা বেগমের। তার হাতে একটা ট্রে। ট্রেতে কতগুলো বাটিভর্তি পায়েস।
একটা বাটি তিনি অরার হাতে তুলে দিতে দিতে বললেন, “এই নাও মা। খেয়ে বলো তো কেমন হয়েছে?”
অরা ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “আবার পায়েসের কী দরকার ছিল আন্টি?”
“খাওয়ার পর ডেজার্ট থাকবে না, তা কী করে হয়? গোবিন্দভোগ চালের পায়েস। আমি নিজে গিয়ে এই চাল নিয়ে এসেছি। কেমন হয়েছে?”
অরা প্রশংসার ভঙ্গিতে বলল, “দারুণ হয়েছে আন্টি। আপনার রান্নার হাত সত্যিই অসাধারণ!”
তিনি প্রশংসায় খানিকটা হয়ে বললেন, “সব আমার শাশুড়ি কাছ থেকে শেখা। উনার মতো ভালো রান্না আমি কাউকে করতে দেখিনি। উনার মতো তো আর পারি না। তবুও যতটুকু শিখেছি, বৌমাকে শেখানোর চেষ্টা করি।”
অরা হতবাক ভঙ্গিতে সীমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই রান্না করিস না-কি?”
সীমা লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, “ওই আর কী!”
সীমা কোনোকালেই খুব একটা রান্না করতো না। তারা দুজনে যখন একসঙ্গে থাকতো, তখনও প্রতিদিন একজন কাজের লোক এসে রান্না করে দিয়ে যেত। সেই মেয়ে না-কি এখন শাশুড়ির কাছে রান্না শেখে! বিয়ের পর মানুষ আসলেই কম সময়ের ব্যবধানে বদলে যায়।
সাবিহা বেগম হঠাৎ বলে উঠলেন, “বৌমা! তোমাদের বাড়িটা অরাকে দেখিয়ে আনো।”
অরা বলল, “তোদের বাড়ি মানে?”
সাবিহা বেগম হাসিমুখে বললেন, “প্রত্যেকটা মেয়েই তো চায় নিজের মতো করে সংসার সাজাতে। আমার বৌমাও নিশ্চয়ই মনে মনে তাই চাইতো। মুখ ফুটে কিছু না বললে কী হবে? আমি তো ঠিকই বুঝতে পারি। গত মাসে আমাদের এই ফ্ল্যাটের নিচের ফ্ল্যাটটা খালি হলো। সঙ্গে সঙ্গে ভাড়া নিয়ে ফেললাম এনায়েত আর বৌমার জন্যে। কয়েকটা দিন থাকুক নিজের মতো করে। নিজেদের বুঝতে শিখুক। কী বলো মা?”
প্রত্যেকটা মা না-কি চায় বিয়ের পর ছেলে তাদের আঁচলে নিচে থাকুক। বউয়ের মতামতকে প্রাধান্য না দিয়ে মায়ের কথামতো চলুক। আর সেখানে সাবিহা বেগম নিজেই ছেলে আর পুত্রবধূকে একান্তে সংসারযাপন করার সুযোগ করে দিচ্ছেন!
সীমা আর এনায়েতের নিজস্ব ফ্ল্যাটটা ছোট হলেও যেন এক শান্তির নীর। পুরো বাড়িটাকেই সীমা নিজের মতো করে সাজিয়েছে। বারান্দায় ফুলের বাগান করেছে। বসার ঘরে বিশাল কাঠের দোলনা ঝুলিয়েছে।
অরা দোলনায় বসে দোল খেতে খেতে বলল, “তোর শাশুড়ি তো বেশ স্মার্ট!”
সীমা দোলনার বিপরীতে থাকা সোফায় বসতে বসতে বলল, “স্মার্টের কী দেখলি?”
“স্মার্ট না হলে কোনো মা তার ছেলে আর ছেলের বউকে একা সংসার সাজাতে পাঠিয়ে দেয় না-কি?”
সীমা হাসলো। সহজ-স্বাভাবিক এক হাসি। তবে এই হাসির মাঝে লুকিয়ে আছে বিচিত্র এক মলিনতা। এই মলিনতা আর কারও চোখে না পড়লেও অরার চোখে পড়তে বাধ্য।
“সীমা?”
“হুঁ?”
অরা সংশয় নিয়ে বলল, “তুই ঠিক আছিস তো?”
সীমা অনাবশ্যক জোর দিয়ে হেসে বলল, “হ্যাঁ। আমি সবসময় ঠিকই থাকি।”
অরা সন্দেহযুক্ত গলায় বলল, “সেটা তো আমিও জানি। সবসময় ঠিক থাকলেও এই মুহুর্তে ঠিক নেই তুই। ব্যাপারটা কী?”
সীমা আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “কিছু না অরা।”
“এনায়েত ভাইয়ার সাথে কোনো ঝামেলা হয়েছে?”
“আরে না।”
নিজের বলা কথাটা যেন নিজেই বিশ্বাস করতে পারছে না সীমা। সে যা বলছে, যেন তা বলতে চাইছে না। বলতে চাইছে ভিন্ন কিছু। অরা তাকে জোর দিতে চাইলো না।
কী যেন মনে করে সীমা নিজেই বলে উঠলো, “ঝামেলা হওয়ার জন্যে তো ভালো সম্পর্ক থাকতে হয়।”
“এখনো কিছু ঠিক হয়নি?”
“না।”
অরা বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে বলল, “কিন্তু কেন? এখন তো নিজেদের আলাদা সংসার রয়েছে। একান্তে সময় কাটানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে।”
সীমা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “এটাই তো সমস্যা।”
“মানে?”
সীমা নিচু গলায় বলল, “আগে যখন সকলের সঙ্গে একসঙ্গে থাকতাম তখন বাধ্য হয়ে সে সকলের সামনে দুয়েকটা কথা বলতো। এক ঘরে থাকতে হতো। কিন্তু এখন…”
কথাগুলো বলতে বলতেই অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে কোথায় যেন হারিয়ে গেল সীমা।
অরা কৌতূহল নিয়ে বলল, “এখন কী?”
সীমা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “রাত করে বাড়ি ফেরে। আমার সঙ্গে তেমন একটা কথাবার্তা বলে না। মাঝেমধ্যেই অন্য ঘরে ঘুমিয়ে পড়ে। গভীর রাত অব্দি ফোনে কথা বলে।”
অরা হতবিহ্বল ভঙ্গিতে বলল, “সে কী?”
সীমা ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “আগেই ভালো ছিলাম অরা। যখন জীবনে কোনো পুরুষমানুষ ছিল না। এমন কিন্তু না যে আমি তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। কিন্তু তার এই
অবহেলাও সহ্য করতে পারছি না।”
অরা কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। মুখে অস্বীকার করলেও মনে মনে সীমা তার সিঙ্গাপুরীর প্রতি একটু একটু করে দুর্বল হয়ে পড়েছে। অরা এটা খুব ভালো করেই জানে। তবে সীমার প্রতি এনায়েতের এই অবহেলার কারণ কী?
অরা সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “একটু ধৈর্য ধর না সীমা। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“কিছুই ঠিক হবে না। আমার কী মনে হয় জানিস?”
“কী?”
সীমা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “অন্য কোনো মেয়ের সাথে তার সম্পর্ক আছে।”
অরা আঁতকে উঠে বলল, “কী বলছিস এসব?”
সীমা থমথমে গলায় বলল, “ভুল কিছু বলছি না। কোন ব্যাটার দায় পড়েছে গভীর রাত পর্যন্ত তার সাথে ফোনে কথা বলার?”
“কাজের কথা থাকতে পারে না? তুই শুধু শুধু ভুল বুঝছিস।”
“মানলাম রাত জেগে কাজের কথা বলছে। কিন্তু শার্টে মেয়েদের পারফিউমের গন্ধ?”
অরা হতবাক গলায় বলল, “কী?”
সীমা শুকনো গলায় বলল, “বাইরে থেকে ফিরে যখন শার্ট ঝুলিয়ে রাখে, তখন আমি মেয়েদের পারফিউমের গন্ধ পাই। বাড়ি থেকে যাওয়ার সময়ে তো ওই গন্ধ থাকে না।”
অরা চুপ করে রইলো। সে কী বলবে, তার কী বলা উচিত? অরা কিছুই বুঝতে পারছে না। এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়া যে কতটা যন্ত্রণাদায়ক সে খুব ভালো করেই জানে। খুব কাছ থেকে আরশাদকেও এই একই জাতের যন্ত্রণা পেতে দেখেছে সে।
সীমা আবারও আক্ষেপজড়িত কণ্ঠে বলতে লাগলো, “প্রতিদিন নতুন নতুন শার্ট পরে, ফোনের দিকে তাকিয়ে অকারণেই হেসে ওঠে। সেদিন আবার দেখলাম চুলের স্টাইলও বদলে এসেছে। একটা মানুষ প্রেমে পড়লে যেমন আচরণ করে, তার আচরণ ঠিক তেমনই।”
অনেকটা সময় চুপ করে থেকে অরা কম্পিত স্বরে বলল, “এখন কী করবি তুই?”
সীমা ব্যর্থ ভঙ্গিতে বলল, “কী আবার করবো? এখানেই পড়ে থাকতে হবে। ফাইন্যান্সিয়ালি ইন্ডিপেন্ডেন্ট মেয়ে আমি। চাইলেই ছেড়ে চলে যেতে পারি। কিন্তু তখন সমাজই আমাকে খারাপ বলবে। আফটার অল, আমি সংসার করতে পারলাম না। দোষ তো আমার হবেই।”
যতটা প্রাণচাঞ্চল্য নিয়ে এ বাড়িতে পা রেখেছিল অরা, এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল ততটাই ভারাক্রান্ত মন নিয়ে। বিবাহিত জীবন না-কি জটিল এক সমীকরণ। সমীকরণের জটিলতার মুখোমুখি কখনো হতে হয়নি তাকে। বিবাহিত জীবন মানেই তার কাছে একরাশ মুগ্ধতার ছড়াছড়ি। অথচ এই বিবাহিত জীবনেই কতটা যন্ত্রণা পোহাতে হয় মানুষকে!
(চলবে)