ফিরে_আসা২ ২১ লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

0
559

#ফিরে_আসা২
২১
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

রাত বারোটার কাছাকাছি। বসার ঘরের সোফায় ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে রয়েছে অরা। ঘুম আসছে না এখনো। প্রেগন্যান্সির শুরু থেকেই তার ঘুমের সমস্যা হচ্ছে। গভীর রাত পর্যন্ত ঘুম আসছে না, ভাঙা ভাঙা স্বপ্ন দেখে উঠে যাচ্ছে। প্রথম প্রথম এই সমস্যা খুব ভুগিয়েছে তাকে। এখন অরা প্রায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে স্বল্প ঘুমের জীবনে।

পেটের ওপরে হাত রেখে অন্যমনস্কভাবেই অরা মনে মনে বলে উঠলো, “দেখেছিস, এখনো এলো না তোর বাবা!”

পরমুহূর্তেই নিজেই চমকে উঠলো । সে কি এতক্ষণ বাবুর সঙ্গে কথা বলছিল? তা তো বটেই! বাবুর অস্তিত্ব একটু একটু করে টের পেতে শুরু করেছে অরা। আনমনেই হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটে। কয়েকদিন আগেও স্বাভাবিক মানুষের মতো স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতো সে। তার মাঝে যে আরেকজন লুকিয়ে আছে, এটা প্রায় ভুলেই যেত। এখন আর ভুলে যায় না। বাবুর ভালো-মন্দ তাকে গভীরভাবে ভাবিয়ে তোলে।

প্রথম তিন মাস ভালোয় ভালোয় পেরিয়ে গেল। ডক্টর বলেছিলেন এই প্রথম তিনটা মাস অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করতে। প্রথম প্রেগন্যান্সির ক্ষেত্রে এই তিনটি মাসে ঝুঁকির আশঙ্কা থাকে। সেই আশঙ্কা আপাতত কেটে গেছে। ডক্টর সেদিন চেকআপের পর বললেন, খুব ভালো ভাবেই না-কি বাবুর গ্রোথ হচ্ছে। মনে মনে আজকাল বাবুকে নিয়ে হাজারটা স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছে অরা। তার সুখের সংসারে বাবু যেন একরাশ বাড়তি সুখ হয়ে আসবে।

দরজার লকে পাসওয়ার্ড চাপার শব্দে নড়েচড়ে বসলো অরা। আরশাদ এসে গেছে। ব্যস্ততায় ঘেরা দিনটার সকল ক্লান্তি যেন নিমিষেই উধাও হয়ে গেল। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরে গেল তার সমস্ত অন্তরাত্মা। অরা উঠে দাঁড়িয়ে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।

দরজা খুলে যেতেই চোখে পড়লো আরশাদের স্নিগ্ধ মুখটা। সাদা টিশার্ট আর কালো জিন্সে ছেলেটাকে রাজপুত্রের মতো লাগছে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো আরশাদের দিকে তাকিয়ে রইলো অরা। এই মানুষটা যে একান্তই তার, ভাবতেই অবাক লাগে।

অরাকে দেখতে পেয়েই আরশাদ ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “অরা! তুমি এখনো জেগে আছো কেন?”

প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না অরা। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো আরশাদকে। যেন হাজার বছর পর দেখছে তাকে। বউয়ের এমন কান্ডে মনে মনে অবাক হলেও নিজেকে সামলে নিলো আরশাদ। একহাতে অরাকে জড়িয়ে ধরে আরেক হাতে দরজাটা বন্ধ করে দিলো।

আরশাদ শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “তোমাকে বলেছি না রাত করে আমার জন্যে অপেক্ষা না করতে! শরীর খারাপ করবে তো।”

অরা আরশাদের বুকে মুখ লুকিয়ে আদুরে গলায় বলল, “আমার কোনো দোষ নেই। সব দোষ তোমার বাবুর। ও বলেছে তোমাকে ছাড়া ঘুমাবে না।”

আরশাদ দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল, “ও আচ্ছা! নিজের সব দোষ আমার বাবুটার ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে না?”

অরা চুপ করে রইলো। একরাশ প্রশান্তিতে ছেয়ে আছে তার সমস্ত শরীর। সময়টাকে ঠিক এখানেই থামিয়ে দিতে পারলে ভালো হতো। যেখানে কোনো ক্লান্তি থাকবে না, দুশ্চিন্তা থাকবে না। থাকবে কেবলই ভালোবাসার ছড়াছড়ি।

আরশাদ বলল, “কথা ঘুমিয়েছে?”

“হুঁ। তুমি ডিনার করেছো?”

“হ্যাঁ।”

“তাহলে ফ্রেশ হয়ে এসো। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।”

ব্যস্ততময় দিনগুলো তাদের এভাবেই কাটে। অরার সারাটাদিন কাটে অফিসে আর আরশাদের শুটিং সেটে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ফোনে কয়েক মিনিটের জন্যে দুজনের কথা হলেও সে কথা যথেষ্ট নয়। দিনশেষে দুজনে একে অপরকে কাছে পেলেও কেবল রাতটুকুর জন্যে। সূর্য উঠে গেলেই তো আবার সেই কর্মব্যস্ততা।

ফ্রেশ হয়ে এসে আরশাদ সোজা চলে গেল মেয়ের ঘরে। প্রকান্ড এক টেডি বেয়ারকে জড়িয়ে ধরে ঘুমে আচ্ছন্ন কথা। আনমনে মেয়ের মাথার হাত বুলিয়ে দিলো আরশাদ। একটা সময়ে তার থেকে দূরে দূরে থাকা ভীষণভাবে ভুগিয়েছে তাকে। এখন আর সেই ভোগান্তি সহ্য করতে হয়। মন চাইলেই চোখের সামনে দেখা যায় মেয়েটাকে। কথার কপালে চুমু খেয়ে ব্ল্যাঙ্কেটা ভালোভাবে তার গায়ে টেনে দিলো।

নিজেদের ঘরে ফিরে এসে দেখলো অরা ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঘুমানোর আগে অরা বিছানায় নতুন করে চুল বাঁধে, গায়ে লোশন মাখে।

আরশাদ আর কথা না বাড়িয়ে শুয়ে পড়লো অরার পাশে। তার কপালের ওপর একটা হাত। যখন আরশাদের মাইগ্রেন ওঠে তখনই এভাবে মাথার ওপর হাত রেখে নিঃশব্দে শুয়ে থাকে।

অরা উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, “মাথা ব্যাথা?”

আরশাদ চোখদুটো বুজে রেখেই বলল, “অল্প।”

দ্রুত চুল বাঁধা শেষ করে অরা গিয়ে বসলো আরশাদের মাথার কাছে। নিজের নরম হাতের স্পর্শ মাথা টিপে দিতে লাগলো আরশাদের।

আরশাদ মজার ছলে বলল, “আজ হঠাৎ এত টেক কেয়ার? মতলবটা কী তোমার?”

অরা ক্ষীণ আহত গলায় বলল, “কোনো মতলব ছাড়া আমি তোমার টেক কেয়ার করি না?”

“তা করো। কিন্তু আজ কেন যেন মনে হচ্ছে কোনো একটা মতলব আছে।”

অরা হাসিমুখে বলল, “কোনো মতলব নেই। এমনিই ইচ্ছা হলো তোমার টেক কেয়ার করি।”

শান্তির আবেশে চোখ বুজে রইলো আরশাদ। অরার একেকটা স্পর্শ যেন তার মাঝে যাদু ছড়িয়ে দিচ্ছে। অরার হঠাৎ কী যেন হলো। আচমকা তার শীতল ঠোঁট দিয়ে স্পর্শ করলো আরশাদের গাল।

আরশাদ চোখদুটো খুলে রহস্য মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, “উফ অরা! এবার বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু। এত আদরে তো অভ্যস্ত না। কী মতলব তোমার? কোনো ঝামেলা বাঁধিয়েছো?”

অরা আমতা আমতা করে বলল, “আরে না! কী ঝামেলা বাঁধাবো?”

ঝামেলা একটা ঠিকই বাঁধিয়েছে। যদিও সেই ঝামেলার সঙ্গে আদরের কোনো সংযোগ নেই। অরা বুঝতে পারছে না কী করে আরশাদের কাছ থেকে ওই শুটিং সেটে যাওয়ার অনুমতি চাইবে। আরশাদের যে স্বভাব, শুটিংয়ে যাওয়ার কথা বললেই রেগে আগুন হয়ে যেতে পারে। রেগে আগুন যাতে না হয়, তাই তো পরিস্থিতিটা সহজ করতে চাইছে অরা।

কয়েক মুহূর্ত পর অরা কোমল স্বরে বলল,
“এই শোনো না!”

“বলো।”

মনে মনে লম্বা শ্বাস নিয়ে অরা বলল, “তুমি তো জানোই ছাইয়ের শুটিংয়ে কত বড় সমস্যা হয়েছে।”

অরা ভ্রু কুঁচকে বলল, “অরা! কতবার বলেছি কাজের আলাপ বেডরুম পর্যন্ত টেনে আনবে না।”

আরশাদ কখনোই চায় না, তারা যখন একাকী সময় কাটাবে তখন সেই সময়ের এক মুহুর্তও কাজের কথা বলে অপচয় হোক। কাজের কথা বলার জন্যে অফিস রয়েছে। আরশাদ যদি অরার হাসবেন্ড না হয়ে কেবল বস হতো তাহলে তো আর রাত-বিরেতে কাজের আলাপ করার উপায় থাকতো না।

অরা থমথমে গলায় বলল, “আচ্ছা তাহলে লিভিং রুমে চলো। ওখানে গিয়ে আলাপ করি।”

আরশাদ হেসে ফেলে বলল, “এই তুমি কে? তুমি কি সত্যিই আমার বউ? না-কি ওর ওপরে অন্য কেউ ভর করে আছো?”

“মানে?”

“মানে আমার নিরামিষ বউটা আজ ঠাট্টা করছে, লজ্জা-টজ্জা না পেয়ে আমাকে আদর করছে। ব্যাপারটা কী?”

লজ্জায় থতমত খেয়ে অরা বলল, “কী শুরু করলে তুমি?”

“আচ্ছা, আচ্ছা। কী বলছিলে?”

অরা পরিষ্কার গলায় বলল, “শুটিংয়ে একটা বড়সর সমস্যা হয়েছে। তুমি তো সবটাই জানো। সেটের বাড়িঘরের ভেতরে কতগুলো আসল বাড়িঘর ছিল। পুরো সেটে আগুন দেওয়ায় ওই বাড়িঘরগুলোও পুড়ে যায়। ওখানকার বাসিন্দারা এই নিয়ে খুব ক্ষেপেছে। শুটিং করতে দিচ্ছে না। তারা নতুন বাড়ি চাইছে, অনশন করছে।”

আরশাদ হতাশ ভঙ্গিতে বলল, “প্রোডাকশন টিম বসে বসে করছে কী? এসব ঝামেলা সামলানোর দায়িত্ব তো তাদের।”

“তারা তো উল্টো ঝামেলা আরও বাড়িয়ে এসেছে। কাল অনশনে থাকা ফ্যামিলিদের সাথে ঝগড়া করে এসেছে।”

আরশাদ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “ফায়ার করে দাও।”

“কী?”

“যে টিম সামান্য একটা প্রবলেম সলভ করতে পারে না, তাদের কোম্পানিতে রেখে আর লাভ কী?”

এই ছেলেটা ফায়ার করা ছাড়া কিছুই জানে না। অরা যখন তার ম্যানেজার ছিল, তখনও তো কথায় কথায় ফায়ারের হুমকি পেত।

অরা বলল, “ফায়ার করলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে?”

“রাগ তো মিটবে।”

“আমার তো আর তোমার মতো রাগ নেই আরশাদ। সমস্যার একটা সমাধান অবশ্য বের করেছি।”

“কী সমাধান?”

অরা শুকনো ঢোক গিলে বলল, “আজ মিটিংয়ে সবাই বলছিল আমার না-কি ফেস ভ্যালু আছে। কে ফিল্মসের সিইও হিসেবে না, তোমার বউ হিসেবে।”

“হ্যাঁ, আছেই তো।”

“এখন আমি যদি ওদের বুঝিয়ে বলি। দেখো শুটিং ফেলে রেখে নতুন বাড়ি তৈরি করে দেওয়া তো সম্ভব নয়। এদিকে ওরা কম্পেনসেশনও নিতে চাইছে না। আমি যদি ওদের কাছে গিয়ে ওদের বুঝিয়ে বলি, কম্পেনসেশনটা নিয়ে নিতে…”

আরশাদ হঠাৎ উঠে বসতে বসতে তীক্ষ্ণ স্বরে বলল “এক সেকেন্ড, এক সেকেন্ড! ওদের কাছে গিয়ে বুঝিয়ে বলবে মানে? তুমি কালিয়াকৈরে যাবে?”

অরা কম্পিত স্বরে বলল, “হ্যাঁ।”

সন্তানেরা কোনো অন্যায় করার পর বাবা-মা যে দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকায়, ঠিক সেই দৃষ্টিতে অরার দিকে তাকিয়ে রইলো আরশাদ। দৃষ্টিতে কিছুটা বিরক্তি, কিছুটা হতাশা।

আরশাদ গম্ভীর গলায় বলল, “অরা! চুপচাপ শুয়ে পড়ো। এমনিতেই অনেক রাত জাগা হয়ে গেছে।”

“আরশাদ শোনো।”

“আমি কিছুই শুনতে চাই না অরা। এখন তুমি কোনো কথা না বলে ঘুমিয়ে পড়বে।”

“আমি না গেলে সমস্যার সমাধান হবে না আরশাদ।”

আরশাদ কড়া গলায় বলল, “হতে হবে না সমাধান। সমস্যা সমস্যার জায়গায় থাক।”

অরা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলো, “এসব কী বলছো আরশাদ? কতগুলো মানুষ আটকা পড়ে আছে।”

আরশাদ বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, “অনশন তো আর সারাজীবন করবে না। কোনো না কোনো সময়ে ভেঙেই যাবে। কিন্তু আমার কথা একটাই, তুমি ওখানে যাবে না।”

“কিন্তু কেন আরশাদ? সিইও হিসেবে এটা তো আমার দায়িত্ব।”

“আর মা হিসেবে কোনো দায়িত্ব নেই? কালিয়াকৈরে তো আর প্লেনে যাওয়া যায় না। প্রায় চার ঘন্টা গাড়িতে ট্রাভেল করতে হবে। এই অবস্থায় এতটা দীর্ঘ সময় জার্নি করা কি ঠিক?”

অরা গোমড়া মুখে বলল, “তুমিই তো বলেছিলে, প্রেগন্যান্সি কোনো কাজে বাঁধা হতে পারে না।”

আরশাদ আবারও শুয়ে পড়তে পড়তে বলল, “সেই আমিই এখন বলছি তোমাকে কোথাও যেতে হবে না। চুপচাপ শুয়ে পড়ো।”

“কিন্তু আরশাদ…”

অরাকে বাঁধা দিয়ে আরশাদ বলল, “বললাম না অরা আমি কোনো কথা শুনতে চাই না।”

আরশাদের সঙ্গে আর তর্কে জড়ালো না অরা। সে জানতো এমনটাই হবে। আরশাদের ঠিক এমন প্রতিক্রিয়াই হবেই। শুটিং আর কোনো দিনও শুরু না হলেও তার কিছুই যায় আসবে না। অরা একদিন ওখানে গেলেই এত বড় একটা সমস্যার সমাধান হতে পারে। সহজ কথা এই ছেলেটা বুঝিয়ে বলা এত কঠিন কেন?

অরা কাঁধ পর্যন্ত ব্ল্যাঙ্কেট টেনে শুয়ে পড়লো।

সঙ্গে সঙ্গে আরশাদ ধমকের সুরে বলল, “দূরে সরে শুয়েছ কেন? কাছে এসো।”

এই ছেলেটা কখন রাগ করে, আর কখন যে এই রাগ গলে জল হয়ে যায় বোঝা মুশকিল। অরা বাধ্য মেয়ের মতো আরশাদের কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো। মুহূর্তের মাঝে আরশাদের চোখে ঘুম নেমে এলেও গভীর রাত পর্যন্ত জেগে রইলো অরা। শুটিং সেটের এই সমস্যার সমাধান কোথায়?

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here