শেষটা_সুন্দর(সিজন-২) #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৪১।

0
388

#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪১।

“তাজমহল” এক প্রেয়সীর নিকট তার স্বপ্নের জায়গা। যার চমৎকার সৌন্দর্য স্বীয় চক্ষে অবলোকন করে আজ সে স্তব্ধ। যদি এই সৌন্দর্যের বর্ণনা করতে বলা হয়; তবে উত্তর হবে, কোনো শব্দের গাঁথুনিতে এই সৌন্দর্যের প্রতিফলন সম্ভব নয়। এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে হবে নিজ অক্ষিতে শায়িত করে।

এই তাজমহলের সামনের চত্বরে করা হয়েছিল একটি বড় “চাহার বাগ”। সেই ভাগ পরবর্তীতে রূপান্তরিত হয়েছিল ১৬টি ফুলের বাগানে। দরজার মাঝামাঝি অংশে এবং বাগানের মধ্যখানে বসানো আছে একটি উঁচু মার্বেল পাথরের পানির চৌবাচ্চা; এবং উত্তর-দক্ষিণে আছে একটি সরলরৈখিক চৌবাচ্চা, যাতে তাজমহলের প্রতিফলন স্পষ্ট।

চাহার বাগ ভারতে প্রথম করেছিলেন প্রথম মুঘল সম্রাট বাবর, যা পারস্যের বাগানের মতো করে নকশা করা হয়েছিল। চাহারবাগ মানেই যাতে স্বর্গের বাগানের প্রতিফলন ঘটবে। মুঘল আমলের লেখায় এক ফার্সি মরমিবাদী স্বর্গের বাগানের বর্ণনা দিয়েছিলেন আদর্শ বাগান হিসেবে, যা পূর্ণ থাকবে প্রাচুর্যে। পানি বা জল এই বর্ণনায় একটি বড় ভূমিকা রেখেছে। ঐ লেখায় আছে, স্বর্গের বাগানের মাধ্যখানে একটি পাহাড় থেকে তৈরি হয়েছে চারটি নদী, আর তা আলাদা হয়ে বয়ে গেছে বাগানের উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমে।

প্রায় সব মুঘল চাহারবাগসমূহ চতুর্ভুজাকৃতির, যার বাগানের মধ্যখানে মাজার বা শিবির থাকে। কিন্তু তাজমহলের ব্যাপারটিতে অন্যগুলোর থেকে আলাদা কারণ, এর মাজার অংশটি বাগানের মধ্যখানে হওয়ার বদলে বাগানের একপ্রান্তে অবস্থিত। এবং এই বাগানের বিন্যাস, এর স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য এবং এর ঝরনা, ইট অথবা মার্বেলের রাস্তা এগুলো ছিল হুবহু সালিমারের মতো।

তবে বর্তমানে এখনও এই বাগান জুড়ে দেখা মেলে হরেক রকমের ফুল ও ফলের সমারোহ। চারদিকের মানুষ ছুটে আসে সেই সৌন্দর্য অন্তরে ধারণ করে অন্তঃকরণের পিপাসা মেটাতে। চক্ষু নিমীলিত করে প্রগাঢ় শ্বাস টেনে অন্তর প্রশান্তি করতেও ছুটে আসে তারা। যেমন এসেছে পুতুল। তবে এখানে এসে এমন অনবদ্য এক ক্ষণের সাক্ষী হবে সেটা সে কল্পনাতেও কখনও ভাবেনি। সে বর্তমানে দাঁড়িয়ে আছে তাজমহলের প্রধান ফটক আর বাগানের মধ্যখানে অবস্থিত চৌবাচ্চার ঠিক সম্মুখ প্রান্তে। চতুর্দিকের বহমান মৃদুমন্দ বাতাসে ইতিমধ্যেই অঙ্গে এক শিহরণ জেগেছে তার। আর তার ঠিক মুখ বরাবর এক হাঁটু ভেঙে অধীর আগ্রহে বসে আছে সারাজ। তার তৃষ্ণার্ত পিপাসার্ত চিত্তপট যেন কোনো একটা কিছু শোনার জন্য বড্ড ছটফট করছে। উৎসুক হয়ে চেয়ে আছে আমজনতাও। পুতুল এবার দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ঠোঁট নাড়াল। স্মিত সুরে বলল,

‘সেই ছোট্ট পুতুলও তার পরম প্রেমিককে মন দিয়ে বসেছিল আরো আগেই। আজ তবে নতুন করে কীসের অনুমতি দিই, বলো? এই অনুমতি তো আমার জন্ম থেকেই তোমার, আর আজীবন তোমারই থাকবে।’

তার বাক্য বিনিময়ের পরপরই আশপাশ থেকে শোনা যায় করতালির শব্দ। এতক্ষণ অতি উৎসুক জনতা যেন এখন বেজায় খুশি। ওদের এত উৎসাহ দেখে পুষ্প হাসে। সারাজ তখন পকেট হাতড়িয়ে বের করে আনে একটা ছোট্ট বাক্স। যার উপরের অংশটা খুলতেই জ্বলজ্বল করে উঠে একখানা হীরার অঙ্গরীয়ক। আরো একদফা বিস্মিত হয় পুতুল। এসব কখন করল সারাজ? পুতুল ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকে। সারাজ অতি যত্নের সমেত আংটি খানা তার আঙ্গুলে পরিয়ে দেয়। আর তারপর তার পুরু ওষ্ঠ ছোঁয়ায় পুতুল নরম হস্তে। এত মানুষের সামনে এমন কান্ডে লজ্জায় কুন্ঠিত পুতুল। তাই কোনোরকমে লজ্জা নিবারণ করে বলে উঠল,

‘আহা, উঠো এবার। কী শুরু করেছ?’

উঠে দাঁড়াল সারাজ। পুতুলের আরো কাছাকাছি গিয়ে দন্ডায়মান হলো। আশেপাশের এত মানুষকে সে যেন আজ তোয়াক্কা’ই করছে না। সে তার মতো নির্লিপ্ত। চুমু খেল পুতুলের ললাটে। কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,

‘আই লাভ ইউ।’

অতিরিক্ত লজ্জায় মরমর পুতুল এবার বিনা দ্বিধায় বলে উঠল,

‘আই লাভ ইউ টু।’

বেশ চাঞ্চল্য পরিবেশ বিরাজ করছে চারদিকে। যারা এতক্ষণ পুতুল আর সারাজকে দেখছিল তারা এবার একটু বেশিই বিস্মিত। সেই বিস্ময়ের কারণ সারাজের কাছে অজ্ঞাত নয়। তাই সে প্রসন্ন হেসে বলল,

‘আমরা হাজবেন্ড ওয়াইফ। বাংলাদেশ থেকে এখানে এসেছি হানিমুনের জন্য। তাই এই ভালোবাসার মহলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ভালোবাসা জাহির করার সুযোগটাও আর হাতছাড়া করতে পারলাম না। আমাদের জন্য যদি আপনাদের কোনোপ্রকার অসুবিধা হয়ে থাকে তবে আমি দুঃখিত।’

হিন্দি সারাজ ঠিকঠাক বলতে পারে না। আর বাংলা বললেও সেখানের অর্ধেক মানুষ বুঝবে না সে জানে। তাই ইংলিশেই বলল সবটা। আর সবার সবটা বোধগম্যও হলো তাতে। কেউ কেউ অভিনন্দনও জানাল। কেউ বা প্রশংসা করল। আবার কোনো কোনো যুগল আপ্লুত হয়ে দোয়া করল যেন, তাদেরও এমন চমৎকার এক বৈবাহিক জীবন হয়।

এইসব মিলিয়ে একটা মনোমুগ্ধকর দিন উপভোগ করেছে পুতুল। খুশিতে চিত্তপটে দেখা দিয়েছে সমুদ্রের ন্যায় উথাল-পাথাল ঢেউ। এই দিন, এই মুহুর্তগুলো আজনম অন্তরে গেঁথে থাকবে তার। সময়ের বিবর্তনে সবকিছু বদলে গেলেও এই অনুভূতির বদল কখনোই ঘটবে না।

_______

হোটেলের পাশাপাশি সিটে বসে আছে পুতুল আর সারাজ। পুতুলের মুগ্ধ দৃষ্টি তার বাম হাতের অনামিকা আঙ্গুলে অবস্থান করা চকমকে আংটিটার দিকে। বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে সেটা। হঠাৎ প্রশ্ন করে,

‘এটা তুমি কখন কিনেছিলে?’

‘কিনেছিলাম কোনো একসময়। কেন তোর পছন্দ হয়নি?’

‘অবশ্যই পছন্দ হয়েছে। আর যেভাবে তুমি দিয়েছ, পছন্দ না হয়ে উপায় আছে?’

কথাটা বলে টেবিলের দিকে একটু ঝুঁকে আসে পুতুল। তারপর ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,

‘এই, তুমি এত রোমান্টিক কবে থেকে হয়েছ বলোতো? আগে তো এমন ছিলে না।’

‘আগে কি আমি তোর হাজবেন্ড ছিলাম? ছিলাম না। আর এখন আমি তোর হাজবেন্ড, তাই আমার রোমান্টিক হওয়াটা এখন জায়েজ। আগে নাজায়েজ ছিল।’

পুতুল চেয়ারে ঠিকঠাক মতো বসে ভ্রু কুঁচকাল। গম্ভীর আওয়াজে বলল,

‘বিয়ের আগে চুমু খেয়েছিলে। সেটা নিশ্চয়ই জায়েজ ছিল না।’

সারাজও ভ্রু কুঁচকাল। বলল,

‘সেই নাজায়েজ কাজটা করতে তুই’ই বাধ্য করেছিলি। এমন ভাবে সেজে এসেছিলি যে, তোর সাজ আমাকে নিজের কাবুতে করে নিয়েছিল। আর আমার সেই ভুলের জন্য অবশ্যই তুই দায়ী।’

মুখ ভেংচাল পুতুল। উঁচু আওয়াজে বলল,

‘শুনো, আমি কোনো দায়ভার নিতে পারব না। নিজে পাপ করবে আর সেই পাপের দায়ভার নাকি আমি নিব; মগের মুলুক পেয়েছ নাকি? যার যার পাপের হিসাব তার তার কাছে, বুঝেছো?’

সারাজ ক্ষুব্ধ হয়ে একপল পুতুলের দিকে চেয়ে থেকে বলল,

‘একটা চুমু খেয়েছিলাম বলে এত কথা শুনাচ্ছিস? ঠিক আছে, আজ থেকে নো চুমু। নো মানে নো। মানে বুঝছিস, তোকে আর একটাও চুমু খাব না। চুমুর অভাবে তুই শুকিয়ে মরে গেলেও না।’

পুতুল বোকার মতো চেয়ে বলল,

‘চুমুর অভাবে কে শুকিয়ে মরে?’

‘কেউ না মরলেও তুই মরবি। আমার চুমু না পেতে পেতে একদিন সেই চুমুর অভাবেই আধমরা হয়ে যাবি। তখন হাজার অনুরোধ করলেও আমি তা পাত্তা দিব না। তখন বুঝবি, চুমুর অভাব কী মারাত্মক জিনিস।’

সারাজের এহেন আত্মবিশ্বাসে দাঁত কেলিয়ে হাসে পুতুল। সে জানে, ভদ্রলোকের এই আত্মবিশ্বাস ভাঙতে তার দুমিনিটও লাগবে না। তাই পুতুলও বেশ দাম্ভিকতার সুরে বলে উঠে,

‘ঠিক আছে। আমিও চ্যালেঞ্জ করলাম, তুমি নিজে থেকেই তোমার এই পণ ভাঙবে। আর সেটাও আজ রাতের মধ্যেই।’

সারাজ হেসে বলে,

‘অসম্ভব।’

পুতুলও পরপর হাসে। বলে,

‘আচ্ছা। আজ রাতেই দেখা যাবে, কে জিতে আর কে হারে।’

সারাজ ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে,

‘মাথা থেকে সব শয়তানি বুদ্ধি ঝেরে ফেল। জিত আমারই হবে।’

পুতুল ততক্ষণাৎ টেবিলে চাপড় মেরে বলে উঠে,

‘রাত আসুক না। তখনই প্রমাণ হবে সব।’

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here