#ভালোবাসার_ফোড়ন_২
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_২৪
ভোরে একটু ঘুম ঘুম এলো। কিন্তু বেশিক্ষণ আর ঘুমোতে পারলাম না। কি করে জানি চাচা আজ জলদি উঠৈ গেল। অতঃপর তার ডাকে ঘুম থেকে উঠে ঘর দোর সব ঝাড়ু দিলাম। চাচা গোয়াল ঘর থেকে গরু কে বের করে বাইরে আনল। অতঃপর তাদের খেতে দিল। আমি সবার জন্য ভাত রান্না করলাম আর গতকালের তরকারি গরম করলাম। ইলিশ মাছ দিয়ে ফুলকপি রান্না করেছিলাম আর ডাল। শীতের দিনে একটা বিশেষত্ব হলো বাসি তরকারি খেতে বেশ ভালো লাগে। কার কাছে কেমন লাগে জানি না তবে আমার কাছে বেশ লাগে।
ফুলি কে ঘুম থেকে উঠিয়ে দিয়ে অতঃপর সবাই মিলে একসাথে খেলাম। চাচা একজন কে এনেছেন যাকে ঘরে রাখা হবে। গরু গুলো আর ঘর দেখাশোনার জন্য। অতঃপর সবাই বের হলাম আমরা!
আমরা এখান থেকে সোজা এতিম খানায় গেলাম। আহিয়ান’রা নাকি সেখানেই যাবে। আমাদের যেতে যেতে অনেক বেলা গড়িয়ে গেল। আমাদের বাড়ি থেকে এতিমখানা অনেক দূরে তবে ভাইয়া দের বাড়ি থেকে তা অনেকাই কাছে। অনেকটা কাছে বলতে শুধু দু’মিনিটের পথ। আসলে ভাইয়ারা তাদের আগে বাড়ি ছেড়ে এখানে এসেছে। আমি ভেবেছিলাম হয়তো দুজন থাকবে বলে ছোট ঘর নিয়েছে কিন্তু না তারা আরো বড় ঘর নিয়েছে। এতো বড় ঘর নেবার পরও আমার মা বাবা কে তাঁদের ঘরে ঠাঁই দিতে পারলো না তারা!
এতিমখানায় এসে দেখি আহিয়ানরা চলে এসেছে। কাজ ও শুরু হয়ে গেছে। বাবুর্চি রা রান্না শুরু করে দিয়েছে। নাহান আর আনাফ ভাইয়া সেখানে দাঁড়িয়ে বাচ্চাদের দূরে সরিয়ে রাখছে। যাতে এখানে তারা না আসে। আহিয়ান আর আকাশ ভাইয়া কে দেখা যাচ্ছে না। হয়তো অন্যকোথায় গেছে তারা। চাচা এসেই কাজ শুরু করে দিয়েছে। ফুলি বাচ্চাদের সাথে খেলছে। এতিমখানাটা অনেক বড় আর সুন্দর। চারদিক গাছপালায় ঘেরা। বাচ্চাদের জন্য দোলনা আছে এখানে। আমি ঘুরতে ঘুরতে এতিমখানার পেছন দিকে এলাম। দেখি সেখানে ছোট্ট ভীড় হয়ে আছে। সেই ভীড়ের মাঝে আহিয়ান আর আকাশ ভাইয়া। তারা সব বাচ্চাদের বেলুন দিচ্ছে। বাচ্চারা একেকজন বলুন পেয়ে লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে।
আমি সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে তাদের কাহিনী দেখছি। আকাশ ভাইয়া আমাকে দেখে বলে উঠে,
“নিহা!
আহিয়ান আমাকে না দেখেই বেলুন হাতে নিয়ে বলে,
“ভূতনির আবার কি হলো!
তার এই কথায় সব বাচ্চারা পেছনে ফিরে আমার দিকে তাকাল। আহিয়ান বেলুন হাতে নিয়ে চুপ হয়ে আছে।একটা বাচ্চা আমার হাত ধরে বলল,
“তুমি ভূতনি!
এই কথায় আকাশ ভাইয়া ফিক করে হেসে দিল। আহিয়ান আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো তিনি জানতেন না আমি এখানে। বাচ্চা গুলো আমাকে ঘেরাও করে জিজ্ঞেস করতে লাগলো,
“তুমি কি সত্যিই ভূত।
আহিয়ান বলে,
“ওটা ভূত না ভূতনি!
“এই আপনি কি বলছেন এসব।
“যা সত্যি তাই বলছি। ভূতনি কে ভূতনি বলবো না তো কি বলবো।
আমি মুখ ফুলিয়ে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে । বাচ্চারা সব হেসে উঠলো। অতঃপর আমি রেগে চলে এলাম সেখান থেকে। দোলনায় এসে বসে পড়লাম কিছুক্ষণ বাদেই ফুলি কিছু বাচ্চাদের নিয়ে এলো খেলা করার জন্য। আমরা সবাই মিলে জোট করলাম কানামাছি খেলবো। সবাই বুদ্ধি খাটিয়ে আমাকে চোর বানালো। মনে হচ্ছে কেউ চোর হতে রাজি হয় নি তাই ফুলি ইচ্ছে করেই আমার কাছে এসেছে। যাই হোক আমি ওদের সাথে খেলতে লাগলাম।
খেলতে খেলতে একসময় একজনের সাথে ধাক্কা খেলাম। আমি প্রথমে ভাবলাম কোন বাচ্চা তাই তাকে ধরলাম। ধরার পর বুঝলাম এটা বাচ্চা না চোখের কাপড় সরিয়ে দেখি আহিয়ান দাঁড়ানো। তাকে দেখেই দ্রুত পিছিয়ে গেলাম। আহিয়ান কিছু না বলে চলে গেল। সবাই হেসে উঠলো। আমি নিজের মাথায় নিজেই বাড়ি মারলাম।
সারাদিন ওদের সাথেই খেলাধুলা করেই কেটে গেল। অতঃপর দুপুরে দোয়া পড়ানোর পর বাচ্চাদের খেতে বসানো হলো। আহিয়ান সব বাচ্চাদের খাবার দিচ্ছে। বাচ্চাও অনেকজন। চাচা আমাকে খাবার দিয়ে বলল সবাইকে খাবার দিতে। আমিও সব বাচ্চাদের খাবার দিতে লাগলাম। কিছু কিছু বাচ্চা খাবার নেবার জন্য ভূতনি ভূতনি বলে ডাকতে লাগল। তাদের দেখাদেখি ফুলিও ভূতনি আপু ভূতনি আপু বলে ডাকতে লাগল। মেজাজ খারাপ করে আহিয়ানের দিকে তাকাতেই দেখি সে হাসছিল। মেজাজ গেলো আরো বিগড়ে।
.
বিকালে সকল বাচ্চাদের কিছু উপহার দেওয়া হলো। বাচ্চারা উপহার পেয়ে লাফালাফি করছিল। এর মাঝেই আমার মা এসে উপস্থিত! মা কে দেখে আহিয়ান ওরা সবাই কথা বলতে লাগল। মা কে দেখে খুব বিচলিত মনে হলো। আশেপাশে যেন কাউকে খুঁজছে। আমি এলাম মা’র কাছে। মা আমাকে দেখে আমার হাত দুটো শক্ত করে ধরলেন। যা আন্দাজ করেছিলাম তাই! কিছু একটা তো হয়েছে। আমি মা কে জিজ্ঞেস করলাম,
“কি হয়েছে মা তোমাকে এমন লাগছে কেন?
“তোর বাবা হঠাৎ অসুস্থ হইয়া গেছে। ।
“কি বলছো এসব। ঔষধ খায়নি ঠিক মতো।
“খাইছে তো।
“তাহলে আবার অসুস্থ হলো কিভাবে?
“কিছুই বুঝপার পারতাছি না। তোর ভাইয়া ডাক্তার ডাকতে গেছে। তোর ভাবী কইলো তুই এহানে তাই আমি…
এতটুকু কথা শোনার পর আমি ছুটে এলাম ভাইয়ার বাড়িতে। আমার ছুটে আসা দেখে চাচা আর আকাশ দুজনেই এলো আমার সাথে।
ভাবীদের বাসায় আসার পর খুব বড়সর একটা চমক খেলাম। খালেদ এখানে! তাকে দেখেই আমি স্থির হয়ে গেলাম। খালেদ সাথে করে ডাক্তার নিয়ে এসেছিল, অতঃপর ডাক্তার কে নিয়েই সে চলে গেল। তবে সে অস্বাভাবিক ভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছিল। তার চাহনি আমার মোটেও ভালো লাগে নি।
বাবার সাথে দেখা করলাম। একদিন না দেখে পাগল হয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। সন্ধ্যা অবদি বসে রইলাম তার কাছে। এখন অনেকটা হলেও সে সুস্থ। আকাশ ভাইয়া কিছুক্ষণ ছিলেন অতঃপর সেও চলে গেল। চাচাও গেলেন তার সাথে।
রাতের বেলায় চাচা চাইলেন বাবা কে নিয়ে যেন আমরা বাড়িতে ফিরে আসি কিন্তু ভাইয়া আর ভাবী কোন ভাবেই ছাড়তে রাজি হলেন না। তাদের এক কথা বাবা অসুস্থ তাই সুস্থ না হওয়া অবদি এইখানেই থাকবেন। বাবা অসুস্থ বলে আমাকেও তাদের বাড়িতে থাকতে হলো। ফুলি রয়ে গেল এতিমখানায় বাচ্চাদের সাথে।
আমাকে থাকতে দেওয়া হলো এক রুমে, ভাইয়া আর ভাবী অন্যরুমে, মা আর বাবা একরুমে আর চাচা থাকার ব্যবস্থা করলেন বাড়ির দাওয়ায়। বাবা একটু ঘুমানোর পর’ই আমি এসে বসলাম ঘরে। রাতে কিছু খায় নি চাচা খেতে বার বার বারন করে গেছে। আমি ঘরে ভিতর তবুও কেন জানি আহিয়ানের গলার স্বর পাচ্ছি বলে মনে হলো। আমি উঠে জানালার কাছে যেতেই দেখি ওদের গাড়ি দেখা যাচ্ছে। হয়তো আহিয়ান গাড়ির কাছেই। আকাশে ধোঁয়া উড়ছে আহিয়ান সিগারেট খাচ্ছে। চাচা’র কাছে শুনেছি আজ’ই রাতের ট্রেনে তারা ফিরে যাবে।
আমি দরজা আটকে দিয়ে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম। চোখ কখন লেগে গেলো বুঝতে পারি নি। হঠাৎ ঘুমের ঘোরেই খুব বাজে গন্ধ নাকে আসতে লাগল। কেউ হয়তো নেশা জাতীয় কিছু খেয়ে আমার কাছে এসেছে এমন লাগছে আমার কাছে। সে হয়তো আমার অনেক কাছে যার কারনে তার মুখের ভারী নিঃশ্বাস আমার উপর পড়ছে। ঘুমের মাঝেই অস্বস্তি লাগছিল। মূহুর্তে’ই চোখ খুলে তাকালাম। সামনে তাকাতেই আমি ভয়ে চমকে উঠলাম। সে আমার মুখ চেপে ধরলো। এটা আর কেউ না খালেদ ছিল। আমি কুফির আলোয় বেশ তাকে দেখতে পাচ্ছিলাম।
আমি তার হাত থেকে মুখ ছোটানোর চেষ্টা করছি কিন্তু সে ততোই জোরে আমারে ধরে রেখেছে। তার শক্তির সাথে পেরে উঠছি না আমি। খালেদ হেসে বলতে লাগল,
“কি ভাবছিলি আমার থেকে পালাইয়া গেলে বাইচা যাবি! তুই জানোস না তোর লইগা আমি আমি কতো কথা হুনছি। আমার মান সম্মান সব গেছে তোর লইগা। বিয়ে ছাইড়া পালাইয়া গেছিল তুই, আজ দেখমু কেমনে পালাইস!
বলেই আমার পিঠে হাত রাখল। আমি যত সম্ভব শক্তি দিয়ে তাকে ধাক্কা দিলাম। নেশাগ্রস্ত থাকায় একটু হেলতে দুলতে শুরু করল সে। আমি জোরে চিৎকার করতে লাগলাম,
“বাঁচাও! বাঁচাও আমাকে বাঁচাও। মা, বাবা, চাচা , ভাইয়া বাঁচাও..
বলতে বলতে খালেদ আবারো আমার মুখ চেপে ধরলো। আমি অনেক কষ্টে মুখ থেকে হাত সরানোর পর পালিয়ে যেতে ধরলাম। সে আমার চুলের মুঠি ধরে বলল,
“পালাবি তুই! আবার পালাবি!
বলেই আমাকে খুব জোরে চড় মারল। ওর চড় খেয়ে আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম। তবুও চিৎকার করতে লাগলাম। খালেদ আমাকে আবার উঠিয়ে জোরাজুরি করতে লাগলো। খুব ধস্তাধস্তি হলো, ঘরের সমস্ত জিনিসপত্র ফেলে দিলাম আমি। যেন আওয়াজ পেয়ে কেউ ছুটে আসে। আমার সাথে পেরে না উঠে সে আবারো আমাকে চড় মেরে বিছানায় ফেললো। আমি ততোক্ষণে দুর্বল হয়ে গেলাম। মাথা ঘুরতে লাগলো আমার। ঠোঁটের কোন থেকে রক্ত ও পড়ছে। আমি সামনে ফিরতেই দেখি সে শার্টের বোতাম খুলে আমার দিকে আগাচ্ছে। মুখে খুব বিচ্ছিরি এক প্রকার হাসি। তখন আমি বাইরে থেকে চাচা, মা আরো কয়েকজনের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম, তারা দরজা ধাক্কাচ্ছে। তার আওয়াজে সাহস কিছুটা হলেও বাড়ল আমার।
সে আমার দিকে আগাতেই আমি দ্রুত সেখান থেকে উঠে দরজা কাছে যেতেই পেছন থেকে সে আমার ঘাড়ে হাত ধরে আমাকে টান দিল। আমি সেখান থেকে ছুটে যেতেই ঘাড়ের দিক থেকে জামার কিছু অংশ ছিঁড়ে গেল। আমি নিস্তব্ধ হয়ে গেলাম। এর মাঝেই দরজা ভেঙে গেল। আর আহিয়ান সহ সবাই এলো ঘরে। তাদের থেকে আমার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল!
#চলবে….
[ রাতে আরেকটা পর্ব দিবো #বোর্নাস_পার্ট । ধন্যবাদ সবাইকে! ]