#স্বচ্ছ_প্রেমের_পদ্মপুকুর
#লেখা_চাঁদনী_ইসলাম
#পর্ব_০৪
আজকাল নিরুর নিজের বাড়ি যেতে ইচ্ছে হয়।অনেক মানুষের সঙ্গে নয়,একান্ত নিজের সাথে সময় কাটাতে ইচ্ছে হয়।মায়ের গন্ধ নিতে মন চায়।নিরু মামাকে বলতেও পারে না ওই বাসায় যাবে।একা থাকার কথা মুখেও আনতে পারবে না। তাই নিরুর ভিতরের ভাবনাটুকু স্বচ্ছ ভাবে গোপনে আড়াল করে।নিরু বড় হচ্ছে যখন তখন কেঁদে বুক ভাসাতেও পারেনা।
আজ নিরুর ভীষণ মন খারাপ,স্কুলে নিরু খুব ভালো একটা বান্ধবী পেয়েছে।নিরু তেমন কারো সাথে মিশতে পারে না।সীতাকুণ্ডে এসে নতুন স্কুলে ভর্তি হয়ে প্রথম দিনেই নিরু রাহিমার সঙ্গে এক বেঞ্চে বসেছিলো।সেদিন থেকেই নিরুর একমাত্র ভালো লাগার জায়গা রাহিমা।রাহিমার বাসাটাও নিরুদের ফ্লাটের খুব কাছাকাছি, দুজনে যখন ইচ্ছে দেখা করতে পারে। এক সাথে বের হতেও পারে।আজ স্কুল থেকে ফেরার পথে রাহিমা নিরুকে জোর করে ধরে বাসায় নিয়ে গেছিলো।রাহিমার আম্মু চালতার আচার বানিয়েছে, সেইটা নিরুকে দিবে বলে।এতদিন শুধু নিরু রাহিমার আম্মুকেই চিনতো।আর জানতো রাহিমার একটা ভাই আছে।কিন্তু ভাইটা যে একদম নিহানের বয়সী সেইটা নিরু জানতো না। রাহিমাদের বাসায় যাওয়ার পর নিরুর বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে। নিহানের মুখটা ভেসে ওঠে।নিহানের বলা আধো আধো বুলি গুলো নিরুর চোখে ভেসে ওঠে। নিরু আর একটা মিনিট ওখানে দাঁড়ায়নি।দ্রুত পায়ে হেঁটে নিচে চলে আসে।রাহিমা দৌড়ে এসে নিরুর হাত ধরে।
_কি হলো তোর?
_ মামানি চিন্তা করবে।স্কুল অনেকক্ষণ ছুটি হয়েছে।
_ তাই বলে এইভাবে চলে যাবি?
_ তুই তো জানিস মামানিকে না জানিয়ে আমি কোথাও বেশি সময় থাকিনা।
_ আচার না নিয়ে যাবি, নে আচার ধর।
_ কাল স্কুল থেকে নিয়ে নিতাম।
_ আজই নিয়ে যাবি।খেয়ে দেখবি অনেক মজা।
_ আচ্ছা এখন যাই।কাল দেখা হবে।
_ সাবধানে যাবি।
নিরু বাসায় এসে স্কুলের কাপড় না ছেড়েই ছাঁদে যায়।আমিনা বেগম মার্কেটে গেছে।আসাদ প্রাইভেট থেকে বাসায় ফিরে,গেট থেকেই দেখতে পায় নিরু ছাদের এক কোণে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে।
সূর্য ডুবে আসছে।এই ভর সন্ধ্যায় নিরু ছাদে কি করে?
আসাদ সোজা ছাদে যায়।নিরু দূর আকাশে তাকিয়ে আছে।নিরুর বিনুনি করা চুল গুলো এলোমেলো হয়ে বের হয়ে পিঠময় ছড়িয়ে আছে। বিনুনি গুলো খুলে খুলে যাওয়ার অবস্থা। নিরুর চুল গুলো খুব একটা লম্বা নয়,কিন্তু প্রচুর ঘন গোছা।এক পাশে সিঁথি কেটে বিনুনি করে রেখেছিলো।সূর্য ডোবার আগ মুহূর্তে ম্লান আলোটা নিরুর গালে যেয়ে লাগছে।
নিরুকে এমন চুপচাপ দেখতে আসাদের একদম ভালো লাগে না। নিরু হাসুক,নিরুর হাসির শব্দে বাসার দেয়ালে ঝংকার তুলুক ।কিন্তু নিরু হাসে না।নিরুর মুখে শেষ কবে হাসি দেখেছে আসাদ মনে করতে পারছে না। কিন্তু আসাদের মনে আছে, নিরু খুব সুন্দর করে হাসে।
_ এই ভর সন্ধ্যায় ছাদে কি করিস?রাস্তায় কেউ অপেক্ষা টপেক্ষা করে নাকি?
আসাদ জানে নিরুর মন খারাপ, তবুও মন খারাপের কথা না তুলে অন্যভাবে নিরুর সাথে কথা বলল।
নিরু চোখ ঘুরিয়ে আসাদের দিকে তাকাল।আসাদের ঠোঁটে দুষ্টু হাসি।দুই পকেটে দুই হাত পুড়ে, নিচের দিকে ঝুকে এইদিক ওইদিক তাকিয়ে কিছু খোঁজার ভান করছে।
_ কই রে কেউ তো নেই।আমাকে দেখে পালালো নাকি।না তুই ইশারা করে পালাতে বললি?
_ আসাদ ভাই এখানে কেউ আসে না।
_ তুই কি চাস কেউ আসুক।
_ আমি কি আপনাকে বলেছি?
_ তা বলিসনি।তুই তো মুখ ফুটে কিছুই বলিস না।
_ কিছু বলার থাকলে বলতাম।
_ আচ্ছা নিচে যা।স্কুল ড্রেস ছাড়।আম্মু এসে দেখলে বকা খাবি।
নিরু চুপচাপ নিচে চলে এলো।এই একটা মানুষ নিরুকে সব সময় জ্বালাতে থাকে।নিরু কোন সময় একা একটু সময় কাটাতে পারে না।মানুষটা এমন কেন কে জানে?
আসাদ কিছুক্ষণ দূর আকাশে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে,বুকের মাঝে কেমন একটা ঝড় বয়ে চলেছে।আসাদ বোঝেনা এই বুক পোড়া শোক আসলে কিসের জন্য?
নিরুর সামনে সপ্তাহ থেকে অষ্টম শ্রেণির মডেল টেস্ট পরীক্ষা।নিরু এখনও সিলেবাস শেষ করতে পারেনি।আজিজুল হক নিরুকে ভালো করে পড়াশোনা করতে বলেছেন।দু’টো মাস্টার রেখেছেন।প্রায়ই পড়াশোনার খোঁজ ও নেন।এইসব কিছুর মধ্যে থেকেও নিরু সহজে পড়াশোনায় মন বসাতে পারেনা। নিরু মাঝে মাঝে মনে মনে আওড়ায় ‘এই পড়াশোনা না থাকলে কি ক্ষতি হতো কে জানে?’
নিরুর টেস্ট পরীক্ষা শেষ হয়।রেজাল্ট ও পায়।টেস্টে দুই বিষয়ে ফেল এসেছে।হেড টিচার আজিজুল হককে কল করে জানিয়েছেন।’নিরুর পড়াশোনার গতি খুবই বাজে,এইভাবে চললে হবে না।’
আজিজুল হক নিরুকে কিছু না বলে আমিনা বেগমকে আগে জানায়।
_ আমিনা, আমরা কি নিরুর প্রতি নজর রাখতে পারছিনা।স্যার কি ঠিকভাবে পড়ায় না?
_ স্যার তো প্রতিদিনই পড়াতে আসে।কোন অভিযোগ করে না।নিরু পড়াশোনায় অমনোযোগী হলে তো আমাদের জানাতো।
আজিজুল হক আসাদকে পুরো ব্যাপারটা জানায়।নিরুকে বিকেলে যখন পড়াতে আসে ওই সময় আসাদ বাইরে থাকে।সকালে যখন পড়াতে আসে আসাদ তখন ঘুমায়, নিরু কেমন পড়ে বা স্যার কেমন পড়ায় আসাদ এই বিষয়টা দেখেনি।আসাদ নিজেই স্যার ঠিক করে দিয়েছিলো।আসাদের মনে হলো আজ ওই সময় বাসায় থাকবে।স্যারের সাথে কথা বলবে।বা দূর থেকে পড়ানো দেখবে।
আসাদ আজ খুব সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেছে।নিজের রুমেই বসে আছে। দরজাটা হালকা খুলে রেখেছে। রুম থেকে ড্রয়িংরুমের পুরোটা খুব ভালো করে দেখা যায়।সকালে ম্যাথ করে, নিরু ঘুমে চোখের পাতা টেনে তুলতে পারছে না।শুধু হ্যাঁ হু করছে।মনে হচ্ছে নিরুকে এখনই যেয়ে না ধরলে পরে যাবে।জাতে মাতাল তালে ঠিক যাকে বলে।ঘুমে তলিয়ে যেয়েও পরছে না,হু হু করছে।আসাদের বুঝতে বাকি রইল না সকালের প্রাইভেটটা কেমন যায়।কিছুটা হাসিও পেল।আসাদ ভেবে নিলো বিকেলে নিরু স্কুল থেকে এসে ক্লান্ত থাকে।তাই বিকেলেও ঘুমায়।তাই পড়াশোনায় এই গতি।
দুপুরের খাওয়া শেষ করে ড্রয়িংরুমে বসলেন আজিজুল হক। আসাদ ও এসে পাশে বসল।সকালের কাহিনিটা পুরো খুলে বলল,পুরো ঘটনা শুনে আজিজুল হক হেসে দিলেও কপালে চিন্তার ভাজ দেখা গেল।
_ নিরুকে নিয়ে অনেক চিন্তা হয় বাবা।
_ তুমি চিন্তা করো না।দরকার হয় প্রাইভেট স্যার বদলাবো।নিরুকেও পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে বলবো। আজকেই কথা বলবো।
আজিজুল হক চুপচাপ বসে রইলেন।চিন্তা করতে না করলেই চিন্তা করা বন্ধ হয় না। বাবা মায়ের মধ্যে যেকোন একজন থাকলেও এতো চিন্তা করতে হতো না। আর নিরু যেমন চুপচাপ ধরনের মেয়ে, এতো চাপা বলেই ওকে নিয়ে ওতো চিন্তা।
বিকেলে ইংলিশ পড়াতে আসে।আমিনা বেগম নিজের রুমে আছেন।কোন কাজ পড়লে ডাইনিংয়ে আসছেন।একবার এসে ভালো করে পড়াতে বলে গেলেন।আসাদ সকালের মতোই নিজের রুমে বসে আছে। হাতে ফোন,ফোন স্কল করতে করতে নিরুদের দিকে একবার চোখ যেতেই রাগে কপালের শিরা ফুলে উঠল।রীতিমতো রাগে শরীর কাঁপছে।কি বিশ্রী ভাবে নিরুর দিকে কুদৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। নিরুর পায়ের পাতার উপর কিভাবে বার বার পা তুলে দিচ্ছে।আসাদের মনে হলো এখনই যেয়ে মারতে মারতে বাসা থেকে বের করতে,খুব কষ্টে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে উঠে দাঁড়ায়।ড্রয়িংরুমে যেয়ে নিরুর পাশে বসে।আসাদকে দেখে মাস্টার কিছুটা থতমত খেয়ে যায়।কোনমতে আসাদকে বলে,
_ কেমন আছো আসাদ?
_ জ্বি আলহামদুলিল্লাহ! আপনি আজ চলে যান।আজ পড়া বন্ধ থাক।
_ কোন সমস্যা?
_ হ্যাঁ সমস্যা। আমরা বের হবো।আপনি আসেন।
আসাদের রুক্ষতা দেখে কথা না বাড়িয়ে চলে যান।আসাদ নিরুর হাত থেকে বইটা নিয়ে শব্দ করেই সেন্টার টেবিলে রাখে।তারপর হাত ধরে ছাদে নিয়ে যায়।
_ এই তোর বোধ বুদ্ধি কোথায় গেছে বল।আমার দিকে তাকা আর তাড়াতাড়ি বল।
_ ……..
_ চুপ করে আছিস কেন বল।আমাদের বাসায় এসে তোর দিকে কুদৃষ্টিতে তাকায় তোর পায়ে পা দেয় আর তুই কিছু বলিস না।কেন বলিস না আমাকে বল?
নিরু এখনো চুপ করে আছে।
_ অনিমা রাগ বাড়াবি না একদম,যা জিজ্ঞেস করছি তাড়াতাড়ি বল।কেন তোর দিকে ওইভাবে তাকাবে?
_ আপনি ওনাকে জিজ্ঞেস করলেন না।
_ আমি তোকে জিজ্ঞেস করছি, তুই বল।
_ আমি জানিনা কেন ওইভাবে তাকায়।উনি ওইভাবে তাকিয়ে থাকে বলে আমি নিচু হয়েই বসে থাকি।ওনার দিকে তাকাই না।বার বার পায়ে পা দেয়।আমি সরিয়ে নিই।তখনই বার বার সরি বলে,খেয়াল করেনি বলে।
_ আমাকে বলিসনি কেন তুই?
নিরু চুপচাপ নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে।
_ আমাকে না বললেও আম্মুকে তো বলতে পারতি।কেন বলিস নাই বল?
নিরু আর কোন কথা বলতে পারল না। এক দৌড়ে নিচে চলে এলো।এই রুক্ষ ভয়ংকর চোখের আসাদ ভাইকে নিরু চেনে না।কেন এতো রুক্ষ আচরণ করছে আসাদ?
চলবে…..