#স্বচ্ছ_প্রেমের_পদ্মপুকুর
#লেখা_চাঁদনী_ইসলাম
#পর্ব_০৭
টানা বৃষ্টি হওয়ার পর আজ মেঘমুক্ত আকাশ। মিষ্টি রোদে গাছের পাতা গুলো চিকচিক করছে।টানা কয়দিন বৃষ্টির পর খেটে খাওয়া মানুষ গুলো যেন প্রাণ ফিরে পেল।বৃষ্টির পর সূর্যের আলোটা পাহাড়ি এলাকার সৌন্দর্য অন্যরকম করে তুলেছে।বৃষ্টির মধ্যে পাহাড়ের সৌন্দর্য দ্বিগুণ রুপে ধরা দেয়। তারপর বৃষ্টি থেমে রোদ ওঠার পর চিকচিক একটা ভাব এসে ভিন্ন এক সৌন্দর্য ধারণ করে।পাহাড়ের সব আবহাওয়াতেই যেন মুগ্ধতা খুঁজে পাওয়া যায়।
রোজ সকালে বাহারি নামের পনেরো বছরের এক কিশোরী টাটকা সবজি দিতে আসে।নিরুর আস্তে আস্তে কিছু মানুষের সাথে সক্ষতা তৈরি হচ্ছে।তার মধ্যে বাহারি নামের মেয়েটার সাথে নিরুর খুব ভাব জমেছে।মেয়েটা মাঝে মাঝেই নিরুর জন্য পাহাড়ি বুনোফুল তুলে এনে নিরুকে দেয়।নিরু ও মজার মজার রান্না করলে মেয়েটার জন্য তুলে রাখে।রাহিমা আর বাহারির জন্য আলাদা করে দুইটা টিফিন বক্স রেখেছে।
বেশ কিছুদিন বৃষ্টি হওয়ায় নিরু গাছ গুলোর পরিচর্যা করতে পারেনি।কিছুক্ষণের জন্য বৃষ্টি থামলে,ছাদের গাছ গুলো রোজ দেখে আসতো।সকাল সকাল রোদ উঠতে দেখে নিরু নিচে নেমে এলো।গাছের গোড়া থেকে মাটি আলগা হয়ে গেছে। নিরু মাটি গুলো চেপে দিচ্ছিলো।
বাহারি আজকেও টাটকা সবজি নিয়ে এসেছে।সাথে কিছু বুনোফুল। নিরু বাহারি কে গেটের কাছে দেখেই হাত ইশারা করে ডাকল।
_ মনে হচ্ছে তোমাকে কতদিন দেখিনি।
_ তিনদিন দেখোনি,যে বৃষ্টি হলো।আর আমাদের বাসার সামনের রাস্তাটা খুব পিচ্ছিল।বৃষ্টি থামলেও আসতে পারিনি।
_ ভালো করেছো।এতোটা রিক্স নিয়ে আসার দরকার নেই।
বাহারি নিরুর হাতে বুনোফুল গুলো দিলো।
_ বাহারি তোমার হাতে কিসের ব্যাগ কোথাও যাচ্ছো নাকি?
_ না, মা তোমাদের জন্য হাসঁ দিলো।পরিষ্কার করে দিয়েছে।শুধু কেটে নিও।
_ আন্টিকেকে কি মামানি হাঁসের কথা বলেছিলো?
_ মা এমনিতেই দিলো।দু’টো জবাই করেছে।তুমি তো কখনো আমাদের ওইদিকে যাওনি।আমার সাথে আজ যাবে? মা হাঁসের মাংস দিয়ে বাঁশ কোড়ল রান্না করবে।তুমি যেতে চাইলে দুপুরের পর নিতে আসবো।
_ আচ্ছা মামানিকে বলে দেখি চলো।
নিরু মামানির সাথে কথা বলে বাহারিকে দুপুরের পর আসতে বলল।আজ বিকেলে আসাদের খালামণি মুরশিদা তার দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে বেড়াতে আসবে।নিরু মামানির সাথে রান্নায় হাত লাগালো।নিরু নিজেও বেশ কয়েক পদের রেসিপি করে ফেলল।রান্নার কাজে নিরুর হাত দ্রুত চলে।আসাদ নিরুর হাতের রান্নার অনেক বড় একজন ভক্ত,কিন্তু নিরুর রান্না নিয়ে আসাদ কখনো সুনাম করেনি।মনে মনেই থেকেছে।যেদিন নিরুর রান্না করা খাবার পায় সেদিন অনেক তৃপ্তি করে খায়।আমিনার কাছ থেকেও নিরু অনেক রান্না শিখেছে।আমিনার রান্নার হাত অনেক ভালো।
_ মামানি তুমি এতো রান্না কোথায় থেকে শিখেছিলে?
_ তুই কোথায় থেকে শিখেছিস?
_আমি তো তোমার কাছ থেকে শিখেছি।
_ আর আমি তোর মায়ের কাছ থেকে শিখেছিলাম।
আমার বিয়ের পর তোর আম্মুকেই তো পেয়েছিলাম।তোর আম্মুর রান্নার হাত তো তুই জানিস-ই।ওখান থেকেই শেখা।আগে তো কিছুই পারতাম না। তোর আম্মুই রান্না করতো। তারপর আমি আস্তে আস্তে তোর আম্মুর কাছ থেকে শিখে নিলাম।
নিরু কেমন যেন চুপ হয়ে গেল।
_ নিরু শোন, মায়ের কথা শুনলেই মন খারাপ করে ফেলবি না।তুই যদি এইভাবে মন খারাপ করে ফেলিস তোর সামনে তো তোর মায়ের কথা কেউ বলবেই না।তোর মায়ের স্মৃতি গুলোও তো আড়াল হয়ে যাবে। তুই আর মন খারাপ করবি না।চুপচাপ থাকবিনা।তোর মায়ের গল্প করবি।আর গল্প জানতেও চাইবি।তোর মা কত ভালো মানুষ ছিলো।কত গুণী।সহজে অমন একটা মানুষের দেখা মেলে না।
নিরুর চোখ দু’টো থেকে অঝরে পানি ঝরছে।আমিনা নিরুকে কাছে টেনে নিলো।পিঠে হাত বুলিয়ে দিলো।
_ নিরু তোর মা বাবা তোর মাঝেই আছে।সব সময় তোর সাথে আছে।আর এই যে এই মা তো তোর সঙ্গে ছায়ার মতো আছে।কাঁদে না মা।
নিরু চোখ মুছে সোজা হয়ে দাঁড়াল।মায়ের মুখটা চোখে ভাসতেই চোখ দু’টো আবারও টলমল করে উঠল। ‘বুকের মধ্যে যে সব সময় ব্যাথা হয়।চোখের পানি, মন খারাপ এই গুলো না হয় দেখা যায়। বুকের মধ্যে যেই অসহনীয় ব্যাথা হয়, সেই ব্যাথা যে কেউ দেখে না।সবাই বলে মা তো সাথেই আছে।মা সাথে থাকলে এতো কষ্ট কেন হয়?’
দুপুরের পর পর-ই বাহারি নিরুকে নিতে আসে।আমিনা বেগম সন্ধ্যার আগেই চলে আসতে বলেন।সন্ধ্যার আগেই বাসায় আত্নীয় চলে আসবে।নিরু ও মামানিকে বলে বাসা থেকে বের হয়। পাহাড়ের অতি নিকটে বাহারিদের ঘর।পাহাড়ের গা ঘেঁষেই বাস করে। এখানে বেশ কয় ঘর মানুষ বাস করে।চারপাশে সবুজ আর সবুজ।খুব কাছ থেকেই ঝর্ণার কলকল শব্দ আসছে।পাশেই ঝিরিপথ দেখতে পেয়ে ঝিরিপথে পা ভেজালো।
_ আশপাশে ঝর্ণা আছে বাহারী?
_ হ্যাঁ আছে।কিন্তু একটু দূরে,
_ ওখানে যেতে কি অনেকটা সময় লাগবে?
_ অনেকটা সময় লাগবে না। কিন্তু এখন যাওয়ার ব্যবস্থা নেই।
_ কেন?
_ জায়গাটা ভূতুড়ে মতো আর বৃষ্টির জন্য খুবই পিচ্ছিল হয়ে আছে।তোমাকে অন্য কোনদিন দেখাতে নিয়ে যাবো।
_ বাহারি তুমি ঠিক রাহিমার কার্বন কপি। তোমার মতো রাহিমাও আমাকে খুব ভালবাসে।আর এই ভাবেই মায়া মায়া করে তাকিয়ে থাকে।
বাহারী লজ্জা পেল।বাহারি নিরুর দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলো।নিরু সেইটা বুঝেই বাহারিকে ওই কথাটা বলল।নিরু এমন একটা মেয়ে ওর মুখের দিকে তাকালেই যেন অদ্ভুত একটা শান্তি পাওয়া যায়। মুখটায় পুরো মায়া ভরা।
_ তুমি অনেক ভালো নিরু।তোমরা এখান থেকে চলে গেলে আমি খুব মিস করবো।
_ আমরা সীতাকুণ্ড থেকে চলে গেলেই হারিয়ে যাবো নাকি।তোমার সাথে রোজ যোগাযোগ করবো।আর এখানে বেড়াতেও আসবো।মামা বলেছে এখানে একটা বাড়ি করবে।তাহলে বুঝতেই পারছো।আমরা এখানে প্রায়-ই আসবো।
বাহারির মুখে এবার হাসি ফুটল।নিরুকে ঘরে বসতে দিয়ে চাউলের মোয়া খেতে দিলো। গাব আর পেয়ারা পেরে দিলো।
_ নিরু এই গুলো এখন খেও না।তাহলে ভাত খেতে পারবে না।এই গুলো পরে খেও,আরও পেরে দেবো বাসায় নিয়ে গিয়েও খেতে পারবে।
বাহারির মা, বাহারি, নিরু এক সাথে খেতে বসল।খাওয়া শেষ করে, পাহাড়ি আদিবাসীদের জীবন নিয়ে অনেক গল্প শুনল।সবজির বাগান গুলো ঘুরে দেখল।বাহারির মা পাকা পেঁপে পেরে কেটে দিলো।নিরু এমন মিষ্টি পেঁপে আগে কখনো খায়নি।বাহারি এর আগে রান্না করে খাওয়ার জন্য কাঁচা পেঁপে দিয়ে এসেছে।বাহারিকে বলে দিলো এবার থেকে যেন পাকা পেঁপে ও দেয়।নিরুর ভীষণ লোভ হলো।বাহারি আরও একটা কাটতে যাচ্ছিলো।কিন্তু নিরু বাহারিকে কাটতে নিষেধ করল।এই পেঁপেটা নিরু বাসায় নিয়ে যাবে।আসাদ ভাইকে কেটে দেবে।এতো মিষ্টি পেঁপে আসাদ ভাই ও কখনো খায়নি বলেই নিরুর ধারণা। একটা পলিথিতে নিরু পেয়ারার সাথে পেঁপেটাও রেখে দিলো।বিকেল হয়ে এসেছে।পাশেই টুংটাং শব্দ হচ্ছে।
_ এইটা কিসের শব্দ হচ্ছে?
_ পাশেই একটা বাড়িতে বিয়ে হচ্ছে।ওই বাড়ির সবাই বাউল গান করে।বাউল গানের আসর জমাচ্ছে।তুমি শুনবে?
_ আমি তো বাসায় চলে যাবো।
_ তুমি বাউল গান শুনেছো?
_ না কখনো শুনিনি।
_ আমার অনেক ভালো লাগে।তুমি সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকলে তোমাকে শোনাতে পারতাম।
_ তাহলে আমি মামাকে একটা ফোন করি।মামা সন্ধ্যার সময় এইদিক দিয়েই যায়।আমাকে যাওয়ার পথে নিয়ে যেতে পারে কি দেখি।তোমার আম্মুর ফোনটা এনে দিবে।
বাহারি ফোন এনে দিলো। নিরু মামার সাথে কথা বলে বাহারি কে জানালো, ‘মামা থাকতে বলল, বাসায় যাওয়ার পথে আমাকে নিয়ে যাবে।আর মামার দেরি হলে আসাদ ভাইকে বলে দিবে নিয়ে যেতে।’
নিরুর থাকার কথা শুনে বাহারি খুশি হলো।
আমড়া পেঁয়ারা কাঁচকলা কদবেল সহ পাহাড়ি আরও কিছু ফল দিয়ে, ঝাল ঝাল করে এক ধরনের ভর্তা বানালো।এই ভর্তাটা নিরু বাসায় গিয়ে সবাইকে বানিয়ে খাওয়াবে।বিশেষ করে আসাদ ভাইকে খাওয়াবে।আসাদ ভাই একদমই ঝাল খেতে পারেনা।প্রথমে নিরু বলবে একদম ঝাল দেয়নি।পরে খেয়ে আসাদ ভাইয়ের কি অবস্থা হয় নিরু সেইটা দেখবে।কথাটা মনে মনে ভাবতে ভাবতেই নিরু হেসে ফেলল।
এতক্ষণ টুংটাং শব্দ আর সুর শুনতে পাচ্ছিলো।আর এখন সুরের সঙ্গে গান ও শোনা যাচ্ছে।নিরু কাঠের মাঝারি সাইজের একটা চৌকিতে বসে পা দুলাচ্ছে আর ভর্তা মাখানো খাচ্ছে।
_ তোমার ঝাল লাগছে না?
_ আর একটু দিলে ভালো হতো।
_ তুমি এতো ঝাল খাও।ঝালের জন্য আমিই খেতে পারছিনা।
_ খেতে পারি।
_ আচ্ছা চলো, গানের আসরে যেয়ে গান শুনে আসি।
_ এখনই যাবে? ভর্তাটা শেষ করে নিই?
_ শেষ করো।
মাগরিবের আযান পড়তে না পড়তেই চারপাশে কালো মেঘে ঢেকে গেল। আকাশে প্রচন্ড মেঘ,বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়তেও শুরু করেছে।দমকা হাওয়াতে কয়েকটা গাছের ডাল ভাঙার ও শব্দ পাওয়া গেল।শো শো করে বাতাস বইছে।বাহারিদের ঘরের চালা পর্যন্ত দুলে উঠছে।হঠাৎ এমন আবহাওয়া দেখে নিরুর বুকটা কেন জানি কেপে উঠল।
চলবে…..