দ্বিতীয়_ফাগুন #পর্বসংখ্যা_২৫

0
578

#দ্বিতীয়_ফাগুন
#পর্বসংখ্যা_২৫
#লেখিকা_Esrat_Ety

মিটিং রুম থেকে এম্প্লয়িরা সবাই একত্রে বেড় হয়। আজ তাদের জন্য বিশেষ ছুটির ঘোষণা করে দিয়েছেন এমডি স্যার। সবাই বেশ প্রফুল্ল চিত্তে রয়েছে। অফিসের গুমোট ভাবটা আর নেই,কেমন একটা উৎসব উৎসব আমেজ চারদিকে।‌ তাশরিফ নিজের কেবিন লক করে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। তার চোখ খুজছে রোদেলা আমিন কে। মেহেরিন এসে তাশরিফের পেছনে দাঁড়িয়ে জিগ্যেস করে,”কাউকে খুজছো?”
তাশরিফ কিছুটা বিব্রত হয়ে বলে,”না তো আপা।”

_ওহহ, তোমার হাবভাব দেখে মনে হলো কাউকে খুজছো। যাই হোক। এমডি তো নতুন জিএম আনবে বলে জানিয়ে দিয়েছে। এই নতুন জিএম কেমন হয় কে জানে!

“শুনছেন।”
রোদেলা তাশরিফকে ডাকে। তাশরিফ ঘুরে তাকায় রোদেলার দিকে। মেহেরিন চলে যায় ওখান থেকে। তাশরিফ বলে,”বলুন।”
রোদেলা এগিয়ে আসে। তাশরিফের বুক ধুকপুক করছে,তার পেঁচা মুখী তার সামনে এসে দাঁড়ায়।
_কথা ছিলো।
_বলুন।
_আপনাকে ধন্যবাদ দিলে ছোট করা হবে। আপনি অনেক বড় উপকার করেছেন আমার। আপনার জন্য আমি এতো বড় একটা সর্বনাশের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছি। আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ।

তাশরিফ ম্লান হাসে। মনে মনে বলে,”আর আপনার জন্য আমার যে সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে তা কি দেখতে পান না! কেনো অন্ধ হয়ে বসে আছেন!”

রোদেলা বলতে থাকে,”ধন্যবাদ সব কিছুর জন্য।”

তাশরিফ মজা করে বলে,”এতো সাদামাটা ধন্যবাদ জীবনে কখনো দেখিনি, সরি শুনিনি।”
রোদেলা আড়চোখে তাশরিফের দিকে তাকিয়ে বলে,”তা ধন্যবাদ কিভাবে দিতে হয়? গানের সুরে? বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে?”

তাশরিফ কিছু না বলে হাঁটা শুরু করে। রোদেলা পিছু পিছু হাটছে। হঠাৎ করে বলে ওঠে,”বাড়িতে যাচ্ছেন?”
_হ্যা,আর কোথায় যাবো। আমার তো শশুর বাড়ি নেই।

_বৃষ্টিকে আজ চেক আপের জন্য নিয়ে যাবো আমি। আপনাদের বাড়িতে যেতে চাচ্ছিলাম।
তাশরিফ মুচকি হাসে। তারপর বলে,”ঠিকাছে চলুন। বাইকে উঠুন।”

_আমি আপনার সাথে যাবো কে বলেছে! আপনার সাথে যাবো আর আপনার মা বলবে আমি আপনাকে লাই দিচ্ছি। তার আর দরকার নেই।

তাশরিফ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়,বলে,”যাবেন না তাহলে আমি বাড়ি যাচ্ছি কি না কেনো জানতে চাইছেন?”

_আপনি যদি এখন বাড়িতে যান তাহলে আমি বাড়িতে যাবো না। নয়তো আপনার মা বলবে তার ছেলে যখনি বাড়িতে থাকে আমি হ্যাংলার মতো তখনি বাড়িতে যাই।

তাশরিফ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকে, তারপর বলে,”ঠিকাছে। আপনি বাড়িতে যান। আমি এখন যাবো না।”

_আপনি কোথায় যাবেন?
_রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবো।

তাশরিফ বাইকে উঠে বাইক স্টার্ট করে চলে যায়। রোদেলা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে। তারপর একটা সিএনজি ঠিক করে উঠে পরে।

বাইরে আচমকা বৃষ্টি পরতে শুরু করেছে। এজন্যই আগষ্ট মাস টা রোদেলার পছন্দ নয়। হাতের ব্যাগটা মাথার উপর ধরে দৌড়ে এপার্টমেন্টের গেইট দিয়ে ভিতরে ঢোকে, ভেতরে ঢুকতেই চোখে পরে কলেজ পড়ুয়া ছয় সাতজন ছেলেদের একটা দল। সবাই মিলে ক্যারাম খেলছে। এখানে রোদেলা যে কয়বার এসেছে এদেরকে এখানে বসে ক্যারাম খেলতেই দেখেছে। কি একটা অবস্থা! এদের কি আর কোনো কাজ নেই! এদিক দিয়ে আদিলের প্রশংসা করতেই হয়, এতটুকু বয়সেই এতো এতো দায়িত্ব কাঁধে উঠিয়ে পালন করার চেষ্টাও করছে যথাসাধ্য। একে তো নিজে স্টুডেন্ট, তারপর বিয়ে করলো। এখন আবার বাচ্চা নিয়ে বসে আছে,কদিন পর বাচ্চার স্কুল এডমিশন। সবকিছু মিলিয়ে আদিলকে বোকা এবং নির্বোধ বলা যেতে পারে অথবা দায়িত্বশীল তকমাও দেওয়া যেতে পারে।

পুরোটা না ভিজলেও আংশিক ভিজে গিয়েছে রোদেলা। মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট।

লিফটে চড়ে রোদেলা হাত ঘড়িতে সময় দেখে। বেলা তিনটা বেজে গিয়েছে। ডাক্তারের কাছে এপয়েনমেন্ট নিয়ে রাখা হয়নি এতো ব্যস্ততার মাঝে। ভুলেই গিয়েছিল সে। এই বৃষ্টিতে বৃষ্টিকে নিয়ে বের হওয়া ঠিক হবে কি না তা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছে সে।

কলিং বেল টিপে দাড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ সে। দরজার নব ঘোরার শব্দ হতেই সে চোখ তুলে তাকায়। তাশরিফ দরজা খুলেছে। রোদেলা কিছুটা চমকে যায়। এ তো বলেছিলো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবে,এখন তো রোদেলার আগে এসে বাড়িতে বসে আছে ! তাশরিফ কিছু একটা বলতে যাবে অমনি রোদেলা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে হনহন করে বৃষ্টির ঘরের দিকে চলে যায়। তারপর এক মিনিট পরেই আবার ফিরে আসে। তাশরিফ লিভিং রুমে দাড়িয়ে আছে। তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় রোদেলা,”বৃষ্টি কোথায়?”

_মা বৃষ্টিকে নিয়ে গিয়েছে ডাক্তারের কাছে। সকালে গিয়েছে তারা। বাড়িতে এসে ফোন দিয়েছিলাম,তখন জেনেছি।

রোদেলা বিরক্ত হয়ে যায়,বলে,”আমাকে বলেননি কেনো?”
_বলতেই তো যাচ্ছিলাম,আপনি তো হনহন করে চলে গেলেন ভেতরে।
_আমি এখনকার কথা বলছি না। আমাকে ফোনে জানান নি কেনো?

রোদেলা ধমকের সুরে বলে কথাটি। তাশরিফ গম্ভীর কন্ঠে বলে,”আমি কেনো জানাবো? আমার কি? ফোন দিলেই তো ভাবতেন ছ্যাবলার মতো ফোন দিচ্ছি!”

রোদেলা চুপ হয়ে যায়। সত্যিই তো! তাশরিফকে সে বকছে কেনো! এখানে তো সব দোষ বৃষ্টির। দেখা হলে ঠাঁটিয়ে একটা চড় মারবে মেয়েটিকে। কোনো বোধ বুদ্ধি নেই।

তাশরিফের দিকে একবার তাকিয়ে রোদেলা ঘুরে সদর দরজার দিকে পা বাড়ায়। পেছন থেকে তাশরিফ বলে ওঠে,”বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি পরছে। সাথে ঝড়ো হাওয়া। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে যান।”

রোদেলা দাঁড়িয়ে পরে। তাই তো! এখন কি করে সে বের হবে। বিরক্তিতে রোদেলা মুখ দিয়ে “চ” কারন্ত শব্দ করে। যা তাশরিফের চোখ এড়ায় না। সে রোদেলাকে দেখে বাঁকা হাসি হাসে। মনে মনে বলে,”প্রকৃতি সবসময় আমাদের কাছাকাছি এনে দিচ্ছে দেখেছেন। যেখানে আপনি সেখানে আমি,যেখানে আমি সেখানে আপনি রোদেলা আমিন। আসলে প্রকৃতির আমাদের জুটিটা বেশ পছন্দ হয়েছে,অথচ আপনি তা বুঝতে পারছেন না।”

রোদেলা বিব্রত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে দুমিনিট। ধুর,এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে বরং আজ বৃষ্টিতে ভিজবে সে। তাছাড়া কোনোমতে একটা সিএনজি পেলেই হলো। এসব ভেবে রোদেলা সামনে পা বাড়াবে তখনি তাশরিফ বলে ওঠে,”বাইরে কিন্তু প্রচুর ঝড়ো হাওয়া বইছে। কোনো গাড়ি যে আপনি পাবেন না তা লিখে রাখুন। আর হেটে হেটে বেশিদূর যেতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না ‌। ঝড়ো হাওয়া এসে আপনার টিংটিঙে শরীরটাকে অনেক দূরে উড়িয়ে নিয়ে যাবে।”

রোদেলা প্রচন্ড রেগে গিয়ে তাশরিফের দিকে তাকায়। চাপা স্বরে চেঁচিয়ে বলে,”টিংটিঙে মানে?”

তাশরিফ উচ্চশব্দে হেসে ওঠে। রোদেলা হঠাৎ রাগ ভুলে গিয়ে তাশরিফের সেই হাসি দেখতে থাকে। অদ্ভুত সুন্দর এই লোকের হাসি। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। তাশরিফ কিছুক্ষণ হেসে হাসি থামিয়ে বলে,”বৃষ্টির ঘরে গিয়ে চেইঞ্জ করে নিতে পারেন। এভাবে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে।”

রোদেলা গম্ভীর হয়ে বলে,”আমি বুঝে নেবো। আপনি আপনার কাজ করুন।”
_ওকে !

তাশরিফ নিজের ঘরে চলে যায়। রোদেলা চুপচাপ সোফাতে বসে থাকে। এরকম বসে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে নির্ঘাত। সে উঠে দাঁড়ায়। বৃষ্টির ঘরে গিয়ে একটা তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছে বেরিয়ে এসে দেখে তাশরিফ রান্নাঘরে। রোদেলাকে দেখে লজ্জিত ভঙ্গিতে বলে,”চা বানাতে এসেছি। আমি অনেক ভালো চা বানাই জানেন? আপনি খাবেন?”

_না, ধন্যবাদ।
কথাটি বলে রোদেলা সোফাতে বসে পরে। তাশরিফ দু’টো কাপে দুই কাপ চা নিয়ে এসে একটা কাপ রোদেলার সামনে রাখে। রোদেলা বলে,”বললাম তো লাগবে না।”
_শোধবোধ করছি।
_মানে?
_সেদিন চা বানিয়ে খাইয়েছিলেন না? আজ আপনি খান। আমি কারো ঋন রাখতে চাইনা।
রোদেলা চায়ের কাপটা নেয়। তাশরিফ একটা সোফায় বসে পরে। রোদেলা আমতা আমতা করে বলে,”আংকেল কোথায়?”

_বাবা তো খুব ব্যস্ত মানুষ। তাকে বাড়িতে কমই পাওয়া যায়।
রোদেলা চায়ে চুমুক দিয়ে বলে,”চা টা ভালো হয়েছে। মনে হচ্ছে কোনো মেয়ে লোক বানিয়েছে। একেবারে পারফেক্ট।”

তাশরিফ মুচকি হেসে বলে,”আমার মা প্রায় সবকিছুই শিখিয়েছেন আমাকে। আমি আর আদিল প্রায় সব কাজ জানি। রান্নাবান্নাও মোটামুটি পারি। আমাকে যে বিয়ে করবে সে খুব লাকি হবে!

রোদেলা চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে বলে,”বুঝলাম।”

_অবশ্য বরিশালের ছেলে বলে কথা। এরা হাজবেন্ড ম্যাটেরিয়াল হয় জানেন?
_না, আপনার কাছে শুনলাম। এতদিন জানতাম বরিশাল চিটার বাটপারদের বিভাগ।

তাশরিফ চায়ে চুমুক দিতে গিয়েও দেয়না। কপাল কুঁচকে বলে,”মুখস্থ কথা। চোর বাটপার তো সব বিভাগেই আছে।”

_তা ঠিক,তবে পারসোনালি আমার বরিশালের লোকজন পছন্দ না। এরা খুব ধুরন্ধর প্রকৃতির হয়। আমার অনেক বান্ধবীর বয়ফ্রেন্ড গুলো ছিলো বরিশালের। খুব বাটপার টাইপের। বরিশালের লোক দেখলেও এড়িয়ে চলি,আই যাস্ট ইগনোর দেম!

_ছোটো বেলায় দাদীর কাছে একটা প্রচলিত প্রবাদ শুনতাম।‌ প্রবাদ টা হচ্ছে,”যে যারে নেন্দে,হেই হ্যারে পেন্দে!”

রোদেলা অবাক হয়ে বলে,”মানে?”
_এটা বরিশালের আঞ্চলিক ভাষা। এর মানে হচ্ছে যে যাকে ঘৃণা করে দিনশেষে তার কপালে সেই জোটে। দেখতে থাকেন আপনার সাথে কি হয়।

রোদেলা কয়েক মূহুর্ত তাশরিফের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,” বাইরে বৃষ্টি বোধ হয় থেমে গিয়েছে। আমি উঠি।”

_এসেছেন যখন বৃষ্টির সাথে দেখা করে তারপর না হয়……

তাশরিফ বলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে যায়। কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছে সে কিছু একটা দেখে। রোদেলা তাশরিফের দৃষ্টি লক্ষ্য করে বলে,”কি হয়েছে?”

_তেলাপোকা।
_হ্যা। অসুবিধা নেই। আমি তেলাপোকা ভয় পাই না।
_আমি পাই।

রোদেলার মনে হলো এই মাত্র সে শতাব্দীর সবচেয়ে আশ্চর্য কথাটি শুনে ফেলেছে। কিছুটা হতভম্ব, কিছুটা আশ্চর্য,কিছুটা হতবাক এবং কিছুটা হতাশ দৃষ্টি দিয়ে তাশরিফের দিকে তাকিয়ে থাকে।

তাশরিফ বলে,”দেখছেন কি? ছেলে বলে তেলাপোকা ভয় পাওয়া যাবে না এটা সংবিধানের কোথায় লেখা আছে?”

রোদেলা উঠে দাঁড়ায়,তারপর একটা টিস্যু পেপার নিয়ে তেলাপোকা টাকে চেপে ধরে কুচলে দেয়। নোংরাটা বিনে ছুড়ে ফেলে তাশরিফের দিকে তাকিয়ে বলে,”এই আপনি কি না রাশেদুজ্জামানের নাক ফাটিয়ে দিয়ে এসেছিলেন?”

_রাশেদ আর তেলাপোকা দুটো আলাদা জিনিস। তেলাপোকা দেখলেই আমার ঘেন্না লাগে। ছিহহঃ

রোদেলা হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না। সে তার হাসি যথাসাধ্য চাপিয়ে রাখার চেষ্টা করে বলে,”আচ্ছা উঠি তাহলে….”

রোদেলা উঠে দাঁড়াতেই তাশরিফও উঠে দাঁড়ায়। এমন সময় তাহমিনা বৃষ্টিকে নিয়ে আধভেজা হয়ে ঘরে ঢোকে। রোদেলাকে দেখতে পেয়েই সে তার ভ্রু কুঁচকে ফেলে। রোদেলাও তাই। তাহমিনা অবাক হয়ে একবার তাশরিফের দিকে তাকায় আর একবার রোদেলাকে দেখে। রোদেলা স্বাভাবিক গলায় সালাম দিলে সে সালামের উত্তর দেয়। যত যাই হোক, পুত্রবধূর বড় বোন। বৃষ্টি আপুকে দেখে ভীত কন্ঠে বলে,”সরি আপু। তোমাকে জানাতে পারিনি। আসলে খুব অসুস্থ হয়ে পরেছিলাম। আদিলও ভার্সিটিতে,ওদের একটা প্রেজেন্টেশন আছে আজ তাই মা দেরী না করে নিয়ে গেলো। সরি আপু তুমি কষ্ট করে এলে!”

রোদেলা ভেবেছিলো বৃষ্টিকে বকবে খুব কিন্তু বোনের কাঁচুমাচু মায়াবী মুখ টা দেখে ওর খুব মায়া হয়। নরম গলায় বলে,
_ইটস ওকে সোনা। কি অবস্থা তোর? সব ঠিকঠাক তো?

বৃষ্টি লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ায়। তাহমিনা টি টেবিলের উপরে রাখা চায়ের কাপ দুটোকে দেখছে। দুজনে মিলে চা খাওয়া হচ্ছিলো তবে!

রোদেলা বোনের কাছে এগিয়ে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”একটু সময় করে পড়তেও বসবি কেমন? মনে রাখবি সবাই তোকে ছেড়ে যাবে কিন্তু এই পড়াশোনা তোকে ছেড়ে যাবে না। বুঝলি?”

তাহমিনা রোদেলার দিকে না তাকিয়ে রোদেলাকে উদ্দেশ্য করে বলে,”আমার বংশে নাতী আসতে চলেছে। সুখবর টা বেয়াইকে জানিয়ে দিও।”
রোদেলা বৃষ্টির পেটের দিকে তাকায়। একটা ম্যাক্সি ধরনের পোশাক পরে আছে সে। তারপর চোখ তুলে বৃষ্টির মুখ দেখে। লজ্জামাখা মুখটা চোখ নামিয়ে রেখেছে। রোদেলা মৃদু হেসে বলে,”আসছি। ভালো থাকিস। সাবধানে থাকিস।”

কথাটি বলেই রোদেলা চলে যায়। বৃষ্টি নিজের ঘরে যায়। বসার ঘরে তাহমিনা আর তাশরিফ দাঁড়িয়ে আছে। তাহমিনা তাশরিফের দিকে তাকায়। তাশরিফ মায়ের চোখ থেকে চোখ নামিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়।

***
“আপনি কি সবসময় দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থেকে এপার্টমেন্টের ভাবীদের যাওয়া আসা দেখেন ভাইয়া?”
সাদাফ তার মেজো শ্যালিকার কথায় মজা পেয়ে হেসে ফেলে।

রোদেলা বলে,”আপু কই? সরুন আপনি। আপুর কাছে আপনার নামে বিচার দিয়ে যাই।”
সাদাফ সরে দাড়াতেই রোদেলা ভেতরে ঢোকে। সাদাফ পেছন থেকে বলে,”বাচ্চাদের ঘুম পাড়াচ্ছে বোধ হয়। তুমি বসো।”

_কেনো ডেকেছিলেন?
_তোমার আপু আসুক। তারপর বলবো।

রোদেলা বসে। সাদাফ তার মুখোমুখি সোফায় বসে পরে। রোদেলা হাতে একটা ম্যাগাজিন নিয়ে বলে,”আপুকে নিয়ে আপনি খুব খুশি তাই না?”
সাদাফ মুচকি হাসে। রোদেলা বলে,”বলতে হবে না,আপনার চেহারা দেখেই বুঝতে পারছি। আমার আসলে মাইনুল কুত্তাটার জন্য আফসোস হয়। আপুর মতো খাটি ঘি ওর পেটে হজম হলো না।”

সাদাফ হাসে। তারপর বলে,”খুশি না অখুশি তার ব্যখ্যা না দিয়ে শুধু বলবো আমার ধ্বসে যাওয়া জীবনটা পরিপূর্ণ হয়েছে।”

রোদেলা তৃপ্তির হাসি হাসে। সাদাফ এদিকে ওদিকে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,”যদিও একটু পাগলি টাইপের। তবুও বেশ!”

_পাগলি টাইপের মানে?
_অতিরিক্ত সেনসিটিভ। মজা করলে দুমিনিট পরে বুঝতে পারে। এতো সরল মেয়ে আমি জীবনে দুটো দেখিনি। সেদিন হয়েছে কি শোনো। ইলেকশন নিয়ে অনেক প্যাড়ায় আছি,তারপর আবার অপজিশন পার্টির কুত্তা গুলোর জালাতন। মুড ভালো ছিলো না তাই বারান্দায় বিরস মুখে বসেছিলাম। এক গ্লাস লেবুর শরবত নিয়ে এসে দিলো, বললাম খাবো না। আমার এই “খাবো না” বলা তার কাছে ধমক লেগেছে। কেঁদে কেটে একাকার করে ফেলেছে। সুহা সিরাতের চেয়েও অবুঝ। অথচ এর বয়স নাকি ত্রিশ!

রোদেলা হাসছে। সাদাফের চোখে মেঘলা আপুর জন্য অপরিসীম ভালোবাসা, মুগ্ধতা দেখে হাসছে।

মেঘলা চুলে খোপা বাঁধতে বাঁধতে বসার ঘরে এসে দাঁড়ায়,”কি কথা বলা হচ্ছে ফিসফিসিয়ে? গোপন কিছু?”

সাদাফ হেসে বলে,”হু।”
রোদেলা বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,”কেনো ডেকেছো আপু এতো রাতে?”
মেঘলা বসে। সাদাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”আপনি বলবেন না আমি বলবো?”
সাদাফ বলে,”তুমি বলো।”
মেঘলা ভয়ে ভয়ে বলতে শুরু করে,”দুদিন পরে জানাবি বলেছিলি। কিছুই তো জানালি না। এদিকে ছেলে তোকে পছন্দ করে বসে আছে। তোকে দেখার পরে অন্য কোথাও মেয়ে দেখেনি। তাদের তো কিছু একটা বলতে হবে। কথা বার্তা এগোবো? ”

সাদাফ আর মেঘলা দুজনে কৌতুহলী হয়ে রোদেলার দিকে তাকিয়ে আছে। রোদেলা একবার সাদাফ আর একবার মেঘলার মুখের দিকে তাকায়। হঠাৎ করে তাশরিফের কথা মনে পরে যায় তার। নিজের প্রতি প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে যায় সে। কি বিচ্ছিরি অবস্থা! এই মুহূর্তে ওই লোকটাকে কেনো মনে পরবে! তার সাথে তো রোদেলার প্রেম ছিলো না! প্রেম ছিলো জাহিনের সাথে,মনে পরলে জাহিনের কথাই মনে পরা উচিত,ওই লোকটা কেনো! রোদেলার অফিসে,জীবনে, মস্তিষ্কে সব যায়গায় এসে ছ্যাবলার মতো রোদেলাকে বিরক্ত করতেই হবে? অসভ্য অভদ্র লোক একটা!

সাদাফ বলে,”কি হলো! ঘুমিয়ে পরলে নাকি! জবাব দিচ্ছো না কেনো?”
রোদেলা চুপচাপ বসে থাকে। সে কি বলবে? তার কি বলা উচিত? বিয়ে টা কি করতেই হবে? জাহিন একটা কচি মেয়েকে বিয়ে করে নিয়েছে। এই তাশরিফ লোকটাও দুদিন পরে মায়ের পছন্দ মতো ক্লাস টেনে পড়ুয়া একটা ফরসা দেখতে মেয়েকে বিয়ে করে নেবে। রোদেলা কি করবে! বিয়ে না করারও তো কোনো কারণ নেই তার। বাবা,আপু খুব করে চাইছে। মেঘলার দিকে রোদেলা তাকায়। মেঘলা বলে,”জাহিনের জন্য এখনো অপেক্ষা করছিস নাকি আবার? ও কিন্তু বৌ নিয়ে এখন নেপাল ঘুরে বেড়াচ্ছে।”
রোদেলা হাসে। সাদাফ বলে,”আরে এই মেয়ে তো দেখছি আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে ফেলছে। বলেন না আপা আমরা কথা বার্তা এগোবো কি না প্লিজ!”

রোদেলা অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,”আপনি আর আপু যা ভালো মনে করেন ভাইয়া!”

***
খাবার টেবিলে পিনপতন নীরবতা। শুধু মাঝেমধ্যে তাহমিনা বৃষ্টিকে “এটা খাও,ওটা খাও” বলে তাগাদা দিয়ে যাচ্ছে। তাশরিফ এক মনে খাচ্ছে। আদিল খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে একটু ফোন ঘাটছে। সারাদিনের ব্যস্ততায় একটু ফেইসবুক ব্যবহার করা সময় পায়না সে। রুমে ঢুকলেই বৃষ্টিকে সময় দিতে হয়। আদিলের হাতে ফোন দেখলেই মুখ ফুলিয়ে বসে থাকে। তাই পাঁচ মিনিট কি ছয় মিনিট যতটা পারে একটু ঢু মেরে আসে খেতে খেতে। বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আদিল বলে,”বৃষ্টি এই ছবিটা কার? এই লোকটা কে? মেঘলা আপু ছবি পাঠিয়েছে,বলছে তোমাকে পাঠাতে গিয়ে ভুলে আমাকে পাঠিয়ে ফেলেছে। কে লোকটা?”
বৃষ্টি আদিলের দিকে তাকায়। তারপর আমতা আমতা করে বলে,”রোদেলা আপুর জন্য এই লোকটাকে ঠিক করেছে দুলাভাই। পুলিশ ইন্সপেক্টর।”

কথাটি বলেই বৃষ্টি তাশরিফের দিকে তাকায়। আদিল একবার মা আর একবার তার ভাইকে দেখে। দু’জনেই এক মনে খাচ্ছে। আদিল নিচু স্বরে বলে,”দেখতে ভালোই। সিমেন্ট আপু সরি মেজো আপুর সাথে মানাবে।”

আদিল কথাটা শেষ করার আগেই তাশরিফ প্লেটে হাত ধুয়ে উঠে পরে। তারপর সোজা গিয়ে রুমের দরজা লাগিয়ে দেয়।

বৃষ্টি এবং আদিল চোখ চাওয়াচাওয়ি করছে। তাহমিনা চুপচাপ খেতেই থাকে। আফতাব হাসান সবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

তাহমিনা লাইট নেভাতে গিয়েও নেভায় না। আফতাব হাসান ঘুমিয়ে গিয়েছে। সে ঘর থেকে বের হয়ে তাশরিফের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তাশরিফের ঘরের দরজা এখন খোলা। সে ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে ভিতরে উঁকি দিয়ে চায়। ভেতরে তাশরিফ নেই। তাহমিনা জানে তাশরিফ কোথায় আছে। সে সোজা হেটে পশ্চিমের টানা বারান্দায় চলে যায়। গিয়ে দেখে তার বড় ছেলে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তাশরিফের পিঠের দিকে তাকিয়ে তাহমিনা মৃদু স্বরে বলে ওঠে,”তাশরিফ।”

তাশরিফ মাথা ঘুরিয়ে মায়ের দিকে তাকায়। তাহমিনা এগিয়ে গিয়ে তাশরিফের পাশে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ দুজনের কেউ কথা বলে না।
তারপর তাহমিনাই বলে,”এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো। মশা কামড়াবে তো। নিজের ঘরে যা।”
তাশরিফ মৃদু স্বরে বলে ওঠে,”মা।”
_বল।
_রোদেলা আমিনকে এনে দাও আমায় , প্লিজ মা!

তাহমিনা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তাশরিফ মাথা নিচু করে রেখেছে। তাহমিনা দেখছে তার ত্রিশ বছরের সুঠামদেহী,লম্বা, সুদর্শন ছেলেটা কেমন হঠাৎ করে আট বছরের একটা শিশু হয়ে গিয়েছে। যে তার মায়ের কাছে আবদার করছে একটা খেলনা কিনে দেওয়ার জন্য!

চলমান….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here