চিত্রলেখার_কাব্য বিংশ_পর্ব ~মিহি

0
592

#চিত্রলেখার_কাব্য
বিংশ_পর্ব
~মিহি

চিত্রলেখা ছাদের প্রাচীরে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। মাঝে মাঝে তার ওষ্ঠজোড়ার ফাঁকে শিসের ন্যায় শব্দ শোনা যাচ্ছে। সাথী তার সামনে বসে। চিত্রলেখার এমন রহস্যময়ী রূপ আগে দেখেনি সে।

– তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারোনি ভাবী?

– তুই কাউকে না জানিয়ে এত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ একা কেন করতে গিয়েছিস? তাছাড়া দীতির পরবর্তী পদক্ষেপ আমরা জানবো কী করে?

– আমি যতদূর জানি দীতি একা এসব করেনি। হয় সে নিজের সহযোগীর সাহায্য নিবে অথবা আমাদের আগে কল করবে। দেখা যাক কোন জুয়াটা সে খেলে!

– ওর উপর নজর রাখাটা দরকার।

– পুলিশের সহায়তা নেওয়া যাবে না। তৌহিদ ভাইকে বললে কাজ হবে বোধহয়।

– তুই কোথায় ডেকেছিস দীতিকে?

– এখনো ডাকিনি। আগে তৌহিদ ভাইয়ের সাথে কথা বলে পরিকল্পনা সাজাতে হবে। ভাইয়াকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করলো না?

– শরীরের আবার অবনতি হয়েছে। অনিক প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে পড়েছে। এসব পুলিশি অত্যাচার ওকে পুরোপুরি শেষ করে দিচ্ছে লেখা।

– চিন্তা কোরো না ভাবী, আমি এখনি বের হচ্ছি। তৌহিদ ভাইকে কল করে কোথাও আসতে বলছি। বাসায় ডাকা যাবে না, অপর্ণা ভাবী চেঁচামেচি করতে পারে অযথা। তুমিও যাবে আমার সাথে।

– তুই আগে বের হ, আমি একটু পরে যাবো। তোর বড় ভাবীর মতো মানুষকে আমি এতদিন শ্রদ্ধা করে আসছি! এখন আমার খারাপ সময়েও তার ব্যবহার জঘন্য। তুই বাড়ি ছাড়লি ঐ মহিলার জন্য! তোর কি মনে হয় আল্লাহ এসব দেখতেছে না?

– ভাবী শান্ত হও। আমি বের হচ্ছি। তুমি তাড়াতাড়ি এসো, আমি মেসেজ করে জানাবোনি জায়গার কথা।

সাথী মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। চিত্রলেখা নিচে নামলো। অপর্ণা নেই আশেপাশে। চটজলদি বোরকা পড়ে নিল সে। অপর্ণার চোখ ফাঁকি দিয়ে দ্রুত বেরোল।

তৌহিদের পরিচিত একটা ক্যাফেতে বসেছে তারা। চিত্রলেখা ইতোমধ্যে সাথীকে জানিয়েছে জায়গার কথা। তৌহিদ চিত্রলেখার কথা এতক্ষণ বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনলো।

– চিত্রলেখা, তুমি একটু তাড়াহুড়ো করে ফেলেছো! তবে এখনো সবটা ঠিক করা যাবে। কোর্টের ডেইটের আগে দুদিন সময় আছে হাতে। আমি আজকেই দীতির পেছনে একটা গোয়েন্দা লাগানোর ব্যবস্থা করছি। আগামীকাল বিকালে তুমি ওকে দেখা করতে ডাকো। এই ক্যাফের পেছন পাশে একটা পরিত্যক্ত বাড়ির মতো আছে। ঐখানেই আসতে বলবে।

– আচ্ছা ভাইয়া।

আচমকা চিত্রলেখার ফোনটা বেজে উঠলো। চিত্রলেখা স্ক্রিনে রঙ্গনের নামটা দেখে ভ্রু কুঁচকালো। এ সময় রঙ্গনের কল? তৌহিদ ভাইয়ের সামনে কলটা রিসিভ করা মোটেও উচিত হবে না। কল কেটে দিয়ে ফোনটা সাইলেন্ট করলো সে।

– কার কল? রিসিভ করো!

– কলেজের ফ্রেন্ড। রিসিভ করলে অযথা গল্প শুরু করবে। ভাবী যে কেন আসছে না এখনো!

– একটু বসো, আমি কফি আনছি। এর মধ্যে হয়তো ভাবীও চলে আসবে।

চিত্রলেখা হালকা হেসে সম্মতি জানালো। রঙ্গন চুপচাপ দূরে দাঁড়িয়ে দৃশ্যগুলো দেখলো। চিত্রলেখার ঠোঁটের হাসি আর খুব সন্তর্পণে তার কল ইগনোর করা! রঙ্গন অনুভব করতে পারলো চিত্রলেখার জীবনে আসলে তার কোনো জায়গাই নেই। সে কাছের বন্ধুও নয় চিত্রলেখার। এক মুহূর্তের জন্য তৌহিদ নামক মানুষটার উপর রঙ্গনের ক্রোধ যেন আকাশ ছুঁলো। সেখানে আর এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করলো না রঙ্গনের। দ্রুত ক্যাফে থেকে বেরিয়ে গেল সে।

_________________

বিকেলের দিকে আশফিনা আহমেদ ফিরলেন। রঙ্গনকে দেখে তিনি অবাক হলেন না তবে তার চোখেমুখে কাঠিন্য স্পষ্ট।

– মা কিছু হয়েছে? কোনো সমস্যা?

– সাথীর ডিভোর্সের জন্য বড় ভাইয়া উঠে পড়ে লেগেছে তবে আমার মনে হচ্ছে অনিক নির্দোষ। যতই ঐ ফ্যামিলিকে দোষারোপ করি, সাথী অনিককে ছাড়া থাকতে পারবেনা এটাও সত্য।

– এখন?

– এখন আবার কী? জোর জবরদস্তি করে কী আর করতে পারবে?

– তুমি মামাকে সাহায্য করতে চাচ্ছো?

– নাহ! যখন বিয়ের সময় আটকেছিলাম তখন তারা আমার কথাকে গুরুত্ব দেয়নি। এখন তাদের ব্যক্তিগত বিষয়ে আমার হস্তক্ষেপ ঘটবে না।

আশফিনা আহমেদ আর কথা বাড়ালেন না। নিজের ঘরের দিকে এগোলেন। রঙ্গন মাঝেমধ্যে অবাক হয় নিজের মায়ের একেক রূপ দেখে। সব রূপেই একটা বস্তু কমন, তার প্রগাঢ় আত্মসম্মানবোধ! তার মায়ের মতো আত্মসম্মানবোধ সে তার পরিবারে অন্য কারোর দেখেনি। রঙ্গন দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছাদে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। ঠিক সে সময় অহম এসে পথ আটকালো তার।

– তুমি আমার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছো ভাইয়া!

– নাহ! পালাবো কেন? তোর না পরীক্ষা চলছে? তাই বিরক্ত করছি না।

– ওহ! ভালো, সবাই আমাকে একা করে দাও।

– ছ্যাঁকা খাওয়া কথাবার্তা বলছিস কেন?

– কারণ আমি ছ্যাঁকা খাইছি। আমার গার্লফ্রেন্ডটা যে আস্ত গাধা! যে যা বলে বিশ্বাস করে ফেলে। একটা সম্পর্কে যদি আমার উপর তার বিশ্বাসই না থাকে, তবে সম্পর্ক কী করে টিকবে বলো তো!

রঙ্গনের কানে অহমের বলা কথা বাজতে থাকলো। সেও তো চিত্রলেখাকে অবিশ্বাস করতে শুরু করেছে কিন্তু তার আর চিত্রলেখার মধ্যে আদতে কোনো সম্পর্ক নেই যার ভিত্তিতে সে কিছু বলতে পারবে। ছেলেটা সত্যিই চিত্রলেখার খুব কাছের কেউ হতে পারে। যদি সত্যি তাই হয় তবে চিত্রলেখা কেন তার সাথে সময় কাটাতে রাজি হলো? প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে রঙ্গনের মাথায়। সরাসরি চিত্রলেখাকেই প্রশ্ন করবে সে! অহম উদাসী মন নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরের দিকে এগিয়েছে ততক্ষণে। রঙ্গনও এগোলো ছাদে যাওয়ার জন্য।

ক্যাফে থেকে বাড়িতে ফিরেই রঙ্গনকে কল করলো চিত্রলেখা। রঙ্গন রিসিভ করলো একটু পরেই।

– কল করেছিলেন যে?

– হুম। ব্যস্ত ছিলে?

– একটু।

– কোথাও গিয়েছিলে?

– হ্যাঁ, এক বন্ধুর সাথে বেরিয়েছিলাম।

– ওহ।

রঙ্গনের আর কিছু বলতে ইচ্ছে করলো না। ছেলেটা তবে সত্যিই চিত্রলেখার বন্ধু কিন্তু আদতে এটা বন্ধুত্ব নাকি অন্যকিছু? রঙ্গন কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে না। চিত্রলেখার উপর তো তার কোনো অধিকার নেই তবে চিত্রলেখার জীবনে কেন সে অধিকার ফলাতে চাইছে? নিজের প্রশ্নে নিজেকেই জড়িয়ে ফেলছে সে।

– আর কিছু বলবেন?

– না!

রঙ্গন আচমকাই কল কাটলো। চিত্রলেখার কণ্ঠস্বরও তাকে দগ্ধ করছে। অদ্ভুত এক আকুতি তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরছে যেন! কোনোভাবেই নিজেকে সামলাতে পারছেনা সে।

___________________

দীতি কী করবে এখনো বুঝে উঠতে পারেনি। তার কাছে আবারো টেক্সট এসেছে। টাকা নিয়ে দেখা করতে বলা হয়েছে তাকে। দীতি এখন অবধি নিজের সহযোগীকে কথাটা জানায়নি। জানলে লোকটা তাকে মেরেই ফেলবে! দীতি লোকটার থেকে প্রায় দশ লাখ টাকা নিয়েছে। সেখান থেকে লাখ তিনেক টাকা নিয়ে এসব চাপা রাখতেই হবে। দীতির ভয় কোনভাবেই কমছে না। অনিককে ফাঁসানোটা সহজ ছিল বোধহয় তাকে এই কাজটা দেওয়া হয়েছিল। অনিকের ফোন ব্যবহার করাটাও কঠিন ছিল না। প্যাটার্ন সিম্পল, আইডি ব্যবহার করতেও অসুবিধা হয়নি। কাজ শেষ করে সমস্ত প্রমাণ অনিকের আইডি থেকে ডিলিট করাটাও কঠিন ছিল না কিন্তু অসুবিধেটা অনিক বাঁধালো দীতিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে।

____________________

চিত্রলেখার অদ্ভুত লাগছে। অদ্ভুত এ অশান্তির কারণ দীতিকে নিয়ে ভয় নাকি রঙ্গনের কারণে বুঝতে পারছে না সে। রঙ্গনের কথার ধরন তাকে পীড়া দিচ্ছে। চিত্রলেখা বুঝতেও পারছে না রঙ্গনের হঠাৎ কী হলো! চিত্রলেখা রঙ্গনকে কল করবে ভেবেও সিদ্ধান্ত নিতে পারলো না। ‘ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স’ সমস্যাটা তার বেশ পুরনো। এ মুহূর্তে রঙ্গনকে কল করার সাহসও তার হচ্ছে না। বারংবার মনে হচ্ছে রঙ্গনের সাথে এ ঘনিষ্ঠতা তার জন্য সঠিক নয়। এ ঘনিষ্ঠতার পরিণতি কী? রঙ্গন কি কেবল তাকে বন্ধুই মনে করে? অজস্র প্রশ্ন মনে, উত্তর চাওয়ার সাহস করতে পারছে না সে।

দু প্রান্তে দুজন, একই মুহূর্তে অলস ভঙ্গিতে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে অজস্র প্রশ্নের ভীড়ে নিজেদের নাম না জানা সম্পর্কের উত্তর তালাশ করে বেড়াচ্ছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here