#চিত্রলেখার_কাব্য
পঞ্চবিংশ_পর্ব
~মিহি
“আমি বিয়েতে রাজি, চাচী। আমার কোনো অসুবিধা নেই, সুবহার যদি সম্মতি থাকে তবে আমারও আর কোনো আপত্তি থাকবে না।” সিয়ামের কথায় রেহানা সুলতানা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। সিয়ামকে সব জানানোর পর যে সে বুঝেছে তাতেই তিনি সন্তুষ্ট।
-সিয়াম, বাবা এটা ভেবো না তোমার উপর সুবহাকে আমরা চাপিয়ে দিচ্ছি। তোমার চেয়ে ভালো ছেলে আমরা খুঁজে পেতাম না। চোখের সামনে তোমাকে বড় করেছি, আমার মেয়ের জন্য তোমার চেয়ে ভালো আর কাকে পাবো আমি?
-চাচী, এসব কথা থাক। চাচ্চুর শরীরের যা অবস্থা তাতে আমরা এসব পরে ভাববো।
-তোমার চাচ্চু বিয়ের কথাটা জানলেই স্বস্তি পাবেন সিয়াম। উনি চান তোমরা যেন এই মাসের মধ্যেই বিয়ে করো।
-চাচ্চুর এ অবস্থায় আমরা কিভাবে…তাছাড়া সুবহার মতামতেরও একটা ব্যাপার আছে চাচী।
-তুমি সুবহার সাথে একবার কথা বলো সিয়াম। আমি নিশ্চিত ও তোমার কথা শুনবে এবং বুঝবে।
সিয়াম মাথা নাড়লো। সুবহাকে এ মুহূর্তে কিছু বোঝানো কী সম্ভব তার পক্ষে। তাছাড়া চিত্রলেখা আছে সেখানে। সিয়াম কী করবে বুঝে উঠতে পারলো না। চিত্রলেখার সামনে সুবহাকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে কথা বলাটা তার ভালো লাগবে না। চিত্রলেখার দিকে তাকাতে অবধি পারছে না। নিজেকে বারবার দোষ দিতে ইচ্ছে হচ্ছে কেন সে যাওয়ার আগে একটাবার চিত্রলেখাকে মনের কথা বলে গেল না। অবশ্য চিত্রলেখা কি তাকে ভালোবাসতো কখনো? উত্তরটা স্পষ্টত না বোধহয়। মেয়েরা নাকি ক্রোশ দূর থেকেও বুঝে যায় ছেলেরা কোন চাহনিতে তাদের পর্যবেক্ষণ করছে। চিত্রলেখারও বোঝার কথা, হয়তো সে ভালোবাসে না বলেই বুঝতে চাইছে না।
সুবহা শান্ত থাকলেও তার মনের অবস্থা কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারছে চিত্রলেখা। মেয়েটার মনের উপর দিয়ে কী এক ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
-আঙ্কেল একদম সুস্থ হয়ে যাবে। তুই এতটা ভেঙে পড়িস না।
-আমি পারছি না রে লেখা। আমার মনের অবস্থা আমি কী করে বোঝাবো তোকে? আমি যদি কাউকে একটু বোঝাতে পারতাম!
-সুবহা তুই..
-তুই..তুই তো অনেকক্ষণ এসেছিস। হোস্টেলে ফিরতে হবে তো তোর। চিন্তা করিস না আমার, তুই ফিরে যা। বাবা সুস্থ হলে আমি তোকে জানাবো।
-কিন্তু …
-তুই একা যেতে পারবি?
-হুম।
চিত্রলেখা বুঝতে পারলো সুবহা একা থাকতে চাইছে। এখন ওকে বেশি কিছু বোঝানোর চেষ্টা করা যাবে না। বন্ধুত্ব মানেই যে সবসময় বোঝাতে হবে তা নয়, মাঝেমধ্যে একটু স্পেস, একটু একা ছাড়তে হয় বন্ধুকে। সুবহাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে চিত্রলেখা ফেরার জন্য বেরোলো। চিত্রলেখাকে যেতে দেখলো সিয়াম। অন্য সময় হলে হয়তো সেও পৌঁছে দেওয়ার বাহানায় দুয়েকটা বাক্য বিনিময়ের নানান কৌশল বের করতো কিন্তু আজ যেন পরিস্থিতিই থমকে গেছে। যার সাথে কথা বলার বাহানা খুঁজতো সে, আজ তাকেই এড়িয়ে চলতে চাইছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুবহার দিকে এগোলো সে। এখন সুবহাকে বোঝাতে হবে তার।
-সুবহা, একটু শোন তো।
-বলো ভাইয়া।
-একটু ছাদে চল তো, এখানে বলার মতো সিচ্যুয়েশন নেই।
-চলো।
সুবহা ওঠার চেষ্টা করতেই নিজেকে সামলাইতে পারলো না। দুর্বল শরীর, কান্নাকাটি করে আরো নিস্তেজ হয়ে পড়েছে সে। উঠে দাঁড়াতেই মাথা ঘুরে উঠলো। পড়তে গিয়েও পড়লো না সিয়ামের আগলে নেওয়াতে।
“ঠিক আছি আমি।” সুবহা নিশ্চয়তা দিলেও সিয়াম ছাড়লো না। আলতো হাতে সুবহাকে ধরে ধরেই সিঁড়ি বেয়ে উঠলো। হাসপাতালের ছাদের পরিবেশ থমথমে। আজ আকাশটাও মেঘলা। কিছুক্ষণ পর পর বৃষ্টি হচ্ছে। শীতে এমন টুপটাপ বৃষ্টি খুব একটা হয়না তবে হিমশীতল বাতাসের স্পর্শে সুবহা খানিকটা কুঁকড়ে ফেলল নিজেকে।
-কিছু বলবে ভাইয়া?
-হুম।
-আমারো কিছু কথা বলতে ইচ্ছে করছে। আমি কাউকে বলতে পারছি না। আমি একদম পাথর হয়ে যাচ্ছি ভেতর থেকে। আমার কথা একটু শুনবে?
-বল।
-বা..বাবার এ অবস্থার জন্য আমি দায়ী। আমি যদি বাবাকে কথাগুলো না বলতাম, বাবা আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতো না। এসব কিছু হতো না।
-কী কথা? কী বলছিস তুই?
-গত রবিবার আমি একা ফিরছিলাম কলেজ থেকে। কলেজের মূল রাস্তা পার হতেই কয়েকটা ছেলে আমাকে ঘিরে ধরে আমার মুখে পানি ছুঁড়ে মারে এবং বলে পরেরবার এসিড মারবে। আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমি সোজা গিয়ে বাবাকে সব বলে দিই। এ কারণেই বাবার এ অবস্থা।
কথাগুলো বলতে বলতে সুবহার চোখ ভিজে উঠলো, অবারিত অশ্রুধারা গুলো সুবহার গাল বেয়ে গড়াতে লাগলো। কান্না করতে করতে সিয়ামের বুকে ঢলে পড়লো সুবহা। সিয়াম এবার শক্ত করেই সুবহাকে জড়িয়ে ধরলো। প্রথমবারের মতো সিয়ামের মনে হলো মেয়েটার তাকে প্রয়োজন, খুব প্রয়োজন।
_________
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিল চিত্রলেখা। বৃষ্টির কারণে এখন গাড়ি পাওয়া একটু মুশকিল। আচমকা একটা রিকশা এসে থামলো চিত্রলেখার সামনে। চিত্রলেখা মাথা তুলে তাকাতেই দেখতে পেল রঙ্গনের হাস্যোজ্জল মুখখানা।
-এখন গাড়ি পাবেনা, এসো আমিই পৌঁছে দিই।
-আমি যেতে পারবো, আপনি যান।
রঙ্গন আর কিছু বললো না। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে রিকশাওয়ালাকে বিদায় করলো। চিত্রলেখা রঙ্গনের কাজের কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না।
-মানুষ চাক বা না চাক, আল্লাহ চাইলে সাক্ষাৎ তিনি করায়েই দেন।
-আপনার মনে হয়না আপনি ফিল্মি ডায়লগ মারতেছেন?
-আমরা তো বন্ধু ছিলাম, হঠাৎ এত রুক্ষ ব্যবহার! আচ্ছা আমি স্যরি, আমিই একটু বেশি পাগল টাইপের তো। এহ শোনো, আজ তো ভালোই বৃষ্টি হচ্ছে। তোমার ঘণ্টা তিনেক সময় হবে?
-কেন?
-ঐ সুন্দর জায়গাটা বৃষ্টির সময় আরো সুন্দর হয়। ‘আমার আশিয়ানা’ টা।
-অন্য কোনোদিন। আজ আমার এক ফ্রেন্ডের বাবা অসুস্থ, তাকে দেখতে এসেছিলাম।
-চিত্রলেখার তবে আজ মন খারাপ। আচ্ছা চলো আজকে অন্য একটা জায়গায় নিয়ে যাবো। একটু সময় হবে কি? অতি সামান্য?
-আপনি এত জেদী কেন? মাত্র ত্রিশ মিনিট, এর বেশি না।
-যথা আজ্ঞা রানীসাহেবা। আসুন এখন রিকশা খুঁজতেই না ত্রিশ মিনিট পেরিয়ে যায়। এসো রাস্তা পেরোতে হবে।
আনমনেই চিত্রলেখার হাতটা ধরে দুপাশে তাকিয়ে সামনে এগোলো রঙ্গন। চিত্রলেখা অবাক বিস্ময়ে আবদ্ধ হাতজোড়া আর রঙ্গনের দিকে তাকিয়ে রইলো। ছেলেটাকে প্রথম দেখাতে যথেষ্ট ম্যাচিউর ভেবেছিল সে। এ তো অহমের চেয়েও ছোট বাচ্চা।
__________
-মামা যাবেন?
-কোথায় যাবেন?
-সামনের রাস্তার মোড়ে যে ‘আরশিনগর’ আশ্রম আছে সেখানে। কত নিবেন?
-বৃষ্টির দিন, কী আর বলবো মামা! চল্লিশ দিয়েন।
-আচ্ছা ঠিক আছে। চিত্রলেখা উঠো।
চিত্রলেখা খানিকটা বাঁকা চোখে তাকিয়ে আছে। সামনের রাস্তার মোড় হেঁটে গেলে মাত্র দশ মিনিট লাগবে। সেখানে এই ছেলে চল্লিশ টাকা দিয়ে রিকশা ঠিক করলো? আল্লাহ যখন জ্ঞানবুদ্ধি বিতরণ করতেছিল, তখন এ নিশ্চিত ভিডিও গেম খেলতেছিল! অবশ্য কীসব ভাবছে চিত্রলেখা! রঙ্গন সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো ছেলে, তার কাছে টাকার কী-ই বা মূল্য।
“তুমি যা ভাবছো তা কিন্তু ঠিক না চিত্রলেখা।” ফিসফিসিয়ে চিত্রলেখার কানের কাছে বলে উঠলো রঙ্গন। চিত্রলেখার শরীর শিউরে উঠলো। এভাবে আচমকা কানের কাছে এসে বলায় তা শরীরে শীতল শিহরণ বয়ে গেল। চিত্রলেখা ফিসফিসিয়েই উত্তর দিল।
-কী ভাবছি আমি?
-এই যে আমি খুব টাকা ওড়ায়ে বেড়ায়, আসলে তা না। আশ্রমে আমরা হেঁটেও যেতে পারতাম। তবে এই বৃষ্টির মাঝে তোমাকে ভিজায়ে সর্দিজ্বরে ফালানোর চিন্তা আমার নাই। জিনিসটা দেখতে খুব এস্থেটিক লাগে তবে অসময়ের বৃষ্টি সেইফ না বুঝছো?
-হুম বুঝেছি।
-কী বুঝেছো?
চিত্রলেখা চুপ হয়ে গেল। অতঃপর এক অদ্ভুত মোহনীয় স্বরে বলে উঠলো,”অসময়ের বৃষ্টি সেইফ না।”
চলবে…
[পরীক্ষা শেষ, এখন থেকে নিয়মিত গল্প পাবেন। কালকে একটা বিশাল বড় পর্ব দিব, তাই আজকের পর্ব একটু ছোটই থাক। আর হ্যাঁ দোয়া করেন যাতে পরীক্ষায় পাশ করি :3]