চিত্রলেখার_কাব্য ঊনত্রিশতম_পর্ব ~মিহি

0
517

#চিত্রলেখার_কাব্য
ঊনত্রিশতম_পর্ব
~মিহি

রঙ্গনের অসহ্য লাগছে। কোনোভাবে নিজেকে স্থির করতে পারছে না। চিত্রলেখার সাথে কথা শেষ করে আসার পর থেকে সে নিজেকে শান্ত করতে পারতেছে না। নিজের মামা নামক পশুটার উপর যে ক্রোধ সে অনুভব করছে তা কোনোক্রমেই কমানো সম্ভব না। চিত্রলেখার বিষয়ে আপাতত বাড়িতে নতুন করে কথা তুলতে চাচ্ছে না সে তবে নওশাদকে সে শিক্ষা দিবেই। চট করে মাথায় একটা বুদ্ধি আসলো রঙ্গনের। এতে সে নওশাদকে শিক্ষাও দিতে পারবে আবার বাড়িতে কোনো ঝামেলাও হবে না। মনে মনে নিজের বুদ্ধির প্রশংসা করে নওশাদকে কল করলো রঙ্গন।

-হ্যালো মামা, কোথায় তুমি?

-বাড়িতে যাচ্ছি। বল কী হয়েছে।

-একা আছো?

-হ্যাঁ।

-আসলে একটা লোক আমাকে হুমকি দিচ্ছে। তুমি কি একটু আসতে পারবা?

-তোকে হুমকি দিচ্ছে? এত সাহস? আমার নাম বললেই তো কাজ হওয়ার কথা। তুই এড্রেসটা মেসেজ কর, আমি দশ মিনিটের মধ্যে যাচ্ছি। দেখি কত বড় সাহস!

-আচ্ছা মামা, থ্যাংকস।

কল কেটে রঙ্গন মুচকি হাসলো। মার্কেটের কাছাকাছিই আছে সে। চটজলদি একটা লোকাল দোকান থেকে একটা হুডি কিনে রাখলো। নওশাদকে যে পাশে ডেকেছে ঐ পাশটা অন্ধকার। তাছাড়া রঙ্গন বেশ ভালো করে দেখে রেখেছে, নওশাদ আসলে কী করতে হবে তা ইতোমধ্যে কণ্ঠস্থ করে ফেলেছে সে।

নওশাদের আসতে মিনিট পনেরো লাগলো। রঙ্গনের ফোনে টেক্সট করে আসার জানান দিল সে। রঙ্গন এই মুহুর্তের অপেক্ষায় ছিল এতক্ষণ। নিজের হাতে থাকা হুডিটা দিয়ে নওশাদের মুখের সামনের অংশ আষ্টেপৃষ্টে আবৃত করে ফেলল। অতঃপর কোনো শব্দ ছাড়া টানা পাঁচ মিনিট ধরে বেধড়ক মারতে থাকলো নওশাদকে। অন্ধকার তার উপর হুডির কারণে ঠিকমতো কিছু দেখতে না পায়ে ঘাসের উপর পড়ে থেকে কাঁতরাতে লাগলো নওশাদ। বেশ কিছুক্ষণ পর রঙ্গন নওশাদকে ছেড়ে ফেলে রেখে গেল। নওশাদ ধীরে ধীরে উঠে বসলো। মুখ থেকে হুডি সরাতেই রঙ্গনের কল আসলো।

-মামা কোথায় তুমি? এই লোকটা বলছে এ নাকি তোমায় ধরে মেরেছে। কী যা তা বলতেছে! তোমাকে কেউ মারতে পারে? এ বোধহয় গাঁজা খাইছে মামা। তুমি কোথায় বলো তো।

-ভাগ্নে, আ..আমি একটু কাজে আটকে পড়েছি। তুই বিষয়টা সর্ট আউট করে নে। আমি পরে দেখবো।

-আচ্ছা মামা। তাহলে তো তুমি আসোইনি আর এই রামছাগল বলছে তোমায় নাকি কুকুরের মতন মেরেছে আবার বলতেছে এসব নাকি সবাইকে বলে বেড়াবে। এইটাকে পরে ধোলাই দিও তো মামা।

নওশাদ কোনোরকম সম্মতি জানিয়ে ফোনটা কাটলো। রঙ্গন হাসতে হাসতে বাড়ির দিকে এগোলো। উচিত শিক্ষা দিতে পেরেছে। সাপও মরলো, লাঠিও ভাঙলো না। রঙ্গন বেশ খোশমেজাজেই বাড়িতে ফিরলো। তখন অবধি সে বুঝতে পারেনি তার জন্য কী অপেক্ষা করছে বাড়িতে। সে ভেবেছিল তার মামার বিশেষ কোনো ক্ষতি হয়নি কিন্তু রঙ্গন রাগের মাথায় যে আঘাতগুলো করেছে তা নওশাদের জন্য কাল হয়েই আসলো। নওশাদের ডান হাতের একটা হাড় ভেঙে গেছে এবং কপালের কাছে একটা গভীর ক্ষত হয়েছে। এসব রঙ্গন জানতে পারশো বাড়িতে ফেরার পর। রঙ্গনের বাবা মাশরুর আহমেদ তাকে জানালেন। নওশাদ তখনো স্বীকার করেনি মার খাওয়ার কথাটা, সে বলেছে এক্সিডেন্টের কারণে হয়েছে এসব। নওশাদের এ অবস্থা দেখে রঙ্গনের মোটেও খারাপ লাগছে না বরং না চাইতেও একটা আত্মতৃপ্তি তার চোখের চাহনিতে ফুটে উঠছে। মাশরুর সাহেব নওশাদকে দেখতে যাওয়ার কথা বলছিলেন রঙ্গনকে।

-রঙ্গন, আমাদের একবার নওশাদকে দেখতে যাওয়া উচিত। আশফিনার যে কী হয়েছে, যাবেনা বলছে। ভাইয়ের উপর কিসের এত রাগ বলতো যে এক্সিডেন্ট করেছে তবুও দেখতে যাবে না!

-মায়ের কথা থাক, আমরা যাবো চলো।

-হ্যাঁ ঠিক বলেছিস। চল আমরা বের হই।

রঙ্গন নিজের চোখে দেখতে চাইছিল নওশাদের যন্ত্রণা। এখন সে সুযোগটাই সে হাতের নাগালে পেয়েছে তবে সুযোগটা লুফে নিতে দ্বিধা কোথায়?

সুযোগটা লুফে নেওয়ার সৌভাগ্য রঙ্গনের হলো না। আশফিনা আহমেদের কড়া স্বরে তাকে মলিন মুখে যেতে হলো উপরের ঘরের দিকে। অগ্নিচোখে তিনি বাড়ির সকলকে নিষেধ করলেন নওশাদের সাথে দেখা করতে যেতে। রঙ্গন এসবে বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখালেও তার চোখজোড়া উজ্জ্বল বর্ণ ধারণ করেছে। তৃপ্তি তার চোখে ভাস্যমান। আশফিনা আহমেদের মুখোমুখি দাঁড়ালো সে। আজ যদি তার মা তাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তবুও সে সবটা সত্যিই বলবে। সে ভুল নয়, মিথ্যা বলার প্রয়োজন তার নেই।

-নওশাদকে তুমি মেরেছো?

আশফিনা আহমেদের প্রথম প্রশ্নেই ভড়কে গেল রঙ্গন। সে কখনোই ভাবেনি তার মা তাকে সরাসরি এ প্রশ্ন করবে। করার কথাও নয়।

-হ্যাঁ আমি মেরেছি।

-তাহলে চিত্রলেখা তোমায় বলেছে সেদিনের কথা। যা হয়েছে সেটা নিয়ে নতুন করে ঝামেলা করার দরকার ছিল রঙ্গন? নওশাদের ক্ষমতা সম্পর্কে তোমার ধারণা আছে? আঘাতটা যখন চিত্রলেখার উপর গিয়ে পড়বে তখন? কিভাবে আটকাবে তুমি?

-চিত্রলেখাকে বাঁচানোর জন্য আমি আছি সবসময় মা।

-অধিকার কী তোমার ওকে বাঁচানোর? ও কি তোমায় ভালোবাসে? ও বলেছে তোমায়? বাড়াবাড়ি করো না রঙ্গন। চিত্রলেখার জন্য আমি আমার ভাইয়ের সাথে কথা বলা বন্ধ করেছি। কিন্তু তুমি যা করছো সেটা পাগলামি। চিত্রলেখাকে বাঁচাতে গিয়ে ওর ক্ষতি করে বসো না।

-মা আমি ওকে বিয়ে করতে চাই।

-চিত্রলেখা একবারো বলেছে সে তোমাকে ভালোবাসে?

-সব কথা মুখে বলতে হয় না, মা। আমি অনুভব করতে পারি। তুমি শুধু একবার ওর পরিবারের সাথে কথা বলো, চিত্রলেখা যদি রাজি না থাকে আমি কোনদিন আর এই বিষয় নিয়ে তোমার সাথে কথা বলতে আসবো না।

-কথা আমি বলবো তবে আগে চিত্রলেখার সাথে। চিত্রলেখা যদি রাজি থাকে তবেই ওর পরিবারের কাছে যাবো আমি।

রঙ্গন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলো না। সে কি ভুল শুনলো নাকি তার মা সত্যিই তার বিষয়টা বুঝতে পেরেছে?

-মা সত্যি?

-হুম। এটা নিয়ে এখন লাফিয়ো না, চুপচাপ নিজের ঘরে যাও আর চিত্রলেখাকে এসব এখনি বলতে হবে না। আমি কাল ওর সাথে দেখা করতে যাবো ওর কলেজে।

রঙ্গন মাথা নেড়ে নিজের ঘরের দিকে এগোলো। আশফিনা আহমেদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। আলমারির লকার থেকে একটা অ্যালবাম বের করলেন তিনি। অ্যালবামটা রঙ্গনের ছোটবেলার। রঙ্গনের নানান রকম বয়সের ছবি শোভা পাচ্ছে সেখানে তবে প্রথম ছবিটা থেকে চোখ সরাতে পারছেন না আশফিনা আহমেদ। চিরপরিচিত রাস্তাটা, রঙ্গনের হাসিমুখ। আশফিনা আহমেদের চোখের কোণে জল আসে। বহুদিন আগলে রেখেছেন সবকিছু তিনি। কখনো এসব স্মৃতিবিজড়িত হয়ে কথা বলেননি। তবে কাল বলতে হবে। চিত্রলেখাকে মিথ্যে বলার কোনো কারণ তার কাজে নেই। সত্যিটা বললে হয়তো চিত্রলেখা নিজেই রঙ্গনকে অপছন্দের করা শুরু করবে। এতে পরোক্ষ আশফিনা আহমেদের কাজ হয়ে যাবে। তিনি মরে গেলেও চিত্রলেখাকে মানতে পারবেন না। এখন যা করার কালকেই করবেন তিনি। অ্যালবামটা বেশ যত্নে রাখা। প্রথম ছবিটা এখনো বের করা। রঙ্গনকে কোলে নিয়ে কান্না করছেন আশফিনা আহমেদ। পরের ছবিটাতে দেখা যাচ্ছে রঙ্গনের গালে চুমু খেয়ে তাকে কোলের মধ্যে আড়াল করছেন। ছবিগুলো রঙ্গনের প্রথম ছবি, চিরচেনা একটা রাস্তার পাশে তোলা। এই দুইটা ছবি আশফিনা আহমেদের মনের খুব কাছের। এ ছবি দুটো তিনি রঙ্গনকেও দেখাননি কখনো। পাছে যদি রঙ্গন কিছু একটা আন্দাজ করে দূরে চলে যায় এ ভয় তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। রঙ্গনকে তিনি যতটা যত্নে বড় করে তুলেছেন, তার প্রতিদানে রঙ্গন নিশ্চয়ই তাকে একা ফেলে যাবে না! আর তা নিশ্চিত করতেই আশফিনা আহমেদ নিজের পছন্দের কোনো মেয়ের সাথেই রঙ্গনের বিয়ে দিবেন যেটা চিত্রলেখা কখনোই নয়, ভুলক্রমেও না!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here