চিত্রলেখার_কাব্য তেত্রিশতম_পর্ব ~মিহি

0
514

#চিত্রলেখার_কাব্য
তেত্রিশতম_পর্ব
~মিহি

চিত্রলেখা এবং সঞ্চারী মাথা নিচু করে প্রিন্সিপাল ম্যামের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অহনা বাড়িতে চলে যাওয়ায় সে আপাতত নিরাপদে আছে। প্রিন্সিপাল আঞ্জুমান নাহার দুজনের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছেন। চিত্রলেখার চোখেমুখে ভয়ের ছাপ। তিনি চিত্রলেখাকে বাইরে যেতে বললেন। চিত্রলেখা দ্রুত পায়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালো। ভয়ে তার হাত পা ক্রমাগত কাঁপছে। গতকাল রাতে তাদের রুমে কোনো একটা ছেলে ঢুকেছিল। চিত্রলেখা তখন গভীর ঘুমে। আচমকা দারোয়ানের চেঁচামেচি শুনে সে এবং সঞ্চারী বাইরে গিয়ে দেখলো দারোয়ান একটা ছেলেকে আষ্টেপৃষ্টে ধরে আছে কিন্তু বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারলো না। ছেলেটা একদৌড়ে দেয়াল টপকে অপর পাশে চলে গেল। দারোয়ান নাকি দেখেছে ছেলেটা তাদের ঘর থেকেই বেরিয়েছে। হোস্টেল ইনচার্জ বিষয়টা প্রিন্সিপাল ম্যামকে জানিয়েছেন। চিত্রলেখা বুঝে উঠতে পারছে না ছেলেটা রঙ্গন কিনা। গত রাত থেকেই রঙ্গনের নম্বর বন্ধ। এ ঘটনার পর থেকে চিত্রলেখা বেশ কয়েকবার রঙ্গনের নম্বরে কল দিয়েছে। চিত্রলেখা না চাইলেও তার মুখে ভয় ফুটে উঠছে। যদি ছেলেটা রঙ্গন হয়ে থাকে তবে চিত্রলেখার জন্য মহাবিপদ অপেক্ষা করছে।

-সঞ্চারী, গতকাল রাতে কী ঘটেছিল?

-ম্যাম, আমি ঘুমিয়েছিলাম। দারোয়ান চাচার চিৎকারে ঘুম ভেঙেছে। আমি উঠার পর লেখাকে দরজার কাছে দাঁড়াতে দেখে ওর কাছে যাই। বারান্দায় এসে দুজন দেখি দারোয়ান চাচার হাত থেকে একটা ছেলে দৌড়ে পালালো।

-তোমার কী মনে হয় লেখা ছেলেটাকে চিনতো?

-হয়তো ম্যাম। আগেও একটা ছেলে লেখার জন্য হোস্টেলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল রাতে। তাছাড়া গতকালকেও ওকে একটা ছেলে নামিয়ে দিয়ে গেছে ম্যাম।

-আচ্ছা তুমি যাও। আমি লেখার সাথে কথা বলবো।

সঞ্চারী বের হয়ে চিত্রলেখার পাশে দাঁড়ালো। চিত্রলেখা তখন দাঁত দিয়ে নখ কামড়াচ্ছে। রঙ্গনকে নিয়ে চিত্রলেখার ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক। তবে চিত্রলেখার মন বলছে রঙ্গন আসেনি সে রাতে। রঙ্গন আসলে অন্তত তাকে জানাতো একবার। তবে কে এসেছিল? ভাবতে ভাবতেই প্রিন্সিপালের কেবিন থেকে ডাক পড়লো চিত্রলেখার। চিত্রলেখা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো।

-চিত্রলেখা বসো। তোমার সাথে কথা বলাটা দরকার এখন। হোস্টেলের কিছু নিয়ম নীতি রয়েছে। তুমি একটা স্বনামধন্য কলেজের শিক্ষার্থী। এ ধরনের আচরণ তোমার বেলায় শোভা পায়না। কল ইওর গার্ডিয়ান রাইট নাও।

-ম্যাম আমি কিছু জানিনা। আমি সত্যিই জানিনা ছেলেটা কে এবং কোথায় থেকে এসেছিল।

-সেই আলাপটা আমি তোমার অভিভাবকের সাথে করবো। তোমাকে যে বিকালে একটা ছেলে নামিয়ে দিয়ে গেছে এটা নিশ্চয়ই তোমার পরিবার এখনো জানেনা? একটা ছেলে তোমার জন্য হোস্টেলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে তা জানে তো?

-ম্যাম, এসব…এসব…

-মিথ্যা বলার প্রয়োজন নেই। যাও বাইরে যাও। তোমার অভিভাবক আসুক, আমি তার সাথেই কথা বলবো। আমিই তোমার অভিভাবককে জানাচ্ছি।

চিত্রলেখাকে আর কিছু বলার সুযোগ দেওয়া হলো না। চিত্রলেখা বুঝতে পারলো না রঙ্গনের হোস্টেলের বাইরে দাঁড়ানোর কথা ম্যামের কানে গেল কী করে। এ কথা তো সঞ্চারী ছাড়া কেউ জানে না। তবে কি সঞ্চারী?

-সঞ্চারী? তুই কেন করলি এসব? রঙ্গন আসেনি রাতে! কে এসেছিল?

-আমি কীভাবে জানবো? তোর কোন প্রেমিক এসেছিল তুই জানিস!

-ছিঃ সঞ্চারী! তুই এতটা খারাপ হতে পারিস আমি ভাবতেও পারিনি। তুই এভাবে আমাকে কেন ফাঁসালি?

-তো নিজে ফাঁসতাম? অভিক এসেছিল আমাকে বার্থডে উইশ করতে। গাধার মাথায় তো বুদ্ধি নাই-ই। দেখ আমার নিজেকে বাঁচাতে হতো। এখন তুই কী করবি দেখ।

-তোকে আমি ভালো বন্ধু ভেবেছিলাম সঞ্চারী!

-আমি বলেছিলাম ভাবতে?

চিত্রলেখা কোনো উত্তর দিতে পারলো না। এত বড় অপবাদ থেকে কিভাবে এখন নিজেকে বাঁচাবে সে? সঞ্চারীর মুখ দেখে মনে হচ্ছে না সে মরে গেলেও নিজের দোষ স্বীকার করবে! চিত্রলেখার প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে। সে এতটা দুর্বল কেন? পরিস্থিতিগুলো সবসময় তারই বিপরীতে কেন যায়? অর্ণবের কানে গেলে চিত্রলেখা কী করবে? সে কিভাবে নিজেকে সঠিক প্রমাণ করবে?

____________________________

-মি.অর্ণব, আপনার বোনের সম্পর্কে যা যা শুনেছিলাম সব তো বললাম। বয়সটা তো ভালো নয়। এখন বরং ওকে কিছুদিন বাড়িতেই রাখুন। হোস্টেলের রুলস আমরা অমান্য করাটা উপেক্ষা করতে পারিনা। নেহাতই ও ভালো স্টুডেন্ট নাহলে হয়তো কলেজ থেকেও সাসপেন্ড করতাম। ওকে বাড়িতে নিয়ে যান।

-আচ্ছা ম্যাম। যা হয়েছে তার জন্য আমি দুঃখিত।

-সমস্যা নেই, ওকে ভালোমতো বোঝান। অল্প বয়স তো, ভুলের দিকে যেতে সময় লাগেনা। আপনি আসতে পারেন। ধন্যবাদ।

-ধন্যবাদ ম্যাম আপনাকেও।

অর্ণব আঞ্জুমান নাহারের সাথে কথা বলে বাইরে গেল। চিত্রলেখার জিনিসপত্র গোছানোই ছিল। হোস্টেল ছাড়ার নোটিশ সে আগেই পেয়েছে। সঞ্চারী তার সামনে আসেনি আর। চিত্রলেখার ইচ্ছে করছিল সঞ্চারীকে কষে একটা চড় বসিয়ে দিতে। এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা একজন মানুষ কী করে করতে পারে? চিত্রলেখা কতটা বিশ্বাস করেছিল তাকে!

“চল!” অর্ণবের কণ্ঠে অভিমানের রেশ স্পষ্ট টের পেল চিত্রলেখা। চোখের জল বাঁধ মানতে চাইলো না তার। তবুও নিজেকে সামলে অর্ণবের পিছু পিছু চললো। তার এখন কিছুই করার নেই।

বাড়িতে পৌঁছে অর্ণব চিত্রলেখাকে নিজের ঘরে যেতে বললো। কলেজের ঘটনা কাউকে জানালো না অর্ণব। চিত্রলেখা একটা ভুল করে ফেলেছে, কথা বাড়ালে সে ভুল তো আর শুধরাবে না। অর্ণবের প্রচণ্ড রাগ হলেও সে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে।

চিত্রলেখাকে জিনিসপত্র সহ ঘরে ঢুকতে দেখল অপর্ণাও। চিত্রলেখার আচমকা ফিরে আসা তার মনে খটকার সৃষ্টি করলো। চিত্রলেখাকে তার মা যেভাবে বলেছিল তাতে চিত্রলেখার তো হোস্টেল থেকে ফেরার কথা নয়। নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে। অর্ণবও কিছু বলছে না। অপর্ণা ঠিক করলো চিত্রলেখার হোস্টেলে খোঁজ নিবে সময় করে। আপাতত চিত্রলেখার গতিবিধির উপর নজর রাখতে হবে।

চিত্রলেখা ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র বিছানার উপর রেখে মেঝেতে বসে পড়লো। এতক্ষণের জমে থাকা কষ্টগুলো কান্না হয়ে ঝরছে অনবরত। আচমকা মাথায় কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে চিত্রলেখা মাথা তুললো। চোখ লাল হয়ে এসেছে তার। চিত্রলেখার এ রূপ সাথীর মনে ভয় ধরালো। এভাবে কাঁদছে কেন মেয়েটা? কী হয়েছে ওর?

-তুই এভাবে কাঁদছিস কেন লেখা? আর সব জিনিসপত্র নিয়ে এসেছিস মানে তুই একেবারে বাড়িতে চলে এসেছিস! কাঁদছিস কেন তবে?

-ভাবী! আমার সাথেই কেন এমন হয় ভাবী? আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছে আল্লাহ? আর কত? আমি আর পারছি না ভাবী! আমার মৃত্যু হয়না কেন?

সাথী চিত্রলেখার ঠোঁটে হাত চাপা দিল। এসব কথা কেন বলছে মেয়েটা? সাথী কিছুই বুঝতে পারছে না কী হয়েছে। চিত্রলেখাকে কোনোরকমে শান্ত করার চেষ্টা করলো সে। কাঁদতে কাঁদতে গলা বসে গেছে চিত্রলেখার। সাথীর স্নেহময়ী হাতের স্পর্শে চিত্রলেখার ক্ষত খানিকটা কমলো। চিত্রলেখা ফোঁপাতে ফোঁপাতে সবটা বললো। কলেজে কী কী হয়েছে আর সঞ্চারীর করা কাজটাও বললো সে। সাথী কী করবে বুঝতে না পেরে চিত্রলেখাকে বুকের সাথে লাগিয়ে সান্ত্বনা দিতে লাগলো। মেয়েটার জীবনে দুঃখগুলো শেষ হয়না কেন? এতটুকু বাচ্চা মেয়ে, তার জীবনে কেন এত কষ্ট বারেবারে ফিরে আসে? মায়ের মতো ভাগ্য নিয়ে জন্মেছে মেয়েটা! হাহুতাশ করে সাথী।

দরজার আড়ালে থাকাটা লাভজনক হলো অপর্ণার। ঘটনাটা ঠিকই জানতে পারলো। এতে অবশ্য তার লাভটাই বেশি হয়েছে। এ ঘটনাটা ঘুরিয়ে প্যাঁচায়ে এলাকায় ছড়াতে পারলেই তার এবং নওশাদের পথে আর কোনো বাধা থাকবে না। অপর্ণার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। চিত্রলেখাকে পথ থেকে সরানোর এর থেকে ভালো উপায় সে আর কখনো পাবে না। অপর্ণা ঠোঁটের হাসিটা লুকিয়ে একটা বাটি হাতে করে পাশের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। পাশের বাড়িতে এক মধ্যবয়সী মহিলা থাকেন। রমনা নাম। মহিলার কাজই হচ্ছে এর বাড়ির খবর ওর বাড়িতে পৌঁছানো। নিকট ভবিষ্যতে কী হতে চলেছে তা স্পষ্ট দেখতে পারছে অপর্ণা। এখন আপাতত রমনাকে টোপটা গেলালেই তার কার্য সম্পন্ন!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here