#চিত্রলেখার_কাব্য
আটত্রিশতম_পর্ব
~মিহি
______________________
-লেখা তুই অযথা চিন্তা করছিস! তোর পরীক্ষা যথেষ্ট ভালো হয়েছে, তুই এডমিশনের প্রিপারেশনে মন দে।
-আমি পারছিনা ভাবী। সব কেমন এলোমেলো লাগছে। নওশাদ লোকটা আমার পরীক্ষার সময়টুকুতে এত ঝামেলা করবে আমি ভুলেও ভাবিনি। বিশ্বাস করো ভাবী এক্সাম হলে যতবার আমায় হ্যারাস করা হয়েছে তার হিসেব করে আমি শেষ করতে পারবো না। ঐ লোকটার শাস্তি না হওয়া অবধি আমি কিভাবে ভালো থাকবো বলো। মেডিকেল আমার স্বপ্নের চেয়েও দামি কিছু, যেখানে আমি আমার ভালোবাসাকেও উপেক্ষা করেছি সেখানে ঐ লোকটা কেন আমার সাথে এমন করলো?
-দেখ, ক্ষমতা ব্যবহার করে আর কতদূরই বা যাবে! তাছাড়া এইচএসসির খাতা তো আর ঐ লোক দেখতেছে না। তোর না ক্লাস ছিল আজ বিকালে? আমি রেখে আসবো?
-ক্লাস অনলাইনে নিবে আজ, জানানো হয়েছে।
-রঙ্গনের সাথে কথা হয়েছে তোর? দশদিন হলো ঢাকায় এসেছিস, ওকে একবার জানানো উচিত না?
-চার মাস ধরে কথাই হয়নি আমাদের আর তো জানানো। ওর সাথে একদিন কথা বললে পরের এক সপ্তাহ আমার আর পড়ায় মন বসে না ভাবী! তোমার এই ফুপাতো ভাইটা এমন কেন বলো তো।
-উহুম উহুম…প্রেম জমে ক্ষীর?
-ধূর! যাও তো তুমি। খালি কেমন কেমন করো!
-আচ্ছা স্যরি। অর্ণব ভাইয়া তোকে রেখে যাওয়ার পর থেকেই দেখতেছি তোর মন খারাপ। বাদ দে তো আমার চাচার কথা। ঐ লোকটা মানুষের কাতারেই পড়ে না।
-এত সহজে তো ছাড়বো না ভাবী। ওনার শাস্তির ব্যবস্থা না করে আমি এসেছি ভেবেছো? সময় আসলেই বুঝতে পারবে।
-আচ্ছা বুঝেছি। ফালুদা বানাবো ভাবছি। তুই বসে থেকে পড়, আমি বানিয়ে আনছি।
সাথী চলে যেতেই চিত্রলেখার মন আবারো খারাপ হয়ে গেল। ঢাকা শহর তার মোটেও ভালো লাগছে না। কেমন যেন দম বন্ধ করা শহর। সেই পরীক্ষার আগে একবার সুবহার সাথে কথা হয়েছিল, তারপর থেকে তারও খোঁজ নেই। রঙ্গনকে তো কল করারই সাহস পায়নি চিত্রলেখা। আগের কলের লজ্জা কাটিয়ে উঠতেই বোধহয় তার বছর দেড়েক লাগবে আরো।
চিত্রলেখা চোখ বন্ধ করলেই নওশাদ লোকটার কুৎসিত চেহারা ভেসে উঠে। এমন একটা পরীক্ষা যায়নি যেখানে পরীক্ষার হলে তার পাঠানো লোক এসে চিত্রলেখাকে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে এক্সপেল করার চেষ্টা করেনি! একমাত্র সে-ই জানে কোন যুদ্ধে সে নেমেছে। নওশাদকে তো সে ছাড়ার পাত্রী মোটেও নয়। নিজের শহর ছাড়ার আগেই সে সব বন্দোবস্ত করে এসেছে, এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। সময় জিনিসটাই ইদানিং চিত্রলেখার সাথে শত্রুতায় মেতে উঠেছে। মেডিকেল পরীক্ষার সময় আর কয়েক মাস মাত্র। আগামী চল্লিশ দিনের মধ্যে বোর্ডের রেজাল্ট আসবে। তার এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে মেডিকেল এক্সাম হবে। সরকারের সিদ্ধান্তে নাখোশ হয়েও লাভ নেই। চিত্রলেখা জানে সে এক অভাগা ব্যাচের স্টুডেন্ট। এখন সময়কে দোষারোপ না করে তাকেই যথাসাধ্য প্রস্তুতি নিতে হবে।
অনলাইন ক্লাস করতে বসে আজ খানিকটা বিরক্ত হলো চিত্রলেখা। আজকে এক নতুন টিচার ক্লাস নিচ্ছে। ফিজিক্সের ক্লাস চলছে, বুয়েটিয়ান টিচার সম্ভবত তবে তার কথাবার্তার মাঝে চিত্রলেখার অদ্ভুত একটা অস্বস্তির রেশ রয়ে যাচ্ছে। চিত্রলেখা ক্লাস না করেই ডিসকানেক্ট করে বেরিয়ে এলো। তৎক্ষণাৎ মনে হলো ভুল করে ফেলেছে। মাঝ ক্লাস থেকে লিভ নিলে ব্যাপারটা আরো বেশি দৃষ্টিগোচর হবে আর কোচিং থেকে এলার্ট আসবে এটার। চিত্রলেখা নিজের কাজের উপরই বিরক্ত হলো। পরিকল্পিত সবকিছু যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফালুদা খেতে খেতে আবার বই হাতে নিল সে।
__________________________
-করতেছে টা কী এখন?
-পড়া ছাড়া তার আর কোনো কাজ আছে?
-তোমার ননদ পড়তে পড়তে পাগল হয়ে যাবে আপা, আমি বিয়ের আগেই বউহারা হতে চাই না!
-রঙ্গন! তুমি এখনো বাচ্চাই আছো, আচ্ছা শোনো।
-কী?
-সামনের সপ্তাহের রবিবার কী বলো তো।
-রবিবার!
-গাধা! ঐদিন তোমার প্রেমিকার জন্মদিন।
-কী! অবশ্য তোমাদের কৃপায় যতসময় পাইছি প্রেম করার, তাতে জন্মদিন জানবো ভাবলা কেমনে? সব খাটাশ তোমরা!
-বেয়াদব, বড় আপার সাথে এইভাবে কথা বলে?
-আচ্ছা স্যরি। সামনের সপ্তাহে জন্মদিন তো! আচ্ছা ঠিক আছে। আমার সাথে প্রথম জন্মদিনটা সেরা জন্মদিন হবে রঙ্গনার।
-আয়হায়!
-আহা আপা, লজ্জা দিও না। আমি রাখছি, তোমার ননদকে একটু কম পড়তে বলো। ডিএমসির সব সীট কি একাই দখল করতে চায়?
-গুণী-জ্ঞানী বউ পাচ্ছো, শুকরিয়া আদায় করতে শিখো ছেলে।
-আলহামদুলিল্লাহ। এখন তুমি একটু আমার বউয়ের খেয়াল রাখো আপা, আমি পরে কথা বলবো।
-আচ্ছা আল্লাহ হাফেজ।
সাথী কল কেটে দিয়ে হাসতে থাকলো। অবশেষে চিত্রলেখার জীবনে একটুখানি সুখের আভাস তো পাওয়া যাচ্ছে! রঙ্গন ছেলেটা মারাত্মক ভালোবাসে চিত্রলেখাকে। মানুষ আর কী-ই বা চায় জীবনে? চিত্রলেখা তো সারাজীবন একটুখানি ভালোবাসাই চেয়েছিল, একটুখানি নিখাদ ভালোবাসা। সাথী মুচকি হাসতে হাসতে চিত্রলেখার ঘরের দিকে এগোলো। সারাদিন ধরে পড়ছে মেয়েটা! ঠিকমতো একটু গল্পও তো করা দরকার।
-এই লেখা, ফালুদা শেষ করেছিস?
-হুম ভাবী, অনেক সুন্দর বানিয়েছো।
-তোর তো ক্লাস ছিল এখন, করলি না যে?
-আর বলো না ভাবী, আজ যে স্যারটা ক্লাস নিতে এসেছিল কেমন জানি করে কথা বলে। মানলাম স্যার ইয়াং, হয়তো আমাদের চেয়ে বড়জোর বছর তিনেকের বড় কিন্তু স্যার তো! তার কথাবার্তা যদি অতিরিক্ত ফ্র্যান্ক হয়, সেটা দৃষ্টিকটু না?
-হুম। তোদের সময়টা বড্ড অদ্ভুত রে। এখন শিক্ষক হতে খুব বেশি নীতিবান হতে হয়না। তাই শিক্ষকরাও নিজেদের সম্মানের জায়গাটা ধরে রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না। তোদের জেনারেশনে তাল মিলাতে গিয়ে তারা নিজেদের সম্মান খুইয়ে ফেলছে।
-ভালোই বলেছো ভাবী।
মিনিট বিশেক গল্প করলো চিত্রলেখা। মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মনে হচ্ছে অনেকটা ক্লান্তি যেন দূর হলো। এখন একটু ঘুমিয়ে শেষরাতে উঠে আবার পড়তে হবে। ঘুমোনোর জন্য টেবিল থেকে উঠতেই ফোনের মেসেজ টোন বেজে উঠলো। চিত্রলেখা বিরক্তিতে চ’কারান্ত শব্দ উচ্চারণ করলো। ঘুমোতে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে ফোন বেজে উঠার মতো কর্কশ কাকের ডাকও নয়! চিত্রলেখার মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে ফোনটাকে ব্লেন্ডারে ঢুকিয়ে একদম গুড়ো গুড়ো করে ফেলতে। প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে ফোনটা হাতে নিলো সে। চিত্রলেখা ফোনে হোয়াটসঅ্যাপ ছাড়া কিছুই রাখেনি। হোয়াটসঅ্যাপেই এসেছে মেসেজটা। মেসেজ ওপেন করলো সে।
“আসসালামু আলাইকুম আপু। তুমি আজকে আমার ক্লাসটা করোনি। কোনো অসুবিধা? আসলে আমি স্টুডেন্টদের সাথে খুব বেশি ফ্রি। কোনো সমস্যা থাকলে দয়া করে আমাকে জানিয়ো।”
মেসেজটা পড়ে চিত্রলেখার মাঝে বিশেষ কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না তবে চিত্রলেখা বুঝতে পারলো সে বোধহয় অযথাই ভুল বুঝেছিল লোকটাকে। চিত্রলেখা নাম মনে করার চেষ্টা করলো স্যারটার। বোধহয় আহাদ নাম। চিত্রলেখা বুঝতে পারলো না রিপ্লাই করবে কি করবে না। আর রিপ্লাই করলেই বা কি রিপ্লাই করবে! বাড়তি ভাবনাচিন্তা এবং ফোন উভয়ই রেখে চিত্রলেখা ঘুমিয়ে পড়লো। পরেরদিন সকাল নয়টায় ক্লাস আছে কোচিংয়ে।
________________
নয়টার ক্লাসের কথা ভেবে সাড়ে আটটায় বেরিয়েছিল চিত্রলেখা কিন্তু ঢাকার জ্যাম তাকে ঠিকই দশ মিনিট লেইট করালো। প্রথমে আবার সেই আহাদ স্যারের ক্লাস! দশ মিনিট পর ক্লাসে ঢোকার পারমিশন চাইছে সে। কত জোড়া চোখ যে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়েছে তা অনুভবও করতে চায় না সে। আহাদ বিশেষ কোনো বাক্য উচ্চারণ না করে কেবল নাম জিজ্ঞাসা করে তাকে ভেতরে আসার অনুমতি দিল। চিত্রলেখার নাম বলতেও খানিকটা সংকোচবোধ হচ্ছিল। যে বিষয় থেকে মানুষ পালিয়ে বেড়াতে চায়, তা-ই যেন বারবার মূর্তির মতো সামনে এসে উপস্থিত হয়। চিত্রলেখা আহাদকে যত বেশি উপেক্ষা করতে চেয়েছিল ঠিক ততটাই তার চক্ষুর সম্মুখে আসতে বাধ্য হচ্ছে চিত্রলেখা।
চলবে…
[আহাদকে নায়ক ভাবার ভুল করবেন না আগেই জানায়ে রাখলাম :)]