#চিত্রলেখার_কাব্য
ঊনচল্লিশতম_পর্ব
~মিহি
অপর্ণা ইদানিং ঘর থেকে মোটেও বের হয়না তবে আজ রাদিফের পরীক্ষার খাতা দেখাবে, গার্ডিয়ান ছাড়া যাওয়া যাবে না। বাধ্য হয়েই অপর্ণা গায়ে কালো বোরকা জড়িয়ে রাদিফের স্কুলের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে। মিনিট পনেরো লাগবে যেতে। রিকশা নিল অপর্ণা। কিছুসময় সব ঠিকঠাক থাকলেও একটু পর অপর্ণা লক্ষ করলো দুইটা বাইক তাকে দুইপাশ থেকে ফলো করছে। অচিরেই তার মনে ভয় ধরলো। না জানি কোন বিপদ অপেক্ষা করে আছে তার জন্য! অপর্ণা রিকশাওয়ালাকে বললো দ্রুত যেতে। তাতে অবশ্য লাভ হলো না। বাইকে থাকা লোকগুলো রিকশার সামনে বাইক থামালো। রিকশাওয়ালা না পারতে রিকশা থামালো একপাশে। লোকগুলো এসে সোজা অপর্ণার দিকে ছুরি তাক করলো।
-চুপচাপ নেমে আমাদের সাথে চল!
-কারা আপনারা? আমার রাস্তা কেন আটকেছেন?
-বেশি কথা বললে কথা বলার মতো অবস্থাতেই থাকবি না, কোনো কথা না বলে আমাদের সাথে আয়।
-দেখুন আমার বাচ্চা স্কুলে অপেক্ষা করছে, আপনারা টাকা নিয়ে যান। আমায় ছেড়ে দিন প্লিজ।
-তোর আসলেই প্রাণের মায়া নাই!
লোকগুলোর একজন অপর্ণার বোরকা ধরে টানাটানি শুরু করলো। সরু রাস্তা হওয়ায় এদিকে গাড়ি খুব কম। অপর্ণা চিৎকার করারও সাহস পাচ্ছে না। আচমকা পুলিশের হুইসিল শোনা গেল। লোকগুলো ছুরি ফেলে দিয়ে দৌড়ে পালালো। অপর্ণা যেন জমে গেছে। সে কোনভাবেই নড়তে পারছে না। কোনোরকম রিকশাওয়ালাকে বললো রিকশা ঘুরিয়ে আগের জায়গায় নামিয়ে দিতে। রিকশাওয়ালাও যথেষ্ট ভয় পেয়েছে। সেও সময় না নিয়ে রিকশায় টান দিল।
________________________
অর্ণব অপর্ণার বাড়ির সোফাটাতে বসেও খানিকটা সংকোচবোধ করছে। আগেরবার এখানে এসেছিল ডিভোর্স লেটারে সই করতে, এখন তাকে কেন এত জরুরি তলব দেওয়া হয়েছে জানা নেই তার। অবশ্য অতীব দরকারি কোনো কথা না থাকলে তার শাশুড়ির মতো মানুষ কখনো তাকে অনুনয় করে এখানে ডাকতো না তা সে জানে। অর্ণবের ডিভোর্সের পেছনে অন্যতম কলকাঠি নাড়ানো ব্যক্তিটিও তার শাশুড়ি মা। বিষয়গুলো অল্পবিস্তর বুঝতে পারে অর্ণব কিন্তু এসব প্রকাশ করতে চায় না। অপর্ণার বাবা-মা, পরিবারের সবাই উপস্থিত আছে। বাচ্চারা বোধহয় অপর্ণার সাথে ঘরে রয়েছে। অর্ণব বোঝার চেষ্টা করছে তাকে কেন ডাকা হয়েছে।
-অর্ণব বাবা, তোমায় খুব গুলো কিছু কথা বলার জন্য ডেকেছি।
-তা বুঝতে পেরেছি। বলুন।
-নওশাদ লোকটা যে অপর্ণাকে বিরক্ত করছে তা আমি আগেও লেখাকে জানিয়েছি। আমার মেয়েটা ঘর থেকে বের অবধি হয়না। আজ বের হয়েছে, কিছু লোক এসে তার গলায় ছুরি ধরেছে। তুমি বুঝতে পারছো ব্যাপারটা কত সিরিয়াস?
-জ্বী বুঝতে পারছি।
-দেখো বাবা, অপর্ণাকে তো তুমি চেনোই। মেয়েটার অযথা জেদ, ওকে তুমি মাফ করে দাও বাবা। আর দেখো নওশাদের ক্ষমতা আছে, লোকটা তো এমনি এমনি চুপ করবে না। চিত্রলেখাকে ওর সাথে বিয়ে দিলে কোনো ক্ষতি তো হচ্ছে না। যথেষ্ট টাকাপয়সা আছে, বিয়েতে অমত করার কী আছে? বিয়েটা হয়ে গেলে সব সমস্যা মিটে যাবে।
-আপনার লজ্জা করেনা? আপনি তো একজন মেয়ে, আপনি দেখতেই পারছেন নওশাদ লোকটা কতটা ভয়ঙ্কর তারপরেও আপনি এই কথা বলার সাহস পেলেন কী করে?
অর্ণব চলে যাওয়ার জন্য উঠলো। অপর্ণার বাবা আটকালেন তাকে।
-বাবা অর্ণব, আমাদের কথায় রাগ কোরো না। আমাদের মেয়েকে নিয়ে আমরা চিন্তিত। আমাদের বোধবুদ্ধি কাজ করছে না অর্ণব।
-আপনার মেয়ের বোধবুদ্ধি সময়মতো কাজ করলে এখন এ পরিস্থিতিতে পড়তেন না। যাই হোক, আমি আমার বাচ্চাদের সাথে একটু দেখা করতে চাই।
-অপর্ণার সাথে একবার…
-আমার বাচ্চাদের একটু বাইরে ডেকে নিবেন? আমি দেখেই চলে যাবো।
উপস্থিত সবাই থ মেরে গেল। অর্ণবের কথার কাঠিন্য সকলে উপলব্ধ করতে পারলো। মানুষ কতটা কষ্ট পেয়ে এতটা কঠোর হতে পারে তা বোধহয় তারা অনুভব করার চেষ্টা করলো।
রূপসা-রাদিফের সাথে খানিকক্ষণ কথা বলে বেরিয়ে এলো অর্ণব। বাচ্চা দুটো এখনো বাবার থেকে দূরত্ব মেনে নিতে পারেনি। পরিস্থিতি বোঝানো তো এতটা সহজ নয়! অপর্ণার বাড়ি থেকে বেরিয়ে অর্ণব তৌহিদের সাথে দেখা করার জন্য গেল। তৌহিদের সাথে তার বেশ গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।
-অর্ণব ভাই? এখনি আসলেন যে? অবশ্য আমিই আপনার ওখানে যেতাম আজ।
-লেখার সাথে কথা হয়েছে তোমার? কাজ কতদূর? সময় তো বেশি নাই।
-কাজ বেশি বাকি নাই ভাইয়া তবে অপর্ণা ম্যামের উপর নজর রাখছিলাম আজকে। ঠিকঠাক টাইমে পুলিশের সাইরনটা বাজিয়েছিলাম বলে বেঁচে গেছে! যতদূর বুঝলাম গুণ্ডাগুলো প্রফেশনাল না, নওশাদ বোধবুদ্ধি ভাড়া করেছে। নিজের ইমেজ ক্লিন রাখতে চায় আর কী!
-এসব জেনে কাজ নাই তৌহিদ আমার, অপর্ণার যা হয় হোক। ও মরে গেলেও আমার যায় আসে না।
-এটা আপনার মুখের কথা ভাই, আপনি যে কষ্ট পাচ্ছেন তা আপনার চোখ বলে দিচ্ছে। মাফ করে দিয়ে নতুন করে সব শুরু করলেই পারেন!
-তুমি যদি কাউকে ভালোবাসো তবে অবশ্যই তাকে আমৃত্যু ভালোবাসবে কিন্তু তার সমস্ত অন্যায় ক্ষমা করার মতো বড় অন্যায় কখনো করো না। ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে যাওয়ার পরিণাম জানো? না পাবে ভালোবাসা আর না পাবে শান্তি!
-অপর্ণা ভাবীকে কখনো ক্ষমা করবেন না ভাইয়া?
-না।
-ভাবী অনুতপ্ত হলেও না?
-না। একটা ভুল করার পর অনুতপ্ত হলেই কি সেই ভুলের মাশুল দেওয়া হয়ে যায়? ভুল ভুলই থাকে। তাছাড়া ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত অপর্ণারই ছিল। এখন তার অনুতপ্ত হওয়ার কারণ নেই। সেসব তোমার ভাবতে হবে না, তুমি তোমার কাজ করো।
-আচ্ছা ভাইয়া। আমার আরো কিছুদিন দেখা লাগবে। তাছাড়া এবার ভোটে হেরে লোকটা ক্ষ্যাপা শেয়াল হয়ে আছে। একটু সামলে কাজ করতে হবে।
-করো। সময়মতো যেন সব হয়।
__________________________
চিত্রলেখা বুঝে উঠতে পারছে না এই আহাদ লোকটার সমস্যা কী। হোয়াটসঅ্যাপে আবারো মেসেজ করেছে লোকটা। বিরক্তির ভঙ্গিতে ফোনটা দূরে ছুঁড়লো লেখা। সে অপেক্ষায় আছে তৌহিদের কলের। কল আসছে না মানে এখনো কাজ হয়নি। এতে অবশ্য বিরক্ত হয়ে লাভ নেই। যে দায়িত্ব সে তৌহিদকে দিয়েছে তাতে সময় লাগা স্বাভাবিক। তৌহিদের অযথা এ উকিলগিরিতে সময় ব্যয় না করে পার্মানেন্টলি গোয়েন্দাগিরিতে জয়েন করা দরকার।
চিত্রলেখা ফোন হাতে নিয়ে গ্যালারিতে ঢুকলো। রঙ্গনের একটাই ছবি আছে তার কাছে। প্রোফাইলে যে ছবিটা দেওয়া ছিল আগে, সেটাই সেভ করে রেখেছিল সে। ঢাকায় আসার পর থেকেই রঙ্গনের স্মৃতি মারাত্মক পোড়াচ্ছে তাকে। মন চাচ্ছে একটু দেখা করতে কিন্তু পরক্ষণেই মস্তিষ্ক ঘোষণা করছে যে রঙ্গনের সাথে দেখা হলেই সে মনোযোগ হারিয়ে ফেলবে। অবশ্য কথাটা মিথ্যে নয়। রঙ্গনের বলা একটা বাক্যও চিত্রলেখার মনে উত্তাল ঢেউ আনতে সক্ষম।
সাথী চিত্রলেখার ঘরে উঁকি দিয়ে ভালোমতো দেখলো মেয়েটা কী করছে। চিত্রলেখার বিরক্ত হয়ে বসে থাকা দেখে সাথীরও বিরক্ত লাগলো। কানে ধরে রাখা ফোনটা হাত দিয়ে আড়াল করলো।
-আপা, কী হয়েছে? কিছু বলছো না যে?
-তোমার বউয়ের মন খারাপ রঙ্গন।
-লে কেন!
-আমি কিভাবে বুঝবো? তুমি কল রাখো। আমি দেখি কেন এমন বাংলার পাঁচের মতো করে বসে আছে।
-আপা শোনো না, আমি তোমার বাড়িতে আসি আচ্ছা? ভাই হিসেবে প্রথমদিন বোনের বাড়িতে যেতে চাইছি, মানা করো না প্লিজ।
-আমি কিছু বলবো না কিন্তু তোমার বউ যদি আরো রাগ করে তবে আমার দোষ নেই।
-আচ্ছা আপা। চিত্রলেখাকে এখন কিছু বলতে যেয়ো না। ওকে একটু একা থাকতে দাও।
-দুপুর থেকে খায়নি। এখন সন্ধ্যে সাতটা বাজে। অনিকটারও আজ মিটিং আছে, আসতে আসতে দশটা বাজাবে। আমি দেখি ওকে কিভাবে খাওয়ানো যায়।
-আপা প্লিজ তুমি কিছু করো না। আমাকে দেখতে দাও।
-কী করবে তুমি?
-কিছু একটা।
রঙ্গন কল কেটে দিল। মাঝেমধ্যে নিয়ম ভাঙাই যায়। আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই এমন বিশেষ একজন থাকে যার জন্য আমরা সকল নিয়ম একবার করে হলেও ভাঙি।
চলবে…
[ঘুমের ঘোরে লিখছি, ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ রইলো।]