#চিত্রলেখার_কাব্য
একচল্লিশতম_পর্ব
~মিহি
চিত্রলেখার ঘরের দরজা বন্ধ সকাল দশটার পর থেকে। সাথী বার কয়েক দরজায় ঠকঠক করেও কোনো লাভ হয়নি। এখন বাজে সাড়ে এগারোটা। সাথী খানিকটা হলেও ভয় পাচ্ছে। অনিককে ইতোমধ্যে কল করেছে সে। এইচএসসির রেজাল্ট নিয়ে চিত্রলেখা মন খারাপ করেছে তা সাথীও বুঝতে পারছে। জিপিএ ফাইভ পাওয়াটা চিত্রলেখার জন্য স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল, সেখান থেকে ৪.৮০ পাওয়াটা সে কোনোভাবেই আশা করেনি। একরকম মন ভেঙেছে তার। চিত্রলেখা ঠিকই উপলব্ধি করছে এখানে নওশাদের দোহাই দিয়ে লাভ নেই। তার চেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে থেকেও কি কেউ ভালো ফলাফল করেনি? করেছে! এখানে ব্যর্থতা তার। ইন্টার লাইফের শুরুর সময়টা নষ্ট না করলে বোধহয় এখন আফসোস করতে হতো না। চিত্রলেখার চোখ ভিজে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। মনে অদ্ভুত রকমের সব কুচিন্তা খেলা করছে। তার সাথেই এমন কেন হলো? সব স্বপ্ন যেন চোখের সামনে ধূলিসাৎ হতে দেখছে সে!
সাথী প্রায় আধঘণ্টার দরজা ধাক্কা দিয়েও চিত্রলেখার সাড়াশব্দ পেল না। এদিকে অনিকের নম্বর বন্ধ। কোনো উপায় না পেয়ে সে রঙ্গনের নম্বরে কল করলো। রঙ্গন অফিসে ছিল, ফোনের দিকে খেয়াল করেনি সে। একটু পর সাথীর নম্বর থেকে মিসড কল দেখে তৎক্ষণাৎ সাথীর নম্বর ডায়াল করলো সে। রিসিভ হতে সময় লাগলো না।
-আপা বলো, কী হয়েছে? আজ তো রেজাল্ট দিয়েছে, লেখা…
-লেখা দরজা খুলছে না রঙ্গন, প্রায় এক ঘণ্টা হয়ে গেছে। আমি অনেকক্ষণ ধরে ওকে ডাকছি কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছি না। আমি কী করবো কিছুই বুঝতে পারছি না।
-আপা তুমি নক করতে থাকো। আমি আসছি। আর ভাইয়াকেও কল করো। দরকার পড়লে দরজা ভাঙাও আপা প্লিজ। আ..আমি আসছি।
রঙ্গন আর কিছু বলতে পারলো না, কল কেটে দিল। সাথী দরজায় শব্দ করেও লাভ হচ্ছে না। অনিকের অফিস কাছেই কিন্তু সাথী চিত্রলেখাকে রেখে সেখানে যাওয়ারও সাহস পাচ্ছে না। যদি মেয়েটা কিছু একটা করে বসে? সাথী কেবল আল্লাহ আল্লাহ করে চলেছে। তার সমস্ত ধ্যানজ্ঞান যেন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।
_________________________
রঙ্গনের আসতে কাঁটায় কাঁটায় সাত মিনিট লাগলো। ঠিক কোন স্পিডে বাইক চালিয়ে সে এসেছে তা সে নিজেও মনে করতে চাইলো না। অনিকও ততক্ষণে সাথীর সাথে যোগাযোগ করতে পেরে আসার উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে। রঙ্গন কোনো কথা না বলেই জোরে জোরে দরজায় শব্দ করতে লাগলো। চিত্রলেখার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে রঙ্গন দেরি করলো না। বেশ জোরেই দরজায় ধাক্কা দিতে থাকলো। অনেকটা জোরে ধাক্কা দেওয়াতে ভেতরের ছিটকিনি ভেঙে যেতে সময় লাগলো না। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে রঙ্গনের চোখ পড়লো চিত্রলেখার উপর। দেয়ালের সাথে মিশে মেঝেতে হাঁটু ভাঁজ করে বসে আছে মেয়েটা। আশেপাশের কোনো শব্দই যেন তার কানে যাচ্ছে না। রঙ্গন কিংবা সাথীর ভেতরে প্রবেশেও যেন সে মোটেও অবাক হয়নি। রঙ্গনের কেন যেন মনে হচ্ছে চিত্রলেখা এখনো রেজাল্টের বিষয়টা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। সে নিঃশব্দে চিত্রলেখার পাশে বসলো। তাতেও চিত্রলেখার মাঝে কোনো ভাবান্তর ঘটলো না। রঙ্গন চিত্রলেখার গালে হাত রাখলো। নোনা জল চিত্রলেখার চোখ বেয়ে গড়াতে সময় নিলো না। রঙ্গনের তখন পরিস্থিতি বিবেচনার সময় নেই। সে তড়িঘড়ি করে চিত্রলেখাকে বক্ষপিঞ্জরে আগলে ধরলো শক্ত করেই। চিত্রলেখার কান্না তখন বাঁধ ভাঙলো। আর্তনাদের করুণ স্বরে সাথীরও করুণা হতে লাগলো। জিপিএ ফাইভ জিনিসটাকে এ সমাজ কতটা গুরুত্বপূর্ণ বানিয়ে ফেলেছে তা যেন সাথীর চোখে আঙুল দিয়ে বোঝানো হলো। চিত্রলেখা কবে থেকে এ প্রচলিত সমাজের বাধাধরা মানতে লাগলো? সে তো বরাবরই নিয়ম ভঙ্গকারী হতে চাচ্ছে তবে কেন এখন এ সামান্য শিকলে নিজেকে জড়িয়ে ফেলার অভিপ্রায়?
রঙ্গন ধীরে ধীরে চিত্রলেখার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। চিত্রলেখাকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলো সে।
-লেখা শান্ত হও, কিচ্ছু হয়নি। এভাবে কান্না করার মতো কিচ্ছু হয়নি!
-আমি পারবো না রঙ্গন। আমি যেখানে এইচএসসিতেই পারলাম না সেখানে এডমিশনে কিভাবে পারবো? আমার দ্বারা হবে না! আমি ব্যর্থ।
-লেখা! তুমি পাগল হয়েছো? এইচএসসি আর এডমিশন এক হলো? তুমি ভালোমতো প্রস্তুতি নিয়েছো, তুমি পারবে। তুমি এইটার চিন্তা বাদ দাও। কত মার্ক কাটা যাবে? ৫ বা ৬? এটা বাদেও তুমি পারবে। আমি বিশ্বাস করি তুমি পারবেই।
-আমি নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছি না রঙ্গন। আমি পারবো না।
-আমি এইচএসসিতে ৪.৪৮ পেয়েছিলাম। সেই দুঃখে পাবলিক পরীক্ষায় দিইনি। দিলে কি আমি পেতাম না চান্স? আমি ভয় পেয়েছিলাম আর এই ভয়টাই আমাকে দুর্বল করেছে। ভয়কে নিজের উপর ভারি হতে দিও না লেখা। আমি, আপা, ভাইয়া সবাই আছে তোমার পাশে। তুমি পারবেই। তোমাকে জবাব দিতে হবে সবাইকে। তোমার স্বপ্ন তোমায় পূরণ করতেই হবে!
চিত্রলেখা শান্ত হলো খানিকটা। চোখের পানি মুছতেই খেয়াল হলো সে এখনো রঙ্গনের বুকের মাঝে আবদ্ধ। সাথীও সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। চিত্রলেখা তৎক্ষণাৎ রঙ্গনের বুক থেকে সরে গেল। রঙ্গন মাথা চুলকাতে চুলকাতে উঠে দাঁড়ালো।
-রঙ্গনা, তোমার রেজাল্টের চিন্তা একদম বাদ এখন। তুমি শুধু এডমিশনে মন দিবা আর এখন থেকেই। রাগ আর মন খারাপের সময় পড়াশোনা সবসময় ভালো হয়। সুতরাং এখন থেকেই পড়তে বসো আর আমি এই সময়টাতে দূরে থেকেই প্রতিমুহূর্তে পাশে থাকবো। তুমি শুধু লড়ে যাও, রঙ্গন আছে আর তোমারই থাকবে।
চিত্রলেখার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো। তার চোখের দ্যুতি বলে দিল সে নিজেকে প্রস্তুত করছে ভবিষ্যতের যুদ্ধটার জন্য। রঙ্গন বেস্ট অফ লাক জানালো কেবল। চিত্রলেখার চাহনি আর কিছুক্ষণের মধ্যে তাকে পাগল করতে উদ্যত হবে, আপাতত সে উন্মাদের কোঠায় নাম লেখাতে চায় না।
অনিকের আসার আগেই রঙ্গন বেরিয়ে গেল। অনিক এখনো জানেনা রঙ্গন চিত্রলেখার সাথে এখনো যোগাযোগ রেখেছে। বিষয়টা এমন হুট করে না জানাটাই ভালো। অনিক এসে দেখল বাড়ির পরিস্থিতি স্বাভাবিক। সে যারপরনাই অবাক হলো। সাথী যেভাবে ভয় দেখিয়ে তাকে বাড়িতে এনেছে তাতে সে অনেকটা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। বাড়ির পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখে সে আর সেসব কথা তুললো না।
_______________________
রাত প্রায় সাড়ে বারোটা। চিত্রলেখা তখনো পড়ছে। রঙ্গন ঠিকই বলেছিল। রাগ আর মন খারাপ এ দুইটা জিনিস মানুষের পড়াশোনায় মনোযোগ বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। দীর্ঘসময় ধরে পড়ার ফলে চিত্রলেখার ঘাড়ে খানিকটা ব্যথা শুরু হলো। বিশ্রামের জন্য বিছানায় হেলান দিয়ে ফোনটা হাতে নিলো সে। অনেকদিন সুবহার সাথে কথা হয়না ভেবে সুবহার নম্বর ডায়াল করলো সে। বারকয়েক রিং হওয়ার পর সুবহা কল রিসিভ করলো।
-কেমন আছিস লেখা?
-আছি আলহামদুলিল্লাহ। তোর খবর বল।
-আমিও ভালো। বাবা আগের থেকে একটু সুস্থ। এখানে নিয়ে এসেছি। বলা যায় নতুন সংসার এটা। রেজাল্ট কেমন আসছে তোর?
-৪.৮০। তোর কী অবস্থা?
-৪.১৭! তুই তো ভালোই করেছিস। সামনে তো মেডিকেল এক্সাম তোর, ভালোমতো প্রস্তুতি নে।
-তুই তো ঢাবিতে পরীক্ষা দিবি?
-আমার রাবিতে পড়ার শখ রে এখন। এত সুন্দর জায়গা রাজশাহী। এটা ছেড়ে ঐ ঢাকার কোলাহলে যেতে ইচ্ছে করবে বল।
-তাও তো কথা। তুমি তো এখন সংসারী নারী। তোমার কি আর ইচ্ছে করে সংসার ফেলে কোথাও যেতে?
-জুতো চিনিস?
-হ্যাঁ চিনি তো। কেন তুই চিনিস না?
-ধূর! এত রাতে জেগে আছিস? পড়ছিস তাইনা?
-হুহ। তুইও পড়তেছিস?
-হ্যাঁ।
-আচ্ছা পড়, পরে কথা হবে।
-আচ্ছা।
চিত্রলেখা কল কেটে ফোন রাখবে ঠিক সে সময় লক্ষ করলো হোয়াটসঅ্যাপে আবার একটা মেসেজ এসেছে। তবে এবার আননোন নম্বর থেকে। মেসেজ ওপেন করলো চিত্রলেখা। টাইপিংটা বডি চেনা চেনা লাগছে। লেখাটা পড়তে শুরু করলো সে,
“এইচএসসিতে জিপিএ ফাইভ মিস করেছো? ব্যাপার না সোনা, ভাব যা বেশি তোমার এইটুকু নিচে নামা দরকার ছিল। বেশি উড়ো না বাবু, আচ্ছা? মেডিকেলে তোমার চান্স পাওয়া আমি নিশ্চিত করবো শুধু আমার হও একবারে। তুমি মেডিকেলে সীট পাবে আর আমি তোমাকে। ডিল খারাপ না। ভেবে দেখো বেবি ডল!”
চিত্রলেখার গা গুলিয়ে উঠলো মেসেজটা দেখে। সে স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে এই নোংরা মেসেজটা তাকে কে করতে পারে।
চলবে…