প্রিয়াঙ্গন #পার্ট_১২ জাওয়াদ জামী জামী

0
337

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_১২
জাওয়াদ জামী জামী

কুহুু দৌড়ে রুমে দরজা লাগিয়ে দিয়ে, বিছানায় গিয়ে বসল। ও ভয়ে জুবুথুবু হয়ে গেছে। সেই সাথে শরীরে হালকা কাঁপুনির অস্তিত্ব টের পাচ্ছে। তাহমিদ ওর সাথে কেন এমন আচরণ করছে, তা কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছেনা কুহুর। এর আগে মাত্র একবার তাহমিদের সাথে কুহুর দেখা হয়েছে। সেটাও কোন সুখকর পরিস্থিতিতে হয়নি। মায়ের মৃ’ত্যু’র পর শোকে আচ্ছন্ন কুহু একরাতে তাহমিদকে প্রথম দেখেছিল উঠানে পাতা চেয়ারে বসে থাকতে। পরদিন সকালেই সে গ্রাম থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। তারপর পেরিয়েছে দুই মাস। এর ভেতর আর দেখা হয়নি তার সাথে। কিন্তু গতরাতে বাসায় এসেই কুহুকে দেখেই কেমন হেয়ালি কথাবার্তা শুরু করেছিল সে। কুহু কালকেও না পেরেছে তাহমিদের কথার মানে বুঝতে। আর আজও না পারছে তার কথার অর্থ বের করতে।
অবশ্য তাহমিদের কথার মানে বোঝার কোনও ইচ্ছেও নেই ওর। ও ভয় পাচ্ছে মেজো চাচিকে। চাচি যদি জেনে যায় বিষয়টা? তবে নিশ্চয়ই কুহুকে কথা শোনাতে ছাড়বেনা!

পরদিন সকালে কুহু আর তাহমিদের সামনে যায়না। তাহমিদ খেতে আসলে কুহু নিজের রুমে গিয়ে ঘামটি মে’রে বসে থাকল।

তাহমিদ খেতে বসে এদিকওদিক তাকিয়ে কুহুকে খোঁজার বৃথাই চেষ্টা করল। কিন্তু কুহুকে না দেখতে পেয়ে হতাশ হয়ে খাওয়া শেষ করে রিশা,নিশো, সৃজনকে পড়তে বসায়।

সেইদিন কুহু আর তাহমিদের সামনে আসলনা।তাহমিদ রাত দশটায় বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। ও তখনও চারপাশে তাকিয়ে কুহুকে খুঁজল। কিন্তু যে একবার নিজ থেকে আড়ালে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়, তাকে বৃথাই খোঁজার চেষ্টা করা বোকামি বৈ কিছুই নয়।
তাহমিদ মনমরা হয়ে বিদায় নেয় সকলের কাছ থেকে। ও যাবার সময় বারবার পেছন ফিরে তাকায়, যদি একটি বার তার রাতজাগা তারাকে দেখতে পেত। কিন্তু ওর আশা অপূর্ণই থেকে যায়। ওর স্বপ্ন অংকুরিত হতে পারলনা। বিরস বদনে, অলস পায়ে ত্যাগ করল, তার প্রিয় অংগন।

” মাগো, তুমি কাইল সারাদিন রুম থাইকা বাইর হইলানা ক্যা? কি হইছিল, মা? ” রাজিয়া খালা মলিন গলায় জিজ্ঞেস করলেন।

” তেমন কিছু না, খালা। শরীরটা একটু খারাপ লাগছিল, তাই বের হইনি। ” কুহু অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা বলল। ওর খুব খারাপ লাগছিল মাতৃসমা এই বৃদ্ধাকে মিথ্যা বলতে।

কুহুর কথা শুনে খালা একটু হাসলেন। তিনি কোমল চোখে তাকালেন কুহুর পানে।

” মাগো, এই জীবনে স্বামী-সন্তান নিয়া সংসার করবার পারিনি। সন্তান হইলনা জন্য স্বামী আরেকটা বিয়া করল। এক বছর পর সতীনের পেটে সন্তান জন্মালো। তার তখন থাইকাই আমার নরকদর্শন শুরু হইছে। স্বামী, সতীন মিল্লা কি অত্যাচারডাই না করত। অত্যাচার সইবার না পাইরা একদিন স্বামীর ঘর ছাড়লাম। বাপের বাড়িতে গেলাম। কিন্তু ভাইয়ের বউয়েরা আমাকে সেই বাড়িতে থাকপার দিলনা। বাপের ঘরও ছাড়লাম। ট্রেনে চাইপা গেলাম ঢাকা। সেখানে কাজ করলাম কত জায়গায়। একদিন রাস্তায় দেখা হইল তাহমিদ বাবার নানার লগে। হেয় আমার দুঃখের কথা শুইনা নিজের সাথে এইখানে নিয়া আসল। আর তখন থাইকাই আমি এই বাসায় আছি। এখানে আইসা আমি তাহমিদ বাবারে পাইলাম। আমি তার মা হইয়া উঠলাম। আর সে হইল আমার সন্তান। আমার বহু বছরের আক্ষেপ ঘুচল তাহমিদ বাবারে পাইয়া। জন্ম না দিয়াও আমি তার মা হইলাম। ”

কুহু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সামনে দাঁড়ানো মমতাময়ী খালার দিকে। তার মনে কত কষ্ট সে পুষে রেখেছে, অথচ তার মুখ দেখলে সেটা বোঝা যায়না।

এদিকে রাজিয়া খালা একমনে বলেই চলেছেন,

” তারপর জীবনে অনেক চড়াই-উৎরাই দেখলাম। সংসারের ভাঙ্গন দেখলাম, লোভ, হিংসা দেখলাম। এতকিছুর পরও আমি তাহমিদ বাবার মা-ই থাইকা গেলাম। রিশা, নিশো ওরাও আমারে খুব ভালোবাসে। ওদেরকে নিজ হাতে মানুষ করলাম। আবার তুমি আসলা আমার কাছে। তোমারে পাইয়া আরেকবার আমার মা হওয়ার দুঃখ ঘুচল। তুমি আমারে আপন কইরা নিলা। আমিও ভালোবাসলাম তোমারে। আসলে তুমি মাইয়াডাই এমন। তোমারে ভালো না বাইসা থাকাই যায়না। এখন আবার তোমারে ভালোবাসার সাথে সাথে নতুন দ্বায়িত্বও কাঁধে পরছে। তোমারে ভালো রাখার দ্বায়িত্ব, তোমার নিরাপদ রাখার দ্বায়িত্ব। তাই কই কি মা, আমার কাছে মিথ্যা কইওনা। মা মনে কইরা আমারে সব খুইলা কইবা, কেমন? ”

কুহু খালার কথা শুনে ধন্দে পরে যায়। ও খালার বলা শেষের কথাগুলোর মানে বুঝতে পারছেনা। খালা ওকে কি বোঝাতে চাইল? চিন্তারা মাথায় জট পাকাচ্ছে। কিন্তু ওর চিন্তা পাখনা মেলার আগেই নায়লা আঞ্জুম রাজিয়া খালাকে ডাক দেয়। খালা বাহিরে গেলে কুহুও চিন্তায় ক্ষান্ত দেয়।

দুইদিন পর কোচিং থেকে বাসায় এসে কুহুর চক্ষু চড়ক গাছে রুপান্তরিত হয়। বাসায় বেশ কয়েকজন নতুন মানুষকে দেখে ও গুটিয়ে যায়। একজন মধ্যবয়সী নারীর সাথে মেজো চাচি হেসে হেসে কথা বলছে।

কুহু কোন কথা না বলে ধীর পায়ে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যেতেই কথা বলল সেই মধ্যবয়সী মহিলা।

” নায়লা, এটাই কি তোর সেই হাভাতে ভাসুরের মেয়ে? ভাতের অভাবে নিজের বাড়িতে না থেকে অন্যের ঘাড়ে বসে বসে খাচ্ছে! আসলে গ্রামের মানুষদের লজ্জাশরম সব সময়ই একটু কম থাকে। ”

ভদ্রমহিলার কথা কানে যেতেই কুহু লজ্জায় কুঁকড়ে যায়। থমকে গেছে ও। মাটির সাথে যেন সেঁটে গিয়েছে ওর দুই পা। চক্ষু গহবরে ঠাঁই নিল অশ্রুকনারা। তারা জানান দেয়, আমরা অতিসত্তর আসছি। ঠোঁট কা’ম’ড়ে চেষ্টা করছে অশ্রুবিন্দুদের পতন ঠেকানোর।

” হুম ছোট আপা, এ-ই সে। তবে বেশি কিছু বলোনা। রিশার বাবা জানলে আমাদের অসুবিধা আছে। এই মেয়েটাকে দেখতে যেমন সাধাসিধা মনে হয়, বাস্তবে তার উল্টো। দেখবে ইনিয়েবিনিয়ে চাচার কাছে আমাদের নামে বিচার দেবে। তুমি সত্যিই বলেছ, গ্রামের মিসকিনদের লজ্জাশরম কমই হয়। ”

এবার কুহুর চোখ দিয়ে ঝরঝর করে অশ্রু বিন্দুরা ঝরে পরল। যেন ওরা প্রতিযোগিতায় নেমেছে, কার আগে কে ঝরতে পারে।

রাজিয়া খালা রান্নাঘর থেকে সবকিছুই শুনলেন। তার চোখেও পানি জমেছে। ড্রয়িংরুম আর রান্নাঘরের মাঝখানে পাথরের স্ল্যাবের ব্যবধান থাকায়, রান্নাঘর থেকে ড্রয়িংরুমের সব কথাবার্তাই শোনা যায়। একটা এতিম মেয়েকে কেউ যে এভাবে বলতে পারে, সেটা তার কল্পনাই ছিলনা। তার মন অনেক কিছু বলতে চাইলেও, সে যে এই বাসার কাজের মেয়ে। সেজন্য নিজের ইচ্ছেকে জলাঞ্জলি দিয়ে কাজে লেগে যান।

কুহু রুমে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। ওর এই মুহুর্তে এই বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। মেয়েটা একপর্যায়ে ব্যাগ গোছাতে শুরু করল। কিন্তু পরক্ষণেই চাচার কথা মনে হতেই কাপড়চোপড় ব্যাগ থেকে বের করে আলমারিতে গুছিয়ে রাখল। ও ভালো করেই জানে, চাচার কানে আজকের কথাগুলো গেলে, চাচা ওদেরকে ছাড়বেনা। কুহু চায়না ওর কারনে চাচার সংসারে অশান্তি হোক। তাই শত অপমানেও ওর নিজেকে শক্ত রাখতে হবে। ধীরে ধীরে নিজের পায়ের নিচের মাটি শক্ত করতে হবে। একটা কাজ জোগাড় করে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। তবে তার আগে চাচাকে বোঝাতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে, কুহু আর ছোটটি নেই। পরিস্থিতি ওকে বদলে দিয়েছে। সে এখন নিজের সাথে সাথে ভাইয়েরও খেয়াল রাখতে পারে। ভাইয়ের দ্বায়িত্ব পালন করতে সক্ষম সে।

কুহুর সম্বিৎ ফিরে খালার ডাকে। খালা কোন কথা না বলে কুহুকে জড়িয়ে ধরলেন। খালার একটু আদরের ছোঁয়া পেতেই কুহুর নিলাজ মন হু হু করে উঠল। আবারও কাঁদতে শুরু করল মেয়েটা।

রাজিয়া খালা অনেকক্ষণ কুহুকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলেন। কুহু শান্ত হলেই তবে ওকে নিয়ে রান্নাঘরে গেলেন তিনি।

” হেই রাজিয়া খালা, তোমার সাথে এই পরীটা কে? উঁহু পরী নয়, এটাতো ব্ল্যাক ডায়মন্ড! তা এই ব্ল্যাক বিউটি কে? ” রান্নাঘরের ফ্রিজ থেকে পানির বোতল বের করে ডক ডক করে পানি পেটে চালান দিয়ে বলল জয়। সে নীরবে কুহুকে পরখ করতে ব্যস্ত। জয় নামক ছেলেটার চোখ কুহুর সর্বশরীরে বিরাজ করছে।

কুহু ছেলেটাকে রান্নাঘরে ঢুকতে দেখেই জড়সড় হয়ে কাজ করছিল। তখনই ছেলেটি রাজিয়া খালার সাথে কথা বলল। তাকে জিজ্ঞেস করল কুহুর কথা।

” ও কুহু। রিশার বড় চাচার মেয়ে। ” রাজিয়া খালার জয়ের কথা বলার ধরন পছন্দ হয়না। তাই তিনি আর কথা বাড়ালেননা।

” কু….হু। মানে কোকিলের ডাক। ভেরি গুড। তাকে একটু কথা বলতে বলবে, খালা? তার গলা দিয়ে কোকিলের স্বর বের হয় কিনা একটু দেখতাম। এই যে হট বিউটি? একটু কথা বলোনা? ” চোখ টিপে বলল জয়।

কুহু জয় নামক ছেলেটার কথা শুনে ওড়না দিয়ে শরীর ভালোভাবে পেঁচিয়ে নিয়ে রাজিয়া খালার আড়ালে গিয়ে দাঁড়ায়।

” জয় বাবা, তোমার কাম শেষ হইলে এখান থাইকা যাওগা। আমরা কাম করতাছি। রান্দোন ঠিক সময়ে না হইলে তোমার মা খ্যাচখ্যাচ করব।তখন তারে তো তোমার এই কথাগুলান কইতে পারমুনা। ”

রাজিয়া খালার হুমকিতে কাজ হলো। জয় রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

সেইদিন জয় কারনে-অকারণেই কুহুর আশেপাশে আঠার মত চিপকে রইল। ও কুহুর সাথে কথা বলতে চেষ্টা করছে। কিন্তু কুহু তাকে পাত্তা না দিয়ে রাজিয়া খালার সাথেই রইল। ও খালার কাছ থেকে জেনেছে জয় ওর চাচির ছোট বোনের ছেলে। তাই সে ভয়ে আরও গুটিয়ে যায়।

” হেই ডুড, আজকে নানুর বাসায় এসে একটা হট আইটেম দেখলাম। এবার রাজশাহীর ট্রিপটা আমার জন্য লাকি। আগে এখানে এসে বোর হতাম। এখন থেকে সেটা আর হতে হবেনা। মেয়েটাকে পটাতে পারলে মন্দ হবেনা। এটলিষ্ট রাজশাহীতে একটা বেড পার্টনার তো মিলবে। ”

অপার পাশ থেকে কিছু একটা শুনে জয় জোড়ে হেসে উঠল। ওর চোখ চকচক করছে। ঠোঁট দিয়ে ভেজায় নিজের ঠোঁট।

এতক্ষণ দরজায় দাঁড়িয়ে সবটাই শুনল কেউ একজন। জয়ের কথা শেষ হতেই সে অতি সন্তপর্ণে সেখান থেকে সড়ে যায়।

রাত এগারোটা পঁয়ত্রিশ। কুহু পড়ছে । সৃজন ঘুমিয়ে গেছে অনেক আগেই। এমন সময় দরজায় টোকার শব্দ শুনে কুহুর বুক ধক করে উঠল। এই রাতে কে এসেছে!

দরজার অপরপ্রান্তে দাঁড়ানো ব্যক্তি যেন কুহৃর মনের কথা শুনতে পেল। তার গলা শুনেই কুহুর ভয় নিমেষেই উবে যায়।

” কুহু মা, দরজা খুইল্যা দেও। আমি রাজিয়া খালা। ”

কুহু দরজা খুলেই দেখল খালা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন।

” খালা, আপনি এত রাতে? ”

” আইজ তোমার লগে শুইতে আইলাম। আমারে শুইতে নিবা? ”

” কেন নিবনা, খালা! আসেন ভেতরে আসেন। কিন্তু বিছানায় তো তিনজন শোয়া যাবেনা। এক কাজ করি সৃজন খাটে ঘুমাক। আমরা দুইজন মেঝেতে বিছানা করে ঘুমাই। ”

” তুমিও সৃজন বাবার লগে বিছানায় শোও। আমি নিচে শুই। ”

” আপনি এটা কি বলছেন! আপনি মুরব্বি হয়ে একা নিচে শোবেন, আর আমি ওপরে শোব! এটা কিছুতেই হয়না। আমিও আপনার সাথে নিচে শোব। আপনি আমাকে গল্প শোনাবেন। কতদিন গল্প শুনিনা। আগে বাবা নিয়ম করে গল্প শোনাত। কিন্তু সে অসুস্থ হওয়ার পর থেকেই আর গল্প শোনা হয়নি। ” কুহুর চোখ চিকচিক করছে। চোখে পানি স্পষ্ট।

রাজিয়া খালা কিছু না বলে বিছানা করে কুহুকে নিয়ে শুয়ে পরল। আজ সে কুহুকে অনেক গল্প শোনাবে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here