#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_২০
সকালে চিঠি পাবার পর চারুর তক্ষুণি কল করতে মন চাইছিল নিখিলকে। কিন্তু কি যেন ভেবে করে নি। চিঠি পাবার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝি কল করতে হয়? একটু ধৈর্য তো রাখা উচিৎ। তাছাড়া, এখন অফিসের সময়। কে জানে, লোকটা ব্যস্ত কি-না?
রাতেই কল করবে চারু। যখন অফিস সময় পেরিয়ে যাবে, দিনের ব্যস্ততা ফুরিয়ে যাবে, অবসন্ন-ক্লান্ত দেহমন নিয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়ে দু’টো মিষ্টি কথা কইবে সে। ব্যক্ত করবে প্রাণের আকুলতা!
__
হাত ঘড়িতে সময় দেখলো সৌভিক। ন’টা পঁয়তাল্লিশ বাজে। হাতের কাজ আপাদত গুছানো শেষ। কয়েকটা ফাইল আছে সহকর্মী রাতুলের কাছে, সেগুলোর প্রয়োজন। সেগুলো সহ সাড়ে দশটায় একটা মিটিং অ্যাটেন্ড করতে হবে ওকে। জায়গাটা অফিসের বাইরে। এখান থেকে যেতে আধ ঘণ্টার মতো লাগবে। এখনই বেরিয়ে যাওয়া উচিৎ। বলা তো যায় না, যদি জ্যামে আটকা পড়ে?
কন্ট্যাক্টসে গিয়ে চটজলদি রাতুলকে ফোন করলো। কুশল বিনিময়ের পর ফাইলগুলোর প্রসঙ্গ তুলতেই সে দুঃখিত সুরে জানালো,
— “আজ হাফ ডে ছুটি নিয়েছি, ভাই। বাইরে আছি—”
সৌভিক তিক্ত গলায় বললো,
— “সে কি কথা, রাতুল ভাই? আপনি জানেন তো মিটিংয়ে ফাইলগুলো দরকার! আপনি সেগুলো না দিয়ে…”
ওপাশ থেকে রাতুলের অপরাধী সুর,
— “নিখিল ভাইয়ের কাছে ফাইল রেখেছি। আপনি ওঁকে বলুন একবার।”
‘কি যন্ত্রণা!’ — মনে মনে বিরক্ত হলো সৌভিক। রুঢ় স্বরে বললো,
— “ফাইলগুলো তো আপনার কাছেই রাখবার কথা। তাকে কেন এরমধ্যে—”
তড়িঘড়ি জবাব সহকর্মীর,
— “ভাই, জরুরি কাজে বাইরে এসেছি। বসের কাছে ছুটি চেয়েছি এক দিনের। উনি কিছুতেই দিবেন না। শেষে দয়া করে হাফ ডে দিল, ফাইল তাকে না দিয়ে কার কাছে দেই বলুন তো? প্লিজ ভাই! আমি নিখিল ভাইকে কল করে বলছি। উনি দিয়ে দেবেন।”
— “আচ্ছা।”
সৌভিক বিরস মুখে সায় দিয়ে কল কাটলো।
মনে মনে সে যথেষ্ট বিরক্ত। বাড়ি থেকে ফেরার পর পারত পক্ষে ওকে এড়িয়েই চলছে। একই অফিসে পাশাপাশি কেবিনে ওদের ডেস্ক। যেতে-আসতে দেখা হচ্ছে কতো! নিখিল তো শুধু সহকর্মী নয়, ভালো বন্ধুও।এখানে ওকে উপেক্ষা করে যাওয়া বেশ কঠিন! তবুও তা করেছে। কারণ তার মন ভালো নেই।
নিখিল অবশ্য কথা বলছে। সৌভিকের ভেতরটা কোন অন্তর্দহনে পুড়ে ছারখার হচ্ছে সে সম্বন্ধে তো ওর জ্ঞান নেই!
স্বভাব বশেই দেখা হলে হাত নাড়িয়ে সম্ভাষণ জানাচ্ছে। কিংবা হাসি হাসি মুখ করে জিজ্ঞেস করেছে,
‘কেমন আছিস?’
সৌভিক খুব সূক্ষ্ম ভাবে পাশ কাটিয়ে গেছে। শুনেও যেন না শোনার ভান করেছে। নিখিল হয় তো সেটা বুঝেছে। আহত হয়েছে হয় তো। কিন্তু ওর হেলদোল হয় নি। চারু ওর নেহাৎ পছন্দের মানুষ নয়, ভীষণ ভালোবাসার এক নারী!
তাকে ও বিনা যুlদ্ধে জয় করে নিয়েছে, সৌভিকের জ্বলবে না? মনটা পুড়ে অঙ্গার বনবে না?
ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে সৌভিক এসে নিখিলের দরজায় নক করলো। নিখিল ব্যস্ত ছিল, মুখ না তুলেই ডাকলো,
— “কাম ইন!”
সৌভিক ভেতরে ঢুকে যান্ত্রিক ভঙ্গিতে বললো,
— “রাতুল তোর কাছে যে ফাইলগুলো রেখে গেছে সেগুলো দে।”
মুখ তুলে তাকালো নিখিল। ক’দিন পর বন্ধুকে সরাসরি কথা বলতে দেখে হাসলো মিষ্টি করে,
— “বস্। দিচ্ছি আমি।”
কঠিন সুর সৌভিকের,
— “বসতে আসি নি আমি। কাজ আছে। ফাইল দে।”
নিখিলের দুঃখ হলো। ঠোঁটটা কিঞ্চিৎ বাঁকিয়ে কেমন যেন হাসি দিলো। অতঃপর ফাইল হস্তগত হতেই হনহন করে বেরিয়ে গেল সৌভিক। কোনো কথা না বলেই!
ওর প্রস্থানে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরোলো নিখিলের বুক চিড়ে। বন্ধুর অভিমান যুক্তিযুক্ত নয়। কিন্তু একেবারে অন্যায্য তাও সে বলতে পারে না। চারুকে তো সেও ভালোবাসে, সৌভিকও। এবং ওর জীবনে আগে থেকেই ছিল সে। তবে কেন সময় থাকতে চারুকে নিজের করে নেয় নি? কেন মেয়েটাকে নির্মম-দুর্দশা সইতে হয়েছে?
ফাইল নিয়ে সোজা বেরিয়ে গেল সৌভিক। লিফটে চড়ে কাঙ্খিত গ্রাউন্ড ফ্লোরের উদ্দেশ্যে বোতাম টিপলো। ত্রিশ সেকেন্ডের মাথায় গন্তব্যে পৌঁছে দরজা খুলে গেল লিফটের। সামনে না তাকিয়েই বেরোচ্ছিল সৌভিক, হুট করে কারো সঙ্গে প্রবল একটা ধাক্কা খেয়ে দু’ পা পিছিয়ে গেল!
এমনিতেই মেজাজ বিগড়ে আছে, এরমধ্যে—
আগন্তুককে লক্ষ্য করে ঝাড়ি দিতে দিতে ফিরে তাকালো,
— “চোখে দেখেন না? কীভাবে পথ হাঁটেন?”
বলতে বলতেই খেয়াল হলো মেয়েটাকে!
কয়েক হাত দূরে মাটিতে ছিটকে পড়ে আছে আনিকা। ওকে দেখেই দ্রুত উঠে দাড়ালো। এগিয়ে এসে হড়বড় করে বললো,
— “সো স্যরি স্যার। আ’ম সো স্যরি! আমি দেখি নি!”
থমথমে দৃষ্টিতে চাইলো সৌভিক। এখানে কেন এই মেয়ে? শীতল সুরে বললো,
— “মাত্র এলেন?”
ঘনঘন মাথা নাড়লো মেয়েটা। ঠিক অপরাধীর ন্যায়! একপল হাত ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে নিলো সৌভিক। কিছুটা রাগত কণ্ঠে বললো,
— “ন’টা চুয়ান্ন বাজছে। অফিস টাইম সাড়ে ন’টা থেকে। আপনি আধ ঘণ্টা পর কেন?”
ধমক খেয়ে মাথা নিচু করলো আনিকা। অস্ফুট আওয়াজে কি যেন বলতে চাইলো, হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দিল সৌভিক। তীব্র শোনাল ওর পুরুষালি কণ্ঠস্বর,
— “থাক। সাফাই দিতে হবে না। ওতে আমার কাজ নেই। লেইট করে অফিসে এলে ইমেজ আপনার খারাপ হবে, আমার নয়! গতকাল ভালো করে বুঝিয়েছি। না বুঝলে কি করার!”
শেষের কথাগুলো আক্ষেপ করেই বললো। আনিকা নামের মেয়েটা লজ্জায় এতটুকু হয়ে কোনোমতে বললো,
— “স্যরি স্যার!”
— “আর দেরি করবার দরকার নেই। কাজে যান।”
মেয়েটা ফের ঘাড় নাড়ালো। তারপর হন্তদন্ত হয়ে ঘুরে হাঁটা ধরলো সিঁড়ির দিকে। সৌভিক মহাবিরক্ত হয়ে ডাকলো,
— “ওদিকে আবার যাচ্ছেন কোন দুঃখে?”
মেয়েটা তৎক্ষণাৎ পিছু ফিরে তাকালো। লজ্জিত হয়ে বললো,
— “না, মানে স্যার…”
— “লিফটে প্রবলেম নাকি? ফোবিয়া – তোবিয়া আছে?”
— “না, না!”
চটপট মাথা নাড়লো। সৌভিকের ত্যক্ত গলা ভেসে এলো,
— “এমনিই লেট করে এসেছেন। লিফট ছেড়ে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে কি এখন সারাদিন পার করতে চান?”
— “স্যরি স্যার।”
মেয়েটা আড়ষ্ট হয়ে দাড়ালো। সৌভিক এবার রাগে ফেটে পড়লো,
— “আবার স্যরি! যান তো আপনি!”
মেয়েটা প্রায় দৌড়েই প্রস্থান করলো!
ওর যাবার দিকে কপাল কুঁচকে তাকালো সৌভিক। তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে বিড়বিড় করলো,
— “অদ্ভুৎ পাগল!”
__
নিখিল অফিস থেকে ফিরছে মিনিট দশেক হলো। চট করে গোসলটা সেরে বেরিয়েছে অমনই ওর সেলফোনের রিংটোন বাজলো। টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বিছানায় ফেলে রাখা ফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখলো। আননোন নাম্বার। নিখিলের ধরতে মন চাইলো না।
ফোনটাকে সাইলেন্ট করে রেখে সে ব্যালকনিতে চলে গেল টাওয়াল নাড়তে। আবছা-অন্ধকার মেশানো জায়গাকে বরাবরই চমৎকার লাগে ওর। তাছাড়া হিম ছড়ানো শীতল হাওয়ায় বইছিল প্রচুর।। নিখিল গ্রিলে হাত ঠেকিয়ে দাড়িয়ে রইলো।
একটু পরে নাজিয়ার গলার স্বরে চটকা ভাঙলো,
— “নিখিল? খেতে আয়!”
— “আসছি!”
জবাব দিয়ে ত্বরিৎ পায়ে খাবার ঘরের দিকে এগোলো। ততোক্ষণে অজ্ঞাত ফোনকলের কথা মাথা থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে গেছে ওর!
দু’ বার রিং করবার পরও যখন ওপাশ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেল না তখন একটু খারাপ লাগলো চারুর। তবে হতাশ হলো না। হতেই পারে, নিখিল এখনও ব্যস্ত!
সে বরং একটু পরে কল করবে।
কিন্তু একটু পরেও কল করে নিখিলের কোনো পাত্তা পেল না চারু। কারণ সে যখন কল করে চাতকের ন্যায় ব্যাকুল হয়ে চেয়ে আছে স্ক্রিনের দিকে, তখন তার থেকে সাড়ে তিনশো কিলোমিটার দূরে নিজের কক্ষের নরম বিছানায় শুয়ে পরম নিশ্চিন্তে চোখ বুঁজেছে নিখিল। হাতের কাছেই মুঠোফোন রাখা, কিন্তু তা এখন মূকের ভূমিকায় অবতীর্ণ!
অগত্যা নিরাশ হয়ে ফোন রাখলো চারু। খানিকটা দুশ্চিন্তায়, খানিকটা বেদনায় জর্জরিত হলো বিরোহিনী মন!
___
ফোনকলের কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছে নিখিল। সকালে উঠেও ফোন চেক করা হয় নি। ব্যস্ত হাতে তৈরী হয়ে অফিসে ছুটেছে। কাজের ফাঁকে ফোন চেক করতে গিয়ে, আননোন নম্বরটা চোখে পড়েছে। বেশ কবার কল এসেছে। জরুরি ছিল বোধ হয়। কিন্তু ব্যস্ততায় ‘পড়ে কল ব্যাক করবো’ ভেবে ফোন রাখলো। এরপর মনে রইলো না। এবং চারুর কাঙ্খিত কল ব্যাক করাও হয়ে উঠলো না!
দুটো দিন সেভাবেই পার হলো। চারু এরমাঝে আর কল করলো না। সম্ভবত সে কষ্ট পেয়েছে নিখিলের অনিচ্ছাকৃত এই উদাসীনতায়!
রাতে খাওয়া – দাওয়া সেরে সবে বিছানায় গা এলিয়েছে নিখিল, তখন পুনর্বার কল এলো। আজ নম্বর দেখে ভুল হলো না। রিসিভ করলো নিখিল,
— “আসসালামু আলাইকুম। কে বলছিলেন?”
ওপাশ থেকে নম্র মেয়েলি সুর ভেসে এলো,
— “ওয়ালাইকুম আসসালাম।”
এক মুহূর্তের জন্য হৃদযন্ত্রের স্পন্দন থমকে গেল। বিস্ময়াহত নিখিলের ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেল দুটো শব্দ,
— “চারুলতা জাফরিন!”
উত্তর এলো না। রমণীর শান্ত নিঃশ্বাসের আওয়াজ পাওয়া গেল কেবল। আটকে রাখা দমটা ছাড়লো নিখিল। নিজেকে সামলে শুধালো,
— “কেমন আছেন, চারুলতা?”
— “আলহামদুলিল্লাহ্। আপনি?”
— “এইতো — এতদিনে মনে পড়লো তবে?”
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অভিমানিনীর উষ্মা,
— “কদিন ধরে কল করলাম। আপনিই তো গুরুত্ব দিলেন না!”
অপরাধ বোধ জাগলো বটে কিন্তু সেটাকে ছাপিয়ে দিয়ে গেল একটা রঙিন অনুভূতি! চারুর অনুযোগ ওর বুকে ঝড় তুললো। প্রবল ঝড়ে ভেসে গেল নিখিল নওশাদ নামে তুচ্ছ প্রাণী!
চলবে___
#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
সকল পর্বের লিংক
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=122111588804106938&id=61553208165829&mibextid=2JQ9oc