#চুপিসারে (১২)
#রেহানা_পুতুল
নদী নিচু মাথায় ভীত স্বরে বলল,
আমারতো আপনাকেই বেশ সংকোচ হয় বড় ভাইয়া।
শ্রাবণ খোলা রাস্তায় নদীর দু’বাহু দু’হাত দিয়ে ধরলো। নদীর চোখে চোখ রেখে জেদী সুরে টেনে টেনে বলল,
তুই এখন বাইকে যেতে যেতে আমাকে একটা রোমান্টিক গান শুনাবি। ঠিক যেমনটি কাল রজতকে শুনিয়েছিস।
ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন আমার
সঙ্গে?
গোপনে আওড়ে নিলো নদী।
কিরে কি বলছিস?
কই? নাতো ভাইয়া।
তোর ঠোঁট নড়া দেখে মনে হলো কিছু বলছিস।
নদী চুপ হয়ে আছে। শ্রাবণকে না ধরেই বসেছে আজ।
কিরে আমাকে ধরে বোস।
নাহ। লাগবে না।
ভেরি গুড়। তাহলে শুরু হোক গান এবার, বলে বাইক ছেড়ে দিলো শ্রাবণ। পাঁচ মিনিট পর শ্রাবণ বাইক থামিয়ে নিলো কিছুপথ পাড়ি দিয়ে। কিঞ্চিৎ ঘাড় বাঁকিয়ে ভারকন্ঠে বলল,
নদী বোবায় ধরেছে নাকি তোকে? গাচ্ছিস না যে?
ভিতর থেকে আসছে না। আমি চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছি ভাইয়া।
মিথ্যে বলছিস কেন?তোর আস্পর্ধা দেখে আমি বিচলিত হচ্ছি নদী। আমি কাউকে কোন আদেশ করলে সে মুহূর্তেই তা পালন করতে সচেষ্ট। আর তুই কি করছিস? আমি ভুল কিছু আবদার করেছি নাকি?
আমি ‘কাউকে’ নই ভাইয়া। আমি আপনার ঘরের মেম্বার। আমিতো বলিনি যে কখনোই গান শুনাব না আপনাকে?
আত্মবিশ্বাসী সুরে নদীর স্পষ্ট জবাব।
রজতকে খুব ভালোবাসিস না?
একদম নাহ। আমার কাছে আপনি যা রজত ভাইও তা। তফাৎ হলো আমি উনার সঙ্গে ইজি। কারণ উনি সেভাবেই চলছে সবসময়। কখনো গরম চোখে বা রাগ করে কথা বলেনি আমার সঙ্গে।
শ্রাবণ আর কিছু বলল না। দ্রুত বাইক চালিয়ে চলে গেলো বাড়ির উঠানে। নদী বাইক থেকে নেমে পড়লো। নিশ্চুপ পায়ে ঘরের ভিতর চলে গেলো। শ্রাবণ বাইকে বসা থেকে নদীর পিছন দিকে চেয়ে রইলো। এরপর বাইক ঘুরিয়ে বাজারে চলে গেলো শ্রাবণ। পরপর দুটো সিগারেট শেষ করে ফেলল।
সেদিন বিকেলে রফিক দেওয়ান নদীকে ডেকে বললেন,
মা তুইতো এখন আমাদের বাড়িতেই আছিস। এটাকে তোর নিজের বাড়ি মনে করে চলবি। তোর বাবার বাড়ি আর তোর চাচার বাড়ির কোন পার্থক্য মনে রাখবি না। কেউ কিছু বললে আমাকে অবশ্যই ইনফর্ম করবি। আর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শ্রাবণতো নানা ব্যস্ততায় সময় পায়না সারথির পড়াশোনার খোঁজখবর নিতে। ওরতো টিউটর আছেই। বাড়ি এসে পড়িয়ে যায়। পাশাপাশি তুই বড়বোনের মতো ওর পড়াশোনার তদারকি করিস। কেমন? এই দায়িত্বটা তুই নিলে কাকা একটু স্বস্তি পাবো।
আপনি কোন চিন্তা করবেন না বড়চাচ্চু। আমি সারথির দিকে লক্ষ্য রাখবো সবসময়।
হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে বলল নদী।
পাশ থেকে মোরশেদা বলল,
এখন আমার দুইটা মেয়ে। নদী আসাতে আমাদের বড় সুবিধা হলো সারথি একটা সঙ্গী পেলো। নয়তো সুরমার সাথেই সারাদিন টইটই করে ঘুরতে থাকে হাঁসের মতো। আজকাল দেখি সুরমার ভাষায় সারথি কথাও বলে মাঝে সাঝে।
নদী ধুম করে হেসে ফেলল। সারথির মাথায় চাটি মেরে বলল,
কিরে বইয়ের ভাষায় কথা বলতে পারিস না?
হুম কইতো।
কইতো কি? বল বলিতো।
সারথি এক দৌড়ে অন্যদিকে চলে গেলো।
রজত একে একে মামা,মামী,খালা,খালু,নানী সবাইকে ফোন দিয়ে বলল,যেন তার মাকে অনুরোধ করে বুঝিয়ে বলে নদী সম্পর্কে। এমনকি নিজের বিছানায় পড়ে থাকা অসুস্থ বাবাকেও বলল। সবাই তাই করলো। কিন্তু তার মা রাফিয়ার এককথা,
নদী আমার মরা ভাইর মাইয়া। ভাইজি হিসেবে ভালোবাসি। এদ্দুর ঠিক আছে। কিন্তু ঘরের বউ হিসেবে তারে আমি আনুম না। তার মা থাকে আরেক জায়গায়। তাইলে আমার ছেলে জামাই আদর পাইব ক্যামনে? খাতির করবো কে? ওর জন্য নিয়মনীতিগুলা কে পালন করবো? গ্রামে দশজনের কাছে উঁচা মুখ আমার নিচা হইয়া যাইবো। এমন ভাঙ্গা ঘরের মাইয়া দিয়া শান্তিও হইব না। কিছু কমু আর গলায় ফাঁস দিতে যাইব। পুলিশ আইসা আমারে হাতকড়া পরাইবো। জাইনা শুইনা আপদ ঘরে আনার মানেই হয় না। আমি অনেকদিন ধইরাই মনে মনে আরুকে পছন্দ কইরা রাখছি। বিয়া হইলে আরুর লগেই হইবো রজতের।
সবাই আবার রজতকে ভিন্ন ভিন্নভাবে ফোন দিয়ে তার মায়ের বলা কথাগুলো জানালো। রজত শেষ চেষ্টা করে দেখলো। শ্রাবণকে বলল তার মাকে বলার জন্য। শ্রাবণ তাই করলো। কিন্তু রাফিয়া অন্যদের চেয়ে শ্রাবণের উপর রেগে গেলো বেশী। শ্রাবণ রজতকে জানালো। রজত নদীর মা রুবিনাকে বিস্তারিত জানালো। এবার রুবিনাও নড়ে গেলো। বলল,
বাবা তোমাকে দেখেই নদী ও আমি রাজী হয়েছি। কিন্তু তোমার মা যেখানে মেনেই নিবে না। সেখানে আমার মনে হয় তোমারও বিষয়টা স্বাভাবিকভাবেই নেওয়া উচিত। জানি তোমার খুব খারাপ লাগবে। কিন্তু নদীর ভালোর কথা ভেবে হলেও তোমার চুপ হয়ে যাওয়াটাই উত্তম হবে। রজত ফোনকল বিচ্ছিন্ন করলো হতাশ মনে।
গত তিনদিন ধরে রজত বাড়ি আসে না। ফোন বন্ধ। কোথায় গিয়েছে তাও কেউ জানে না। কাছের সবাই বিষয়টা ভুলেও গেলো। কিন্তু রজত ভুলতে পারছে না কিছুতেই। বাড়াবাড়ি রকমের মন খারাপ হয়ে গেলো তার। কিছুই ভালো লাগছে না তার। সবকিছু অসহ্য লাগে। নিরুদ্দেশ হয়ে পড়ে আছে এক বন্ধুর বাড়ি। নদীকে সে মামাতো বোন হিসেবেই দেখতো। কিন্তু তার মায়ের মুখে আরুকে বিয়ে করার কথা শুনেই তার মাথায় নদী চলে এলো।
ভাবলো,
নিজেদের মধ্যে বিয়ে করতে হলে নদীকেই করবো। নদীও আমাকে অপছন্দ করবে না। যেহেতু আমাদের দুজনের ঘনিষ্ঠতা আছেই। আদতে হলোও তাই। নদীও সব ভেবে মত দিলো। কিন্তু ভাগ্য ও পরিবেশ,পরিস্থিতি তাদের অনুকূলে নেই। তবে সে আরুকেও বিয়ে করবে না নিশ্চিত। মায়ের কাছে তার ইচ্ছার কোন মূল্যই হয়নি। তাই সেও মায়ের ইচ্ছাকে থোড়াই কেয়ার করে।
বিষয়টা নদীর কানে পৌঁছাতে সময় নিল না। তারও ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেলো। তার মাকে ফোন দিলো বড় চাচী মোরশেদার মোবাইল দিয়ে। তার মা রুবিনা তাকে বুঝিয়ে নিলো সাধ্যনুযায়ী।
মারে, কথায় আছে আল্লাহর ইচ্ছার কাছে বান্দার ইচ্ছার কোন মূল্য নাই। তার হুকুম নাই রজত ও তোর মিলন। থাক মা মেনে নে। তুই গান ও পড়াশোনায় মন রাখ। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। এমনতো নয় যে রজতের সঙ্গে তোর ভালোবাসার বা বন্ধুত্বপূর্ণ রিলেশন। তাহলে কষ্টটা হতো যন্ত্রণাদায়ক। অসহনীয়।
নদী আবেগাপ্লুত স্বরে বলল,
আম্মা তা রাইট। রজত ভাইয়ের সঙ্গে আমার এমন কিছুই না। তবে উনি আমাকে ভালোবেসে ফেলেছে। এটা আমি রিয়েলাইজ করতে পেরেছি আম্মা। তাই আমার জন্য না যতটা খারাপ লাগছে, তার চেয়ে বেশি খারাপ লাগছে রজত ভাইয়ের জন্য। উনার নাম্বার ও অফ পাচ্ছি।
নদী মায়ের থেকে বিদায় নিলো ব্যথাতুর মনে। চাচাদের পুকুর পাড়ের দিকে চলে গেলো হাঁটতে হাঁটতে। একটা আমগাছ হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। হৃদয়টা কেনজানি তছনছ হয়ে যাচ্ছে রজতের জন্য। নিরব জলে দুচোখ ভরে টইটুম্বুর হয়ে গেলো তার বর্ষার ভরা বিলের মতো। চোখ মুছে কিছু সময় পর ঘরে ফিরে এলো।
সারথি সবার সামনেই জিজ্ঞেস করলো নদীকে,
নদীপু তোমার চোখ ভেজা ও লাল ক্যান? চোখে খোঁচা লাগছে?
হুম রে বইন। চোখ দুটো ঢলতে ঢলতে বলল নদী।
শ্রাবণ পাশে থেকে টিপ্পনী কেটে বলল,
সারথি, তোর নদীপুর চোখে এমন খোঁচা লাইফে এই প্রথম ঢুকলো। তাই কষ্টটা একটু বেশী পেয়েছে চোখে। নারে নদী?
নদী না শোনার ভান করে শ্রাবণের সামনে হতে চলে গেলো হনহন পায়ে।
এদিকে রজতের নিখোঁজে রাফিয়ার পাগল পাগল দশা। শ্রাবণকে দিয়ে বহু কষ্ট করে রজতের সন্ধান জানল। শত অনুরোধ করেও রজতকে বাড়ি আনতে পারলো না। রজত জানাল তার যেদিন মন চাইবে সেদিন বাড়িতে আসবে। তার আগে নই।
নদী আপা পানিতে ডুইবা গেছে। ভাইয়া বাঁচাও।
সারথি ও নদী পুকুরে গোসল করতে নামলো। কিছুক্ষণ পর সারথি চিৎকার করতে করতে এলো ঘরের সামনে। শ্রাবণ উম্মাদের মতো তিন লাফে গিয়ে পুকুরে পড়লো। সারথি তারসাথে দৌড়ে গিয়ে নদীর ডুবে যাওয়ার স্থান দেখিয়ে দিলো।
শ্রাবণ ভেজা অঙ্গে নদীকে পাঁজাকোলা করে পাড়ে তুলে আনলো। সবাই জড়ো হলো। নদী অজ্ঞান হয়ে আছে। সুরমা নদীর বুকে চাপ দিয়ে পানি বের করার চেষ্টা করছে। শ্রাবণ সিনজি নিয়ে এলো উঠানে ফোন করে। ভেজা জামা সেলোয়ার সহ নদীকে নিয়ে হাসপাতালে চলে গেলো। সঙ্গে সুরমাও গেলো নদীর পরার জামাকাপড় একসেট নিয়ে।
শ্রাবণ বিশ্বাস করলো নদী ইচ্ছে করেই মরে যাওয়ার জন্য এই কাজটি করলো। নয়তো সে সাঁতার জানে না। তবুও কেন পুকুরের পানিতে দূরে গেল?
শ্রাবণ ভয়ানক ক্ষেপে গেলো নদীর উপরে। নদীকে নিয়ে একটা নতুন ফন্দী এঁটে ফেলল #চুপিসারে।
চলবে
#চুপিসারে
সকল পর্বের লিংক
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=122113601558106938&id=61553208165829&mibextid=2JQ9oc