অন্ধকার রুমে বলিষ্ঠ এক পুরুষকে নিজ কক্ষে দেখতেই চমকে উঠলো পর্ষা। চেঁচাতে যাবে তার আগেই বলিষ্ঠ পুরুষটি দৌড়ে এসে তার মুখ চেপে ধরলো। তীক্ষ্ণ স্বরে শুধালো,
“হুস! শব্দ না। ভয় নেই আমি আপনার কোনো ক্ষতি করতে আসি নি। আমাকে অল্প কিছুক্ষণ সহ্য করুন আমি একটু পরই চলে যাবো।”
পর্ষা চোখ বড় বড় তাকিয়ে রইলো পুরুষটির কুচকুচে কালো চোখ জোড়ার দিকে। তার হাতে থাকা মোমবাতিটা পড়ে গেল নিচে। তখনই পর্ষার কক্ষের বেলকনিতে কিছু মানুষের পদধ্বনি শোনা গেল। পর্ষা এতে ঘাবড়ে গেল আরো। সে কিছু করার বা বলার আগেই বলিষ্ঠ হাতের অধিকারি পুরুষটি পর্ষার মুখ থেকে হাত সরিয়ে বললো,“হুস কথা বলবেন না। মারা পড়বেন তবে।”
পর্ষা শুনলো সে চুপ করে দাড়িয়ে রইলো। হঠাৎই সেই পুরুষটি পর্ষার হাত ধরে পর্ষার কক্ষের খাটে তলায় লুকিয়ে পড়লো পর্ষাকেও নিয়ে নিলো সাথে। পড়ে থাকা মোমবাতিটা কোনোরকম নিভিয়ে ছুঁড়ে মারলো দূরে।’
পর্ষা সব দেখছে। কিন্তু কি হচ্ছে? কেন হচ্ছে? সব যেন পর্ষার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। পর্ষার কক্ষে প্রায় পর পর চার পাঁচজনের পদধ্বনি শোনা গেল। নিভু নিভু টচলাইট জ্বলছিল একজনের হাতে। পর্ষা মানুষদের আনা গোনা টের পেতেই ঘাবড়ে গেল প্রচুর। উত্তেজনায় বলে উঠল,“এত মা..
আর কিছু বলার আগেই সেই পুরুষটি আবার মুখ চেপে ধরলো পর্ষার। পর্ষার বাহুচেপে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বললো,“কথা নয়।”
কথাটা ফিসফিস করে বললেও পর্ষার সারা অঙ্গ যেন ভয় মিশ্রিত এক ধমকা হাওয়ার মতো কেঁপে উঠলো পুরো। সে ঘেমে গেছে। ভয়ে সারা শরীর তার কাঁপছে। পর্ষার খাটের তলায় হাল্কা মাঝারি সাইজের বাক্স ছিল। যার কারণে উপস্থিত মানুষগুলো খাটের তলায় দেখলেও কিছু নজরে আসলো না। একজন বাক্স সরাতে নিতেই পর্ষা চোখ বন্ধ করে ফেললো। আর বলিষ্ঠ পুরুষটি তার পকেট থেকে বের করছিল পিস্তল। উদ্দেশ্যে ধরা খেলেই পর পর শুট করে সে পালিয়ে যাবে। সেই উদ্দেশ্য আর পূরণ করা হলো না বাক্স সরাতে চাওয়া রোগা পাতলা মানুষটিকে তার সঙ্গে থাকা আরেকজন পিঠে চাপড় দিলো। সঙ্গে সঙ্গে খাটের তলা থেকে সরে এসে উঠে দাঁড়ালো। পুরো ঘর দেখা হলো কিন্তু কেউ নেই। বাড়িতেও বোধহয় কেউ নেই। তাদের মধ্যে থাকা একজন বলে উঠল,“শালায় মনে হয় এখানে আসে নি অন্যকোথাও গেছে। চল সব।”
কথাটা বলেই যেখান থেকে এসে ছিল সেখান থেকেই চলে গেল। প্রায় আধ ঘন্টা পর। পরিবেশ শান্ত। ফারিশ তার পকেট থেকে ফোনটা বের করলো কল করে বিশ্রী ভাষায় বললো,“আধ ঘন্টার মধ্যে আমার গাড়ি চাই নয়তো তোদের সব কয়টাকে আমি দেখে নিবো। ফারিশ মাহমুদের সাথে বেইমানি এর ফল কতটা ভয়ংকর হতে পারে তোরা হয়তো ভুলে গেছিস। আমায় শুধু ফিরতে দে।”
অপরপ্রান্তের ব্যক্তিটি ফারিশের কথা শুনেই ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললো,“আসছি ভাই, আসছি।”
ফোন কাটলো ফারিশ। রাগে তার পুরো শরীর কাঁপছে। পর্ষা তখনও স্বাভাবিক হয় নি। সে চুপচাপ লুকিয়ে ছিল খাটের তলায় ফারিশের পাশে। ফারিশ একপ্রকার ভুলেই গিয়েছিল সে কোনো মেয়েকে চেপে ধরে আছে। হঠাৎই হুস আসলো ফারিশের সঙ্গে সঙ্গে সে ছেড়ে দিল পর্ষাকে। পর্ষারও হুস আসলো দ্রুত খাটের তলা থেকে বের হলো। ফারিশও বের হলো। পর্ষা ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ফারিশের মুখশ্রীর দিকে। যদিও অন্ধকারে তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বাহিরে গর্জন করে ঝুম বর্ষা হচ্ছে। ফারিশের জামা বৃষ্টিতে ভিজে থাকায় পর্ষার জামাও তার সংস্পর্শে গিয়ে ভিজে গেছে। পর্ষা দ্রুত বিছানা সাঁতরে টাওয়াল জড়ালো গায়ে। হন্তদন্ত হয়ে নতুন মোমবাতি খুঁজলো। কিছুক্ষণের মাঝে পেয়েও গেল। এরপর খুঁজতে ছিল লাইটার। দ্রুত আলো চাই তার। ফারিশ তার পকেট থেকে লাইটার বের করে জ্বালালো। মেয়েটা যে হন্তদন্ত হয়ে ভয়ে দৌড়াচ্ছে তা বেশ বুঝতে পেরেছে ফারিশ। পর্ষা লাইটারের আলো দেখতেই এক জায়গায় দাঁড়ালো। তখনই লাইটারের আলোতে দেখতে পেল সেই পুরুষটির মুখশ্রী। মাথায় ঝাকড়া চুল, বৃষ্টিতে খানিকটা ভিজে তা। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের অধিকারি পুরুষটির বড় বড় চোখ, চোখের মনির অত্যাধিক কালো,গাল ভর্তি চাপ দাঁড়ি, চোখের পাশে কাটা দাগ, গায়ে ভেজালো কালো জ্যাকেট জড়ানো। সে বসে পর্ষার খাটের ওপর। পর্ষার হাত কাঁপছে, এভাবে হুট করে একটা পুরুষ তার কক্ষে ঢুকে পড়বে ভাবতে পারে নি। ফারিশ চোখের ইশারায় ডাকলো। লাইটার তখনও জ্বলছিল তার হাতে। পর্ষা কাঁপা কাঁপা হাতে তার হাতের মোমবাতিটা এগিয়ে দিলো ফারিশের দিকে। ফারিশ লাইটার দিয়ে মোমবাতি জ্বালালো। পর্ষা মোমবাতিটা রাখলো খাটের পাশে থাকা ডেসিং টেবিলের ওপর। ফারিশ পকেট থেকে এবার বের করলো একটা সিগারেট। সেটাকে লাইটারের সাহায্যে জ্বালিয়ে মুখে দিয়ে ধুঁয়া উড়ালো। পর্ষা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো ফারিশের দিকে। ফারিশও এবার দৃষ্টি রাখলো মেয়েটার দিকে। কেমন টাওয়াল গায়ে মেয়েটা ভয়ে কাঁপছে। ফারিশের খুব মজা লাগছে। তার জায়গায় অন্যকেউ থাকলে হাসতো কিন্তু সে হাসছে না কারণ ফারিশ সহজে হাসে না। ফারিশের এবার বিরক্ত লাগছে। সে আরেকবার সিগারেটে ফুঁ দিয়ে ধমক দিয়ে বললো,“এত ভয় পাওয়ার কি আছে আমি কি আপনায় মেরেছি?”
পর্ষা স্থির হয়ে দাঁড়ালো তাও তার হাত পা কাঁপছে। সে কাঁপা কাঁপা স্বরে প্রশ্ন করলো,“কে আপনি?”
ফারিশ জবাব দেয় না। পর্ষা আবারও প্রশ্ন করে,“আমার কক্ষে কি করছেন?”
এবার মুখ খুললো ফারিশ। বললো,
“কিছুই তো করছি না, দেখছেন না।”
“যাচ্ছেন না কেন?”
“গাড়ি আসুক চলে যাবো।”
“আমার কি আপনাকে ভয় পাওয়ার উচিত?”
হাসি আসলো ফারিশের। ভয়ে কাঁপছে ওদিকে জিজ্ঞেস করছে ভয় পাওয়া উচিত কি না। ফারিশ হাসি দমিয়ে উত্তর দিলো,
“আপনার ভয় পাওয়া উচিত কি না বলতে পারছি না কিন্তু আপনি যে ভয়ে কাঁপছেন তা কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি।”
পর্ষা লজ্জা পেল। ভুল প্রশ্ন করার লজ্জা। পর্ষা স্বাভাবিক হলো। জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলে দু’পা এগিয়ে এসে বললো,“আমি মটেও ভয় পাই নি সে তো আচমকা নিজের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো মস্তিষ্কের উপর দিয়ে যাচ্ছিল বিধায় ঘাবড়ে গেছিলাম একটু।”
ফারিশ হাতে থাকা সিগারেটটায় লাস্ট টান দিয়ে নিচে ফেলে পা দিয়ে পিসে ফেললো। তারপর আয়েশ করে বসে বললো,“ওহ আচ্ছা বুঝেছি।”
পর্ষা থরথর করে বললো,
“কি বুঝেছেন?”
জবাব দেয় না ফারিশ। এত কথা সহ্য হচ্ছে না। শরীরে যন্ত্রণা হচ্ছে। ফারিশ তার জ্যাকেটটা খুললো। সঙ্গে সঙ্গে পর্ষা আবার দু’পা পিছিয়ে গিয়ে কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো,“আপনি জ্যাকেট খুলছেন কেন?”
ফারিশ নিরুত্তর। ফারিশ তার জ্যাকেটটা খুলে পিছনে টিশার্টের উপর দিয়েই পিঠে হাত দিলো। জ্বলে উঠলো বোধহয়। হাতটা সামনে আনতেই দেখলো ফারিশ রক্ত। ফারিশের হাতে রক্ত দেখে পর্ষা দ্রুত দৌড়ে আসলো আচমকা হাত ধরে বসলো ফারিশের চিন্তিত স্বরে বললো,“রক্ত আপনি কি আহত?”
ফারিশ জবাব দেয় না। এবার বিরক্ত লাগছে পর্ষার এ ছেলে প্রশ্নের জবাব কেন দেয় না। পর্ষা বিরক্ত নিয়ে বললো,“কথার উত্তর দিচ্ছেন না কেন?”
ফারিশ স্থির দৃষ্টিতে পর্ষার দিকে তাকিয়ে বললো,“পানি আছে?”
পর্ষা একঝলক ফারিশকে দেখলো। বললো,
“আছে।”
“নিয়ে আসুন তাহলে।”
পর্ষা দেরি না করে দৌড়ে চলে গেল তাদের ডাইনিং রুমের দিকে। গ্লাস ভরে পানি নিয়ে এসে দিলো ফারিশের হাতে। ফারিশ নিলো। পানি না খেয়ে তার রক্তে ভেজা হাতটা ধুলো। তীক্ষ্ণ স্বরে বললো,
“ফারিশ আহত হয় না।”
“এটা কেমন কথা আপনার শরীর দিয়ে রক্ত ঝরছে আর আপনি বলছেন ফারিশ আহত হয় না।”
ফারিশ হাসলো। খুব নিদারুণ দেখালো সেই হাসি। ফারিশ বললো,“আমি কে এটা আপনি জানলে বোধহয় আপনিও আমায় আঘাত করতেন।”
পর্ষা কথাটায় বেশি গুরুত্ব দিলো না। দৌড়ে নিজের কক্ষে থাকা ডাক্তারির সরঞ্জাম রাখার বাক্সটা নিয়ে আসলো। খাটের পাশে বসে বললো,“আপনি কে এটা আমার জানার প্রয়োজন নেই আমি একজন ডক্টর আর আমার দায়িত্ব আহত মানুষদের সেবা করা। আপনি খাটে শুয়ে পড়ুন আমি আপনার চিকিৎসা করবো।”
ফারিশ অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে পর্ষার মুখশ্রীর দিকে। শক্ত কণ্ঠে বলে,
“দরকার নেই ফারিশ কারো সেবা নেয় না।”
“অদ্ভুত তো শুয়ে পড়ুন দ্রুত।”
ফারিশ বসে রয়। পর্ষার এবার রাগ ওঠে। সে নিজেই শুইয়ে দেয় ফারিশকে। ফারিশ রাগান্বিত স্বরে বলে,
“আপনি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছেন।”
“চুপ থাকুন তো। কথা বেশি বলেন। যখন কথা বলার প্রয়োজন তখন চুপ থাকেন আর যখন কথা বলার প্রয়োজন নেই তখন বেশি বলেন। আহত হয়ে ভুল করে হলেও যখন ডাক্তারের কাছে এসেছেন তখন সেবা তো নিতেই হবে।”
ফারিশ কি বলবে বুঝতে পারছে না। এই প্রথম যেন মনে হলো কারো প্রশ্নের পিঠে সে কথা বলতে পারছে না। অবাক হলো ফারিশ। মেয়েটা তাকে ভয় পেয়েও কেন ভয় পাচ্ছে না?”
#চলবে….
#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ০১
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ। ফাইনালি হাজির নতুন গল্প নিয়ে। গল্প কেমন লাগলো অবশ্যই জানাবে। পরবর্তী পর্ব পেতে পোস্টটির নিচে লাইক কমেন্ট করে সবাই রেসপন্স করো। রেসপন্স ভালো আসলেই পরবর্তী পর্ব দিবো]
নীল ক্যাফের উপন্যাস シ︎