#আকাশ_ছোঁয়া_ভালোবাসা♥
#পর্ব_৯+১০
– তুমি আনতে বলবা না আমি আবার বমি করমু?
আম্মা বিরক্ত হয়ে উঠে বলল, যা খুশি কর। বাপে ঝিয়ে একেবারে জ্বালাই খাইলো।
.
.
.
.
আমি মনের আনন্দে জিলাপী খাইতেসি আর ক্ল্যান্ডারের সামনে দাঁড়াই আছি। মনে মনে হিসাব কষতেসি। আজকে মাসের তেইশ তারিখ। আগামী মাসের মাঝামাঝি আমার প্যারা মানে প্রথম সাময়িক পরীক্ষা। আর আমি যদ্দুর জানি ক্রাশেরও এইচ এস সি পরীক্ষা। আল্লাহ, আমার ক্রাশ যাতে ভালো করে। আমি মনে এই দোয়া করতেসি আর আম্মা আইসা কইল, তোর পরীক্ষার রুটিন দিসে? আমি মনোযোগ দিয়ে ক্ল্যান্ডার দেখতে দেখতে কইলাম, হুম।
– ঝুলাস নাই যে?
– ঝুলাবো।
আমি আঙুল চুষতেসি আর তাকাই আছি। আম্মা বলল, হাতটা মুখ থেকে নামা। নইলে পরীক্ষা দিতে গেলে আর আঙুল খুঁজে পাওয়া যাবে না।
– আরেকটা খাবো তো।
– আরো একটা!?
– হুম।
– এই নিয়ে কয়টা জিলাপি খাইছিস?
– মাত্র পাঁচটা।
– পাঁচটা কম? এভাবে খাইলে তো বাপের মতো ডায়বেটিস রুগী হয়ে যাবি।
আমি আস্তে আস্তে কইলাম, ডায়বেটিস রুগী হই গেলে তো ক্রাশ আমার দিকে ফিইরা তাকাইবো না। থাক, আর খামু না।
– কি বলিস বিড়বিড় করে?
– কিছু না। তুমি জিলাপি ফ্রিজে তুলে রাখো। পরে খাবো।
আম্মা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চলে গেল। আমি রুটিন ঝুলাইলাম। আজকে থেকে ঠিকমতো পড়তে হবে। শুনছি আমার ক্রাশ নাকি সেই লেভেলের ভালো স্টুডেন্ট। তার বউ হিসেবে তো আমাকেও ভালা করতে হবে। এবার আমি ফার্স্ট হয়ে ছাড়মু। না হলে আমি চেরির বউ না।
পরের সপ্তাহের শুক্রবার আর ক্রাশবার হইলো না। আম্মা কাপড় ধোয় নাই। কিন্তু আমি ছাদ থেকে ঘুরে আসছি। সে ছিল না। তাইলে মনে হয় ধুমাইয়া পড়তেসে। আমারেও পড়তে হবে। আমি তাড়াতাড়ি নাইমা গেলাম। এখন আমি রাত দিন পড়ি। পড়ার আগে ক্রাশের বোতামটারে একটা চুমু দিই। আম্মা আব্বা আমার পড়ার গতি দেইখা খুশি হই গেল।
পরের পুরা মাস আমার সেই খাটুনি আর প্যারা গেল। আমি সেই রকমের পরীক্ষা দিসি। আমারে এবার থামায় কে। শেষ পরীক্ষা দিয়ে বাসায় আইসা দেখি মিষ্টি খালা (আমি ডাকি) আর খালু এসে বসে আছে। তার সাথে মুনতাহা আর সানজিদা আপু। আমি এসে ওদের দেখে লাফাইতে লাগলাম। আমার আব্বু আম্মুর বিয়েতে নানা নানু দাদা দাদু কারোরই মত ছিল না। তাই বিয়ের পর থেকে ওনারা আম্মুর মুখ পর্যন্ত দেখতে চান নাই। তাই আমিও জন্মের পরে নানা নানু দাদা দাদু কাউকে দেখতে পাই নাই। শুধু দাদা মারা যাওয়ায় আব্বু গেসিলো। আমাদের নিয়ে যায় নাই। কিন্তু আমার মিষ্টি খালার সাথে আমার আম্মুর খুব ভালো যোগাযোগ ছিল। এখনও আছে। মিষ্টি খালা আর আম্মু প্রাণের বোন। তাই হয়ত ছাড়তে পারে নাই। আমি ফ্রেশ হয়ে আইসাই সুখবর শুনলাম। সানজিদা আপুর বিয়া। শুইনাই মন ডিংকা চিকা নাচ দিল। পরশু নাকি বিয়া। আমার পরীক্ষা দেইখা আম্মু বলে নাই। এখন যাইতে হবে। পুরা পরিবার ঐদিনই রওনা দিলাম। দিন চার ইচ্ছা মতো নাচ গান কইরা ফিরলাম। আমার জ্বালায় আব্বা আম্মা থাকতে পারলো না। বিয়ে শেষ হইতেই আমার মন আর টিকলো না। বৌভাতের দিনই চলে আসলাম বাসায়। আমি তো আবার এখন বাসা ছাড়া দুই মিনিটও টিকতে পারি না। বাসায় যতক্ষন থাকি চোখ সব সময় দরজার কাচে শেটে রাখি। ক্রাশ কখন যায়। কখন আসে। সব সময় দেখতে থাকি। কবে যে তার পরীক্ষা শেষ হইবো। এখন আন্টিও কম আসেন। আমি যাই মাঝেমধ্যে।
আজকে গেলাম দুপুরে খেয়ে। গিয়ে দেখি আন্টি কি যেন বাটতেসে। দরজা খুলে একটা হাসি দিয়েই রান্নাঘরে চইলা গেলেন। আমিও পিছু পিছু গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কি বাটছেন?
– কুমড়ার বিচি।
– ও, কি হবে এটা দিয়ে?
– মাছের ডিম যেভাবে রান্না করে ওভাবে রান্না করবো।
– ও।
আমি মনে মনে কইলাম, জীবনে রান্নাঘরে গেলাম না। মাছের ডিম কেমনে রাঁনধে ওইটাই জানি না। কুমড়ার বিচি তো পরের কথা। আন্টি বললেন, ছেলেটার অসুখ, কিছু খেতে পারে না। আমি উদ্বিগ্ন হয়ে কইলাম, কি হইসে?
– ভেতরে ভেতরে জ্বর।
– এক কাজ করেন। নিম পাতার রস খাওয়ান। আম্মু বলে এটা নাকি অনেক উপকারী।
– ছেলে খাবে?
– খাবে না মানে? তার না পরীক্ষা? ভালো থাকতে হলে খেতে হবে। না খেলে আমি আছি আন্টি। জোর করে খাইয়ে দেবো।
আমি নিমপাতা যোগাড় করে ব্ল্যান্ড করে নিলাম। আন্টি বললেন, দেখো পারো কি না। আমি খুশিতে মনে মনে চিনা হাসি দিতেসি। ঐ চাঁদনীর লগে পিরিত আমি এই নিমপাতার রস দিয়া ধুইয়া দিমু। আমি গ্লাস নিয়ে তার সামনে হাজির হইলাম। আমাকে দেখে সে বই থেকে চোখ তুলে তাকাল। ইশারাই জিজ্ঞেস করল, কি?
– শরবত। আন্টি দিয়েছেন। আপনি খাওয়ার জন্য।
সে উঁকি মেরে বলল, ইস্, নিমপাতার রস!!! খাবো না। আমি রাগ দেখাইয়া কইলাম, আপনি খাবেন না তো আমার শ্বশুর আব্বা খাবে। সাথে সাথে জিভ কাটলাম। সে ভ্রূ কুঁচকায় বলল, কি বললা তুমি?
– কিছু বলি নাই। খাবেন নাকি ঘাড় ধরে খাওয়াবো?
– এত কষ্ট করার দরকার নাই। একটা শর্তে খাবো।
– কি?
– তোমাকে অর্ধেক খেতে হবে।
সাথে সাথে মুখ বাংলার পাঁচ হইয়া গেল। আল্লাহ গো!!! কি কয়!!!! নিমপাতা আমার জন্মের শত্তুর। কিন্তু ক্রাশের অসুখ। তার উপর পরীক্ষা চলতেসে। কি আর করা! নাক টিপে এক নিঃশ্বাসে পুরা অর্ধেক খাইয়া তার দিকে বাড়াই দিলাম। সে উদাস ভাব করে কইল, এটা দিয়ে আমি কি করব? তিতায় গলা দিয়ে স্বর বের হইতেসে না। তবু কইলাম, খান।
– তোমার মুখ দেয়া জিনিস আমি খাবো না।
আমি গ্লাস হাতে বেকুব হই গেলাম!!! এ্যাঁহ্, খাবে না। ঐ দিন আমার খাওয়া গাজরের হালুয়া খাইসে যে তখন মনে ছিল না? আসছে, এখন খাইবো না। আমি বললাম, আমি অন্য একটা গ্লাস আনছি। আমি নিমের গ্লাসটা রেখে বেরিয়ে গেলাম। এসে দেখি নিমের গ্লাস খালি! আমি আবার বেকুবের মতো দাঁড়াই রইলাম। সে শুয়ে আছে চোখ বন্ধ কইরা। মেজাজটা সেই খারাপ হইল। আমি গ্লাস নিয়ে চইলা গেলাম রান্নাঘরে। আন্টি জিজ্ঞেস করলেন, খেয়েছে?
– জ্বি, আন্টি।
– ভালো কাজ করেছ। এবার দেখি কি হয়।
– আন্টি আমাকে রান্নাটা শিখিয়ে দেবেন?
– আমার তো প্রায় হয়ে এসেছে। খুবই সিম্পল। প্রথমে কুমড়োর বিচিগুলোর খোসা ছাড়িয়ে পানিতে ভিজিয়ে রাখবে। তারপর ওগুলো বেটে নেবে। ভাজির কড়াইয়ে পেঁয়াজ কেটে ভাজি করে তাতে লবণ, হলুদ, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, টমেটো সব দিয়ে কসিয়ে নেবে। এর মাঝে বাটা কুমড়োর বিচি পানি দিয়ে গুলে নেবে যাতে কোনো চাক না থাকে। তারপর ওগুলো কড়াইয়ে দিয়ে দেবে। সেগুলো ফুটতে থাকলে একটা ডিম ফাটিয়ে দিয়ে দেবে। এরপর লবণ দেখে পানি শুকিয়ে আসলে নামিয়ে ফেলবে। সোজা না?
সব শুনে আমার মাথা ঘুরতে লাগল। আমি কাঁদো কাঁদো হয়ে কইলাম, আমার কিছুই মাথায় ঢোকেনি, আন্টি। আন্টি হেসে বললেন, আচ্ছা, আরেকদিন শিখিয়ে দেবো।
– ঠিক আছে আন্টি। আমি ডায়রী নিয়ে আসবো। সব তুলে রাখব। আজকে আসি।
– আচ্ছা।
আসার সময় আবার ক্রাশের রুমে গেলাম। সে বাচ্চাদের মতো ঘুমাইতেসে। লোভ সামলাইতে পারলাম না। তার কপালে একটা চুমু দিয়ে দিলাম। তারপর আমি চইলা আসলাম। রান্নায় যে এত খাটুনি তা কেমনে জানমু। ক্রাশ তোমারে বালুবেসে জীবন শ্যাষ!
.
.
.
.
আজকে ক্রাশের পরীক্ষা শেষ। প্র্যাকটিকাল না কি ওটাও শেষ। আমার ইচ্ছা করতেসে ক্রাশের কলেজ যামু। গাজর খাইতে খাইতে চিন্তা করতে লাগলাম কি করমু। তখনই মাথায় একটা বুদ্ধি আইলো। আমি আম্মারে গিয়া কইলাম, আম্মু, আমি একটু মার্কেট যামু। আম্মা আমার দিকে পুলিশের মতো তাকাই বলল, ক্যান?
– একটা জিনিস কিনতে হবে।
– কি জিনিস?
– আরে বাবা, এতো জেরা করতেসো কেন? চুরি তো করতে যাইতেসি না। চলে আসমু। রিদিকে নিয়ে বের হমু।
– আচ্ছা যা।
আমি দৌঁড়ে রিদিকে ফোন দিলাম। কইলাম, ওই, তাড়াতাড়ি রেডি হ। মার্কেট যামু।
– এখন? এই দুপুরে? আমি কালো হই যাবো।
– তোর কালোর খ্যাঁতা পুড়ি। তুই বের হবি না আমি জুতার কালি আনমু তোর জন্য।
– ছিঃ ছোঁয়া, তোর বেস্টুকে এভাবে ব্ল্যাকমেইল করতে পারিস না।
– তুই আর একটা কথা বাড়াইলে শুধু ব্ল্যাক না হোয়াট ব্লু গ্রীন সব মেইল করমু। তুই রেডি হ। আমি দশ মিনিট পরে ফোন দিতেসি।
আমি ফোন কাইটা দিলাম। খুশি মন থেকে উপচাইয়া উপচাইয়া পড়তেসে। আমি সুন্দর করে একটা লাল জামা পরে রেডি হইয়া নিলাম। একটু সাজুগুজুও করলাম। ক্রাশের সাথে দেখা করতে যামু বলে কথা।
চলবে…
#আকাশ_ছোঁয়া_ভালোবাসা♥
#পর্ব_১০
খুশি মন থেকে উপচাইয়া উপচাইয়া পড়তেসে। আমি সুন্দর করে একটা লাল জামা পরে রেডি হইয়া নিলাম। একটু সাজুগুজুও করলাম। ক্রাশের সাথে দেখা করতে যামু বলে কথা।
আমি মার্কেটের রাস্তায় না গিয়া কলেজের রাস্তা ধরলাম। রিদি জিগাইলো, ঐদিকে কই যাস?
– একটা জায়গায় যামু।
– কোথায়?
– গেলে দেখবি।
আমরা দেড়টার সময় কলেজ গেটে পৌঁছাই গেলাম। রিদি বলল, এখানে আসলি কেন? আমার চোখ তখন ক্রাশরে খুঁজতেসে। বললাম, দেখতে আসছি। কলেজটা নাকি অনেক সুন্দর। ভাবতেসি এখানে পড়মু। মনে মনে কইলাম, ধুর বাবা, এত বড় কলেজ, ক্রাশরে দেখতেই পাইতেসি না।
এমনসময় রিদি বলল, দেখ, ওখানে কিসের ভীড়। কারো কিছু হইলো নাকি!? চল তো দেখি। রিদি আমারে টাইনা নিয়া গেল। আমি অনিচ্ছার সত্ত্বে গেলাম। দুইজনে ভীড় ঠেলে ঢুকতেই আমি থমকে গেলাম। আমার হূদয় ভেঙে শতটুকরা হইয়া গেল। চোখের পানি গড়িয়ে পড়ার অপেক্ষা। এ আমি কি দেখতেসি!? এইটা দেখার জন্য আমি আজকে আসছি? আমি আগাইতে পারলাম না। চোখের পানির প্রথম ফোঁটা পড়ার আগেই ভীড় ঠেলে বেরিয়ে দৌঁড় দিলাম বাসার দিকে। তখনই সবার উল্লাস ধ্বনি। আমি কান চেপে ধরে চলে আসলাম৷ আমি শুনতে চাইনা।
বাসায় এসে সোজা নিজের রুমে। আম্মা অনেকবার ডাকল। আমি দরজা খুললাম না। আমি দরজার পাশে ফ্লোরে বইসা আছি। হাতে ক্রাশের ছবি। একদিন চুরি কইরা নিয়ে আসছিলাম ছবিটা। ইচ্ছা করতেসে ছিঁড়ে টুকরা টুকরা করে ফেলি। কিন্তু সাহস হইল না। কেমনে পারল সে? তাহলে তার ক্রাশ চাঁদনীই ছিল? আজকে চাঁদনী ক্রাশরে প্রপোজ করসে আর সে ফুলটা হাতে নিয়ে নিসে। তারমানে সে প্রপোজ একসেপ্ট করসে৷ হায় রে!!! আমি কোন স্বপ্নের জগতে আছি? নাহ্ আর না। বহুত পাগলামি করসি আর না। তবুও খুব কাঁনদন আসতেছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত ইচ্ছে মতো কাঁনলাম। কাঁনতে কাঁনতে ভিজা বিড়াল হই গেলাম। মনটা হালকা হইতেই ফ্রেশ হয়ে রুমের বাইরে বাইর হইলাম। দুপুরে খাই নাই। আম্মা নিজের রুমে। আব্বা মনে হয় নাস্তা আনতে গেসে। আমি বের হয়ে দেখলাম টেবিলে বাটিতে মিষ্টি রাখা। আমি বাটিটা নিয়ে সোফায় বসে টিভি ছেড়ে দিলাম। মাত্র একটা মিষ্টি মুখে দিয়ে আরেকটা নিসি তখন আম্মা টিভির আওয়াজে রুম থেকে বের হয়ে কইল, খালি পেটে মিষ্টি খাইতেছিস কেন?
– আম্মু এগুলা কিসের মিষ্টি?
– ভাবিরা কয়দিন পর লন্ডন চলে যাবে। ওখানে নাকি ছেলেকে পড়াবে। তাই মিষ্টি দিয়ে গেছে।
শুনে আর দ্বিতীয় মিষ্টিটা গলা দিয়ে নামল না। ওটা মাঝ পথেই আইটকা গেল। আম্মা বলতেই আছে, ওর বাবা লন্ডনে থাকে। ছেলে ভালো পড়াশোনা করছে। এখন শুধু রেজাল্ট দিলেই লন্ডনে মেডিকেলে ভর্তি করিয়ে দেবে। আমি তো…… আম্মা আর কথা শেষ করতে পারল না। বাটি ভাঙার শব্দে চমকে উঠল। আমার হাত থেকে মিষ্টির বাটি পইড়া সাত আট টুকরা হই গেসে। রসে ফ্লোর মাখামাখি। আমি আস্তে করে কইলাম, সরি, আম্মু। তারপর গিয়া রুমের দরজা বন্ধ কইরা দিলাম। আম্মা বহুবার ডেকে কইল, ছোঁয়া কি হইসে তোর? দরজা খোল। আমার উত্তর দেওয়ার সময় নাই। সারাদিন প্রায় না খাওয়ার মতো। এখন মিষ্টি পড়াতে বমি হইতেসে। আমি বমি করে ওয়াশরুম থেকে বের হইলাম। কেন জানি মাথা ঘুরাইতেসে। সব আবছা আবছা। আমি শুয়ে পড়লাম বিছানায়। তারপর আর কিছু মনে নাই।
.
.
.
.
চোখ খুলে দেখি আম্মা আব্বা আমার দুইপাশে বইসা আছে। পায়ের দিকে তাকাই দেখলাম ব্যান্ডেজ। বাটির ভাঙা কাচে কখন পা কাটছে খেয়াল নাই। রুমের দরজা ভাঙা। হাতে স্যালাইন। শরীর দুর্বল। আমি উইঠা বসতে লাগলে আব্বা আম্মা দুজনে উদ্বিগ্ন হইয়া গেল। আমারে হেলান দিয়ে বসাইল। আম্মা জিজ্ঞেস করল, কেমন লাগছে?
– শরীর দুর্বল লাগছে।
– সারাদিন না খাওয়া। লাগবে না।
– কি হইসে আম্মু? দরজা ভাঙা।
– কি আর হবে? তুই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলি। তুই এত ডাকেও যখন সাড়া দিচ্ছিলি না তখন ভয় পাই গেসিলাম। তোর আব্বু এসে দরজা ভেঙে দেখে তুই বিছানায় পড়ে আছিস। তারপর ডাক্তার ডেকে নিল। ডাক্তার বলছে না খেয়ে শরীর দুর্বল হয়ে এই অবস্থা।
আম্মা বাচ্চাদের মতো কাঁদতে কাঁদতে বলল, কি হইসে তোর। এমন অনিয়ম করিস কেন? তোকে নিয়ে কত চিন্তা হয়। তোর কিছু হয়ে গেলে আমরা কি নিয়ে বাঁচবো। আমি আম্মার চোখের পানি মুইছা কইলাম, ওরে আমার কিউট আম্মু রে, এভাবে কেউ কাঁদে? আব্বা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, কিছু কি হইসে? আমি বললাম, কই না তো। আসলে আজকে কেন জানি খুব মন খারাপ হইসে তাই এমন… আব্বা আমি কথা শেষ করার আগেই বলল, বুঝলে শিমু, আমাদের মেয়ে অনেক বড়ো হয়ে গেছে। দুঃখ লুকাতে শিখে গেছে। এখন কিছু খাওয়াও। আমি কিছু বললাম না। আম্মা বলল, তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ো। আমি আজকে ওর কাছে থাকবো। আব্বা চলে গেল। আম্মা গেল খাবার আনতে। আমার চোখ দিয়ে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। মনে মনে বললাম, কিসের ক্রাশ? কার জন্য নিজের ক্ষতি করতেসি? আমি আব্বা আম্মার আদরের একমাত্র মেয়ে। আমাকে নিয়ে তাদের জগত। আর আমি কিনা এমন একজনকে নিয়ে জগত গড়তেসি যে কখনো আমার ছিলই না। আমি নিজের চোখের পানি মুছে বললাম, আজ থেকে আমার জগত আমার আব্বু আম্মু। আর কেউ না।
আম্মু খাবার এনে খাইয়ে দিল। পা মেঝেতে রাখতে পারতেসি না। ভালোই কাঁটছে। রক্তে বিছানার চাদরও ভিজে গেসিল। আম্মা ওটা পাল্টাইলো। আমি ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়লাম। আম্মাও আমাকে জড়াই ধরে শুয়ে পড়ল। আমার চোখে ঘুম নাই। অন্ধকারে বাইরে থেকে আসা আলো খেলতেসে, ছুটে বেড়াইতেসে জানালা থেকে দেয়াল পর্যন্ত। আমি তাকাই আছি। আমার চোখে ভাসতেসে ক্রাশের সাথে দেখা হওয়ার সময়ে ওর লাল হয়ে থাকা মুখখানা। তারপর আর ভাবলাম না। ডুব দিলাম ঘুমের সাগরে।
.
.
.
.
সকালে দশটায় ঘুম থেকে উঠলাম। উঠতে ইচ্ছে করতেসিলো না। তাও উঠলাম। কালকের কথা মনে পড়তেই কেন জানি পাগলের মতো হাসলাম। তারপর ফ্রেশ হইয়া মাথা আঁচড়ানোর জন্য চিরুনিটা নিলাম। চোখ পড়ল বোতামটার দিকে। একবার ভাবলাম খুইলা ফেলি। আবার ভাবলাম না থাক। মাথায় একটা বেণী বানিয়ে খোঁপা করে ফেললাম। শরীরের আড়মোড়া ভেঙে মাত্র রুম থেকে বের হইতেসি এমন সময় দেখলাম বসার ঘরে আন্টি, ক্রাশ আর একটা লোক বসা। বোধ করি লোকটা ক্রাশের বাবা। ধুর, দুইমাস হইয়া গেল এখনও ছেলেটার নামই জানি না। এখন আর ওর নাম ক্রাশ না। কি ডাকমু? হ্যাঁ, চেরি ফল। তাই ভালা। আমি আসতেই আব্বা আমারে ডাকল৷ আমি এসে বসতেই লোকটা বলল, কেমন আছো? আমি উত্তর দিলাম, ভালো। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, আমাকে চেন? আমি চেরির দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করে বললাম, ওনার বাবা। আঙ্কেল হেসে বলল, একদম ঠিক। কালকে দেশে এসেছি। তোমার আন্টির কাছে তোমার গল্প শুনতে শুনতে আর তোমাকে দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। আমি হাসলাম। ক্রাশ থুক্কু চেরি ফল আমার দিকে তাকাই আছে। হয়ত ভাবতেসে আমি কিসু কমু। কইলাম, আঙ্কেল, আমার না একটু কাজ আছে। আমি রুমে যাচ্ছি।
– আচ্ছা।
আমি রুমে আইসা বিড়বিড় করতে লাগলাম। আম্মার ফোন নিয়া কানে এয়ারফোন গুজতে গুজতে কইলাম, মনে হচ্ছে যেন বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে আসছে। আমি গান শুনতে লাগলাম। গানও ভালো লাগতেসে না। আমি এয়ারফোন খুলে শুনলাম আম্মা বলতেসে, এখনো তো সময় হয়নি। আমরা ভেবে দেখবো। ও… কালকে আমার মেয়ের জন্মদিন। আপনারা আসবেন কিন্তু। হয়ত বেশি বড়ো হবে না। ছোটখাটো করে একটু করবো। এই। ওনারা রাজি হয়ে গেলেন। ওনারা চলে যাওয়ার পর আমি আমার ফ্রেন্ডদেরকে ইনভাইট করলাম। আমার কেন জানি চেরি ফলকে ইনভাইট করাটা ভালো লাগলো না।
বিকালের দিকে আম্মু বলল, আমরা একটু বাইরে যাচ্ছি। আজকে হয়ত নাও আসতে পারি। তুই এক কাজ কর। রিদিকে বল এসে থাকতে।
– কোথায় যাচ্ছো?
– তোর নানাবাড়ি।
– হঠাৎ?
– শুনলাম তোর নানুর শরীর খারাপ।
– আমিও যাবো।
– আমরা যাবো আর চলে আসবো। অবস্থা খারাপ দেখলে থাকবো।
আমার কেন জানি যেতে দিতে ইচ্ছে করছে না। তবুও জোর করলাম না। রিদিকে ফোন করে আসতে বললাম। রিদি বলল, আধা ঘন্টা লাগবে। আমি বললাম, আচ্ছা। চারটার দিকে আব্বা আম্মা বের হই গেল। যাওয়ার আগে আব্বা বলল, তোর আম্মুর ফোনটা রেখে গেলাম। দরকার হলে ফোন দিস।
– আচ্ছা।
আব্বা কইল, ভালো থাকিস। সাবধানে থাকিস। আমি হাসলাম। আব্বা আম্মা বের হই গেল। আমি ফোন টিপতে বইসা পড়লাম। পনের বিশ মিনিট পর কলিংবেল বাজল। আমি দরজা খুলে বললাম, এতক্ষণ লাগে? এ্যাঁ!!!! কেউ নাই। নিচে তাকাই দেখলাম একটা বাক্স। আমি বাক্সটা নিয়ে দরজা মেরে দিলাম। টেবিলে রেখে দেখলাম, উপরে আমার নাম দেওয়া। একবার ভাবলাম কে দিল এটা? আমি মাত্র বক্সটা খুলব তখন আবার কলিংবেল বাজল। আমি বক্সটা আম্মুদের রুমে রেখে দরজা খুললাম। রিদি ভেতরে ঢুকে বলল, কি অবস্থা? প্রিপারেশন কেমন?
– কিসের?
– তোর বার্থডের।
– আর অবস্থা।
– কেন? কি হয়েছে?
– কেন জানি ভালো লাগছে না। আব্বু আম্মু না থাকলে ভালো লাগে না।
– ইট’স ওকে। রিদি যখন এসে গেছে তখন আর চিন্তা নেই।
এই ওই কইরা সন্ধ্যা রাত কাটল। দশটার মধ্যে খাইয়া শুয়ে পড়লাম। ঘুম আসতেছে না। রিদি তো শুতেই নাক ডাকতে শুরু করসে। হঠাৎ বাক্সটার কথা মনে পড়ল। আম্মুর রুমে গিয়া বাতি জ্বালাই বাক্সটা খুললাম। খুলে অবাক হইলাম।
চলবে…