#এক_সমুদ্র_প্রেম!
লেখনী: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(০৪)
” তুই?”
সামান্য দুই শব্দের বাক্যখানা এমন ভাবে বলল ধূসর, পিউয়ের রুহু, আত্মা গুটিয়ে এলো একদিকে। গত বছর গুলোয় এমন কর্কশ ভাষার সম্মুখীন হলেও, প্রতিটা বার ভ*য়ে আড়ষ্ট হয় সে। ওই তামাটে চেহারার পোক্ত গড়ন দেখলেই, নেতিয়ে যায় শঙ্কায়।
ধূসরের খসখসে মুঠোয় থাকা তার চিকণ আঙুলটা থরথর করল কেমন! মস্তিষ্কের কোণায় কোণায় বিপদ সংকেতের লাল আলো নেঁচেকুদে উঠল। ধূসর রেগে গিয়েছে। ফুলছে নাক। শোয়া থেকে উঠে বসতে গেল,ঈষৎ শিথিল হলো বাঁধন। তৎক্ষনাৎ সুযোগটা লুফে নিলো পিউ। ধূসরের আরেকটা বজ্রধমক থেকে বাঁচতে ত্রস্ত উঠেই ভো দৌড় লাগাল সে। ধূসর ভড়কাল খানিক। উঁচু কণ্ঠে হুশিয়ারি দিলো,
” দাঁড়া পিউ,যাবিনা বলছি!”
পিউয়ের পা থামেনা। অন্তহীন ছুটে পালিয়ে যায়। ধূসর হাতে পেলে খবর করে ছাড়বে, এসব বুঝেও দাঁড়িয়ে থাকার মতন বেকুব ও নয়। ঠিক যেমন হুটোপুটি করে উঠেছিল যাওয়ার সময়, তেমন ছুটে নামতে দেখেই মিনা আর্তনাদ করে বললেন,
” হায় আল্লাহ! এই মেয়ে এমন ছোটাছুটি করে, কোনদিন পরে হাত- পা ভাঙবে।”
পিউ একেবারে টেবিলের কাছে এসে ব্রেক কষল। ত্রস্ত হাতে গ্লাস তুলে চুমুক দিল। ঘন শ্বাস নিতে দেখে, সাদিফ ভ্রু কুঁচকে বলল,
” এভাবে হাঁপাচ্ছিস কেন? ভাইয়া ধা*ওয়া টাওয়া করেছিল না কী?”
পুষ্প তাল মিলিয়ে বলল,
” ওর তো কাজই একটা, বড় ভাইয়ার ঝাড়ি খাওয়া।”
সবাই হু হা করে হেসে উঠল এতে। যেন ভীষণ মজার কোনো কথা ।
সুমনা বললেন,
” তা আজ কী উল্টোপাল্টা করেছিস আবার? টের তো পেলাম দরজা আ*ছড়ে খুলেছিস,এই নিয়েই না কী?
পিউয়ের আনন সংকীর্ণ। ঠোঁট উলটে ফেলল ক*ষ্টে। এরা ওর খারাপ সময়ে কী মজাটাই না নিচ্ছে! নিক,এমন একদিন আসবে যখন ধূসর ভাই রসগোল্লার চেয়েও মিষ্টি করে কথা বলবেন। তখন সবার এই দাঁত কপাটি কোন গাছের মাথায় থাকে দেখবে সে।
রুবায়দার তার অন্ধকার মুখ দেখে মায়া হলো। এগিয়ে এলেন কাছে। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
” মন খা*রাপ করিস না। ধূসর তো একটু ওরকমই। তুই কেন শুধু শুধু ওকে ডাকতে গেলি!”
পিউ চাপা শ্বাস টানল। মেজো মা কে কী করে বোঝাবে,কেন সে এমন করে? লোকটা পানসে বলে সে কী মুখ ফিরিয়ে নেবে? তার ভালোবাসা কী সস্তা? চোখ মেঝেতে রেখে ভাবল,
‘ এই সামান্য কারনে তোমার ছেলের সঙ্গ ত্যাগ করলে তুমিই তো বলবে, আমার ছেলেটাকে কেউ ভালোবাসেনা। দীর্ঘশ্বাস ফেলবে। পুত্রবধূ পাল্টাতে চাইবে। আর এই ঝুঁ*কি পিউ নেবে না মেজো মা!’
সাদিফ মোলায়েম কণ্ঠে বললেন,
” আয়,খেয়ে নে। মুখ কা*লো করে থাকলে কী লাভ হবে? ”
পিউ চুপচাপ গিয়ে তার পাশে বসল। সাদিফ খালি প্লেটে স্বযত্ন পরোটা-ভাজি তুলে দেয়। খাওয়া-দাওয়ার পাঠ চলার অনেকক্ষন পর দেখা মিলল ধূসরের। এক্কেবারে পরিপাটি হয়ে সিড়ি ভে*ঙে নামছে সে। পিউ মনের দুঃ*খে খাবার চিবোতে চিবোতে তাকাল যেই,খেই হারাল ওমনি। ফিটফাট ধূসর ভাইকে দেখেই গলায় আটকাল খাবার। হা করে চেয়ে রইল সব ভুলে। পড়নে নেভি ব্লু শার্ট । হাতা গোঁটাতে গোঁটাতে আসছে ধূসর। পিউ তার মায়ের মুখে বহুবার শুনেছিল, নেভি-ব্লু রঙটা ফর্সাদের জন্যে। ওদের ভালো মানায়। কিন্তু না, ধূসরকে দেখে মনে হলো কথাটা সম্পূর্ণ ভুল। এত চমৎকার লাগছে কেন ওনাকে? একেবারে তার স্বপ্নের রাজপুত্র!
সাদিফের খাওয়া শেষ। হাত ধুঁতে উঠে যায় সে।
ধূসর চেয়ার ফাঁকা দেখে পিউয়ের পাশে এসে বসল সোজা। ওমনি গাঢ় হলো পিউয়ের ধুকপুকানি। মানুষটার শরীর থেকে আসা, বেলিফুলের ক*ড়া সুবাস সরাসরি ভেদ করল নাসারন্ধ্র। পিউ চোখ বুজে বড় করা শ্বাস টানে। সাথে টেনে নেয়, সমস্ত সুঘ্রাণ। আচমকা শশব্যস্ত চোখ মেলল ও। একটু আগের কথা মনে পড়তেই মুগ্ধতায় লেপ্টে থাকা বদন বদলে গেল। সকাল থেকে ধূসরকে পাশে বসানোর জন্যে ম*রিয়া মেয়েটা, এখন যেন কিছুতেই ওকে পাশে মেনে নিতে পারল না।
আত*ঙ্কের কাছে পিউয়ের প্রেমানুভূতি ফি*কে হয়ে আসে। নিশ্চুপ ভাবে মাথা নামিয়ে নেয় থালায়। ধূসরকে দেখে গৃহীনিরা টেবিল থেকে সরছেননা। কী খাবে,কী নেবে, এই নিয়ে হল্লাহল্লি ওনাদের। তন্মধ্যেই সে বলে বসল,
” বড় মা, আমার মনে হয় পিউয়ের পড়াশুনার প্রতি তোমাদের আরো সচেতন হওয়া উচিত। ওর টিউটর কে বলে দেবে প্রয়োজন মতো সব রকম ক*ড়াক*ড়ি দিতে। ”
ব্যাস!পিউয়ের খাবার বন্ধ। মিনা বেগম বুঝতে না পেরে বললেন,
” কেন রে,কিছু হয়েছে?”
পিউ নিচের দিক চেয়ে, চোখ খি*চে ঠোঁট কা*মড়ে ধরল। গতকাল পুষ্পর পিঠের তালটা আজ ওর পিঠে পরল বলে। ধূসর থমথমে কণ্ঠে বলল,
” ওকে তো আমি বই নিয়ে বসতে দেখিনা। যখনই দেখছি হয় টিভি দেখছে,ফোন টিপছে নাহলে বড়দের মাঝে বসে বসে কথা শুনছে। এরকম করলে পরীক্ষায় রেজাল্ট কীরকম আসবে আন্দাজ করতে পারছো?”
মিনা হা*হাকার করে বললেন,
” আমি কী করব! ওকি আমার কথা শোনে? সবাই তোল্লায় দিয়ে মাথায় তুলেছে। একমাত্র তুই ছাড়া ওকে কেউ শা*সন করেনা,আর ও নিজেও কারো কথা শোনেনা। বাপের আদরে, বাঁদড় হচ্ছে দিনদিন।’
পিউ ঠোঁট ওল্টাল। ধূসর আড়চোখে একবার চাইল তার দিক। পুনরায় মিনার দিক চেয়ে শুধাল,
” এখন কী করতে চাইছো? ”
ভদ্রমহিলা গদগদ হয়ে আবদার করলেন,
” তুই ওকে পড়া না বাবা! তুই পড়ালে ওর সব সমস্যা সমাধান হবে আমি নিশ্চিত।”
পাশ থেকে সুর মেলালেন জবা,
” হ্যা রে ধূসর,তুই মেয়েটাকে পড়া। ”
অথচ আঁতকে উঠল পিউ। ধূসর ভাই পড়াবেন মানে? পাগল না কি? উনি পড়ানো মানে মা*র একটাও নিচে পরবেনা। সাথে বকাঝকা পাবে ডিসকাউন্টে।
যাকে দেখলেই হ্যাং হয়ে যায়,সে ওমন সামনে, অত কাছে বসলে মাথাতে পড়াশুনা ঢুকবে? সম্মুখে প্রিয় মানুষ রেখে কেউ পড়া মুখস্থ করতে পারে? যে পারে সে এলিয়েন। পিউ ভদ্র- সভ্য মেয়ে। ওসব তার দ্বারা সম্ভব নয়।
হাতের মুঠোয় পরোটার টুকরোটা শক্ত করে চেপে ধরল পিউ। দুদিকে ঘনঘন মাথা নেড়ে বিড়বিড় করল,মন প্রান দিয়ে চাইল,
” ধূসর ভাই যেন রাজি না হন। প্লিজ প্লিজ প্লিজ!’
প্রার্থনা বিফলে গেলনা। ধূসর জানাল,
” আমার সময় হবেনা বড় মা। দেখছো তো কত ব্যস্ত থাকি! পিউয়ের পরীক্ষা দুমাস পরেই। যেমন আছে চলুক। ”
পিউ চকচকে চোখে চাইল। মিইয়ে যাওয়া ঠোঁটে হাসি ফুঁটল মুহুর্তে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ভাবল,
” যাক, ধূসর ভাই পড়াচ্ছেন না।’
এরপর আর কেউ কিছু বলেনি। যে যার মত ব্যস্ত হলো কাজে। পুষ্পর খাওয়া শেষে চলে গেল সে। পিউয়ের মনে হলো ধূসরের পাশে বেশিক্ষন বসে থাকা ঠিক হবেনা। গতকাল কলেজে কান ধরে দাঁড়িয়ে ছিল,ইনি সেই ভিত্তিতেই যে কথাগুলো বললেন বেশ বুঝেছে ও। এরপর আর কী কী বলবে তার কোনও ঠিক আছে? ওর কীর্তিকলাপের তো আর ইতি নেই।
পিউ তাড়াহুড়ো করে খাওয়া শেষ করল। মা -চাচীরা থাকাকালীন উঠে যাবে, তাহলে আর বি*পদের আ*শঙ্কা নেই।
কিন্তু না। চেয়ার ছাড়তে উদ্যত হতেই একটা উষ্ণ,নিরেট হাত টেবিলের নিচ থেকে ওর বাম হাতটা চে*পে ধরে। বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে তাকাল পিউ। ভী*ত দৃষ্টি রুপ নিলো মারবেল আকারে।
ধূসর একবারও চাইল না ওর দিক। সামনে চেয়ে বলল,
” মা,বড় মা তোমরা দাঁড়িয়ে থেকোনা। আমি নিজের মতো নিয়ে নিচ্ছি খাবার। যাও,কোনও কাজ থাকলে করো।”
তার সুন্দর -সাবলীল কথাটা মেনে নিলেন সকলে। রিক্ত নিজে নিযে খেতে বসে সব গায়ে ফেলেছে। সুমনা ওর মুখ ধোঁয়াতে বেসিনে নিয়ে চললেন। জবা গেলেন ঘরের পথে। বাকী দুজন,এঁটো থালাবাসন গুছিয়ে চললেন রান্নাঘরে। পুরো টেবিলটা ফাঁকা হলো নিমিষে। বসে রইল পিউ আর ধূসর ভাই। গোটা ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটল ও না পারল কিছু বলতে,না কিছু করতে। ভয়ডরে জুবুথুবু,নিরূপায় হয়ে বসে থাকল মেয়েটা। ধূসর চুপচাপ। এটাই যে ঝ*ড়ের পূর্বাভাস। পিউয়ের অশান্ত মন কু গাইছে।
কী যে করবে এখন!
তার দুশ্চিন্তার মধ্যেই একটা হকচকিয়ে দেয়া কান্ড ঘটাল ধূসর। অপ্রস্তুত হা*মলা চালিয়ে বাম কানটা টেনে ধরল পিউয়ের। গায়ের জোর যা ছিল অর্ধেক ঢেলে দিয়েছে হয়ত। পিউয়ের মনে হলো আজকে এটা ছি*ড়ে নেবে সে। অতর্কিত আক্র*মনে ভড়কেছে ও। পরের দফায় ব্যা*থায় আর্তনাদ করে বলল,
” আ ব্যা*থা পাচ্ছি ধূসর ভাই…..ব্যা*থা পাচ্ছি…”
মানুষটার মন গলেনি। উলটে শ*ক্ত কণ্ঠে বলল,
” আর করবি?”
পিউ অসহায় চোখে চাইল। আগেপিছে না ভেবেই জো*রে- জো*রে মাথা নেড়ে বলল,
” আর করবনা। কোনওদিন না। আমার দোহাই আপনাকে,কানটা ছাড়ুন। একটা কান না থাকলে বিয়ে হবেনা। ”
ধূসর চোখ-মুখ গোটাল। দয়া দেখাল তবে। ছেড়ে দিতেই পিউ ব্যস্ত হাতে কান চাপে। আহত স্থান ডলতে ডলতে কাঁদোকাঁদো গলায় বলল,
” এভাবে কেউ কান মলে ধূসর ভাই? এখন যদি কানে আর না শুনি? ব্যা*থায় রাতে যদি জ্বর আসে? কাল যদি কলেজে না যেতে পারি? পড়তে না পেরে যদি পরীক্ষায় ফেল করি, দোষ কিন্তু আপনার। ”
ধূসর দাঁত খিচে বলল ” টেনে একটা থা*প্পড় দিলেই সব সেড়ে যাবে।”
পিউ চুপসে গেল। চোখ নামাল কোলের ওপর। ধূসর ক্ষুদ্র চোখে চেয়েছিল। পরপর সামনে ফিরে বলল,
” রাতে কি নে*শা করে ঘুমাস?”
পিউ আশ্চর্য বনে চাইল। সে নেশা করবে কোন দুঃখে?
ধূসর পাশ ফিরল। তাকাল ঠিক চোখের দিকে। বড় শীতল সেই চাউনী। অথচ পিউ চটজলদি নামিয়ে নিলো দৃষ্টি। ওই কূয়োর ন্যায় গহীন নেত্রযূগলে বেশিক্ষন চেয়ে থাকা যায়না। চাইলেই যেন মৃ*ত্যু দেখে নিজের।
সে বলল,
” আমার মনে হয় তোর মাথা ঠিক নেই। বড়সড় সমস্যা দেখা দিচ্ছে।’
পিউ জিজ্ঞাসু চোখে চাইল। নিষ্পাপ কণ্ঠে শুধাল,
” কী করেছি আমি?”
ধূসর একটু চুপ থেকে বলল,
” ভুলভাল জায়গায় পাগলামো করছিস।”
সঙ্গে আরেকদিক চেয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে বড় করে নিঃশ্বাস ফেললও সে। পিউয়ের কপাল বেঁকে এলো। সে কোথায় পাগলামো করছে? এক ধুসরকে ভালোবাসা,আর তাকে পাওয়ার কল্পনা ছাড়া দ্বিতীয় কোনও পাগলামী ওর মাঝে নেই।
ধূসর হঠাৎই কেমন করে চাইল আবার। দূর্বোধ্য দুটো অক্ষি। লম্বা শরীরটা খানিক নেমে এলো নীচে,পিউয়ের কপাল বরাবর। আড়ষ্ট দুই লোঁচনে চেয়ে শুধাল,
” তুই কি বোঁকা পিউ? যে সময়টায় তোর পৃথিবী রঙে রঙে রাঙানো উচিত, সে সময়ে বর্ণহীন রঙের প্রতি তোর কেন এত আকর্ষন? ”
ভীষণ কঠিন কথা গুলো পিউয়ের মাথায় ঢুকল না। তার হরিনী চোখেও বুঝতে চাওয়ার আগ্রহ মিলল না। বরং সম্মোহনীর ন্যায় ধূসরের চেহারায় আটকে রইল ও। এক লহমায় আঁখিযূগল আবর্ত হলো পুরো মুখশ্রী জুড়ে। প্রশ্ন জাগল মনে,
” এই চোখ আমায় দেখে মুগ্ধ হয়েছে কোনও দিন? যেমনটা আমি হয়েছি,হয়ে এসেছি?”
এক তরফা প্রশ্নের জবাব কখনও আসেনা। দোনামনা করে লতিয়ে পরে মাটিতে। কিন্তু এই যে ধূসর এতটা কাছে,এতেই যেন এলোমেলো হলো পিউ। চটপটে জ্বিভটা বিবশ হয়ে পড়ল। ফুরিয়ে গেল কথার বাণ। ধূসর খানিকক্ষণ সুস্থির বনে তাকিয়ে থাকে। পরপর প্রগাঢ় কণ্ঠে আওড়ায়,
” তোকে যেন আর আমার রুমের ধারে-কাছে না দেখি।”
ঠিক কী থেকে কী হোলো কে জানে! খাবার মাঝপথে ফেলেই উঠে গেল সে। পিউয়ের বিমোহিত চোখমুখ পালটে যায়। চেহারার পরতে পরতে ঘনিয়ে আসে মেঘ। অভিমান ছেঁয়ে যায় হৃদয়ে। আকুল,ব্যথিত দুই চোখ তৃষ্ণার্তের ন্যায় চেয়ে রয় পাথুরে মানবের যাওয়ার দিকে। তক্ষুণি সাদিফ তার ঘর থেকে হাঁক ছাড়ল,
” এই পিউ, এদিকে আয়তো!”
ধূসর থমকে দাঁড়াল চৌকাঠে। পিউ দৃষ্টি সরাতে গিয়েও বিষয়টা দেখে তাকাল ফের। সেকেন্ডের কম সময়,ওমন থেমে রইল সে। লম্বা কদমে দরজা ছাড়ল পরপর।
পিউ ভেঙচি কাটে। ধূসরের কথাটা ব্যাঙ্গ করে আওড়ায়,
‘ তোকে যেন আমার ঘরের আশেপাশে না দেখি। ‘
এমন ভাব যেন হীরেতে মোড়া ওই ঘর। গেলাম না! দুদিন পর যে ঘর এমনিতেই আমার হবে,সে ঘরে এখন না গেলে বয়েই গেছে হু। ‘
পিউ শব্দ করে চেয়ার ছাড়ল। দপদপে, জ্বলন্ত রাগ নিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে চলল সাদিফের কামড়ায়। এই লোকটার আরেক নাম জ্বা*লাতন। যার মা আছেন,এত গুলো চাচী আছে, তার কাজের জন্যে ওকেই কেন চাই?
***
বিকেল পাঁচটা বাজে। শীতের প্রকোপে প্রকৃতিতে সূর্যের নরম তেজ। একটু পরেই সন্ধ্যে নামার ভাব। কুয়াশা ছড়িয়েছে। আজ ঠিক সাতদিন পর বাড়ি ফিরলেন আমজাদ। এই নিয়ে সকাল থেকে হৈচৈ বেধেছে নিবাসে। প্রত্যেকে অপেক্ষায় তার আগমনের।
ছেলে-মেয়েরা অধীর আগ্রহে পথ চেয়ে বসে। আমজাদের বাড়িতে ঢুকতে মাগরিব গড়াল। আজানের পরপর হাজির হলেন তিনি।
সাথে সবার জন্যে চিটাগং থেকে দুহাত ভরে জিনিসপত্র এনেছেন।
এই বিশাল বসতের মূল কর্তা আমজাদ সিকদার। যার ভয়ে তটস্থ থাকে বাকী তিন ভাই ও ছেলেমেয়ে। ভদ্রলোকের অনুমতি ব্যাতীত বাড়ির বাইরে পা রাখারও নিয়ম নেই। প্রত্যেকেই ওনাকে সম্মান করে,শ্রদ্ধা করে। ভাইয়েরা মান্য করে চোখ বুজে। কেবল নিয়ম বহির্ভূত রয়ে গেল ওই একটি মানুষ।
আমজাদ বেশ কঠোর ব্যাক্তিত্বের পুরুষ। তবে আজ যেন নরম ভীষণ। এসেই প্রত্যেককে আদর করছেন, চুমু দিচ্ছেন। রিক্তকে কোলে নিয়েই বসে পড়লেন সোফায়।
পিউ বাবার পাশ ঘেঁষে বসে। তার দুহাত ভর্তি প্যাকেট। সামনে আরো টেবিল ভরা জিনিসপত্র। বসার ঘর ঘিরে সকলে। আমজাদ সানন্দে যার যারটা বুঝিয়ে দিচ্ছেন তাকে।
সাদিফ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরল আজ। আফতাব,আনিস ওনারা এসেছেন আরো আগে। বড় ভাইয়ের ফেরা মানে উৎসবের আরেক রূপ। সাদিফ এক কাঠি ওপরে গিয়ে,এসেই বড় চাচার পা ছুঁয়ে সালাম করল। অমায়িক হেসে শুধাল,
” কেমন আছেন চাচ্চু? শরির ভালো আছে?”
এমন শ্রদ্ধা,ভদ্রতা সাদুবাদে পুলকিত হলেন আমজাদ। ওর কাঁধ ছুঁয়ে বললেন,
” খুব ভালো আছি বাবা। এতদিন পর তোদের সবাইকে দেখলাম,ভালো না থেকে পারি? তা তোর অফিসের কী খবর? কাজ বাজ যাচ্ছে কেমন ? চাপ হচ্ছেনা?”
” না না,সামলে নিচ্ছি আমি।”
বলতে বলতে সাদিফ পিউয়ের দিক চাইল। মুখের কাছে হাত নিয়ে ইশারায় বোঝাল,
” পানি দিতে।”
পিউ বাধ্যের ন্যায় পানি আনতে যায়। এটা রোজকার চাকরি তার। বসার ঘর তখন আড্ডায় জমজমাট। গল্পে মজে গেলেন একেকজন। আমজাদের দীর্ঘ জার্ণির শ্রান্তিবোধ উবে গেল যেন।
মিনা,রুবায়দা হাজারবার বললেন” আগে একটু বিশ্রাম করতে। গল্প না হয় পরে হতো।”
কিন্তু শোনানো গেল না ওনাকে। আসর ছেড়ে তিনি কেন,কেউই উঠবেনা। সুমনা চা বানিয়ে নিয়ে এলেন।
কথার এক ফাঁকে আমজাদ হঠাৎই প্রশ্ন ছুড়লেন,
” তোর ছেলে কোথায় আফতাব?”
ব্যাস! ভদ্রলোকের হাসিহাসি মুখখানি দপ করে নিভে গেল। শান্তশিষ্ট মানুষটা একবার স্ত্রীর দিক তাকালেন। সেও সহায়হীন চোখে চেয়ে। ছেলের সঠিক হদিস তারা কেউই জানেন না বুঝে নিলেন আমজাদ। দুদিকে মাথা নেড়ে আক্ষেপ সমেত বললেন,
” ওকে নিয়ে আর কোন আশার আলো একদমই দেখছিনা আমি।”
পিউয়ের মুখটা তত্র বিরক্তিতে তেঁতো হয়ে আসে। ধূসরের ভবিষ্যৎ নিয়ে এখন যে এক দফা আলাপ চলবে তা নিশ্চিত।
এসব শুনতে ওর ভালো লাগেনা! বাবা,চাচ্চুরা লোকটাকে নিয়ে সামান্য কটুবাক্য বললেও তার বুক পুড়ে যায়। সবাই কেন এমন করে? ধূসর ভাই তো বসে বসে খাচ্ছেন না। ঘুরেফিরে বাপের টাকাও ন*ষ্ট করছেন না। চলছেন সম্পূর্ন নিজের খরচে। তাহলে ওনার মত চলতে দিলে কী হয়? আর সব থেকে বড় কথা এই যে সে,ওর বউ হবে,সে তো সবটা মেনে নিচ্ছে। তাহলে বাকীরা এরকম করে কেন?
সাদিফের বাবা আজমল একজন ফরেস্ট অফিসার। আপাতত রাঙামাটিতে বদলি উনি। সরকারি লম্বা ছুটি ব্যাতীত বাড়ি আসা হয়না। জবা বেগম ছোট ছেলেকে নিয়ে মাঝেমধ্যে বেড়িয়ে আসেন। বাড়ি ভর্তি ভাইয়েদের আলাপে আজমল মিসিং আজও। ভাইয়েদের মধ্যে এই একটা মানুষই আছেন,যিনি ধূসরের হয়ে দু/চারটে কথা বলেন।
আফতাব বাড়ি এসেই একটা মস্ত বড় বাজারের ব্যাগ মিনার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। সাথে নরম গলায় আবদার ছুড়েছেন,
” প্রত্যেকটা আইটেম রাধবেন ভাবি। যাতে হাত চেটেপুটে খেলেও পেট না ভরে। আজ সবাই কব্জি ডুবিয়ে খাব কিন্তু ।”
” ঠিক আছে ভাই। দেখব কত খেতে পারো!
মিনা আর বাকীরা রান্নাঘরে সে নিয়ে ব্যস্ত। বসার ঘরে ধূসরকে নিয়ে আলোচনা তখনও বহাল। পিউ বিরস, অনীহ ভঙিতে শপিং ব্যাগের স্কচটেপ খুলছে। ডানে-বামে রাদিফ আর পুষ্প বসে। সেই সময় রিক্ত কুটিকুটি পায়ে সদর দরজা হতে ছুটতে ছুটতে এলো। শিশু কণ্ঠে স্লোগান তুলল,
” বলো ভাইয়া গা*লি কিনেছে,বলো ভাইয়া গা*লি কিনেছে।”
সবার উৎসুক চাউনী নি*ক্ষেপ হয় বাচ্চা ছেলেটার ওপর। আধো আধো বুলি স্পষ্ট বুঝতে সময় লাগল কিছুটা। রিক্ত বেশ কয়েকবার আওড়ানোর পর বোঝা গেল গাড়ি কিনেছে ধূসর।
কথাখানা শুনতেই দাঁড়িয়ে পড়ল পিউ। মিনা-রা রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। ত্রস্ত এগোলেন বাড়ির বাইরে। পিউয়ের সব গোলমাল লাগছে। ধূসরের গাড়ি আগে থেকেই আছে। উনি আবার একটা গাড়ি কিনে কী মাথায় রাখবেন?
আমজাদ ফেরার পর গড়ে ওঠা রমরমে পরিবেশ টা মুহুর্তে স্থিত হয়। প্রত্যেকে এগোলো গেটের দিক। পিউ এসেই এক প্রকার ঝুলে পড়ল দরজায়। ধুসর দাঁড়িয়ে, পাশে একটা অচেনা লোক, আর বাড়ির দারোয়ান। তিনজনের মাঝখানে ঠেস দিয়ে দাঁড় করা একটি চকচকে কালো রঙের বাইক।
দারোয়ান হা-হু*তাশ করছেন কিছু নিয়ে। দুদিকে মাথা নেড়ে বিড়বিড় করছেন ক্রমশ। রুবায়দা অবাক হয়ে বললেন,
” কী রে ধূসর,হঠাৎ বাইক কিনলি যে?”
তার আগেই দারোয়ান আহাজারি করে বললেন,
“আপনার পোলা পা*গল হইয়া গেছে আম্মা। নাইলে কেউ গাড়ি বেইচা হুন্ডা কেনে কন?”
পিউ তাজ্জব বনে চাইল। একইরকম বিস্মিত বাকীরা। অথচ নিরুৎসাহিত মানুষটা বাইকের হেলমেট হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছে। এত এত বিমূর্ত দৃষ্টি একটুও প্রভাব ফেলেনি তার ওপর। জবা বেগম বললেন,
” ওমা, সে কী কথা? গাড়ি কেন বেঁচেছিস? কত শখ করে কিনেছিলি!”
ধূসর কারো দিক দেখল না। হেলমেট হাতে,কপাল গুছিয়ে রেখেই বলল,
” আজকাল গাড়ির থেকে বাইক ভালো লাগছে, তাই।”
চলবে,