#এলোকেশী_সে
#মাহমুদা_লিজা
পর্বঃ১
– অবাঞ্ছিতের মত পড়ে না থেকে শিরদাঁড়া উঁচিয়ে বেশ থাকা যায় মা, এভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্যে নিজের ভেতরের সত্তাটাকেও দাসী বানিয়ে রেখেছো কেন?
মেয়ের অমন ঠাস ঠাস ভঙ্গিতে বলা কথাগুলোর জবাবে কঠিন কয়েকটা কথা শোনাতে গিয়েও নিজেকে ধাতস্থ করে রুবাবা বললেন – দেহের ছায়াটাই যখন দাসীর দায় মেনেছে সেখানে মনকে জোর করা বিলাসিতা। অল্প বয়স তোমার, বুঝবে না কেন পড়ে আছি।
মায়ের অমন আস্হা হারানো বুলি শুনে তোড়া খ্যাক করে উঠতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল। মায়ের মনটাই তো আর দশটা নারীর মত দোসর হয়েছে, সেখানে বিবেককে কতটুকুই নাড়াতে পারবে সে।
ভ্রু যুগল নাকের ডগায় টেনে ললাটে তিন চারখানি ভাঁজ ফেলে ফোঁস করে নিশ্বাসটা ছেড়ে শব্দ তুলে প্রস্হান করল মেয়েটা। মেয়ের যাওয়ার পানে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাসটা ছেড়ে রুবাবা নিজের কাজে মন দিলেন।
কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে ঘাড় ঘুরাতেই ছোট জা’কে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস টেনে বললেন – সমাজের রক্তচক্ষু এখনো মেয়েটার ভাবনায় আসেনি, তাহলে এভাবে চটাংচটাং কথা বেরোতো না।
রুবাবার পাশে বসে কলি ছোট্ট করে বলল – তোড়া ভুল বলেনি ভাবী। বরং তুমিই নিজেকে দূর্বল ভেবে এসেছো আঠেরটা বছর। সময় পাল্টেছে, যুগ বদলেছে, নারীরা হাল ধরতে শিখেছে।
সিক্ত নয়নজোড়া সন্তর্পণে মুছে নিয়ে রুবাবা বললেন – একটা ঘটনা বলি, শোন। অষ্টাদশী এই আমিটাকে এইচএসসি পরীক্ষার আগেরদিন বিয়ের পিড়িতে বসিয়ে সংসারের যাঁতাকলে পাঠিয়েছিল আমার জাঁদরেল বাবা। অমত করেছি, মার খেয়েছি, অভিশাপ শুনেছি কিন্তু বাবা যেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বিয়ে তিনি দেবেনই। মায়ের মুখে কোন বুলি নেই, তিনি পাশে দাঁড়ান নি। তিনিও কঠোর স্বরে বলেছেন বিয়ে করে নাও, বয়স বাড়ছে।
রুবাবা থামলেন, হেঁচকি তুলে কাঁদলেন কিছুক্ষণ। শান্ত টলটলে নয়নজোড়া আজ অশ্রুসজল। হরিণী নেত্রজোড়া লাল হয়ে ফুলে উঠেছে ততক্ষণে। আবার বলতে শুরু করলেন তিনি – পরীক্ষার আগেরদিন বিয়ে হয়ে এলেও মনের কোনো এক গোপন কুঠুরিতে আলো জ্বলছিল। হয়ত আমাকে স্বামী নামক পুরুষটা সঙ্গ দিবে, হাত ধরে বলবে -তুমি এগিয়ে যাও।
কিন্তু বিধি বাম, স্বামী নামক পুরুষটা এক বাক্যে জানিয়েছেন – তিনি এসব নিয়ে একদম ভাবছেন না, সংসারে মন দিতে হবে।
ডুকরে কাঁদলেন রুবাবা, ফোপাঁতে ফোপাঁতে বললেন – নিজের স্বপ্ন দাফনের সাথে সাথে সেদিন মনের কোণে সমাহিত করেছিলাম বাবার বাড়ি ফেরার ইচ্ছে। আর যাইনি ও বাড়িতে। এখন বাবা নেই, মা নেই। ভাইদের সংসারে গিয়ে মেয়েকে খেলার পুতুল বানানোর ইচ্ছে নেই। আমার যা হয় হোক কিন্তু মেয়ে তো মাথা তুলে বাঁচতে পারছে তার বাবার বাড়িতে। কেউ আঙ্গুল তুলে বলতে পারছে না পরগাছা।
মেঝ জা’য়ের অন্তরে সুপ্ত ক্রোধখানা উন্মোচন করল কলি। বাবার প্রতি স্বপ্ন ভাঙার দোষারোপ মানুষটার। একজন মানুষের রাগ এতটাও তীব্র হয়! অবশ্য না হয়েও উপায় নেই তো। বুক ভরা স্বপ্নের বিয়োগান্তে দিগ্বিদিক জ্ঞান কাজ করে না তো।
কলির নজর গেল এতক্ষণে তার মেঝ ভাসুরের দিকে। দ্বিতীয় স্ত্রীর নিকট পানি চাইলেন। রুবাবার মত মানুষকে উপেক্ষা করে লোকটা কিভাবে দ্বিতীয় বিয়ে করল, কি দোষ ছিল।
বারংবার কৌশলে জানতে চেয়েছিল কিন্তু কেউই বলেনি কেন এই অন্যায়টা করল নিজাম। কলির ভাবনায় ভাঁটা পড়ল ছেলের ডাক শুনে – আম্মু, আমার জুতু ছিঁড়ে গেল, দুইটা জুতু কিনবা।
কলি হেসে ছেলের কাঁধে হাত রেখে বললেন – শুধু দুটো, তিনটে দিলে হবেনা?
এতক্ষণে রুবাবা ঘুরে তাকালেন। কপট রাগ দেখিয়ে জা’কে বললেন – তুই এখনো পাগলামি ছাড়লি না, ছেলেকে কি বড় করবি।
কলি হাসতে হাসতে লুটোপুটি করার জোগাড়। ঠোঁট টিপে হাসিটা থামিয়ে জবাব দিল – ভাবী, আমরা দুষ্টুমি না শেখালে এরা ভুলে যাবে দুষ্টুমি কি জিনিস।
আবারও হাসিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল কলি। প্রৌঢ়া মেহেরজান লাঠির খুঁট খুঁট শব্দ তুলে নিজের কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। কলির খিলখিল হাসিতে নজর আটকালেও খানিক বাদে দৃষ্টি ঘুরল রুবাবার শীতল মুখখানার দিকে। বড় সাধ করে মেয়েটাকে মেজ ছেলের বউ করে এনেছিলেন। অনাবিল হাসিওয়ালা মেয়েটা সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আজ সে কতটা অভিনিবিষ্ট।
এগিয়ে এসে মেহেরজান বললেন – কিগো রুবা, তুমি আমার পান সাজাই দিলা না যে?
শাশুড়ির কন্ঠ শুনে দুই জা’ই ঘুরে তাকাল। কলি হাসিতে লাগাম টেনে বলল – ইস আম্মা, সবসময় শুধু ভাবী পান সাজাবে কেন? আমাদের তো কখনো বলো না।
ছোট বউয়ের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে মেহেরজান বললেন – তোমারে কইছি না ওরে ভাবী ডাকবা না, আপা ডাকবা। ও আমার মাইয়া, ঐ কুলাঙ্গারের পরিচয়ে ওরে এখানে রাখি নাই, ও আমার আর তোমার শ্বশুরের মাইয়া হইয়া রইছে।
রুবাবা মাথা নিচু করে বেরিয়ে এলো, নয়লে বারবার তার ক্ষততে দগ্ধতা বাড়ে।
শাশুড়ির দোরগোড়ায় আসতেই রুবাবাকে ডাকল তার বড় জা অনিমা। হাতে থাকা পেয়ারাটা এগিয়ে দিয়ে বলল – তোড়াকে দিস, এতবার ডাকলাম, এলোনা।
রুবাবা মলিন হেসে বলল – ও ছোট মানুষ আপা, সমাজের মারপ্যাচ বোঝে না। এখানে থাকতে রাজি নয়। আমি ওর কথায় মত দেইনা বলে এত রেগেছে।
রুবাবাকে ছোট বোনের মত আগলে রাখা অনিমা তখন টেনে এনে বুকে জড়িয়ে বলল – একদম যাস না। তোর অধিকার আছে এখানে। বিন্দু পরিমাণও ছাড় দিবি না। নইলে মেয়েটার অধিকারও জলে যাবে।
রুবাবা মুচকি হাসলেন, মাথা নাড়িয়ে বললেন – মেয়ের অধিকার পাই পাই করে বুঝে নেব আপা। ওকে আমার মত ফেরারী হতে দেবোনা।
আবারও একবার তোড়ার ঘরটার দিকে তাকালেন অনিমা। মেয়েটা বড্ড জেদী। কবে বুঝবে এখানে না থাকলে ঐ লোকটাকে শায়েস্তা করা যাবে না! দৃষ্টি ঘুরিয়ে সামনে তাকাতেই ছেলেকে দেখে হাসলেন তিনি। মৃদু স্বরে বললেন – দুপুরে খেতে কেন আসলি না?
অহন খানিক রসিকতা করে বলল – দুপুরে কল দিয়ে বাসায় ডেকে খাওয়ানোর মত কে আছে বলো? বাবার জন্য তুমি আছো, ছোট কাকার জন্য কাকীমা আছে আর মেঝ কাকার জন্য তার বউ আছে। আমাকে তো কেউ ডেকে বলেনা খেতে এসো।
ছেলের অমন কথা শুনে চক্ষুদ্বয় যেন কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার জোগাড়। বিস্ফোরিত চোখজোড়া যেন জ্বলে যাবে।ততক্ষণে অহন মায়ের মুখোভঙ্গিতে গভীর পর্যবেক্ষণ চালাল। মাথার চুলগুলো আঙ্গুল দিয়ে একপাশে সরিয়ে পুনরায় মাকে জিজ্ঞেস করল – মহারাণী কোথায়? প্রতিদিন তো দেখি খরগোশের কান ধরে নাচে। আজ কোন রাজ্যে গেছে?
ছেলের কথায় খেই হারানো অনিমার কর্ণকুহরে তখনো প্রবেশ করেনি শেষোক্ত বাক্যগুলো। ততক্ষণে শাশুড়ির পান নিয়ে বেরিয়ে এলো রুবাবা। বড় জা’কে অমন মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অহনকে প্রশ্ন ছুঁড়লেন – কখন এলি? আপা এমন মূর্তির মত থমকে গেছে কেন? আবার কি বোমা ফাটালি?
মেঝ কাকীর কথা শুনে অহন কাঁধ উচিয়ে বলল – ভর সন্ধ্যেতে জ্বিনের আছর হয়েছে মেজ মা, মা’কে শুধু বললাম আমার খবর কেউ রাখেনা। এটুকুই বললাম, জিজ্ঞেস করো মেজ মা।
রুবাবা এবার অনিমাকে হাত দিয়ে ঝাঁকিয়ে বলল – আপা, কি হইছে? চোখ এমন কপালে তুলেছো কেন?
অনিমা ছেলের শান্ত আদলখানার দিকে আঙ্গুল তুলে বলল – এই হতচ্ছাড়া আমায় কি বলেছে জিজ্ঞেস কর। এতদিন বিয়ে কর বিয়ে কর বলে আমি শহীদ হয়ে যাচ্ছিলাম, তখন নিজে বলল বিয়ে করবে না। এখন কি বলে শোন।
অহন কব্জিতে থাকা ঘড়িটা খানিক নেড়েচেড়ে বলল – তখন বউ ছোট ছিল, এখন বড় হয়েছে । সেই কোনকালে বলেছি বিয়ে করব না, সেটা কব্জা করে তোমরা এখনো কি রিল্যাক্স মুডে আছো।
কালবিলম্ব না করে হনহনিয়ে অহন চলে গেল নিজের ঘরের দিকে, রুবাবা আর অনিমা একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে করতেই বুঝতে পারছে না বুকের ভেতর ধুপধাপ শব্দ। অনিমা এদিক সেদিক তাকিয়ে বললেন – এই রুবা, এই ছেলের জন্মের পর কত মধু খাওয়ালাম, চোখে কত কাজল দিলাম কিন্তু ও এত নির্লজ্জ আর ঠোঁট কাটা কেন রে?
রুবাবা হাসতে হাসতে বসে পড়ল মাটিতে, পেট চেপে ধরেছে বা’হাতে। কোনমতে হাসি আঁটকে বলল – ঠিকই তো ছেলের বিয়ের বয়স হয়েছে কিন্তু তোমরা ভুলে গেলে কেন?
এতক্ষণ নিষ্প্রভ আদলখানায় মোহনীয় হাসিটা নজর কাড়ল অনিমার। মুগ্ধ চাহনিতে দেখছে রুবাবার ছলছল করা হাসিটা। এই অকৃত্রিম হাসিটা কেন তার দেবরের হৃদয়টাকে আঁটকে দিতে পারল না! পেলব হাতখানা টেনে ধরে অনিমা বলল – তুই হাসছিস বদমাশটার কথা শুনে?
মুখের কথাটা এমন হলেও মনের কথা ছিল – তোর হাসিটা আমার বুকে ছলাৎছলাৎ ঢেউ তুলছে বোন, এভাবেই হেসে ঐ লোকটাকে বুঝিয়ে দে তুই দূর্বল নয়।
চলবে……..