#এলোকেশী_সে
#মাহমুদা_লিজা
পর্বসংখ্যাঃ ১৩(বর্ধিতাংশ)
অহনের নিষ্পলক চাহনিতে খানিক আড়ষ্ট হলো তোড়া। ধীর কদমে হেঁটে টেবিলটার পাশে গিয়ে বলল -“ভাইয়া, আগামী মাসে….”
কথাটা শেষ করার আগেই এলোকেশীর অধরে নিজের তর্জনীটা রেখে বলল -“মে/রে ফেলার ইচ্ছে হয় নাকি? কি দরকার সময় অসময় বুকে ব্যাথা বাড়ানোর?”
লজ্জারা ঘিরে ধরেছে তোড়াকে, অহনের পানে নিবদ্ধ রাখা দৃষ্টিটা সরিয়ে মেঝেতে রাখল। ঐ নুইয়ে যাওয়া আদলটা বেশ মোহনীয় লাগছিল। অহনের মনটা হঠাৎ বিদ্রোহী হয়ে উঠল, এলোকেশী মেয়েটাকে নিজের জীবনে আষ্টেপৃষ্টে জড়ানোর তীব্র আকাংখা জন্মাল আজ। নিজের মনটাকে কিছু কড়া বাক্য শুনিয়ে সামনে থাকা মানুষটাকে বলল -“ছাদে যাব, একা ভালো লাগে না।”
অপরপাশের মানুষটার জবাবের অপেক্ষা না করেই তার হাত
ধরে হাঁটা ধরল সে। ব্যাটারি লাগানো পুতুলের মত তোড়াও চলল, মনটা উশখুশ করছে মায়ের ভয়ে। তবুও প্রিয় মানুষটার একটুখানি সান্নিধ্য সেই ভয়টাকে কাবু করেছে।
ছাদের সিঁড়িটায় ঘোর আঁধার। অহন মুঠোফোনে ফ্ল্যাশলাইট অন করে গায়ে থাকা কালো চাদরটা আরেকটু জড়িয়ে বলল -“ভয় লাগছে?”
সিঁড়ি বেয়ে ততক্ষণে ছাদে পা রাখল দুজনে। অহনের ছোট্ট প্রশ্নের জবাবে দু’দিকে মাথা দুলিয়ে বলল -“ভূতের ভয় না, আম্মুর ভয় পাচ্ছি।”
অহন আরো দু’কদম হেঁটে সামনে এগিয়ে গেল। সেদিনের মত মেঝেতে বসে শীতল কন্ঠে শুধালো -“আর আমাকে ভয় লাগছে না?”
খানিক দূরত্ব রেখে দাঁড়ানো মেয়েটাও অহনের অনুকরণে মেঝেতে বসে গায়ের ওড়নাটা আরেকটু আঁটসাঁট করে জড়িয়ে বলল -“কেন, আপনি কি বাঘ না ভাল্লুক! ভয় পাব কেন?”
অহনের খেয়াল হলো ছাদে অনেকটাই ঠান্ডা। উত্তরী হাওয়া এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে দুজনকেই। নিজের গায়ে থাকা কালো চাদরটা হাওয়াদের আঁটকে দিচ্ছি কিন্তু কিশোরী মেয়েটার ফিনফিনে বস্ত্রটা হাওয়াদের আলিঙ্গন করে মেয়েটার কোমল শরীরটাকে কাঁপিয়ে তুলছে ক্ষণে ক্ষণে। যতবার মেয়েটা কেঁপে উঠছে ততবার ওড়নাটা আরেকটু টেনে ছোট্ট শরীরটা ঢাকার চেষ্টা করে। নিজের গা থেকে কৃষ্ণ চাদরটা খুলে উঠে দাঁড়াল অহন। ধীর কদমে এসে দাঁড়াল তোড়ার পেছনে। অনর্থ কিছু ভাবনা এসে ভর করল তোড়াকে। এবার খানিক ভয় তাকে গ্রাস করছে ক্রমে। পেছনে দাঁড়ানো মানুষটার উপস্থিতি তাকে শংকিত করছে। অপ্রতিভ স্বরে বলল -“মাস্টার মশাই!”
হঠাৎ সে অনুভব করল হিমেল বাতাসটা তাকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে না, ভারী কোন বস্ত্র তাকে আচ্ছাদিত করেছে। নিজ হাতে এলোকেশীকে চাদরে আবৃত করে অহন গম্ভীর স্বরে জানতে চাইল -“শীত লাগছে?”
দুহাতে চাদরটা দু’পাশ থেকে আঁকড়ে ধরে তোড়া ছোট্ট করে বলল -“উহু।”
কিছুক্ষণ আকাশের দিকে উদাস দৃষ্টিতে চেয়ে রইল তোড়া। দৃষ্টি নামিয়ে অহনের পানে চেয়ে বলল -“আপনার শীত লাগছে না?”
একমনে এলোকেশীর দিকে তাকিয়ে থাকা অহনের ভেতর কোন জড়তা কাজ করেনা। প্রকাশ্যে সময়ে অসময়ে নয়নভরে দেখে এই চপলাকে। তবুও কেন যেন ঐ নয়নজোড়া ক্লান্ত হয়না। তোড়ার প্রশ্নের ফিরতি জবাবে আনমনে বলেই দিল -“শীতল অনলে পুড়ে অঙ্গার হচ্ছি তোড়া রাণী, আমাকে শীতেরা কাবু করতে আর পারল কই?”
অমন হেয়ালী বাক্যে ভ্রু কুঁচকাল তোড়া। দিন দিন মানুষটা নতুনরূপে ধরা দিচ্ছে তার কাছে। সকলের নিকট গম্ভীর ট্যাগ লাগানো ছেলেটা তার কাছে বড় বেসামাল অনুভূতিদের ডায়েরী মনে হয়। যে ডায়েরীটার শুরু আছে কিন্তু তার শেষ পাতায় কি আছে তা পড়া হলোনা। তোড়ার নীরবতা মানতে পারল না অহন। খানিক ঈর্ষান্বিত হয়ে বলল -“অয়নের সাথে তো বেশ কথার ঝুলি খুলে বসা হয়। আমি অধম কি অপরাধ করেছি? আমাকে বলার জন্য কি তোমার কোন ভাষা নেই?”
এতদিনের পরিচিত সম্বোধনটা মুহূর্তে পাল্টে গেল। সামনের মানুষটার মুখে ‘তুমি’ সম্বোধনটুকু তাকে শিহরিত করল। বিস্ময়ভরা চাহনি নিয়ে অপলক চেয়ে রইল তোড়া। সে ঠিক শুনেছে কিনা তা ভেবেই ঘোরে চলে গেল। ঘোর কাটিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলল -“আপনি আমায় কি বললেন একটু আগে?”
অহন ঠোঁটজোড়া গোল করে শ্বাসটা ছেড়ে বলল -“তোমার আর আমার সম্পর্কে তুই শব্দটা ঠিক আসে না। তুমি আমার একবুক অনুভূতি, অনুভূতিদের কেউ অসম্মান করে নাকি?”
কি অদ্ভুত আবেশে জড়ালো মেয়েটা। নিজের শক্ত কঠিন খোলসটা ছেড়ে সহজাত আবেগ জড়িয়ে সে শুধালো -“আগলে রাখবেন তো? কখনো মনে হবে না তো অনুভূতিরা মরে যাচ্ছে?”
আর সংযত থাকতে পারল না অহন। নিজের শক্তপোক্ত হাতের তালুতে আদুরে কোমল গালটাকে স্হান দিল। বেশ আদুরে স্বরে বলল -“সেই ক্ষণটা না আসুক ইহজনমে, সেই ক্ষণের আগেই যবনিকা ঘটুক এই অধমের তপ্ত নিঃশ্বাস।”
আকাশের বুকে গোল থালার মত ঝলমলে চাঁদটা যেন আজ মেঘের আড়ালে থাকতে চাইছে না। বারবার উঁকি দিচ্ছে দূরে কোথাও স্বপ্ন বুনতে থাকা মানুষ দুটোর পানে।
মুঠোফোনের পর্দায় সময় দেখে মৃদু স্বরে শুধালো -“ঘুমোবে না?”
উপরে নিচে মাথা দুলিয়ে তোড়া বলল -“হু।”
মুঠোফোনে দৃষ্টি রেখেই অহন বলল -“তুমি যাও, আমি কিছুক্ষণ পরে যাব?”
তোড়ার উৎসুক চাহনিটা বুঝতে পেরে কপট দুষ্টুমির ছলে অহন বলল -“এখনো বউ হওনি তো, বউ হলে নিজে সাথে করেই নিয়ে যেতাম। এখন তোমার সাথে গেলে নিজেকে বর বর ফিল হবে।”
অপ্রত্যাশিত কথাটা কানে আসতেই তোড়া নাজেহাল হওয়ার ভঙ্গিতে ঘাঁড়টা ডানদিকে কাত করে মুচকি হাসল। পেছনে ঘুরে হাঁটা ধরল। ছাদের দোরটার কাছে এসে পেছনে একবার তাকাতেই দেখল অহন তখনও অপলক চেয়ে আছে তার গমন পথে। দৃষ্টি সরিয়ে সামনে এনে আঁধারে মিলিয়ে গেল মেয়েটা। রেলিং হাতড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল। মনটা খুশিতে বাক-বাকুম করছে। সে হয়ত গুছিয়ে অনুভূতি প্রকাশ করতে জানেনা কিন্তু ঐ চমৎকার শৌর্যের পুরুষটা ঠিকই তার সুপ্ত অনুভূতিতে শান দিচ্ছে।
_________
সাপ্তাহিক ছুটি হওয়ায় বাড়িতে বসে অলস সময় কাটাচ্ছে সকলে। বিকেলের জমজমাটি আড্ডায় মেয়ের দলটা বাড়ির পেছনের গাছগাছালির ছায়ায় বসে গল্প জুড়েছে। চায়ের কাপে ছোট ছোট চুমুক আর সুখ দুঃখের গল্পে মজেছে তারা। বাড়ির পুরুষগুলো বসে বসে তাদের আড্ডায় উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। তোড়ার খরগোশছানাগুলোর গুটি গুটি পায়ে দৌঁড়ানো, পাখিদের কিচিরমিচির সবার অলস সময়টাকে মোহনীয় করে তুলেছে।
তুষার,তন্ময়, পরশ আর প্রহর মেতেছে ক্যারম খেলায়।
অহন বসে বসে ছোটদের ক্যারাম খেলা দেখছে। মাঝেসাঝে একে ওকে দেখিয়ে দিচ্ছে। সবাই বাড়িতে থাকলেও অয়নটা সেই দুপুরের আগে বেরিয়েছে, এখনো ফেরেনি। নতুন ফোন কেনার কথা বলে বেরিয়েছে ছেলেটা। দুপুর গড়িয়ে শেষ বিকেলে এসে বেলা ঠেকেছে, তাও ছেলেটা আসেনি। দুপুরে খেয়েছে কিনা তাও জানায়নি।
আচমকা পরশের চিৎকারে চমকে উঠে অহন। কানটা সজোরে টেনে ধরে জিজ্ঞেস করল -“চিৎকার দিলি কেন? পেটে মোচড় দিলে ওয়াশরুমে যা।”
পরশ বড় ভাইয়ের হাতটা ধরে বলল -“জিতে গেছি ভাইয়া, আমি জিতে গেছি।”
কানটা ছেড়ে দিয়ে মাথায় চাটি মেরে অহন বলল -“আস্তে চিৎকার করবি। নইলে দেখবি প্যান্টের পেছনে হাওয়া ঢুকবে আর বের হবে।”
কথাটা বলে খানিকটা দূরত্ব নিয়ে বসল অহন। ওদিকে পরশ বড় ভাইয়ের কথার মর্ম না বুঝে বারবার জিজ্ঞেস করছে হাওয়া কিভাবে ঢুকবে! অহন ঠোঁট টিপে হাসলেও জবাব দিলো না। অগত্যা ছেলেটা দৌড়ে গিয়ে কলিকে সবার সামনে জিজ্ঞেস করে বসল -“আম্মু, প্যান্টের পেছন দিয়ে হাওয়া কিভাবে ঢুকবে?”
কলি ভ্রু জোড়া কপালে তুলে বলল-“তোর কি প্যান্ট ছিঁড়ে গেছে নাকি আবার?”
ততক্ষণে হাসির রোল উঠেছে সেখানে। লজ্জা পেয়ে ছুটে পালাল পরশ। যাওয়ার আগে অহন ভ্রু নাচিয়ে ইশারা করল কেমন লাগে!
গোধূলির লোহিত রঙা সূর্যটা অস্তাচলে হেলে পড়েছে। সন্ধ্যার আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। সবাই তড়িঘড়ি করে ঘরে ঢুকে এলেও তোড়া তখনো ঘাসের উপর বসে বসে আকাশ দেখছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে অহন জিজ্ঞেস করল -“অয়ন কোথায়? ছুটির দিনে ও তো বাইরে থাকে না।”
তোড়া ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল। মুখটা উপরে তুলে বলল -“জানিনা তো।”
অহন চুলে আঙ্গুল চালাতে চালাতে কিছু একটা ভেবে জিজ্ঞেস করল -“অনুর বাসায় একটু খবর নাও তো। কোন ঝামেলা হলো না কি আবার?”
অহনের কথামত কাজললতার নাম্বারে ডায়াল করল তোড়া। ওপাশ থেকে কোন জবাব এলোনা। রিং হতে হতে ডিসকানেকটেড হলো কল। আবারও ডায়ালপ্যাড থেকে কাজললতার নাম্বারে কল দিল তোড়া। ওপাশ থেকে জবাব এলো এবার। তোড়া উৎকন্ঠা নিয়ে কিছু বলার আগেই কাজললতার কথা শুনে চমকাল মেয়েটা। এপাশ থেকে কোন প্রশ্ন করার আগেই ফের ডিসকানেকটেড হলো লাইন।
তোড়ার ভয়াতুর আদলটা নজরে আসতেই তার দু’বাহু ধরে ঝাঁকালো অহন, উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল -“কি হয়েছে?
এদিক সেদিক চোখ বুলিয়ে স্বর নিচু করে তোড়া বলল -“অনুও বাসায় নেই। ভাবী বলল দুপুরের পর পরই পালিয়েছে। সবাই ভাবীকে দোষ দিচ্ছে।”
বিরক্ত আর দুশ্চিন্তা এসে ভর করেছে অহনকে। বাড়িতে আজ কোন দূর্যোগ ঘটবে তা ভেবে অস্হির হলেও পরক্ষণেই ঠোঁটজোড়া গোল করে দম নিল। ছোট ভাইকে আগলে নেয়ার পরিকল্পনা সাজিয়ে নিল মনে মনে।
তোড়াও ঘরে এসে বসার ঘরটাতেই গাঁট হয়ে বসে রইল। আগত দুর্যোগ নিয়ে বেশ চিন্তিত সে নিজেও। জ্যেঠীমা আর জ্যেঠার হাস্যোজ্জ্বল বদনখানা দেখে আফসোস হলো তার। অয়ন যদি সত্যি অনুকে বিয়ে করে নিয়ে আসে তাহলে তাদের কি অবস্থা হবে, মনের দশাই বা কি হবে তা নিয়ে সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই কলিংবেলটা বেজে উঠল।
বাড়ির দরজাটার দিকে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলল তোড়া। ভীত নয়নে তাকিয়ে আছে জ্যেঠীমায়ের দিকে। কলিংবেলের শব্দ শুনে কলি এগিয়ে এসে দেখল তোড়া স্হির হয়ে সোফার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দরজা খুলতে খুলতে কলি তোড়াকে ডেকে বলল -“পাজি মেয়ে এখানে থেকেও দরজা খুলিসনি কেন? আমি আরও দৌড়ে এলাম।”
কথাটা শেষ করে দরজার বাহিরে তাকাতেই মৃদু চিৎকার দিয়ে উঠল কলি। তার স্বল্প আওয়াজের চিৎকারটাই তোড়ার কাছে দমবন্ধের মত মনে হলো। ততক্ষণে কলির ডাকে অনিমাও এসে হাজির হলো। কলিকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বাহিরে দৃষ্টি পড়তেই দু’পা পিছিয়ে গেলেন তিনিও। গলা ফাটিয়ে নিজের স্বামী আর বাড়ির সকলকে ডাকলেন তিনি। ভাবি পরিস্থিতি আঁচ করে হন্তদন্ত হয়ে নিচে নেমে এলো অহন। একে একে সবাই হাজির হলো বসার ঘরে। সবার জোড়া জোড়া দৃষ্টি বাহিরের মানুষগুলোর উপর।
চলবে………..