#ফিরে_আসা২
২৫+২৬
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
সবুজের এক অনন্য গুণ আছে। এই রঙ চোখ জুড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। চোখ বুজে রাখলে যেমন চোখ বিশ্রাম পায়, সবুজের দিকে তাকিয়ে থাকলেও ঠিক ততটাই আরাম পায়। অরা মুগ্ধ হয়ে সবুজ দেখছে। উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে সে। আশেপাশে তিন ধারে পাহাড়। এত উঁচু পাহাড়ে সে উঠলো কী করে? অরা মনে করতে পারছে না। মনে করাটাকে এই মুহূর্তে প্রয়োজনীয় বলে মনেও করলো না। তার সমস্ত মনোযোগ সবুজের দিকে।
আকাশের রঙটা বড় অদ্ভুত এই মুহূর্তে। কমলা আর গোলাপীর এক মিশ্রন। সূর্যাস্তের পর পর আকাশটাকে ঠিক এরকমই দেখায়। কিন্তু এখন তো সূর্যাস্তের সময় নয়! এখন কোন সময়? অরা সেটাও মনে করতে পারলো না। দিন দিন কি তার স্মৃতিশক্তি লোপ পাচ্ছে?
মিষ্টি একটা বাতাস বয়ে গেল। বাতাসে অরার চুলগুলো উড়ছে। প্রাণ ভরে উপভোগ করার মতো একটা বাতাস। চোখদুটো বন্ধ করে লম্বা একটা শ্বাস নিলো অরা। আবারও বাতাস বয়ে গেল। তবে এবারের বাতাসের তেজ খানিকটা বেশি। পাহাড়ের গায়ে বেড়ে ওঠা গাছগুলো নড়ে উঠলো। কয়েক মুহূর্ত পর আবারও বয়ে গেল বাতাস। এই বাতাসের তেজ আরও বেশি। গাছপালা নড়ে উঠলো, পাহাড়ের গায়ে পড়ে থাকা পাতাগুলো বাতাসে উড়ে গেল। নিমিষেই ধুলোর ছড়াছড়ি হলো চারিদিকে। এবার যেন একটু ভয়ই পেলো অরা। এসব কী হচ্ছে তার সাথে?
আরেকদফা বাতাস বয়ে গেল। বাতাসের তীব্রতা এতটাই ভয়ঙ্কর ছিল যে অরা নিজেই উড়ে গেল। তড়িৎ গতিতে বাতাস তাকে টেনে নিয়ে গেল পাহাড়ের শেষ প্রান্তে। এই উঁচু পাহাড়ের নিচ থেকে পড়া মানেই নির্ঘাত মৃত্যু। অরা পড়ে যায়নি। ঝুলে আছে পাহাড়ের শেষ প্রান্তে থাকা একটা গাছের সঙ্গে। আরেকদফা বাতাস এলে এই গাছটাও ভেঙে যাবে, আর সেও এক নিমেষে পড়ে যাবে নিচে।
অরা মনে মনে প্রার্থনা করছে, বাতাসের তীব্রতা এবার যেন শেষ হয়। প্রাণে যেন বেঁচে যায় সে। কিন্তু তার কোনো প্রার্থনাই বোধ হয় কাজে এলো না। আবারও বয়ে গেল বাতাস, সবথেকে তীব্রতর, সবথেকে ভয়ঙ্কর বাতাস। যে গাছটাকে আঁকড়ে ধরে অরা ঝুলে ছিল সেই গাছটাও ভেঙে পড়লো। অরা একটু একটু করে পড়ে যাচ্ছে পাহাড়ের নিচে। সে চিৎকার করতে চাইছে, তবে চিৎকার করতে পারছে না। ঠিক এই মুহূর্তে তার মনে পড়লো, সে তো একা নয়। তার সঙ্গে আছে তার সন্তান। নিজের মৃত্যুকে ভয় নেই অরার। কিন্তু বাবু? ওকে তো বাঁচাতে হবে। এই মুহূর্তে কী করে বাঁচাবে সে বাবুকে? আর কোনো পথ কি খোলা আছে?
জেগে উঠলো অরা। প্রচন্ড গতিতে ধড়ফড় করছে তার হৃদয়। এই নভেম্বরের মৃদু শীতের মাঝেও ঘামছে সে। সাবধানে উঠে বসলো অরা। লম্বা লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করছে সে। পারছে না। সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। নিজের অজান্তেই অরার হাতদুটো চলে গেল তার পেটের ওপরে। বাবু ঠিক আছে। ঠিক তো সে নিজেও আছে।
তবে এমন একটা স্বপ্ন কেন দেখলো অরা?
বেডসাইড টেবিলে রাখা পানির গ্লাস থেকে পানি খেল অরা। কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে না সে। বহুদিন পর এমন বাজে একটা স্বপ্ন দেখলো সে। বিয়ের আগে অরা প্রায়ই দুঃস্বপ্ন দেখতো। এখন আর দেখে না। রাতে আরশাদের শক্ত বহুডোরে আবদ্ধ থেকে তার সমস্ত ভয় পালিয়ে যায়। আরশাদ পাশে থাকলে দুঃস্বপ্ন দেখেও ভয় পায় না অরা। আজ বহুদিন পর একা ঘুমোতে হয়েছে। সেই ঘুমের মাঝে এমন স্বপ্ন দেখেছে বলেই হয়তো ভয়েই মাত্রা এতটা বেশি।
কয়েক মুহূর্ত লম্বা শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে নিলো অরা। তবে মনের ভয়টা এখনো কাটলো না। আচমকা মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠলো। এই আকস্মিক আওয়াজে রীতিমত আঁতকে উঠলো অরা। নিজেকে আরেকদফা সামলে মোবাইলটা হাতে নিলো অরা। স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে আরশাদের নাম।
অরা কল রিসিভ করতেই আরশাদ অপরপ্রান্ত থেকে বলল, “উঠেছো?”
অরা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “হুঁ। মাত্র উঠলাম। তুমি? তুমি সেটে পৌঁছেছো?”
“না, আমি গাড়িতে। অরা?”
“হুঁ?”
আরশাদ সন্দেহযুক্ত কণ্ঠে বলল, “তোমার গলাটা এমন শোনাচ্ছে কেন? ঠিক আছো তুমি?”
অরা চমকে উঠে বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ! ঠিক
আছি।”
দুঃস্বপ্নের কথা ভুলেও বলা যাবে না আরশাদকে। বললেই নির্ঘাত রাগ করবে। গম্ভীর গলায় বলবে, “তোমাকে আগেই নিষেধ করেছিলাম ওখানে যেতে। একা একা ঘুমালেই তো তুমি দুঃস্বপ্ন দেখো!” কী দরকার সকাল সকাল ছেলেটাকে রাগিয়ে দিয়ে?
আরশাদ উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, “রাতে ভালো ঘুম হয়নি না? তুমি তো আবার নতুন জায়গায় সহজেই ঘুমাতে পারো না।”
অরা ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “প্রেগন্যান্সি শুরুর পর থেকে তো সবকিছু উল্টোই হচ্ছে। এখন দেখছি নতুন জায়গাতেই ঘুম ভালো হচ্ছে। কাল এখানে পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে কতক্ষণ ঘুমালাম। রাতেও বেশিক্ষণ জাগতে পারিনি। একটার পরপরই ঘুমিয়ে পড়ি।”
আরশাদ কী যেন ভেবে বলল, “তাহলে এক কাজ করি, তুমি ঢাকায় এলে বাবু না আসা পর্যন্ত আমরা অন্য একটা ঘুমাবো। এমনিতেও তোমার বেশি একটা দোতলা বেয়ে ওঠানামা করা ঠিক না। নিচতলার কোনো একটা ঘরে আমরা থাকবো।”
মাঝে মাঝে নিজের ভাগ্য দেখে নিজেই বিস্মিত হয়ে পড়ে অরা। এতটা ভাগ্যবতী কেন সে? তার ছোট-বড় সকল প্রয়োজনের দিকে খেয়াল আরশাদের। অপরিচিত জায়গায় তার ঘুম ভালো হচ্ছে বলে নির্দ্বিধায় নিজের পরিচিত জায়গা ছেড়ে দিতে রাজি আরশাদ। তাকে নিয়ে কত চিন্তা মানুষটার! অরার তো আজকাল নিজেকে নিয়ে চিন্তাই করতে হয় না। তার ভাগের চিন্তাটুকু আরশাদ করে দেয়।
মনের অজান্তেই অরার চোখে জল চলে গেল।
সাবধানে চোখের জল মুছে অরা কোমল স্বরে বলল, “আরশাদ?”
“হুঁ?”
“I love you.”
আরশাদ মজার ছলে বলল, “Good for you.”
অরা ভ্রু কুঁচকে থমথমে গলায় বলল, “তাই না?”
আরশাদ হেসে ফেলে বলল, “I love you too.”
হাসি ফুটে উঠলো অরার ঠোঁটেও। ভাগ্যিস আরশাদ কল করেছিল। না হলে তো আজকের দিনটা অমন ভয়ঙ্করভাবেই শুরু হতো।
হোটেলের রুম সার্ভিসে কল করে অরা ঘরেই ব্রেকফাস্ট আনিয়ে নিলো। নিচে নেমে ব্রেকফাস্ট করার মতো শক্তি এই মুহূর্তে সে পাচ্ছে না। দুই তাক বিশিষ্ট রুম সার্ভিস ট্রলি ভর্তি বিভিন্ন প্রকার খাবার-দাবার। অরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো, প্রায় সবই সে খেয়ে ফেলেছে। যে মেয়েটা দুদিন আগে কম কম খেত সে নিজের অজান্তেই এখন এত বেশি খেয়ে ফেলছে! সব বাবুর দোষ!
প্রেসক্রিপশন মিলিয়ে মিলিয়ে সব ওষুধগুলো খেয়ে নিলো অরা। আরশাদ শুধু শুধুই চিন্তা করে। এই তো, অরা ঠিক নিজের দায়িত্ব নিজেই নিতে পারছে।
গোসল করে বেরিয়ে আজকের দিনটার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে অরা। চারদিন শুটিং আটকে থাকার জন্যে সিনেমার বাজেট স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে গেছে। প্রোডাকশন টিম প্রতিদিনের জন্যে একটা বাজেট নির্ধারণ করে দেয়। আর সেই বাজেট অনুযায়ী খরচ করার দায়িত্ব প্রোডাকশন ম্যানেজারের। এই চারদিনে বেঁধে দেওয়া বাজেটের থেকেও বেশি খরচ হয়ে গেছে। সেই বেশির মাত্রা কতটুকু তাই আজ বের করতে হবে। প্রোডাকশন ম্যানেজাররা শুটিং সেটে একটা ঝামেলার সৃষ্টি হলেই সুযোগ বুঝে বাজেটের অতিরিক্ত খরচ করে ফেলে।
খরচ তো কিছুই করে না, খরচের খাতায় বেশি বেশি লেখে। আর সেই অতিরিক্ত টাকাটা শেষমেশ যায় তারই পকেটে। প্রোডাকশন ম্যানেজারের সঙ্গে অরা আজ এই বাজেট নিয়েই বসবে।
তৈরি হতে হতে মনে মনে কেমন খটকা লাগলো অরার। কেমন একটা অস্বস্তি অনুভূত হচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন অনবরত তাকে দেখেছে। জানালার দিকে চোখ গেল অরার। ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে সরে এসে জানালার কাছে দাঁড়ালো অরা। কিঞ্চিৎ শঙ্কা নিয়ে পর্দা সরালো। নাহ্! জানালার বাইরে তো কেউ নেই। তাহলে কেন তার মনে হলো কেউ তাকে দেখছে?
আর বেশি কিছু ভাবতে পারলো না অরা। এমনিতেই বেশ দেরি হয়ে গেছে। দুঃস্বপ্নটা তার মাঝে চাপা একটা ভয়ের সৃষ্টি করেছে। সেই ভয়ের কারণেই হয়তো এসব উল্টো-পাল্টা ভাবছে অরা। বদ্ধ ঘরের মধ্যে সে ছাড়া আর তো কেউ নেই? কেউ তাকে দেখবে কী করে?
বেরিয়ে গেল অরা। হোটেল থেকে কিছুটা দূরেই শুটিং সেট। এখানেই গোটা একটা গ্রামের সেট তৈরি করা হয়েছিল। আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার পরে যা ধ্বংসস্তূপ ছাড়া আর কিছুই নয়। এই ধ্বংসস্তূপেই আপাতত কয়েকদিন শুটিং চলবে।
একটু পরেই শুটিং শুরু হবে। সেটে চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। ক্যামেরা রোল হচ্ছে, পরিচালক অভিনেতাদের শেষ মুহূর্তের ব্রিফিং দিচ্ছেন। প্রস্তুতি শেষ হতেই শুরু হলো দৃশ্যধারণ। দৃশ্যটা এমন অগ্নিকান্ডে ঘর হারিয়ে তিন মাস বয়সী শিশুকে বুকে জড়িয়ে আর্তনাদ করছে মা।
পরিচালক ‘অ্যাকশন’ বলার সঙ্গে সঙ্গে তার মনিটরে ফুটে উঠলো দৃশ্য। বাচ্চাকে বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে নায়িকা মোহনা। দেখে বোঝার উপায় নেই অভিনয়। মনে হচ্ছে যেন চোখের সামনে যা ঘটছে, পুরোটাই বাস্তব। মোহনা ডেট নিয়ে ঝামেলা করলেও, তার অভিনয়ের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার উপায় নেই। দুর্দান্ত অভিনয় তার।
শুটিং পুরোদমে চলছে। অরা কিছুক্ষণ শুটিং দেখে কাজ শুরু করলো প্রোডাকশন ম্যানেজারের সঙ্গে। প্রোডাকশন ম্যানেজার নতুন একটা হিসাবের খাতা খুলে বসেছে। একদেখায় বোঝা যাচ্ছে এই খাতা গরমিলে ভরা। মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল অরা। আজকের দিনটা বেশ ক্লান্তিময় হতে চলেছে।
অরা একটা একটা করে সব হিসাব নিয়ে আলাপ করছে তার সঙ্গে।
টানা দুই ঘন্টা হিসাব-নিকাশ নিয়ে কাজ করে হাঁপিয়ে উঠলো অরা। প্রোডাকশন ম্যানেজারের কাছ থেকে একটা ব্রেক চেয়ে উঠে এলো। এই হোটেলে সামনে একটা বাগান আছে। বাগানটা কেবল নামেই বাগান। আসলে তো প্রাণহীন। তেমন একটা গাছগাছালি নেই। বড় বড় কয়েকটা আম আর কাঁঠাল গাছ। গাছগুলোর পাতা সবই শুকিয়ে গেছে।
গাছগাছালি না থাকলেও রডের রঙ চটা একটা দোলনা আছে। দোলনার ওপরে পা ভাঁজ করে বসে আচার খাচ্ছে অরা। এই হোটেল থেকে কিছু দূরেই না-কি বিখ্যাত এক আচারের দোকান আছে। সেখান থেকেই এই আচার আনিয়েছে।
ডক্টর নাসরিন সকাল থেকেই শুটিং সেটে রয়েছেন। জীবনে কোনদিন শুটিং দেখেননি তিনি। আর কবে দেখবেন তার ঠিক নেই। খানিক বিশ্রামের জন্যেই বোধ হয় হোটেলের দিকে এলেন তিনি। অরাকে বাগানে দেখে এদিকেই পা বাড়ালেন তিনি।
অরা হাসিমুখে বলল, “শুটিং কেমন লাগছে?”
ডক্টর নাসরিন মুগ্ধ গলায় বললেন, “অসাধারণ! আমার ধারণাই ছিল না এভাবে শুটিং হয়। একটা দৃশ্য না-কি ভেঙে ভেঙে শুট করা যায়! আমি তো ভাবতাম একবারেই পুরো দৃশ্যটা শুট করা হয়।”
অরা মিষ্টি করে হাসলো।
ডক্টর নাসরিন ইতস্তত করে বললেন, “আপনাকে একটা রিকুয়েস্ট করবো অরা?”
“নিশ্চয়ই!”
“আমি না আপনার হাসবেন্ডের অনেক বড় ফ্যান। আমার খুব শখ তার শুটিং দেখার। আমার সেই শখটা পূরণ করবেন?”
অরা দৃঢ় ভঙ্গিতে বলল, “অবশ্যই করবো! এটা আবার রিকুয়েস্ট করার মতো একটা বিষয় হলো? এই লটে ওর শুটিং পরশু পর্যন্ত। তারপর আবার শুরু হবে ডিসেম্বরের প্রথম দিকে। আপনি কবে ফ্রি থাকবেন আমাকে আগেভাগে জানিয়ে দিয়েন।”
ডক্টর নাসরিন উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বললেন, “Thank you so much! কিন্তু অরা, আপনাকেও আমার সাথে যেতে হবে? আমি আপনার ডক্টর, এই অজুহাত ছাড়া তো আর শুটিং দেখতে যেতে পারি না।”
অরা হেসে ফেলে বলল, “কেন পারেন না? আমার প্রোডাকশনের কোনো শুটিং দেখার জন্যে আপনার কোনো অজুহাতের প্রয়োজন নেই।”
“So sweet of you!”
ডক্টর নাসরিন অরার আচার খাওয়ার দিকে লক্ষ্য করে বললেন, “দেখলেন! আমি বলেছিলাম না প্রেগন্যান্সির কোনো না কোনো পর্যায়ে আপনার টক খেতে ইচ্ছা করবে?”
অরা অবাক গলায় বলল, “আমিও বিষয়টা খেয়াল করলাম। এতদিন নাটক-সিনেমায় দেখেছি প্রেগন্যান্ট মেয়েটা টক খেতে পছন্দ। বাস্তবে যে এমনটা হয় এটা আমি বিশ্বাস করতাম না। এখন নিজের বেলায় দেখি, সত্যিই টক খেতে ভালো লাগছে। আচ্ছা ডক্টর? আমার বাবুটা এখন কত বড় হয়েছে?”
ডক্টর নাসরিন খানিকক্ষণ চিন্তা করে বললেন, “আপনার তো এখন ফিফটিন্থ উইক চলছে তাই না?”
অরা আগ্রহ নিয়ে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো।
“এই সময়টায় বাবুর গ্রোথ অনেক দ্রুত হয়। প্রতি সপ্তাহেই সে একটু একটু করে বেড়ে ওঠে। এরই মধ্যে হয়তো তার দাঁতও গঠন হতে শুরু করেছে।”
অরা হতবিহ্বল ভঙ্গিতে বলল, “তাই? এখনই দাঁত তৈরি হয়ে গেছে?”
ডক্টর নাসরিন হাসিমুখে বললেন, “হ্যাঁ! আর মজার বিষয় কী জানেন? দুধ দাঁত পড়ে যাওয়ার পর যে স্থায়ী দাঁত গজায়, সেটাও এখনই গড়ে ওঠে। মাঁড়ির ভেতরে লুকিয়ে থাকে।”
বাবুকে নিয়ে যত জানে, ততই অবাক হয়ে ওঠে অরা। মাত্র কয়েক মাস আগে যে প্রাণের অস্তিত্ব পর্যন্ত ছিল না, সে আজ এত দ্রুত বেড়ে উঠছে। চোখের পলকেই তার কাছেও চলে আসবে। অরার চিন্তাভাবনার অধিকাংশ জুড়ে আজকাল কেবল বাবুই থাকে। বাবু যখন একটু একটু করে কথা বলতে শিখবে, অস্পষ্ট গলায় আঁ আঁ শব্দ করতে করতে একটা সময়ে যখন কথা বলতে শিখবে তখন কাকে আগে ডাকবে? বাবাকে না-কি মাকে? সামনের দিনগুলো যে বড় সুখময় হতে চলছে তা বেশ আগেভাগেই টের পাচ্ছে অরা।
আফসোস আমরা আগেভাগে যা টের পাই, কখনো কখনো তা সঠিক নাও হতে পারে।
ডক্টর নাসরিনের সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ গল্প করে কাজে ফিরলো অরা। প্রোডাকশন ম্যানেজার যে পরিমাণ ভুল বাজেটে করেছে তাতে যে কারোরই মেজাজ খারাপ হয়ে যাওয়ার কথা। অরার জায়গায় আরশাদ থাকলে নির্ঘাত এই লোককে এতক্ষণে ফায়ার করে দিতো। অরার জায়গায় অরা আছে বলেই সেই তখন থেকে ঠান্ডা মাথায় তার ভুলগুলো ধরিয়ে দিচ্ছে।
সুস্পষ্ট, নির্ভেজাল বাজেট নতুন করে তৈরি করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। শীতকালে তো পাঁচটা বাজতে না বাজতেই সন্ধ্যা। সে কারণে আরও বেশি ফাঁপরে পড়ে গেল অরা। আরশাদের সঙ্গে সেই সকালের পর আর কথা হয়নি। তার ম্যানেজার অয়নকে ফোন করে অরা জেনেছে, এই লটের শুটিং প্রায় শেষের দিকে বলে একটু বেশিই ব্যস্ত আজ আরশাদ। তাই আর তাকে বিরক্ত করলো না।
ঘরে ফিরে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো অরা। দিনভর বসে থাকতে থাকতে সারা শরীরে ক্লান্তি ধরে গেছে। আজকাল অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ছে অরা। ডক্টর নাসরিন তখন বলছিলেন এ সময়ে নিজেকে ফিট আর কর্মক্ষম রাখার জন্যে শরীরচর্চার বিকল্প নেই। ব্যায়াম অরা কোনোকালেই তেমন একটা করেনি। এবার বোধ হয় বাবুর জন্যে সেটাও রপ্ত করে ফেলতে হবে।
উঠে বসলো অরা। এভাবে বিছানায় পড়ে থাকলে ক্লান্তি দূর হবে না। একটা হট শাওয়ার নিলে মন্দ হয় না। শরীরটা ঝরঝরে লাগবে। ভাবনা অনুযায়ী টাওয়াল নিয়ে অরা চলে গেল হট শাওয়ার নিতে।
গোসল সেরে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো অরা। বাথরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে টাওয়াল দিয়ে চুল মুছছে সে। চুল মুছতে একটু তাড়াহুড়োই করলো। তাকে গোছগাছ করতে হবে। কাল সকালেই তো ঢাকায় ফিরে যাচ্ছে।
অরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার ঠিক পাশেই উঁচু একটা গোলাকার টেবিল। টেবিলে ছোট ছোট কতগুলো শো-পিছ। আর মস্ত একটা কাঁচের ফুলদানি। ফুলদানিতে আসল ফুল নেই। প্লাস্টিকের সাদা গোলাপের তোড়া।
চুল মুছতে গিয়ে অসাবধানতা বশত অরার টাওয়াল গিয়ে আছড়ে পড়ে ফুলদানির ওপরে। বিকট শব্দ করে ফুলদানিটা ভেঙে পড়ে মেঝের ওপর।
অরা তড়িৎ গতিতে ছিটকে আরেক দিকে সরে গেল। তার বুক প্রচন্ড গতিতে ধড়ফড় করে উঠলো। এত বড় একটা ফুলদানি এখানে রাখার প্রয়োজন কী কে জানে? অরার যতদূর মনে পড়ে, গতকাল প্রথমবার যখন সে এ ঘরে এসেছিল তখন ফুলদানিটা ঘরের বড় টেবিলটার ওপরে ছিল। রাতে ওই ক্লিনিং স্টাফরা এসে এটাকে ছোট টেবিলের ওপর রেখে গেছে। যত সব ঝামেলার দল!
মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কাঁচের টুকরো। অরা সাবধানে সেগুলো এড়িয়ে ঘরের আরেকপ্রান্তে যাওয়ার চেষ্টা করছে। হঠাৎ থেমে গেল সে। তার চোখদুটো আটকে গেল মেঝেতে পড়ে থাকা ওই পাস্টিকের ফুলগুলোর মাঝে। ফুলের মধ্যে থেকে জ্বলজ্বল করেছে একটা নীলাভ আলো।
অরা এখনই এগিয়ে গেল না সেদিকে। বুদ্ধি করে আগে ঘরের অপরপ্রান্তে গেল। একটা প্লাস্টিকের স্যান্ডেল পড়ে এসে আবারও ফিরে এলো ওই ভাঙা ফুলদানিটার কাছে। এবার কাঁচের টুকরোগুলোকে তোয়াক্কা না করেই অরা এগিয়ে গেল ওই প্লাস্টিকের ফুলের দিকে।
কোনো এক অজানা কারণে তার বুকটা ধুকপুক করছে। সামান্য প্লাস্টিকের ফুলের তো নিজস্ব আলো থাকার কথা নয়, যা কিনা জ্বলজ্বল করে উঠবে!
ফুলগুলোর মাঝে হাত দিলো অরা। হাতের মধ্যে যা অনুভব করলো অরা, তার জন্যে মোটেও প্রস্তুত ছিল না সে। জিনিসটা ফুলের মধ্যে থেকে বের করে আনলো।
স্পাই ক্যামেরা। এই ক্যামেরা দিয়ে শুটিংও করা হয়। তবে অত্যন্ত ক্ষুদ্র এই ক্যামেরার মূল কাজ কারও ঘরে লুকিয়ে রাখা। এই ক্যামেরা যেখানে লুকিয়ে রাখা হবে, সেই জায়গাটা মোবাইলের মাধ্যমে সরাসরি দেখা সম্ভব।
তার মানে কেউ এই মুহূর্তে অরাকে দেখতে পাচ্ছে? কিন্তু কে? কতক্ষণ ধরে? অরা আজ পুরোটা দিন ঘরে যা যা করেছে, সবই সে দেখেছে? অরা তো এই ঘরে চেঞ্জও করেছে! কী সর্বনাশ! কে তার এত বড় ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে? নিশ্চয়ই হোটেলের কেউ। কাল রাতে ওই ক্লিনিং স্টাফরাই নিশ্চয়ই এই জিনিসটা ফুলের মাঝে লুকিয়ে রেখেছিল। অরার তখনই বোঝা উচিত ছিল ওদের কোনো বদ মতলব আছে। না হলে রাত একটার সময়ে কেউ রুম ক্লিন করতে চায়?
নিজের মাথার চুল নিজেরই টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছা করছে। আতঙ্কে ছটফট করছে অরা। সে এখন কী করবে? আরশাদকে একটা ফোন করবে? না, না! আরশাদকে আচমকা ফোন করে এসব বললে ও কিছুই বুঝবে না, উল্টো অরার ওপর রাগ দেখাবে। নিজেকেই একটা সমাধান বের করতে হবে।
অরা কখনোই নিজেকে রাগী বলে মানে না। তবে আজ রাগে রীতিমত তার গা কাঁপছে। জীবনে এতটা রাগ তার কোনোদিনও হয়নি।
দ্রুত পায়ে হেঁটে অরা হোটেলের রিসিপশনে পৌঁছে গেল। রিসিপশনে একটি মেয়ে বসে আছে।
অরা দ্রুততার সঙ্গে তাকে বলল, “আপনাদের ম্যানেজারকে ডাকুন!”
মেয়েটি ভদ্রভাবে বলল, “কেন ম্যাম? কোনো সমস্যা?”
অরা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বলল, “হ্যাঁ সমস্যা! ডাকুন আপনার ম্যানেজারকে!”
মেয়েটা ভীত হয়ে ফোন করলো ইন্টারকমে। মুহূর্তেই স্যুট-টাই পরিহিত ভদ্রবেশী ম্যানেজার এসে হাজির।
অরা ম্যানেজারের সামনে ওই স্পাই ক্যামেরাটা তুলে ধরে বলল, “এসবের মানে কী?”
ম্যানেজার ঢোক গিলে বলল, “এটা কী ম্যাম?”
অরা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “বুঝতে পারছেন না কী? আপনার হোটেলের স্টাফ কাল রাতে ক্লিনিংয়ের অজুহাতে এই ক্যামেরা আমার ঘরে ফিট করে দিয়ে যায়। এই ক্যামেরা সিসিক্যামেরার কাজ করে। আমার ঘরে কী হচ্ছে না হচ্ছে লাইভ দেখা যায়।”
লোকটা ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “না মানে ম্যাম, আপনার হয় তো কোথাও ভুল হচ্ছে।”
অরা চটে গিয়ে বলল, “ভুল হচ্ছে মানে? জিনিসটা আমার সামনে! আপনাদের হোটেলের ফুলদানির মধ্যে খুঁজে পেয়েছি আমি। কীসের ভুল হচ্ছে এখানে?”
ম্যানেজার কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। তখনই অরা কিছুটা দূরে দেখতে পেলো গত রাত যে ছেলেটা তার কাছে চাবি চেয়েছিল, সেই ছেলেটা যাচ্ছে।
অরা ব্যস্ত ভঙ্গিমায় আঙুল তাক করে বলল, “ওই যে! ওই ছেলেটা কাল আমার রুমে ক্লিনিং করতে এসেছিল। ও-ই এই ক্যামেরা লুকিয়ে রেখেছিল। ডাকুন ওকে!”
ম্যানেজার দুর্বল কণ্ঠে ওই ছেলেটাকে ডাকলো, “আসিফ!”
এমনভাবে ডাকলো যেন ছেলেটা শুনতে না পায়। তবে আসিফ ঠিকই শুনতে পেলো।
ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে এসে বলল, “জি স্যার?”
অরা তেজস্বী কণ্ঠে বলল, “জিজ্ঞেস করুন! আপনার হোটেলের স্টাফ গেস্টদের প্রাইভেসি নিয়ে এভাবে ছেলেখেলা করছে কেন?”
ম্যানেজার আমতা আমতা করে বলল, “আসিফ? তুমি ম্যামের রুমে এই ক্যামেরা ফিট করে এসেছো কেন?”
আসিফ ছেলেটা হতবাক ভঙ্গিতে বলল, “আপনিই তো এমনটা করতে বলেছিলেন স্যার।”
ম্যানেজার হাতের ইশারায় ছেলেটাকে চলে যেতে বলল। এই ম্যানেজার তার মানে এতক্ষণ সবটাই জানতো? জেনেবুঝে নাটক করছিল অরার সঙ্গে?
অরা অগ্নিকণ্ঠে বলে উঠলো, “আপনি? ওহ্! তার মানে এটা আপনাদের বিজনেস? আপনারা হোটেলের নাম করে আড়ালে গেস্টদের ঘরে স্পাই ক্যামেরা ফিট করেন? গেস্টদের প্রাইভেসির কোনো মূল্য নেই আপনাদের কাছে?”
এমন ঘটনা প্রায়ই শোনা যায়। হোটেলে যেসব ঘরে মেয়েটা একা থাকে সেখানে ক্যামেরা লুকিয়ে রাখা হয়। আবার কোনো দোকানের ট্রায়াল রুমেও আয়নার পেছনে ক্যামেরা লুকানো থাকে। তাই বলে অরার নিজেকেও এই পরিস্থিতির শিকার হতে হলো? পৃথিবীটা আজকাল এতটাই অনিরাপদ হয়ে গেছে?
ম্যানেজার কম্পিত স্বরে বলল, “না আসলে ম্যাম…”
ম্যানেজারকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে অরা বলল, “আমি আপনার এবং আপনার এই হোটেলের বিরুদ্ধে কেস করবো। আপনাদের এই নোংরামি বন্ধ করে ছাড়বো আমি!”
অরা পা বাড়ালো তার রুমের দিকে। কেসের ভয়ে এবার ম্যানেজার মুখ খুললো, “ম্যাম! বিশ্বাস করুন ম্যাম এটা আমাদের বিজনেস না। আমরা কোনো গেস্টের ঘরেই কোনোদিন এমন ক্যামেরা ফিট করিনি। গেস্টদের প্রাইভেসি আমাদের ফার্স্ট প্রায়োরিটি।”
“তাহলে আমার ঘরে ক্যামেরা ফিট করেছেন কেন?”
ম্যানেজার সংকোচজড়িত গলায় বলল, “স্যারের কথা মতোই আমরা কাজটা করেছি ম্যাম বিশ্বাস করুন। ওই ক্যামেরাটা আমাদের না। শুটিংয়ের ক্যামেরা। ক্যামেরার রেকর্ড করা লাইভ ফুটেজ স্যারের কাছেই আছে।”
অরা বিভ্রান্ত গলায় বলল, “কার কাছে?”
“আরশাদ স্যারের কাছে।”
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না অরা। সে কি ঠিক শুনলো? আরশাদ? আরশাদ তার ঘরে, তারই অজান্তে ক্যামেরা ফিট করিয়েছে? কিন্তু কেন? এসব কী হচ্ছে অরার সঙ্গে?
(চলবে)