#ফিরে_আসা২
২৯
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
যে ঘটনা অরার ভেতরে তীব্র এক কালবৈশাখীর ঝড়ের সৃষ্টি করছে, তার মনটাকে ভেঙে চুরমার করে ফেলছে, সেই একই ঘটনা যেন কোনো ছাপই ফেলতে পারেনি আরশাদের মাঝে। অন্যান্য দিনের মতোই স্বাভাবিক সে। সকালে উঠে স্বাভাবিকভাবে কথাকে কোলে নিয়ে বাগানে ঘোরাফেরা করলো, নাস্তা করে শুটিংয়ের প্রস্তুতি নিলো। সবকিছুর মাঝেও এড়িয়ে গেল অরাকে। যেন এ বাড়িতে অরার অস্তিত্ব তার চোখেই পড়ছে না।
সকাল থেকে কাজের ফাঁকে দুয়েকবার আরশাদের সামনে পড়েছে অরা। একবারও তার দিকে চোখ তুলে তাকালো না আরশাদ। অবশ্য তাকিয়েছে কিনা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। অরা নিজেই তো তার দিকে চোখ তুলে তাকায়নি তার দিকে। মনে হচ্ছিল যেন আরশাদের দিকে তাকানো বিশাল কষ্টের কাজ।
এক দিনের ব্যবধানে জীবনটা কেন এমন এলোমেলো হয়ে গেল? এমন নরকীয় জীবনে তো অরা অভ্যস্ত নয়। বিয়ের পর থেকেই রূপকথার জীবনে তাকে অভ্যস্ত করেছে আরশাদ। কোনোদিন যে দুজন ঝগড়া করে দুজনের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, এমন পরিস্থিতি কল্পনাও করতে পারেনি অরা।
ঝগড়া তো সেবারও হলো তাদের মাঝে। অরা যখন আরশাদের অজান্তে কথাকে নওশীনের সঙ্গে দেখা করাতে নিয়ে গেছিল। আরশাদ তো সেবার পরদিনই নিজের ভুলটা বুঝতে পেরে নিঃসংকোচে ক্ষমা চেয়েছিল অরার কাছে। ক্রমেই পাল্টে গেল সেই মানুষটা। মনের মধ্যে তীব্র এক মিথ্যা লালন করছে আরশাদ। সেই মিথ্যাটাকেই সত্যি বলে বিশ্বাস করছে।
আরশাদ কি আর কোনোদিনও অরার সঙ্গে কথা বলবে না? তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেই কাটিয়ে দেবে বাকিটা জীবন? একদিনেই দমবন্ধ লাগছে অরার। সহ্য হচ্ছে না আরশাদের অবহেলা। কিছুক্ষণ আগেই শুটিংয়ের জন্যে বেরিয়ে গেল আরশাদ। বিয়ের পর থেকে এই প্রথম তাকে না বলে, তার কপালে চুমু না খেয়ে শুটিংয়ে চলে গেল সে। যদি অবহেলাই করার ছিল, তবে এত এত ভালোবাসায় জীবনটাকে ভরিয়ে দিয়েছিল কেন?
কথার সঙ্গে ব্রেকফাস্ট করতে বসলো অরা। খাওয়ার ইচ্ছা তার একেবারেই নেই। তবুও খেতে হচ্ছে বাবুর জন্যে। আচ্ছা? বাবু পৃথিবীতে আসার পরও কি আরশাদ এমন অবহেলা করবে অরাকে? আরশাদ যদি বাবুকেও অবহেলা করে? বেশি কিছু আর ভাবতে পারলো না অরা। এমনিতেই কাল থেকে মনের ওপর প্রবল চাপ পড়ছে।
কথাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে অফিসে এলো অরা। সে ভেবেছিল কয়েকটা দিন অফিস থেকে ছুটি নেবে। কাজ করার মতো মন-মানসিকতা এই মুহুর্তে তার নেই। শরীরের অসুখের জন্যে সিক লিভের ব্যবস্থা আছে। মনের অসুখ হলেও তো সেই লিভ নেওয়া যায়। শেষমেশ সেই পরিকল্পনা ছেড়ে অফিসে এলো সে। মনের এমনিতেই যে বিধ্বংসী অবস্থা, ঘরে অবরুদ্ধ থাকলে তো আরও খারাপ লাগবে। কাজের মাঝে ডুবে থাকলে হয়তো ভালো থাকবে অরা। যতক্ষণ কাজ নিয়ে ভাববে ততক্ষণ আরশাদের চিন্তা প্রবেশ করতে পারবে না তার মস্তিষ্কে।
গোটা অফিস আজ অরার প্রশংসায় ভাসছে। অরা যেভাবে আধঘন্টার মধ্যে অনশনরতদের অনশন ভেঙে শুটিং শুরু করার ব্যবস্থা করে দিলো, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। যেই আজ অরার সামনে পড়ছে, সেই অভিনন্দন জানাচ্ছে। প্রশংসায় খুব একটা বিগলিত বলে মনে হলো না অরাকে। নিজের কেবিনে গিয়ে কাজে মন দিলো সে।
পরপর তিনদিন অফিসে না আসায় একগাদা ফাইল জমে গেছে তার টেবিলে। একেক করে সবগুলো ফাইল চেক করলো অরা। যে ফাইলগুলোতে ভুল আছে সেগুলো সংশোধন করতে পাঠালো।
হঠাৎ বেজে উঠলো ডোরবেল। সিসিটিভি ফুটেজের দিকে একনজর তাকাতেই অরা দেখতে পেলো বাইরে দাড়িয়ে আছে রিয়াজ। রিয়াজ কে ফিল্মসের ফাইন্যান্স হেড।
অরা উঁচু গলায় বলল, “Come in!”
রিয়াজ নিঃশব্দে অরার কেবিনে প্রবেশ করলো। ফাইন্যান্স টিম আর প্রোডাকশন টিম – দুটোরই কাজ টাকা-পয়সাকে ঘিরে। তবে দুটো টিমের কাজের মাঝে বিস্তর পার্থক্য আছে। প্রোডাকশন টিম প্রত্যেকটা সিনেমার জন্যে আলাদা আলাদা বাজেট তৈরি করে। বাজেটের টাকা তাকে বেঁধে দেয় ফাইন্যান্স টিম। টাকা-পয়সা ছাড়াও অন্যান্য খাতে প্রোডাকশন টিমকে কাজ করতে হয়। এই যেমন সিনেমার লোকেশন, সিনেমার শুটিংয়ে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি। তবে ফাইন্যান্স টিমের কাজের ক্ষেত্র কেবলই টাকা-পয়সা।
ফাইন্যান্স টিমের কাজ কোন কোন সিনেমায় কত টাকা খরচ হবে, সিনেমার বাইরেও আলাদা কোথায় খরচ হবে – এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া। ফাইন্যান্স টিমের মূল উদ্দেশ্য বছর শেষে কে ফিল্মসকে একটি লভবান প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা। রিয়াজ যেহেতু এই টিমের প্রধান, তাই তার দায়িত্বটাও বেশি।
রিয়াজ অরার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বিনয়ী ভঙ্গিতে বলল, “Good Morning Mam.”
অরা স্বাভাবিক গলায় বলল, “Good Morning. বসুন রিয়াজ।”
রিয়াজ নিঃশব্দে বসতে বসতে বলল, “অন্যুয়াল মিটিং নিয়ে একটু কথা ছিল ম্যাম।”
কে ফিল্মসে প্রতি বছর, বছরের শেষের দিকে এই অ্যানুয়াল মিটিং হয়। বছরে কত টাকা খরচ হলো, কোথায় কোথায় টাকা খরচ হলো, কত লাভ হলো, এসব নিয়ে আলোচনা করা হয়। ফাইনাল রিপোর্ট এ সপ্তাহের প্রথম দিকেই তৈরি করেছে রিয়াজ এবং তার টিম। কালিয়াকৈরে যাওয়ার আগে সেই রিপোর্ট দেখে গেছে অরা।
এ বছর দুর্দান্ত ব্যবসা করেছে কে ফিল্মস। নিট লাভ ২৮.৮%। গত বছরের থেকে প্রায় ৫% বেশি। এই ফলাফলকে বিশদভাবে বিশ্লেষণ করা হয় অ্যানুয়াল মিটিংয়ে। ভবিষ্যতে কী করলে এই লাভের অংশ আরও বেড়ে দাঁড়াবে সেই নিয়েও আলোচনা করা হয়। অ্যানুয়াল মিটিংয়ে কে ফিল্মসের সকল টিমের প্রধানরা উপস্থিত থাকে। অরাকে তো থাকতেই হয়। তবে সবার ভয়ের কারণ হলো, এই মিটিংয়ে কোম্পানির চেয়ারম্যান আরশাদও উপস্থিত থাকে। একটু পান থেকে চুন খসলেই যার মেজাজ বিগড়ে যায়।
অরা হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে বলল, “একটা ডেট ফিক্সড করুন তাহলে! আপনাদের কোনো প্রিপারেশন নেওয়ার থাকলে সেটাও নিয়ে ফেলুন।”
“আমাদের প্রিপারেশন নেওয়া হয়ে গেছে ম্যাম। সকলেই মোটামুটি রেডি। আরশাদ স্যার কাল আমাদের সময় দিয়েছেন।”
অরা অবাক হয়ে বলল, “আগামীকাল?”
“জি ম্যাম।”
অরা বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, “এতটা বড় একটা মিটিংয়ের ডেট আমাকে না জিজ্ঞেস করেই ফিক্সড করে ফেলেছেন আপনারা?”
রিয়াজ কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “না মানে ম্যাম, আপনিই তো বলেছিলেন আরশাদ স্যারের সুবিধামতো একটা ডেট ফিক্সড করতে।”
মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল অরা। আরশাদের মুখোমুখি হওয়ার মতো মন- মানসিকতা এই মুহূর্তে তার নেই। অ্যানুয়াল মিটিংয়ে তো কোম্পানির সিইও আর চেয়ারম্যান কথা না বলে থাকতে পারে না। মিটিংটা কোনোভাবে পেছাতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু কালকের পর নিজের ব্যস্ত শিডিউল থেকে আর কবে সময় বের করতে পারবে আরশাদ তার ঠিক নেই। মিটিংটা হওয়া কোম্পানির জন্যে জরুরি। নিজেদের মধ্যে হওয়া তিক্ততার প্রভাব কোম্পানির ওপর পড়তে দেওয়ার কোনো মানে হয় না।
রিয়াজ চলে যেতেই ক্লান্ত ভঙ্গিতে ডেস্কে মাথা রাখলো অরা। হৃদয়ের জ্বালাপোড়া আবারও বাড়তে শুরু করেছে। যতক্ষণ কাজের মাঝে ছিল, আরশাদকে ভুলে ছিল ততক্ষণই ভালো ছিল অরা। আবারও আরশাদের কথা মনে পড়তেই যেন মনে হলো কেউ তার বুকের ওপর ভারী পাথর চেপে ধরে রেখেছে।
চোখদুটো বন্ধ করলো অরা। মুহূর্তেই তার সামনে ভেসে উঠলো আরশাদের মুখটা। তার গতকালের কথা বলার ধরণ। আরশাদের চোখদুটোর মধ্যে নিজের জন্যে তীব্র ঘৃণা দেখতে পাচ্ছিল অরা। যে মানুষটার ভালোবাসায় দিনভর তার ডুবে থাকা, তার ঘৃণা তো মোটেও সহনীয় অরা। অরার আক্ষেপ একটাই, সে তো ঘৃণা পাবার মতো কোনো কাজ করেনি। তবে কেন?
অসম্ভব দমবন্ধ লাগছে অরার। মনে হচ্ছে কেউ যেন তার গলা চেপে ধরে রেখেছে। শ্বাস নিতেও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। এই বদ্ধ ঘরের মধ্যে থাকলে নির্ঘাত পাগল হয়ে যাবে সে। কী যেন মনে করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো অরা। লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেল লিফটের দিকে। তার গন্তব্য ছাদ। এতটাই দমবন্ধ লাগছে যে ছাদে গিয়ে খোলা হাওয়ায় শ্বাস নেওয়া না পর্যন্ত গতি নেই।
ছাদে এসে দাঁড়াতেই কিছুটা হালকা অনুভব করলো অরা। বুকের ওপরের পাথরটা একটু একটু করে হালকা হতে শুরু করেছে। আবারও স্বাভাবিক পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে অন্তরাত্মা। ছাদের রেলিং ধরে আকাশের দিকে তাকালো অরা। একঝাঁক পাখি ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে। অবাস্তব আকাঙ্ক্ষা করার মতো মেয়ে অরা নয়। তবে আজ তার ভীষণ ইচ্ছা করছে পাখি হয়ে যেতে। কোনো দুশ্চিন্তা ছাড়া, কোনো আঘাত ছাড়া যে কেবলই আনন্দ নিয়ে বিচরণ করে বেড়ায় আকাশজুড়ে।
“Good Morning Mam! আপনি এখানে?”
চমকে উঠে পেছন ফিরে তাকালো অরা। মাহমুদ হাসিখুশি ভঙ্গিতে এগিয়ে আসছে তার দিকে।
অরা ভ্রু কুঁচকে বলল, “কেন আসতে মানা আছে না-কি?”
মাহমুদ ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “না, না! কী যে বলেন ম্যাম। আসলে এই সময়টায় সবাই ব্যস্ত থাকে। ছাদটায় সারাদিন আমরা ক্রিয়েটিভ টিমের সদস্যরাই ঘুরে বেড়াই।”
মাহমুদের সঙ্গে এই মুহূর্তে কোনপ্রকার কথোপকথনে জড়াতে ইচ্ছা করছে না অরার। তবে মনটা অস্থির হয়ে উঠেছে। মাহমুদ সর্বক্ষণ তার দুরন্তপনা দিয়ে সামনের মানুষটার মন ভালো করে দেওয়ার চেষ্টায় মেতে থাকে। মন ভালো তো আর হবে না, তবুও মনটাকে কিছুটা হলেও হালকা করার জন্যে কথোপকথনে জড়ালো তার সঙ্গে।
হালকা গলায় বলল, “তাই না-কি?”
“জি ম্যাম! অন্যান্য ডিপার্টমেন্টের মতো আমাদের তো লাগাতার কাজ করতে হয় না। ক্রিয়েটিভ হওয়ার এই একটা মজা! আমাদের কাজে কোনো যান্ত্রিকতা নেই। তবে যাদের কাজে আছে, তারা আমাদের হিংসা করে।”
“সেটা কীভাবে?”
মাহমুদ আক্ষেপের সুরে বলল, “আপনি জানেন না ম্যাম? গোটা অফিস আমাদের আড়ালে ডাকে বেকার টিম! এটা কোনো কথা হলো বলুন?”
মাহমুদের কথা বলার ধরণ দেখে কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেল অরা। অন্যমনস্ক ভঙ্গিতেই বলল, “তোমাকে দেখে আমার একজনের কথা মনে পড়ে যায় মাহমুদ।”
মাহমুদ আগ্রহ নিয়ে বলল, “কার কথা ম্যাম?”
অরা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “মোবারক, আমার ভাই। সেও তোমার মতোই ছিল। দুরন্ত, ছটফটে। একবার কথা শুরু করলে তাকে থামানোর সাধ্য পৃথিবীর কারোরই ছিল না।”
নতুন মা তার নির্মম অত্যাচার দিয়ে অরার জীবনটাকে নরকে পরিণত করে ছেড়েছিল। নতুন মায়ের প্রতি তার মনে জন্মেছিল তীব্র ঘৃণা। তবে ছোট ছোট ওই নিষ্পাপ শিশুগুলো তো কোনো দোষ করেনি। অরা তার ভাইদের অসম্ভব ভালোবাসতো। আজও মনের ডায়েরিতে তাদের নাম ‘সৎ ভাই’ হিসেবে লেখা নেই। ওরা তো তার নিজেরই ভাই। ভাই-বোনের সম্পর্কে কোনো আপন-সৎ থাকে না।
মাহমুদ কৌতূহলী গলায় বলল, “বাহ্! তা এখন তিনি কোথায়?”
অরা ফ্যাকাশে গলায় বলল, “কী জানি! কত বছর হয়ে গেল ওদের দেখি না!”
আবারও দীর্ঘশ্বাসে ছেয়ে গেল অন্তরাত্মা। মাঝেমধ্যেই ভাইদের কথা মনে পড়ে অরার। ওরা নিশ্চয়ই এখন আর সেই আগের মতো ছোট্ট নেই। অনেক বড় হয়ে গেছে। অরাকে কি এখনো মনে রেখেছে তারা? মনে রাখার কথা তো নয়। অরার ইচ্ছা করে, তাদের খুঁজে বের করতে। কিন্তু এত বড় একটা পৃথিবীতে খুঁজবে কী করে? তার কাছে না আছে তাদের ছবি, না আছে ঠিকানা। আছে শুধু নামগুলো।
অরাকে গম্ভীর ভঙ্গিতে চিন্তায় ডুবে যেতে দেখে মাহমুদ পরিস্থিতি সহজ করার জন্যে বলল, “আমারও একটা বোন আছে ম্যাম।”
“তাই?”
মাহমুদ মজা করে বলল, “হুঁ। আমার থেকে আট বছরের ছোট, তবে এমন একটা ভাব করে যেন আমার বড় বোন। বাড়ি ফিরতে দেরি হলে দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে রেখেই জেরা করে। যদি টের পায় আমি মায়ের কাছ থেকে কিছু একটা লুকাচ্ছি, তাহলেই হলো! নানাভাবে ব্ল্যাকমেইল করতে শুরু করে আমাকে।”
অরা ফিকে হাসি হেসে বলল, “আর কে কে আছে তোমার বাড়িতে?”
“আমার মা আর বোন।”
“আর বাবা?”
“বাবা দুবছর আগেও ছিলেন। বলা নেই কওয়া নেই, হুট করে একদিন চলে গেলেন।”
ছেলেটার কথাবার্তায় অবাক না হয়ে পারলো না অরা। মৃত্যুর মতো এত করুণ একটা ঘটনার বর্ণনা এমন হালকা গলায় কেউ কী করে করতে পারে?
অরা ব্যথিত গলায় বলল, “I’m sorry, আমি জানতাম না।”
মাহমুদ হাসিমুখেই বলল, “সরি বলবেন না ম্যাম, জানার তো কথাও নয়।”
কয়েক মুহূর্ত নীরবতায় কেটে গেল।
নীরবতা ভঙ্গ করে মাহমুদ বাবার স্মৃতি রোমন্থন করে বলে উঠলো, “আমার বাবা ছিলেন নিউরোলজিস্ট। মানুষের মাথা নিয়ে ছিল তার করবার। আর সেই মানুষটাই কিনা ব্রেইন স্ট্রোক করে মারা গেলেন। আমার বাবা আমার ওপরে মোটেও খুশি ছিলেন না ম্যাম। আমার সারাটাদিন তখন কাটে লেখালিখি করতে করতে। নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখি, নিজের আনন্দের জন্য কবিতা লিখি। বাবা এসব একদমই পছন্দ করতেন না। ডক্টরের ছেলে দিনরাত লেখালিখি করছে, এই সত্যি তিনি মেনেই নিতে পারতেন না। শুধু বলতেন, লেখালিখি করে খাবি কী? আজ বাবা বেঁচে থাকলে বেশ ভালো হতো। তাকে দেখাতে পারতাম, লেখালিখির জন্যে আজ আমার এত বড় একটা কোম্পানিতে চাকরি হয়েছে।”
অরা অস্পষ্ট গলায় বলল, “তাও তো তোমার একটা পরিবার আছে, You should be grateful.”
পরিবার বলতে কিছুই নেই অরার। যে মানুষগুলোর মাঝে সে বেড়ে উঠেছে, তারা তো কোনোদিন তাকে পরিবারের অংশই মনে করেনি। মনে করেছে কেবল বোঝা। জীবনে প্রলয়ংকারী এতগুলো দিন পাড় করে এসে অবশেষে যে মানুষটাকে অরা নিজের পরিবার মনে করতে শুরু করলো, সেই মানুষটাও কোনো কারণ ছাড়াই মুখ ফিরিয়ে নিলো তার ওপর থেকে। পরিবার না থাকার কষ্ট অরার থেকে ভালো করে আর কে-ই বা বুঝবে?
(চলবে)
[ঝামেলাটা আপনাদের ভালো লাগছে না জানি। আমারও ভালো লাগছে না। তবে কী, ঝামেলা ছাড়া কোনো গল্প হয় না। এই গল্পের সিজন ২ লেখার অনেকগুলো কারণ আছে। বেশির ভাগ প্রেমের গল্পের শেষটা হয় বিয়ের মাধ্যমে। অথচ বিয়ের পরবর্তী জীবনটা যে কোনো রূপকথা নয়, এটা খুব কম গল্পেই উঠে আসে। যে গল্পগুলো বেশির ভাগ লেখকরা বলে না, আমি সেই গল্পটা বলতে চেয়েছি। বলছি, জানি না কতটুকু পারছি। এছাড়াও আরও একটা কারণ আছে গল্পে এই ঝামেলাকে টেনে নিয়ে আসার। সেই কারণটা বলবো, পরের পর্বের শেষে। ভালো থাকবেন সকলে। ❤️]