#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৪ ( দ্বিতীয়াংশ)
#আদওয়া_ইবশার
এমন নির্দ্বিধায় অকপটে রক্তিমের নাম্বার চাওয়ায় উপস্থিত সকলেই স্তম্ভিত। গোলগোল নয়নে ভূত দেখার মতো তাকিয়ে থাকে দৃষ্টর মুখের দিকে। রক্তিম শিকদার’ও কিন্চিৎ অবাক হয়। কিন্তু সেটা প্রকাশ করেনা। গম্ভীরচিত্তে জানতে চায়,
“আমার নাম্বার দিয়ে কি করবে?”
“আবার কখনো যদি ঐ ছেলেটা বিরক্ত করতে আসে তখন সাথে সাথে আপনাকে ফোন করে জানিয়ে দিব। আপনি দলবল নিয়ে গিয়ে ঐ ছেলেকে কেলিয়ে আসবেন।”
নিঃসংকোচে জবাব দৃষ্টির। পাশ থেকে ফুরন কেটে রাকিব বলে,
“এর জন্য ভাইয়ের নাম্বার নিতে হবে কেন তোমার? আমাদের যে কারো একজনের নাম্বার নিলেই তো হয়। ভাই কি সবসময় ফ্রি হয়ে ফোন হাতে নিয়ে বসে থাকে না কি? যে তুমি ফোন করলে ওমনি ভাই রিসিভ করে তোমার কথা শুনে দৌড়ে চলে যাবে!”
কটমট দৃষ্টিতে রাকিবের দিকে তাকায় দৃষ্টি। ঝাঝালো স্বরে বলে,
“হ্যা আপনাদের নাম্বার নিয়ে বিপদে পরে কল দেই।এরপর উপকারের নাম করে আপনারাই প্রতিদিন ফোন করে আমাকে ডিসটার্ব করুন। কি ভেবেছেন চিনিনা আমি আপনাদের? এক একটা বদের হাড্ডি, মেয়ে দেখলেই ছুক ছুক করা স্বভাবের ধামড়া বেটা-ছেলে!”
এমন তরতজা একটা মনগড়া মিথ্যা অপবাদে প্রত্যেকের কুঠোর ছেড়ে চোখ দুটো বেরিয়ে আসার উপক্রম। এক জায়গায় ঠাই দাঁড়িয়ে রক্তিম শিকদারের ছেলেদের বারবার এভাবে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে অপমান করার মতো দুঃসাহস পায় কোথায় এই মেয়ে? অত্যাধিক রাগ হয় উপস্থিত প্রতিটা ছেলের। দৃষ্টির দিকে তেড়ে আসে রাকিব। আক্রমণাত্মক মনোভাব নিয়ে বলে,
“সাহস কত বড়! আর একটা উল্টাপাল্টা কথা বললে জ্বিভ টেনে ছিড়ে দেখিয়ে দিব আমরা কি জিনিস।”
মুখ বাঁকায় দৃষ্টি। আড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ব্যঙ্গ করে বলে,
“অ্যাহ্! দুই টাকার মুরোদ নেই আবার কোটি টাকার বিছানায় ঘুমানোর স্বপ্ন দেখে। চামচিকা চামচিকার মতোই থাকুন। এতো পাওয়ার দেখাতে আসবেন না বলে দিলাম। নইলে আমিও এক একটার মেইন পয়েন্টে মেরে দেখিয়ে দিব দৃষ্টি কি জিনিস।”
এতোক্ষন পর্যন্ত সব কিছু চুপচাপ সহ্য করে গেলেও এবার আর চুপ থাকেনা রক্তিম। স্ব-স্বরে ধমকে ওঠে দৃষ্টিকে,
“এই মেয়ে চুপ!”
ব্যাস! দৃষ্টি নামক বাচাল কন্যার মুখ বন্ধ করার জন্য রক্তিম শিকদারের জোরালো কন্ঠের এক ধমকই যথেষ্ট। হুট করে এমন একটা ধমক খেয়ে চুপসে যায় দৃষ্টি। ভয়ে লাফিয়ে উঠে অন্তরাত্বা। বুকে থুথু দিয়ে কোনোমতে নিজেকে সামলে ঘনঘন চোখের পলক ঝাপটায়। ভিতু চোখে রক্তিমের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই রক্তিম দু-পা এগিয়ে আসে। তৎক্ষণাৎ কয়েক কদম পিছিয়ে যায় দৃষ্টি। রক্তিম বুঝতে পারে তার ধমক কাজে দিয়েছে। ভয় পেয়েছে মেয়েটা। মেহেদীর পকেট থেকে এক প্রকার ছু মেরে কলম নিয়ে খাঁবলে ধরে দৃষ্টির হাত। আবারও কেঁপে ওঠে দৃষ্টি। ভয়ে মুখ দিয়ে অস্পষ্ট আওয়াজ বের হয়। তাদের থেকে একটু দূরে মোটা মেহগনি গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা তুসীও কাঁপে রক্তিম শিকদারকে দৃষ্টর কাছাকাছি দেখে। সৃষ্টিকর্তার কাছে মনে মনে আর্জি জানায়,
“আল্লাহ! আল্লাহ প্লিজ এবারের মতো মাথা মোটাটাকে বাঁচিয়ে দাও।”
সকলকে অবাক করে দিয়ে দৃষ্টির হাতের মুষ্টি খুলে কলমের খচখচ খোঁচাতে লিখে দেয় রক্তিম নিজের নাম্বারটা। মুহুর্তেই ঝলমলিয়ে হাসি ফোটে দৃষ্টির ওষ্ঠপুটে। কাজটুকু কয়েক সেকেন্ডে শেষ করে আবারও পিছিয়ে যায় রক্তিম। দুজনের মাঝে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে অত্যন্ত শীতল কন্ঠে হুমকি ছুড়ে দৃষ্টির দিকে,
“যা চেয়েছো দিয়েছি। জানের মায়া থাকলে আশা করি এই নাম্বারে অপ্রয়োজনীয় কোনো কল আসবেনা। আর একটা কথা। আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার ছেলেদের যা নই তাই বলে অপমান করলে। আজকে কিছুই বললাম না। দ্বিতীয়বার যদি এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে চিরতরে জবান বন্ধ করে দিব।”
ঠান্ডা মাথার এমন ভয়ংকর হুমকিতে একটু ভয় ডুকে যায় দৃষ্টির মনে। পরপর কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে মনে মনে ভাবে, “এ কোন জল্লাদের প্রেমে পরলি রে তুই দৃষ্টি? দুনিয়াতে এতো এতো ভালো মানুষ থাকতে সাক্ষাৎ জমের দোয়ারে এসে ভীড়লি! না জানি এই গুন্ডা হিরো কবে তোর প্রাণপাখিটা উড়িয়ে দেয়।”
জোর করে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায় দৃষ্টি। কাওকে আর কিছু বলতে না দিয়ে যেমন দৌড়ে এসেছিল তেমন গতিতেই দৌড় লাগায়। চোখে-মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে দৃষ্টির প্রস্থানের দিকে তাকিয়ে থাকে দলের ছেলেরা। কপাল কুঁচকে রক্তিমের দিকে তাকিয়ে মেহেদী জানতে চায়,
“এতো সহজে মেয়েটাকে নিজের নাম্বার দিয়ে দিলি তুই!”
“তো কি করতাম! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঐসব ফালতু কথাবার্তা শুনে মাথার পোকা মারতাম?”
কাটকাট স্বরে জবাব রক্তিমের। জবাবটা একটুও মনঃপুত হয়না কারো। অসন্তুষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রক্তিমের মুখের দিকে। কিন্তু কেউ কিছু বলার সাহস পায়না।
দৃষ্টিকে দৌড়ে আসতে দেখে গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে তুসী।কাছাকাছি দাঁড়িয়ে উৎকন্ঠা নিয়ে জানতে চায়,
“ঠিক আছিস তো তুই? ঐ গুন্ডাটা কিছু করেনি তো! এতো কাছে এসে কি করছিল তোর?”
তুসীর মুখে গুন্ডা ডাকটা শুনে কপাল কুঁচকায় দৃষ্টি। নিচের ঠোট দাঁত দিয়ে কামড়ে চোখ পাকিয়ে বলে,
“তুই কাকে গুন্ডা ডাকছিস? দুদিন পর সম্পর্কে যে তোর দুলাভাই হবে সেই সম্মানীয় মানুষটাকে কোন মুখে গুন্ডা ডাকিস তুই? বেয়াদব মেয়ে!”
তাজ্জব বনে যায় তুসী। ঘনঘন দুপাশে মাথা নাড়ে। হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
“পাগল কখনো পুরোপুরি সুস্থ্য হয় না কথাটা ভুলে গেছিলাম আমি। তুই আবার মনে করিয়ে দিলি। মরবি তুই। খুব শিগ্রই মরবি। যেদিন ঐ রক্তিম শিকদারের চোখের আনলে ভস্ম হবি সেদিন গিয়ে এসব পাগলামি বন্ধ করবি। এর আগে না।”
তুসীর কথা পাত্তা দেয়না দৃষ্টি। সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে আপন খুশিতে মত্ত হয়। নিজের হাতটা তুসীর চোখের সামনে তুলে ধরে বলে,
“এটা কি বল তো?”
“কি?” জানতে চায় তুসী। তৎক্ষণাৎ ছোটখাট এক চিৎকারে নিজের উল্লাস প্রকাশ করে বলে,
“রক্তিম শিকদারের নাম্বার। বুঝতে পারছিস আমি কতটা জিনিয়াস! তুড়ি বাজিয়ে নাম্বার জোগাড় করে ফেললাম। তাও আবার সয়ং রক্তিম শিকদার নিজে লিখে দিয়েছে। এবার তো আমার প্রেম জমে ক্ষীর হবে। কেউ আটকাতে পারবেনা আমাদের প্রেম।”
অত্যাধিক বিস্ময়ে তুসীর আঁখিযুগল ছানাবড়া।,
“ফাজলামি করছিস আমার সাথে! তুই বললি আর ওমনি রক্তিম শিকদার নিজের নাম্বার দিয়ে দিল? কেমনে কি করেছিস তুই?”
মিটিমিটি হেসে জবাব দেয় দৃষ্টি,
“বলা যাবেনা। সিক্রেট।”
****
একসময় মানুষের পদচারনায়,উৎসবমোখর আনন্দে, খিলখিল হাসির শব্দে সর্বদা মুখোরিত থাকা শিকদার মঞ্জিল গত পাঁচ বছর যাবৎ নিশ্চুপ। বাইরে থেকে দেখলে কখনো মনেও হয়না রাজপ্রাসাদের মতো দেখতে এই বাড়িতে কোনো মানুষ বসবাস করে। ভিতরে ডুকলে মনে হয় প্রতিটা দেয়াল, আসবাবপত্র নিজের দুঃখবিলাসে ব্যস্ত। হাতে গুণা কয়েকটা মানবপ্রাণ যেন কোনো অনুভূতি শূণ্য কাঠের পুতুল। অথচ একটা সময় এই বাড়ির পাশ দিয়ে কেউ হেঁটে গেলেও মনে মনে ভাবতো, “ইশ! যদি কখনো আমি এই বাড়ির মানুষ গুলোর মতো সুখী হতে পারতাম।” সেই বাড়ির পাশ দিয়েই বর্তমানে মানুষ হেঁটে গেলে হয়তো সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা জানায়, “হে প্রভু! আর কারো জীবনে তুমি এমন কালো অধ্যায় দিয়োনা। যে অধ্যায় মানুষের জীবন থেকে সম্পূর্ণ সুখ চুষে নিয়ে পুরো বাড়িময় শোকের ছায়ায় আবৃত করে নেয়।” আজীজ শিকদার বলতে গেলে দিনের পুরোটা সময় নিজের সমাজসেবা মূলক কাজে বাইরে থাকেন। সবসময়ের মতো বাড়িতে থেকে যায় শুধু তিনটা প্রাণ। শিকদার মঞ্জিলের কর্তৃ রেহানা বেগম, সর্ব কনিষ্ঠ কন্যা ইতি আর একমাত্র বাড়ির কাজে সাহায্য করা কাকলির মা। তিনজন তিনজনের মতো করেই পরে থাকে বিশাল বাড়ির তিন কোণায়। রেহানা বেগম এক ছেলেকে হারিয়ে জগত সংসারের সব কিছু থেকেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। রক্তিম, সংগ্রাম দুটো ছেলেই নিজের পেটের সন্তান। সমান আদর-যত্নে দুজনকেই ছোট থেকে বড় করে তুলেছে। সেই আদরের দুই সন্তানের একজনও তার কাছে নেই। ছোট সন্তানের খুনের দায়ে বড় সন্তানকে দূরে সরিয়েছে নিজেই। গুটা দুনিয়ার কাছে রক্তিম শিকদার নির্দোষ প্রমাণিত হলেও নিজের মায়ের কাছে এখানো সে দোষী। ছোট ভাইয়ের খুনি। সেই খুনি ছেলেকে রেহানা বেগমের কাছে টেনে নেবার প্রশ্নই আসেনা। বরং সামনে পরলে ছেলেকে যতটা কথার আঘাতে জর্জরিত করতে পারে ততই যেন নিজের মনে শান্তি মিলে।
নিজের রুমে বসেই কিছু একটা ভাবনায় মশগুল ছিলেন রেহানা বেগম। নিঃশব্দে মায়ের কাছে এসে দাঁড়ায় ইতি। কতক্ষণ চুপচাপ মা’কে দেখে নিয়ে মৃদু স্বরে ডেকে ওঠে,
“মা।” হঠাৎ ডাকে খানিক চমকায় রেহানা বেগম। ভাবনার সুতা ছিড়ে বেরিয়ে আসে। অনুভূতি শূণ্য চোখ দুটো ঘুরে তাকায়। মাসটপে ধরা দেয় ছোট মেয়ের মলিন মুখের আদল।দৃষ্টিজোড়া চঞ্চল হয়। বুকের ভিতর সৃষ্টি হয় অদম্য এক ঝড়। হাসফাস করে মাতৃমন আরেকটা বার মা ডাক শোনার জন্য। গত পাঁচটা বছর যাবৎ মধুর এই মা ডাকটাও খুব একটা শুনতে পাননা তিনি। অথচ পাঁচ বছর আগের স্মৃতি ঘাটলেই দেখা যায় মা ডাক শুনতে শুনতে রাত শেষে নতুন ভোর আসত রেহানা বেগমের জীবনে। আবার সেই মা ডাক শুনতে শুনতেই দিন শেষে রাত্রি গভীর হতো। ছোট ছেলে সংগ্রাম দুই মেয়ে স্মৃতি, ইতি, পুত্রবধূ জেরিন প্রতিটা কথার আগে তাদের মা না ডাকলে যেন শান্তি লাগতনা। রক্তিম অফ ডিউটিতে যতটা সময় পেতো পুরোটা সময় কিছুক্ষণ পরপর ফোনকলে মায়ের সাথে মন খুলে কথা বলত। সেও অন্যদের মতোই প্রতিটা কথার শুরুতে এবং শেষে মা শব্দটা উচ্চারণ করতোই। সেই দিন গুলো এখন শুধু জমে আছে স্মৃতির খাতায়। মাঝখানে কতশত দিন গেল। রেহানা বেগমের মাতৃ হৃদয়টা মা ডাক শুনে তৃষ্ণা মিটাতে ব্যর্থ। বড় মেয়ে স্মৃতির বিয়ে হয়ে গেছে। বাবার বাড়ির শোক ভুলে স্বামী সংসার নিয়ে ব্যস্ত সে। সারাদিনে একবারও সময় হয়না মা’কে ফোন করে মা বলে একটু ডাকার। আর ছোট মেয়ে বড় ভাই বাড়িতে না থাকার জন্য মা’কে দায়ী করে কাছে থেকেও সারাক্ষণ দূরে সরে থাকে। রেহানা বেগমের মাঝে মাঝেই মনে হয় অনর্থক বেঁচে থেকে শ্বাস নিয়ে শুধু শুধু বিশুদ্ধ অক্সিজেন নষ্ট করছেন। তার বেঁচে থাকা আর না থাকাই কিছুই হবেনা এ পৃথিবীর কারো। যে নারীর সন্তান থেকেও নেই। সুখের সংসার পূর্ণ হয় অসুখে। স্বামী নামক আস্থাভাজন মানুষটাও সর্বক্ষণ দেখিয়ে যায় শুধু নির্লিপ্ততা। সে নারীর এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোনো মানে হয়না। কিন্তু মরতেও পারেনা। আত্মহত্যা যে মহাপাপ। বুক ভরা বেদনা, হাহাকার, তৃষ্ণা নিয়েই কাটাতে হবে বাকীটা জীবন।
ইতি এখনো তাকিয়ে আছে মায়ের মুখের দিকে জবাবের আশায়। কন্ঠ কাঁপে রেহানা বেগমের। গলার কাছে কথারা এসে গিট পাকিয়ে থাকে। বহুকষ্টে ভাঙ্গাস্বরে তীব্র চেষ্টার পর বলতে পারেন,
“হু!”
সাথে সাথে বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ইতির। মায়ের দুঃখ গুলো সে বুঝে।এতোটা কাছে থেকে মেয়ে হয়ে মায়ের দুঃখ বুঝবেনা এতোটা পাষাণ মেয়ে তো আর ইতি না। কিন্তু সবটা বুঝেও তার কিছুই করার থাকেনা। তার কাছে সবসময় মনে হয় মায়ের এই কষ্ট পাওয়াটা পুরোটাই মায়ের স্বভাবের জন্যই হচ্ছে। যে বা যারা চলে যাবার কোনো না কোনো উছিলায় তারা তো চলেই গেছে। সেই চলে যাবার দায়ে কাছে থাকা সন্তানকে দায়ী করে দূরে ঠেলে দেওয়াটা পা দিয়ে ঠেলে লক্ষি বিদায় করার মতো হয়ে গেল না! যেখানে পুরো শহর জানে রক্তিম নির্দোষ। নিজের ভাই, স্ত্রী খুনের পিছনে রক্তিমের কোনো হাত নেই। সেখানে মা হয়ে রেহানা বেগম কেন এটা বিশ্বাস করতে পারেনা? কেন এভাবে দূরে ঠেলে দিল রক্তিমকে? ইতির বরাবরই মনে হয়, শুধুমাত্র তার মা ভাইকে দূরে ঠেলে দেবার কারণেই ভাইটা তার একজন আদর্শবান মানুষ থেকে গুন্ডা মাস্তানে পরিণত হয়েছে। ঠিক এই জায়গাটা থেকেই মায়ের প্রতি ইতির অভিমান।এ বিষয়ে যতবার মা’কে বুঝানোর চেষ্টা করেছে ঠিক ততবার মা তাকেও কথার আঘাতে জর্জরিত করে দূরে সরে যেতে বাধ্য করেছে। তবুও ইতি কিছুদিন যেতেই বেহায়ার মতো বারবার আসে বুঝাতে। যেমনটা এসেছে আজকে।
নিঃশব্দে মায়ের পাশে বসে কাধে মাথা রাখে ইতি। সহসা এক টুকরো প্রশান্তিতে চোখ দুটো বন্ধ করে নেয় রেহানা বেগম। বুক ভরে টেনে নেয় শান্তির নিশ্বাস।করেছেন
“কাল যখন ভাইয়া বাড়িতে এসেছিল এক ধ্যানে কিভাবে তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল! একটু কথা বললে কি এমন হতো মা?”
সহসা বন্ধ চোখ জোড়া খুলে তাকায় রেহানা বেগম। তড়িৎ নিজের কাধ থেকে মেয়ের মাথাটা নামিয়ে দেয়। শক্ত চোখে তাকিয়ে বলেন,
“আবারও ঐ খুনির সাফাই গাইতে এসেছিস আমার কাছে?”
ইতির চিত্ত বিগলিত হয়। মায়ের হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় পুড়ে অশ্রুস্বজল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
“আর কত মা? আর কত! আর কত এভাবে কষ্ট দিবে ভাইয়াকে? শুধু যে ভাইয়া একাই কষ্ট পাচ্ছে এমনটাও না। তার মতো সমান কষ্ট তুমিও পাচ্ছো। তবে কেন এতো রাগ তোমার? কেন তুমিও কষ্ট পাচ্ছো ভাইয়াকেও কষ্ট দিচ্ছো। তুমি চাইলেই কিন্তু আমাদের বাড়িটা একটু হলেও আগের মতো হতে পারে মা। ভাইয়া জীবনটাকে সুন্দরভাবে সাজাতে পারে। ও তোমার ছেলে মা। তোমার প্রথম সন্তান। যার মুখ থেকে তুমি প্রথম মা ডাক শুনেছিলে। তোমার সেই ছেলে রাজপ্রাসাদের মতো নিজের বাড়ি রেখে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। নিজের পরিচয় নিজের বাবার পরিচয় সব দূরে ছুড়ে গুন্ডা পরিচয়ে পরিচিত হচ্ছে মানুষের কাছে। তোমার কি একটুও কষ্ট হয়না তার জন্য? এখনো সময় আছে মা। তুমি চাইলেই আবারও ভাইয়ার জীবনটা নতুন মোড় নিতে পারে। আমাদের সবার জীবনে আবারও শান্তির বর্ষণ নামতে পারে। প্লিজ মা সময় থাকতে থাকতে সব ঠিক করে নাও। আর নষ্ট হতে দিওনা ভাইয়াকে। প্লিজ!”
ইতির আহাজারিতে থমকে থাকে রেহানা বেগম। অপলকে তাকিয়ে থাকে মেয়ের কান্নারত মুখের দিকে। একসময় জড়বস্তুর মতোই অসাঢ় কন্ঠে বলে ওঠে,
“আচ্ছা! সব ঠিক করে দিব। কাছে টেনে নিব তোর গুন্ডা ভাইকে। বিনিময়ে আমি কি পাব? ফিরে আসবে আমার মরে যাওয়া ছোট ছেলেট সংগ্রাম শিকদার? ফিরে পাব আমার আদর্শবান বড় ছেলে আর্মি ক্যাপ্টেন রক্তিম শিকদারকে? যে রাতে নিজের বড় ছেলের হাতে ছোট ছেলে খুন হয়েছে সেই রাতের স্মৃতিটুকু মুছে যাবে আমার মন-মস্তিষ্ক থেকে? উত্তর দে। পাব আমি আমার হারিয়ে ফেলা সুখ গুলো?”
শেষের কথা গুলো বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে যান রেহানা বেগম।দু-হাতে ইতির কাধ ঝাকিয়ে একই প্রশ্ন করতে থাকেন বারবার। উত্তর দেবার মতো ইতি কোনো শব্দ খোঁজে পায়না। মায়ের চিৎকারের সাথে সাথে সে নিজেও চিৎকার করে কাঁদে। একসময় মায়ের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতেই বেরিয়ে যায় রুম থেকে। এসেছিল সব ঠিক হয়ে যাবে এমন একটা আশা নিয়ে। অথচ যেতে হলো বুক ভরা যন্ত্রণা নিয়ে।
চলবে…….