দৃষ্টির_আলাপন #পর্বঃ৫ #আদওয়া_ইবশার

0
250

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৫
#আদওয়া_ইবশার

অলস দুপুর। সূর্যটা একেবারে মাথার উপর। অসহ্য রকম গরম পরেছে। দুই ক্লাস বাদ রেখেই গরমে টিকতে না পেরে কলেজ থেকে বেরিয়ে আসে ইতি। রাস্তায় আসতেই দেখতে পায় দূরে মেহেদী দাঁড়িয়ে আছে। ইতিকে বেরোতে দেখে দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসে তার দিকে। একদম ইতির সোজাসুজি দাঁড়িয়ে ক্লান্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। গরমে ছেলেটার ফর্সা মুখের আদল লাল হয়ে আছে। কপালের পাশ দিয়ে চিকন ঘামের রেখা নামছে। এক পলক সেদিকে তাকিয়ে উল্টো পথে হাটা ধরে ইতি। হতবম্ভ হয় মেহেদী। কয়েক পল ইতির গমনপথে তাকিয়ে থেকে তড়িৎ এগিয়ে গিয়ে হাত ধরে। সাথে সাথেই শুনতে পায় ইতির ঝাঝালো স্বর,

“মাঝ রাস্তায় একটা মেয়ের হাত ধরতে লজ্জা করেনা? অসভ্য পুরুষ কোথাকার!”

ইতির এহেন আচরণে ব্যথিত হয় মেহেদী। অসহায় মুখে তাকিয়ে জানতে চায়,

“এমন করছো কেন আমার সাথে? কি করেছি বলবে তো একবার!”

“আগে হাত ছাড়ুন।”

শক্ত কন্ঠে বলে ইতি। অধৈর্য্য হয় মেহেদী। হাতের বাঁধন আরও জোরালো করে নাছোড়বান্দা হয়ে বলে,

“আগে আমার কথার জবাব দাও। পরে হাত ছাড়ব কি না ভেবে দেখব।”

চোখ পাকায় ইতি। বলে,

“আমি কিন্তু চিৎকার করে লোক জড়ো করব। গণপিটুনি খাওয়ার আগে হাত ছাড়ুন”

“করো। আমিও দেখি রক্তিম শিকদারের বন্ধুর গায়ে টাচ করার মতো কলিজা কার আছে।”

ভাবলেসহীন জবাব মেহেদীর। নিম্নোষ্ঠ কামড়ে কতক্ষণ মেহেদীকে দেখে ইতি জবাবে বলে,

“রক্তিম শিকদারের বন্ধুর গায়ে টাচ করার কলিজা নেই কারো। অথচ রক্তিম শিকদারের বোনের হাত ধরার কলিজা ঠিকই আপনার আছে তাই না! খবরটা তো রক্তিম শিকদারের কানে পৌঁছেতে হয়। সে না হয় এসে মেপে দেখল তার বন্ধুর কলিজাটা কত বড়।”

কথার মোড় অন্যদিকে ঘুরে যেতে দেখে একটু বিরক্ত হয় মেহেদী। পরপরই বিরক্তি ভাবটা ঝেড়ে ফেলে হাতের জোড়ালো টানে ইতিকে আরো একটু কাছে টেনে নেই। দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলে দুজনের। প্রগাঢ় অনুভূতির মিশেলে ডাকে মেহেদী,

“এই ইতু!”

ছোট্ট একটা ডাকেই জমে যায় ইতি। মনে জমে থাকা অভিমানটুকু গলতে শুরু করে একটু একটু করে। এই ছেলে আস্ত এক জাদুকর। যখনই ইতি ভাবে একটু রেগে কিছুদিন দূরে থেকে শাস্তি দিবে, ঠিক তখনই এমন করে নিজের জাদুবলে সব ভেস্তে দেয়। কিন্তু এবার তো তাকে গলে গেলে চলবেনা। শক্ত রাখতে হবে নিজেকে। পর পর কয়েকটা ঢোক গিলে শান্ত রাখার প্রয়াস চালায় নিজেকে। চোখ ফিরিয়ে নেয় মেহেদীর থেকে। তৎক্ষণাৎ দুহাতের আজলায় ইতির মুখটা ধরে নিজের দিকে ফিরায় মেহেদী। ব্যকুল হয়ে জানতে চায়,

” এতো নিষ্ঠুর কেন তুমি? আমার রাতের ঘুম হারাম করে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছো!কি করেছি? আমার অপরাধ কি? কেন এভাবে ইগনোর করছো একবার বলো আমাকে। প্রয়োজনে শাস্তি দাও, মারো। তবুও এভাবে অবহেলা করোনা জান প্লিজ!”

“ভালোবাসা ফুরিয়ে গেছে। তাই এভাবে অবহেলা করছি। উত্তর পেয়েছেন? এবার দয়া করে ছাড়ুন আমাকে। নইলে কিন্তু এখন সত্যি সত্যি চিৎকার করে লোক জড়ো করব।”

বহুকষ্টে নিজের অনুভূতি গুলোকে দমিয়ে শক্ত কন্ঠে জবাব দেয় ইতি। একটু থমকায় মেহেদী। পরোক্ষণে ঠোঁটে স্মিত হাসি ফুটিয়ে বলে,

“মজা করছো না! আরে বাবা তোমার এই মজা যে আমাকে শান্তিতে নিঃশ্বাস টুকুও নিতে দিচ্ছেনা বুঝতে পারছো তুমি? অনেক হয়েছে মজা। এবার এসব থামাও। একটু স্বাভাবিক হয়ে দুটো কথা বলে আমার মনটা শান্ত করো।”

এক ঝটকায় মেহেদীর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে পিছিয়ে যায় ইতি। ঝাঝালো স্বরে মৃদু চিৎকারের সাথে বলে,

“আমি তো সবসময় মজা করি। কখনও আমার কোনো কথা তোমার কাছে সিরিয়াস মনে হয়েছে? এক বিন্দু পরিমাণ মূল্য কখনো আমাকে বা এই সম্পর্কটাকে দিয়েছো? যদি দিতে তাহলে আমার কথা একবার হলেও ভেবে দেখতে। এভাবে আমার ভাইয়ের পিছু নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় গুন্ডামি না করে নিজেও ভালো হতে আমার ভাইকেও ভালো হওয়ার পরামর্শ দিতে। কিন্তু কি করছো তুমি? সেই আমি যা নিষেধ করি তাই। একই ভাবে গুন্ডামি আর মাস্তানি। তোমার না আছে নিজেকে নিয়ে ভাবনা না আমাকে আর না আমার ভাইকে নিয়ে। তুমি শুধু মুখেই ভাইয়াকে নিজের প্রাণের বন্ধ বলো। প্রকৃত পক্ষে বন্ধু হলে এভাবে তাকে খারাপ কাজে এপ্রিশিয়েট করতে না। আমাকেও তো ভালোবাসো না। ভালোবাসলে অন্তত আমাকে পাওয়ার চিন্তা তোমার মাথায় থাকত। কিভাবে নিজেকে যোগ্য করে আমার বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে সেই চিন্তা থাকত। কিন্তু কয়? কিছুই তো নেই তোমার মাঝে। তবে কেন শুধু শুধু ভালোবাসতে যাব তোমাকে? যাতে ভবিষ্যতে তোমাকে না পাওয়ার যন্ত্রণায় নিঃশেষ হতে পারি?”

উত্তরে নিরবতাকেই বেছে নেয় মেহেদী। কিছুই বলেনা। শুধু শান্ত চোখে তাকিয়ে দেখে প্রিয়তমার অশান্ত রূপ। প্রায় মিনিট পাঁচেক সময় পর ফুস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে। অত্যন্ত শান্ত কন্ঠে বলে,

“কোনটাকে খারাপ কাজ বলছো তুমি? রাস্তা-ঘাটে মেয়েদের উত্তক্ত করা বখাটেদের শায়েস্তা করাটা খারাপ কাজ? না কি অসহায় মানুষের গলায় পারা দিয়ে তাদের রক্ত চুষে খাওয়া পিশাচদের শায়েস্তা করাটা খারাপ কাজ? অন্যায়ের প্রতি সোচ্চার হওয়া যদি খারাপ হয় তবে ভালো কি অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া?”

“এসবের জন্য দেশে আইন আছে। তোমাদের তো কেউ বিচার করার দায়িত্ব দেয়নি। আইনের লোক না হয়েও অপরাধির শাস্তি দেওয়াটা এক প্রকার অপরাধ।”

তাচ্ছিল্য হাসে মেহেদী। শ্লেষাত্মক স্বরে বলে,

“আইন! হাহ্! কোন আইনের কথা বলছো তুমি? যে আইন সর্বদা টাকার কাছে বিক্রি সেই আইন? যে আইন একটা মেয়ে ধর্ষিত হবার পর এসে তদন্ত করার নামে হাজারটা নোংরা কথা বলে মেয়েটাকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে সে আইন?”

ইতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে আর এক মুহুর্তও দাঁড়ায়না মেহেদী। একটা রিকশা ডেকে ইতির সামনে দাড় করিয়ে বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে যায় প্রিয়তমার রাগ ভাঙ্গানোর কথা ভুলে। অসহায় নয়নে ইতি শুধু তাকিয়ে দেখে মেহেদীর প্রস্থান। ব্যর্থতার নিঃশ্বাস ছাড়ে বুক ফুলিয়ে।

****

আজ এক সপ্তাহ হয়ে গেছে দৃষ্টি ঢাকা ছেড়ে ময়মনসিংহ নিজের বাড়িতে এসেছে। সাময়িক ছুটি কাটিয়ে আবারও শুরু হয়ে গেছে পড়াশোনা। লেগে গেছে ভর্তি যুদ্ধের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার কাজে। কিন্তু খুব বেশিক্ষণ মন টিকছেনা তার বইয়ের মাঝে। মাথায় কতক্ষণ পর পর কিলবিলিয়ে উঠছে রক্তিম শিকদার নামক প্রেম পোকা। কিছু একটা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে সর্বক্ষণ বলছে, “রক্তিম শিকদারের নাম্বার নিজের কাছে থাকতেও এখনো বোকার মতো কিসের জন্য বসে আছিস তুই? যাতে অন্য কোনো মেয়ে এসে তোর আগেই ভাগিয়ে নিয়ে যেতে পারে এজন্য?”

দৃষ্টি বিরক্ত। নিজেই নিজের প্রতি চরম ভাবে বিরক্ত। তার এক মন বলে,পড়াই মন দে। ঢাকায় কোনো একটা ভার্সিটিতে চান্স পেয়ে গেলে কপাল খুলবে তোর। সবসময় তোর হিরোর কাছাকাছি থাকতে পারবি। আরেক মন বলে, দেরি করে লাভ নেই। এখনই মনের কথা বলে দে। এই এক মনের দুই ভাবনা নিয়ে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছেনা তার। না হচ্ছে পড়া আর না হচ্ছে প্রেম। কি করবে সে! বইয়ের মাঝে মাথা ঠেকিয়ে ভাবে কিছুক্ষণ। পর পর ওঠে গিয়ে বিছানায় অবহেলায় পরে থাকা ফোনটা হাতে তুলে নেয়। কল লিস্টে ঢুকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে “My real hero” নামে সেইভ করে রাখা নাম্বারটার দিকে। যে নাম্বারে অসংখ্যবার কল দিতে গিয়েও আবার কেটে দিয়েছে। অসহায়ের মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মাথা নাড়িয়ে তুসীর নাম্বারে ডায়াল করে। অপরপাশ থেকে ফোন রিসিভ হতেই তুসীকে কিছু বলতে না দিয়ে দৃষ্টি হাহাকার করে ওঠে,

“তুসুরে! আমি মরে যাচ্ছি। প্লিজ বাঁচা আমাকে।”

তুসী নিজেও বইয়ের মাঝে ডুবে ছিল। হঠাৎ দৃষ্টির ফোন পেয়ে যতটা না বিরক্ত হয়েছে তার থেকেও বেশি ত্যক্ত তার কথা শুনে। বই থেকে দৃষ্টি সরিয়ে চোখ-মুখ কুঁচকে বিরক্ত প্রকাশ করে বলে,

“আচ্ছা! তো মর। কখন মরছিস একটু বলে দে এখন। তাহলে আগেভাগেই রওনা দিব আমরা। নইলে ঢাকার যে জ্যাম। দেখা যাবে তোর মুখটা এক পলক আমাদের না দেখিয়েই কবর দিয়ে দিবে। শেষ দেখা দেখতে না পেয়ে পরে আফসোস করতে হবে।”

এহেন জবাবে ফুসে ওঠে দৃষ্টি। রাগ-দুঃখ দুটোর মাঝে পরে দোলাচলে ভেসে বলে,

” হা’রা’মি কু’ত্তা কষে একটা লাথি খাবি তুই। আমি মরে যাচ্ছি আমার যন্ত্রণায়। কোথায় একটু আমাকে শান্তনা দিবে, বুদ্ধি দিবে। তা না করে কখন মরব সেটা জানতে চায়! আমার খালা তোর মতো এমন নিমক হা’রা’মি কিভাবে পেটে ধরল।”

“সেটা তোর খালাকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর। অযথা আমার কানের কাছে কাও কাও করে মেজাজ নষ্ট করবিনা। পড়ছি। ফোন রাখ।”

নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কথা গুলো বলে তুসী নিজেই ফোন কেটে দেয়। আশাহত হয়ে তাজ্জব বনে কতক্ষণ বসে থাকে দৃষ্টি। মনে মনে ফুসে ওঠে তুসীকে যা মনে এসেছে তাই বলে বকে ধমকে নিজেকে একটু শান্ত করে। এরপর আবারও মনোনিবেশ করে ফোনে। আগে পরে কোনো কিছু না ভেবেই গানের দুটো লাইন টাইপ করে পাঠিয়ে দেয় নাহিদের নাম্বারে,

প্রেমে পরেছে মন প্রেমে পরেছে,
অচেনা এক মানুষ আমায় পাগল করেছে।

ছোট্ট বার্তাটা পাঠিয়ে অদম্য এক আনন্দ হয় দৃষ্টির মনে। প্রাণখোলা হেসে ফুরফুরে মনে আবারও বইয়ে নজর দেয়। জটিল একটা অংকের সমাধান করতে ব্যস্ত হয়ে পরে। একদম শেষ পর্যায় আসতেই টুং করে নোটিফিকেশন বেজে ওঠে ফোনের। সাথে সাথেই ধরফরিয়ে ওঠে দৃষ্টি। মন ছুটে যায় অংক থেকে। কাজটা নিশ্চয়ই সীম কোম্পানির। এছাড়া আর কারো না। বুকে থুথু দিয়ে সীম কোম্পানিকে বকতে বকতে ফোন হাতে তুলে নেয়। লক খুলে ম্যাসেজ অপশনে ঢুকতেই ছানাবড়া হয়ে যায় চোখ দুটো। রক্তিমের নাম্বার থেকে ফিরতি ম্যাসেজ এসেছে! এ ও সম্ভব! দ্যা গ্রেট গুন্ডা রক্তিম শিকদার নিজের ব্যক্তিত্বের বাইরে গিয়ে দৃষ্টির ম্যাসেজের রিপ্লাই দিয়েছে! বিশ্বাস হয়না দৃষ্টির। নিজেকে সামলে ঝটপট হাতে টাচ করে ম্যাসেজটা পুরোপুরি সো করে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে অপ্রত্যাশিত এক গানের কিছু লাইন,

‘কীবা তোমার নাম গো কন্যা বাড়ি কোন গেরাম?
গ্রাম ঠিকানা যদি জানিতাম,
আমি তোমার বাড়ি ঘটক পাঠাইতাম।
আমি তোমারে বউ বানাইতাম।’

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here