দৃষ্টির_আলাপন #পর্বঃ৬ #আদওয়া_ইবশার

0
242

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৬
#আদওয়া_ইবশার

অত্যধিক বিস্ময়ে হেঁচকি ওঠে যায় দৃষ্টির। চোখ দুটো গোলগোল মার্বেলের মতো আকৃতি করে ফোনের দিকে তাকিয়ে সমান তালে হেঁচকি দিয়ে যাচ্ছে। রক্তিম শিকদার তার ম্যাসেজের এমন একটা রিপ্লাই দিবে এটা কি আদও সম্ভব! এতোদিন যে শুনে এলো রক্তিম শিকদার প্রথম স্ত্রী হারিয়ে সর্বদা নারী জাতির থেকে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে চলে। তবে কি সে কথা মিথ্যে? ভাবনার আকুল সাগরে ডুবে থাকা দৃষ্টির ধ্যান ভঙ্গ হয় ছোট ভাই দিহানের কথায়। বোনের রুমের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল দিহান। তখনই দেখতে পায় হেঁচকির তোড়ে বোনের বেহাল দশা। ঝটপট রুমে প্রবেশ করে জানতে চায় দিহান,

“কি ব্যাপার আপু! তুমি না কি শিবলীদের ছাদ থেকে আচার চুরি করে খেয়েছো? আম্মু কি তোমাকে আচার বানিয়ে খাওয়ায় না? না খাওয়ালে আমাকে বলতে আমি বাজার থেকে কিনে এনে খাওয়াতাম। শুধু শুধু কেন চুরি করে মানসম্মান ডুবাতে গেলে?”

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় দৃষ্টি। থম ধরে বসে থেকে মনে করার চেষ্টা করে সে কখন শিবলীদের ছাদে গেল আর কখন আচার চুরি করে খেল? তার জানা মতে সে তো আজ সারাদিন ঘর থেকেই বের হয়নি। তবে আচার কখন চুরি করল!,

“আমি কখন আচার চুরি করে খেলাম? এই কথা কে বলেছে তোকে? ঐ বুড়ি সফুরা খানম?”

প্রশ্নটুকু করে একটু থামে। কিছু একটা ভেবে বিরক্তি প্রকাশ করে আবারও বলে,

“আমি বুঝিনা ঐ বুড়ির কিসের এতো দন্দ আমার সাথে! এক পা কবরে চলে গেছে এখনো কূটনামি কমায়নি। হাঁটুর বয়সী একটা মেয়ের সাথে লেগে থাকে সবসময়।”

সে কথার কোনো জবাব দেয়না দিহান। জানতে চায়,

“হেঁচকি কমে গেছে?”

হেঁচকির কথা মনে হতেই সাথে মনে পরে ভাইয়ের আগমনে রক্তিম শিকদারের ঘটনা পুরোটাই মাথা থেকে বেরিয়ে গেছিলো কিছুক্ষণের জন্য। আশ্চর্য হয় দৃষ্টি। বিস্মিত চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ভাবে ওমন একটা গুরুত্বপূর্ণ ভাবনা কিভাবে তার মাথা থেকে সরে গেল। তাও এক লহমায়,

“হ্যাঁ কমে গেছে। কিন্তু কিভাবে?”

বুক ফুলিয়ে হাসে দিহান। শার্টের কলার ঝাকিয়ে বলে,

“দেখেছো তোমার ভাই কত বড় ম্যাজিসিয়ান! এক চুটকিতে তোমার হেঁচকি হাওয়া করে দিয়েছি।”

কথা শেষ করে প্রফুল্ল চিত্তে হেলতে দুলতে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। তাজ্জব বনে তখনো ঠাই বসে থাকে দৃষ্টি। কিছু সময় পর নিজেকে ধাতস্থ করে ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভাবে। পরপর ঝটপট হাতে একটা বার্তা পাঠিয়ে দেয় রক্তিমের নাম্বারে,

“কে আপনি?”

আবারও দৃষ্টিকে অবাক করে দিয়ে ঐপাশ থেকে ফিরতি জবাব আসে,

“যার জন্য তুমি পাগল হয়ে আছো আমি সেই পুরুষ সুন্দরী।”

না। এটা কিছুতেই সম্ভব না। এ রক্তিম হতে পারেনা। বার কয়েক মাথা ঝাকায় দৃষ্টি। ভাবে হয়তো ঐদিন রক্তিম তাকে অন্য কারো নাম্বার দিয়ে বোকা বানিয়েছে। না হয় রক্তিমের ফোন অন্য কারো হাতে। রক্তিম শিকদার কখনো তার ব্যক্তিত্বের বাইরে গিয়ে এমন রিপ্লাই দিতে পারেনা। প্রশ্নই আসেনা।

****
অগোছালো ছোট্ট একটা রুম। আসবাব বলতে আছে কেবলমাত্র একটা ছোট্ট খাট একটা টেবিল আর একটা আলনা। বিছানা এলোমেলো। আলনায় পুরুষ মানুষের কয়েকটা শার্ট, প্যান্ট। সেগুলোও ভাজহীন অগোছালো করে রাখা। টেবিলের উপর একটা প্লেট, একটা গ্লাস, একটা জগ। সাথে একটা খাবারের বক্স। এই ছোট্ট কবুতরের খোপের মতো এক রুমের বাসাটাই রক্তিমের শিকদারের দিন শেষে মাথা গুজার স্থান। গত দুটো বছর যাবৎ এখানেই কাটছে তার প্রতিটা নির্ঘুম রাত। হাতে গুণা কয়েকটা জিনিস আর চারপাশের দেয়াল গুলো জানে রক্তিমের এক একটা দীর্ঘশ্বাসের গল্প।

এলোমেলো বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে রক্তিম। চোখ দুটো বন্ধ। পাশেই উদাস চিত্তে এক হাটু মুড়িয়ে আধশোয়া হয়ে আছে মেহেদী। নিচে মেঝেতে রাকিব, জাবির,শান্ত একেকজন একেক ভঙ্গিমায় শুয়ে, বসে। কতক্ষণ পরপর শোনা যাচ্ছে তাদের চাপা স্বরের গুঞ্জন। আচমকা রক্তিমের বন্ধ চোখের পল্লব আলগা হয়। অলস ভঙ্গিমায় ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় মেহেদীর দিকে। ভরাট কন্ঠে বিরক্তির মিশেলে বলে,

“তোর গালে কি মাম্প হয়েছে?”

কিছু একটা ভাবনায় মগ্ন ছিল মেহেদী। হুট করে এমন একটা প্রশ্নে একটু চমকায়। পরোক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে,

“না। হঠাৎ এ কথা জিজ্ঞেস করলি কেন?”

“মেয়েদের মতো গাল ফুলিয়ে বসে আছিস কেন তবে?”

প্রলম্বিত এক নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে মেহেদীর বুক চিরে। মনে মনে বলে,

“সেই কারণ যদি জানতি, তবে এতোক্ষণে হয়তো তোর সাথে আমার সম্পর্কের সমীকরণটা এমন থাকতনা। হয় আমাদের বন্ধন আরও মজবুত হতো না হয় একেবারে ছিন্ন হতো।”

ভাবনায় এটা থাকলেও মুখে উত্তর দেয় অন্য কথা,

“তেমন কিছুনা। এমনিতেই ভালো লাগছেনা। আব্বা আজকেও চিল্লাপাল্লা করেছে কতক্ষণ, কেন কোনো চাকরি করিনা, দোকানেও বসিনা। ভালো লাগেনা এসব।”

জবাবে মৌনতাকে বেছে নেয় রক্তিম। শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বন্ধুর বিষন্ন মুখের দিকে। দুনিয়ায় যদি কোনো ব্যক্তি থেকে থাকে যে রক্তিম শিকদারকে একটু হলেও বুঝে। চেষ্টা করে তার ভিতরে থাকা কষ্ট গুলোকে কিন্চিৎ হলেও কমাতে। তবে সে ব্যক্তি হলো এই মেহেদী নামের ছেলেটা। যেখানে নিজের মা’ও রক্তিমকে দূরে ঠেলে দিয়েছে সবার মতো। সেখানে এই বোকা ছেলেটা বন্ধুত্বের দায়ে থেকে গেছে তার সাথে। ঢাল হয়ে পাশে থাকে প্রতিটা দিন। বাবা-মায়ের হাজার নিষেধ বারণ সত্বেও গুন্ডা বন্ধুর সঙ্গ ছাড়েনি। বরং সে নিজেও তার সাথে থেকে সাধারণ মানুষের কাছে হয়েছে গুন্ডা।

“খারাপ কি বলে? করছিস না কেন কিছু? বাপের একমাত্র ছেলে হয়ে চাকরি না কর। অন্তত বাপের ব্যবসায় হাত লাগা। অযথা আমার মতো এক খুনি, মাস্তানের পিছনে ঘুরে নিজের জীবন নষ্ট করিস না।”

মুহূর্তি শান্ত মেজাজটা খিঁচিয়ে ওঠে মেহেদীর। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,

“আমি আমার বাপ মায়ের একমাত্র সন্তান। সেজন্য আমাকে হয় চাকরি করতে হবে নাহয় বাপের ব্যবসা সামলাতে হবে। আর তোর বাপের তো গোয়াল ভর্তি ছানা তাইনা? এজন্য তোর এসবে কোনো টেনশন নাই। তোর বাপ-মায়েরও নাই। তোর বাপের সব কিছু দেখভাল করার জন্য তো গোয়ালভর্তি ছানা আছেই। তোর গুন্ডামি করে বেড়ালেও চলবে।”

বাবা-মায়ের কথা স্বরণ হতেই একটু অন্যমনস্ক হয় রক্তিম। ধূর্ত চোখের কুচকুচে কালো মনি দুটো একদম স্থির। কন্ঠ অত্যন্ত শীতল রেখে উত্তর দেয়,

“ছিল তো। গোয়াল ভরা না থাকলেও একটা ছিল। যাকে নিজের হাতে মেরে খুনি হয়েছি আমি। খুনিরা কখনো কোনো মানুষের দায়িত্ব নিতে পারেনা। কিন্তু তুই তো আর খুনি না। তোর এভাবে আমার সাথে থাকা মানায় না।”

চোখ-মুখ খিঁচিয়ে নেয় মেহেদী। এই ভাই-বোন দুটো পেয়েছে টা কি তাকে? একজন দুপুরে এক নাটক করে মাথা ব্যথা বানিয়ে দিয়েছে। সেই ব্যথা সাড়াতে এসেছে একটু নিরিবিলি নিজের মতো থাকতে সেটাও হতে দিলনা তার ভাই। মেজাজ খিঁচিয়ে চওড়া গলায় খ্যাঁকিয়ে ওঠে মেহেদী,

“বা’লে’র কথা কইয়োনা আমারে। তোমার এই কথা শুনতে শুনতে কানের পোকা সব মরে গেছে আমার। নিজে যেটা পারবেনা সেটা নিয়ে অন্য মানুষরে জ্ঞান দিতে আসবে। যত্তসব ভন্ডামি।”

মেহেদীকে রাগে ফুসতে দেখে শুকনো হাসে রক্তিম। শোয়া থেকে ওঠে বসে। বালিশের নিচ থেকে সিগারেট বের করে একটা বাড়িয়ে দেয় মেহেদীর দিকে। অন্য দিকে ফিরে থমথমে মুখে হাতে বাড়িয়ে সিগারেট নেয় মেহেদী। পুড়ো ঠোঁটের ভাজে সিগারেট রেখে লাইটার দিয়ে আগুন ধরায় রক্তিম। কাজটা করার ফাকে এক পলক দেখে নেয় নিচে বসে থাকা তিনজনকে। এক টান দিয়ে নাক মুখ দিয়ে ধোয়া উড়াতে উড়াতে গমগমে স্বরে জানতে চায়,

“তিন মাথা একসাথে করে কি রাজকার্য করছিস?”

প্রশ্নটা কানে যেতেই হুড়মুড়িয়ে তিন মাথা আলাদা করে ছিটকে বসে তিনজন। রাকিব বোকা হেসে মাথা চুলকে বলে,

“কিছুটা ভাই।”

রাকিবকে অস্বীকার যেতে দেখে পাশ থেকে ফট করে জাবির বলে দেয়,

“আমাদের রাকিব ভায়া আবার নতুন প্রেমিকার সন্ধান পাইছে ভাই। তাও আবার পাখি নিজে থেকে এসে ধরা দিছে। আহ! কি সেই মাখো মাখো প্রেমকথন!”

একটু থমকায় রক্তিম। আচমকা শক্ত হয়ে ওঠে চোখ-মুখ। চোয়াল শক্ত করে শানিত কন্ঠে বলে,

“কতবার বলেছি ঐসব ছলনাময়ীর পাল্লায় পরবিনা কেউ। এরা কাল সাপের থেকেও ভয়ংকর হয়। একেবারে বরবাদ করে দেয় পুরুষের জীবন।”

পাশ থেকে তৎক্ষণাৎ জবাব দেয় মেহেদী,

“সব মেয়ে এক হয়না। যদি এক রকম হতোই তবে তোর আর আমার মা এখনো নিজের কথা না ভেবে স্বামীর সংসারে পরে থাকতনা হাজার ঝড়-ঝাপটা সহ্য করে।”

খাটের হেডবোর্ডে হেলান নিয়ে আবারও চোখ দুটো বন্ধ করে নেয় রক্তিম। দম ছাড়ে বুক ফুলিয়ে। জলন্ত সিগারেট আঙুলের ভাজে নিয়ে সেই হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়েই কপাল চুলকাতে চুলকাতে বলে,

“কাচ যেমন ভাঙলে জোড়া লাগেনা। তেমন বিশ্বাস ও একবার একবার ভেঙ্গে গেলে আর কারো প্রতি তৈরী হয়না। নারী জাতির কাছে একবার যে ঠকে সে জানে এরা কতটা ভয়ংকর।”

“তোর বিশ্বাস ভেঙেছে কিন্তু আমাদের তো ভাঙ্গেনি। তবে আমরা কেন নারী বিদ্ব্যেশি হব?”

লম্বা দুটো দিয়ে সিগারেটের উচ্ছিষ্ট অংশটুকু ফিল্টারে ফেলে মেহেদীর দিকে তাকায় রক্তিম। গম্ভীর চোখ দুটো অপলক রেখে শান্ত অথচ অত্যন্ত ধারালো স্বরে জানতে চায়,

“তোর সত্যিই বিশ্বাস আছে নারী জাতির উপর? বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবি কখনো ঠকবিনা?”

কিছু একটা হয়তো ছিল রক্তিমের কন্ঠে। যার দরুন অল্প ঘাবড়ায় মেহেদী। জ্বিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে স্থিমিত স্বরে জানায়,

“এই মনে যে নারীর প্রতিচ্ছবি আঁকা আছে আমার বিশ্বাস, সে নারী কখনো আমার বিশ্বাস ভাঙবেনা।”

রক্তিমের ঠোঁট দুটো অল্প বিস্তর ফাঁক হয়। গম্ভীর মুখে তবে কি অধরা হাসির দেখা মিলল! নিচে বসেই গভীর নয়নে রক্তিমের মুখ পর্যবেক্ষণ করে হাসি খোজার প্রয়াস চালায় রাকিব, জাবির, শান্ত। তবে না! কিছুই পাওয়া যায়না। হতাশ হয় তিনজনই। দৃষ্টি ফিরিয়ে তাকায় একে অপরের মুখের দিকে। ঠিক তখনই শুনতে পায় রক্তিমের কন্ঠ নিঃশৃত বাক্য,

“যদি তোর মনে সত্যিই এতোটা বিশ্বাস থেকে থাকে। তবে কথা দিলাম আমি। তোর মনে যে নারীর প্রতিচ্ছবি সে নারী তোর।”

এমন একটা জবাব একটুও আশা করেনি মেহেদী। সেই আশাহীন জবাব পেয়ে বুক কাঁপে মেহেদীর। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়। দৃষ্টি হয় চঞ্চল। ঘনঘন ঢোক গিলে শুকিয়ে আসা গলাটা ভিজানোর ব্যর্থ প্রয়াস চালায়। মনে মনে ভাবে,
“যদি জানতি সেই নারী তোর আদরের ছোট বোন তবে কখনো এমন কথা দিতে পারতিনা।” মুখে জবাব দেয় অসাঢ় কন্ঠে,

“যে কথা কখনো রাখতে পারবিনা এমন কথা কখনো দিস না।”

কপালে গুটি দুয়েক ভাজ পরে রক্তিমের। শ্লান ভরাট স্বরে জানতে চায়,

“আমার জানা মতে আমি কাওকে কখনো এমন কোনো কথা দেইনি যে কথা রাখতে পারিনি। তবে তোর কেন মনে হচ্ছে তোকে দেওয়া কথা রাখতে পারবনা?”

“এমনি।” ছোট্ট স্বরে জবাব দিয়ে আর কিছু বলার সুযোগ দেয়না মেহেদী। চুপচাপ বেড়িয়ে যায় রুম থেকে। সেদিকে অপলক তাকিয়ে থাকে রক্তিম। কিয়ৎ সময় পের হতেই এবার সত্যি সত্যিই রক্তিমের ঠোঁটের কোণে দুর্বোধ্য সেই হাসির রেখে দেখা দেয়। যা দেখে অবাকের চরম পর্যায় গিয়ে কিছু বলতে ভুলে যায় নিচে বসা তিনজন। শুধু ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে দেখে মহামূল্যবান সেই হাসি।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here