দৃষ্টির_আলাপন #পর্বঃ৭ (প্রথম অংশ ) #আদওয়া_ইবশার

0
226

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৭ (প্রথম অংশ )
#আদওয়া_ইবশার

দিন যায়, রাত আসে। সেই রাত শেষে আবারও এক নতুন দিনের সূচনা হয়। এভাবেই কেটে যায় মাসের পর মাস। সুখ-দুঃখ দুটোকেই সারথী করে সময় এগিয়ে যায় নিজের মতো করে আপন নিয়মে। দৃষ্টি, তুসী দুজনের পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়ে দিয়েছে অনেক দিন আগেই। দুজনেই সর্বোচ্চ জিপিএ নিয়ে উত্তির্ণ হয়েছে। ভর্তি পরীক্ষার সময়টাও অতি নিকটে। সেদিন রক্তিমের নাম্বার থেকে এমন রিপ্লাই পেয়ে আর যোগাযোগ করার সাহস পায়না সে। তবে সময় যত গড়াচ্ছে ততই মনে হচ্ছে রক্তিম নামক মানুষটা তার সর্বত্র জুড়ে বিরাজ করছে। দিন কে দিন গাঢ় হচ্ছে অনুভূতি। প্রগাঢ় হচ্ছে হৃদয়ের তোলপাড়। তনুমন উতলা সিক্ত হচ্ছে নব্য প্রেমের ছোঁয়ায়। মনে হয় মনটা আর তার মাঝে নেই। পরে আছে সাভারে গুন্ডা রক্তিম শিকদারের কাছে। এই এতো এতো অনুভূতির যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ দৃষ্টি। ইচ্ছে করে এক ছুটে ময়মনসিংহ ছেড়ে পালিয়ে যেতে রক্তিমের কাছে। চোখে চোখ রেখে প্রগাঢ় স্বরে বলতে,
“আপনাকে ছাড়া আমি ভালো নেই। নিঃস্ব হয়ে গেছি আপনার প্রেমে। আমাকে প্লিজ আপনার শক্ত বুকে ঠাই দিয়ে একটু নিশ্চিন্তে শ্বাস নিতে দিন গুন্ডা মশাই!”

কিন্তু পারছেনা। এই এতো এতো অসহ্য বেহায়া অনুভূতিদের নিজের মাঝে লুকিয়ে রেখে চুপটি করে দিন পার করতে হচ্ছে। অনুভূতিদের জাতাকলে পিষ্ঠ হচ্ছে নব্য প্রেমে সিক্ত হওয়া হৃদয়।

জানালার কার্নিশ ঘেষে উদাস চিত্তে আকাশ পানে তাকিয়ে আছে দৃষ্টি। মেঘলা আকাশ। টুকরো টুকরো মেঘ গুলো উড়ে যাচ্ছে নিজের মতো করে। মাঝে মাঝে দুই-একটা পাখি ডানা মেলে মনের সুখে উড়ছে মেঘেদের সাথে পাল্লা দিয়ে। পিছন থেকে কেউ হঠাৎ কাধে হাত রাখায় আকাশ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে পেছন ঘুরে তাকায় দৃষ্টি। দিলশান আরা দাঁড়িয়ে আছে। চঞ্চল মেয়েটা এভাবে চুপটি করে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে দেখে ভাবে হয়তো কিছু একটা নিয়ে মন খারাপ মেয়ের। জিজ্ঞেস করে,

“কি ব্যাপার? এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন? কিছু নিয়ে মন খারাপ?”

ধাতস্থ হয় দৃষ্টি। নিজেকে স্বাভাবিক করে ঠোঁটে জোরপূর্বক হাসি টেনে বলে,

“কিছুই হয়নি আম্মু। একটানা পড়তে ভালো লাগছিলো না তাই এখানে দাঁড়িয়েছিলাম। তুমি স্কুল থেকে কখন এসেছো?”

মেয়ের কথা বিশ্বাস হয়না দিলশান আরা’র। তবুও কোনো প্রশ্ন না করে উত্তর দেয়,

“মাত্রই এলাম। একটানা পড়তে কে বলেছে তোমাকে? মাঝে মাঝে দিহানের সাথে বাইরে থেকে একটু ঘুরে এসো। মাইন্ড ফ্রেশ হবে।”

দ্বিমত করেনা দৃষ্টি। মাথা ঝাকিয়ে সায় জানিয়ে বলে,

“আচ্ছা যাব। তুমি যাও ফ্রেশ হয়ে আসো। দুপুরে খাইনি আমি। তোমার সাথে খাব।”

কোনো রা ছাড়াই বেরিয়ে যায় দিলশান আরা। একটা সরকারি কলেজে বাংলা প্রভাষক হিসেবে গত সাত বছর যাবৎ যুক্ত দিলশান আরা। কর্ম জীবনের ব্যস্ততার কারণে চাইলেও সবসময় ছেলে-মেয়ে দুটোকে ঠিকঠাক সময় দিতে পারেনা। ছুটির দিন ছাড়া দুপুরে একসাথে খাওয়ার সুযোগটাও হয়ে ওঠেনা। দৃষ্টির বাবা সাদেক সাহেবের ময়মনসিংহ শহরেই নিজস্ব ছোটখাট একটা গার্মেন্টস ফেক্টরি। বাবা ব্যস্ত ব্যবসায়ীক কাজে আর মা ব্যস্ত শিক্ষকতাই। দৃষ্টি, দিহান দুই ভাই-বোনের দিন কাটে একা একাই। বাসায় সারাদিন তারা দুজন ভাই-বোন আর একজন কাজের লোক ছাড়া কেউ থাকেনা। দৃষ্টি সাদেক সাহেব, দিলশান আরা দুজন কঠোর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষের মেয়ে হিসেবে হয়েছে একদম বিপরীত ধাচের। স্বভাবে অত্যন্ত চঞ্চল এই মেয়ের চঞ্চলতা নিয়ে মাঝে মাঝে বাবা-মা দুজনের মাঝে চলে বাক বিতন্ডতা। দোষারোপ করে একে অপরকে। তাদের ব্যস্ততার কারণে মেয়েটা শাসন বারণ না পেয়ে এমন চঞ্চল হয়েছে। তবে কিছুই করার থাকেনা। দুই সন্তানের সুন্দর একটা ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সাদেক সাহেব টাকার পিছনে না ছুটে পারেনা ছেলে-মেয়ে দুটোকে সময় দিতে। আর না পারে দিলশান আরা নিজের যোগ্যতা, মেধা লুকিয়ে রেখে শুধু স্বামী-সংসার সন্তান নিয়ে দিন কাটাতে। দিলশান আরার মতে প্রতিটা মেয়ের প্রয়োজন আলাদা ভাবে নিজের একটা পরিচয় গড়ে তোলা। মাথা উচু করে সমাজে চলতে গেলে শুধু চার দেয়ালের মাঝে বন্দি থেকে সংসার সামলালেই হয়না। তার জন্য প্রয়োজন হয় নিজেকে যোগ্য হিসেবে সমাজের সামনে উপস্থাপন করা। দিলশান আরার এই ভাবনাতেই অসন্তুষ্ট সাদেক সাহেব। স্ত্রীকে বারবার বুঝানোর চেষ্টা করে, সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু হতে পারেনা। জবাবে দিলশান আরাও জানিয়ে দেয়, তার ছেলে মেয়ে সঠিক শিক্ষা আদর্শ নিয়েই বড় হচ্ছে। যেটুকু চঞ্চলতা আছে মেয়ের মাঝে পুরোটাই বয়সের দোষ। ঠিক এভাবেই দুজন দুজনের জায়গা থেকে বিভিন্ন যুক্তি দাঁড় করিয়ে একটা সময় ক্লান্ত হয়ে ছিটকে আসে এসব আলোচনা থেকে। তবে সময় তো আর থেমে থাকেনা। বাবা-মায়ের অনুপস্থিতিতেই কাটে দুই ভাই-বোনের দিন। তবুও কখনো তারা বাবা-মায়ের প্রতি কোনো অভিযোগ রাখেনি। চঞ্চল দৃষ্টির স্বভাবে থাকলেও ভালো করেই বুঝতে পারে বাবা-মায়ের দিকটা। সে জানে বাবা এবং মা দুজন দুজনের জায়গা থেকে ঠিক। এবং তারা যা করছেন তা শুধুমাত্র তাদের দুই ভাই-বোনের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই করছেন।

অনেক দিন পর একটু সময় পেয়ে ছেলে-মেয়ে দুটোকে নিয়ে দিলশান আরা দুপুরের খাবার খেয়ে গল্প আড্ডায় পার করে সন্ধ্যার আগ পযর্ন্ত পুরোটা সময়। মায়ের সান্নিধ্য পেয়ে দৃষ্টিও কিছু সময়ের জন্য ভুলে যায় রক্তিমের কথা। ছোট বাচ্চাদের মতোই ভাই-বোন দুজন মায়ের দুই পাশে বসে উগলে দেয় মনে জমে থাকা সমস্ত কথা। সন্ধ্যার কিছুটা পর পর সাদেক সাহেব বাড়িতে এসে স্ত্রী সন্তানদের একসাথে হাসি খুশি বসে আনন্দ করতে দেখে প্রশান্ত হৃদয়ে নিজেও যোগ দেয় তাদের সাথে। বহুদিন পর বাবা-মা দুজনকে একসাথে পেয়ে বিগলিত হয় ভাই-বোন দুজন। রাজ্যের যত আবদার, অভিযোগ, অভিমান জমে থাকা কথা সব প্রকাশ করে বাবা-মায়ের কাছে। সন্তানের পড়াশোনা, নিজেদের কর্ম জীবনের ব্যস্ততা সমস্ত চিন্তা চেতনা এক পাশে রেখে কেটে যায় সুন্দর কিছু সময়।প্রাপ্তির খাতায় যুক্ত হয় স্বরণীয় এক মুহূর্ত। জমজমাট আড্ডা শেষ হয় একেবারে রাতের খাবারের সময়। সকলে মিলে একসাথে খাওয়া শেষে যে যার রুমে যায় ঘুমানোর উদ্দেশ্যে। সুন্দর একটা সময় কাটানো শেষে রুমে এসে ফুরফুরে মনে ঘুমাতে যায় দৃষ্টি। ঠিক তখনই বেজে ওঠে তার ফোন। বিছানার কাছ থেকে ফোনটা তুলে নিয়ে দেখতে পায় কলটা এসেছে তুসীর নাম্বার থেকে। মুখ ভেংচায় দৃষ্টি। বিরবির করে বলে,

“আমি কল দিলে ধরতে চায়না। ধরলেও এমন ভাবে কথা বলে যেন অচেনা কেউ বিরক্ত করছি তাকে। এখন কেন আমাকে কল দিচ্ছিস। ধরবনা আমিও। দেখ কেমন লাগে।”
ফোনটা সাইলেন্ট মোডে রেখে ঘুমিয়ে যায় নিশ্চিন্তে।

সকালে ঘুম ভাঙ্গে মায়ের ডাকে। কাক ডাকা ভোরে দু-চোখ থেকে ঘুম সরেনা দৃষ্টির। দিলশান আরা কতক্ষণ ঠেলেঠুলে মেয়েকে উঠিয়ে ফোন ধরিয়ে দেয় হাতে। বলে যায় জরুরি কল। কথা বলে যেন। কোনোমতে ফোন কানে ঠেকিয়ে ঘুমে জড়িয়ে আসা কন্ঠে সাড়া দেয় দৃষ্টি,

“হ্যালো কে?”

তৎক্ষণাৎ ফোনের অপর পাশ থেকে ভেসে আসে তুসীর ব্যগ্র কন্ঠ,

“এখনো আপনার ঘুম কাটেনি শেহজাদী! ঘুমান। শান্তির ঘুম ঘুমান আপনি। এদিকে আপনার রাজ কুমার বুলেটের আঘাতে বুক ঝাঝরা করে হাসপাতালে মৃ’ত্যু’র সাথে পাঙ্গা লড়োক।”

সকাল সকাল এমন একটা সংবাদে কিংকর্তব্য বিমূঢ় দৃষ্টি। হতবম্ভ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বোঝার চেষ্টা করে তুসীর কথাটুকু। ফাঁকা মস্তিষ্ক ঘটনার সারসংক্ষেপ ধরতে পারেনা এখনো। নিজেকে একটু ধাতস্থ করে প্রশ্ন ছুড়ে,

“কি বলছিস? কার কি হয়েছে?”

এবারও শোনা যায় তুসীর রাগি কন্ঠের ব্যাঙ্গাত্বক জবাব,

“আপনার পেয়ারের হিরো রক্তিম শিকদারের উপর গত রাতের আগের রাতে কারা যেন হামলা করেছিল। গুলি লেগেছে বুকে। শরীরের আরও বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের চিহ্ন। ঘটনা এতোক্ষন শোনা না গেলেও অবস্থার অবনতি হওয়াই পুরো এলাকায় রটনা হয়ে গেছে। কেউ কেউ তো আবার বলছে বাঁচার না কি কোনো সম্ভাবনা নেই।”

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here